কাদেরিয়া বাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতার পক্ষে গঠিত একটি সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী। এ বাহিনীর নেতা ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। যুদ্ধকালীন সময়ে এই ক্ষুদ্র অথচ লড়াকু বাহিনীটি সাহসিকতার জন্য স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের কাছে সুপরিচিতি লাভ করে এবং নেতার নামানুসারে কাদেরিয়া বাহিনী নামে খ্যাতি লাভ করে। [১] সে সময় কাদের সিদ্দিকী "বঙ্গবীর" এবং "বাঘা সিদ্দিকী" নামে পরিচিত হন।
গঠন
১৯৭১ সালের ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা গণ মুক্তি পরিষদের টাঙ্গাইল জেলা ইউনিট গঠিত হয়। তারা স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে এবং তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়। অপারেশন সার্চলাইট চালুর পরে, টাঙ্গাইলের স্থানীয় মুক্তি বাহিনী মির্জাপুরের গোরান-সতিয়াচরে টাঙ্গাইলের রাস্তায় অবরোধ স্থাপন করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবরোধ ভেঙে ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইলে প্রবেশ করে।
আবদুল কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) বর্তমান বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে ১০,০০০ বেসামরিক ব্যক্তি নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীটি টাঙ্গাইল অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বহু গেরিলা যুদ্ধে জয়লাভ করে। কাদের সিদ্দিকী বাল্লা গ্রামের কাছে মাকরার যুদ্ধে আহত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এর সদর দপ্তর ছিল টাঙ্গাইল জেলারসখিপুর উপজেলার মহানন্দপুর গ্রামের একটি ভবনে যেখানে বর্তমানে মহানন্দপুর বিজয় স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত।[২]
অভিযানের এলাকা
কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইল এলাকার অভ্যন্তরে পরিচালিত হয়েছিল। পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় এই বাহিনী বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে অবস্থান করে এবং মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের মতো ভারতে চলে যায় নি। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা কাদের সিদ্দিকী নিজেই টাঙ্গাইলের অধিবাসী ছিলেন।[৩]
জাহাজমারার যুদ্ধ
একাত্তরের ১০ ই আগস্ট, টাঙ্গাইলের কাদের বাহিনী অস্ত্র, গোলাবারুদ ও জ্বালানী সংবলিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটি জাহাজে আক্রমণ করে। দুটি জাহাজের নাম ছিলো এসটি রাজন এবং এসইউ ইঞ্জিনিয়ার্স এলসি-৩। সিরাজকান্দিতে যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর অভিসরণ বিন্দুতে তাদের আক্রমণ করা হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পরে কাদেরিয়া বাহিনী বিজয়ী পক্ষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা এই অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরবরাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যুদ্ধটি জাহাজমারা যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়। গণপূর্ত বিভাগ যুদ্ধের জায়গার কাছে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছে।[৪]
টাঙ্গাইলের স্বাধীনতা
একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর ২ হাজার ভারতীয় সৈন্য টাঙ্গাইলে অবতরণ করে। তারা কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। উভয় বাহিনী মিলে টাঙ্গাইলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে মুক্ত করে। নতুন টাঙ্গাইল শহরটি পাকিস্তানের সর্বশেষ দুর্গ ছিল। টাঙ্গাইল ১১ ই ডিসেম্বর মুক্ত হয়েছিল।[৫][৬]
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে কাদেরিয়া বাহিনী ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে ঢাকায় প্রবেশ করে।[১]
বিগঠন
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরেও শেখ মুজিব পাকিস্তানে ছিলেন। তাকে সামরিক ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেছিল। কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা দেন যে মুজিব ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি এবং তাঁর ৫০ হাজার লোক আত্মসমর্পণ করবেন না। ১৯৭২ সালে মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে আসলে, কাদের এবং তার লোকেরা টাঙ্গাইল শহরের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে মুজিবের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছিল।[৭][৮]
প্রাক্তন সদস্যগণ
কাদের সিদ্দিক ছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা, তার নামেই এই বাহিনী কাদেরিয়া নামে প্রচলিত হয় । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি শেখ মুজিবের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। শেখ মুজিবকে হত্যার পর তিনি লুকিয়ে বর্ডারের ওপারে চলে যান এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ সরকারের বিরুদ্ধে হামলা চালান। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তিনি তার নিজস্ব দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এর সভাপতি।[৯]
ডাঃ নুরান নবী ১৯৭১ সালে কাদের বাহিনীর জন্য ভারত থেকে গোলাবারুদ ও অস্ত্র আনার বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেন। তিনি 11 ডিসেম্বর 1971 সালে টাঙ্গাইলে ভারতীয় Paratrooper অবতরণের পরিকল্পনায় সহায়তা করেছিলেন। যুদ্ধের পর, তিনি বায়োকেমিস্ট্রিতে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হন। তিনি জাপানে পিএইচডি সম্পন্ন করেন এবং কোলগেট টুথপেস্টে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বই লিখেছেন, যার নাম ‘জন্মেছি এই বাংলায়’[১০]
আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী কাদের সিদ্দিকীর বড় ভাই। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ছিলেন। তিনি টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী এবং পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী ছিলেন। পাটমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলোর বেসরকারিকরণ হয় । মুসলমানদের হজ নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করায় রাষ্ট্রপতি হামিদ তাকে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেন।[১১]