অপারেশন পাইথন১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় অপারেশন ট্রাইডেন্টের পর পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দর শহর করাচীতেভারতীয় নৌবাহিনী পরিচালিত একটি নৌ-হামলার ছদ্মনাম। করাচী বন্দরে অপারেশন ট্রাইডেন্টের প্রথম হামলার পর প্রচুর ভারতীয় নৌ-জাহাজের উপস্থিতি দেখে অন্য আরেকটি হামলা পরিকল্পনার কথা আশঙ্কা করে পাকিস্তান তাদের উপকূলবর্তী এলাকায় আকাশপথে নজরদারি জোরদার করে এবং বাণিজ্য জাহাজের সাথে যুদ্ধ জাহাজ মিশিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে। এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭১ সালের ৮/৯ ডিসেম্বর ভারত অপারেশন পাইথন পরিচালনা করে। তারা একটি মিসাইল বোট এবং দুইটি ফ্রিগেট নিয়ে করাচী উপকূলের অদূরে নোঙর করা জাহাজগুলোকে আক্রমণ করে। ভারতের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও পাকিস্তানি ফ্লিট ট্যাংকার পিএনএস ঢাকা মেরামতের অযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কিমারি তেল সংরক্ষণাগার ধ্বংস করা হয়।[১] এছাড়াও এই হামলায় করাচীতে নোঙর করা দুইটি বিদেশি জাহাজও ডুবে গিয়েছিল।
প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালে করাচী বন্দরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদরদপ্তর ছিল এবং করাচী উপকূলে তাদের অধিকাংশ নৌবহরেরও অবস্থান ছিল। তাছাড়া এটি ছিল পাকিস্তানের সমুদ্রিক বাণিজ্যের সংযোগপথ।[২] এসব কারণে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর উপকূলবর্তী এলাকার যুদ্ধবিমানগুলোকে সম্ভাব্য যেকোন আক্রমণ থেকে করাচী বন্দরকে নিরবচ্ছিন্নভাবে রক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র সমুদ্রবন্দর হওয়ায় বন্দরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[৩][৪]
১৯৭১ সালের শেষের দিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ২৩ নভেম্বর পাকিস্তান সারাদেশজুড়ে জরুরী অবস্থা জারী করার পর ভারতীয় নৌবাহিনী ওখার কাছাকাছি করাচীর নিকটবর্তী এলকায় টহল দিতে তিনটি মিসাইল বোট পাঠায়। পাকিস্তানি নৌবহরও একই এলাকা দিয়ে টহল দেওয়ায় ভারতীয় নৌবাহিনী নিজেদের জন্য একটি সীমানা রেখা নির্ধারণ করে দেয়, যাতে তাদের বহরের জাহাজগুলো এটি অতিক্রম না করে। পরবর্তীতে ঐ এলাকা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনে টহলদানকারী নৌকাগুলো পাঠানোর সিদ্ধান্ত যথাযথ বলে প্রমাণিত হয়েছিল।
পাকিস্তান ৩রা ডিসেম্বর সীমান্তের কাছে অবস্থিত ভারতীয় বিমানঘাঁটি আক্রমণ করলে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।[৫]
অপারেশন
পূর্ব-প্রস্তুতি
দিল্লিতে পশ্চিম নৌ কমান্ডের পাশাপাশি ভারতীয় নৌ সদরদপ্তর (এনএইচকিউ) কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করাচী বন্দর আক্রমণের পরিকল্পনা করে।[৬] এজন্য পশ্চিম নৌ কমান্ডের অধীনে একটি আক্রমণকারীদল গঠন করা হয়। আক্রমণকারী দলটিতে ইতমধ্যে ওখা উপকূলের অদূরে পাঠানো তিনটি বিদ্যুৎ-শ্রেণীর মিসাইল বোট সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু এরফলে আক্রমণের ব্যাপ্তি এবং রাডারে নজরদারির পরিধি সীমিত হয়ে গেলে দলটির জন্য অতিরিক্ত সাহায্যকারী জাহাজ নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর বিদ্যুৎ-শ্রেণীর তিনটি মিসাইল বোট আইএনএস নিপাত(কে৮৬), আইএনএস নির্ঘাত(কে৮৯) এবং আইএনএস বীর(কে৮২) নিয়ে করাচী স্ট্রাইক গ্রুফ নামে একটি আক্রমণকারী দল গঠন করা হয়। মিসাইল বোটগুলোর প্রত্যকটি ৪০ নটিক্যাল মাইল (৭৪ কিমি; ৪৬ মা) পরিধির মধ্যে আক্রমণে সক্ষম চারটি পি-১৫ টার্মিট সার্ফেস-টু-সার্ফেস মিসাইল, দুইটি অ্যান্টি সাবমেরিন কর্ভেট আইএনএস কিলতান(পি৭৯) ও আইএনএস কতচাল(পি৮১), এবং একটি ফ্লিট ট্যাংকার আইএনএস পোশক দ্বারা সজ্জিত ছিল।[৭] দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ২৫তম মিসাইল বোট স্কোয়াড্রনের কমান্ডিং অফিসার[৮] কামান্ডার বাবরু ভান যাদব[৯][১০]
৪/৫ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় নৌবাহিনী করাচী উপকূলে করাচী স্ট্রাইক গ্রুপের মাধ্যমে অপারেশন ট্রাইডেন্ড পরিচালনা করে। এই অপারশনের মধ্য দিয়ে ঐ অঞলে প্রথমবারের মতো অ্যান্টি শিপ মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছিল। এতে পাকিস্তানিদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও পাকিস্তানের একটি মাইনসুইপার, একটি ডেস্ট্রয়ার, গোলাবারুদ বহন করা একটি কার্গো জাহাজ এবং করাচীর একটি তেল সংক্ষণকারী ট্যাংক ধ্বংস করা হয়।[১১] অন্য একটি ডেস্ট্রয়ার এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে এটি মূলত ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এই হামলার জবাবে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ওখা উপকূলে বোমাবর্ষণ করলে ভারতের মিসাইল বোটের জন্য তেল সরবরাহ ব্যবস্থা, একটি গোলাবারুদের আস্তাকুঁড় এবং মিসাইল বোট জেটি ধ্বংস হয়। ভারতীয় নৌবাহিনী এমন একটি আক্রমণের বিষয়ে পূর্বানুমান করতে পেরে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে নিজেদের মিসাইল বোটগুলো আগে থেকেই অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়েছিল। নিজেদের তেল সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানিদের এই আক্রমণের পর অপারেশন পাইথনের পূর্বে ভারতীয়রা আর কোন ধরনের আক্রমণ চালাতে পারেনি।[৫]
অপারেশন ট্রাইডেন্টে ভারতীয় নৌবাহিনী কৌশলগতভাবে জয়ী হলেও এই হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু করাচী বন্দরের তেল সংরক্ষণাগারগুলো তখনো চালু ছিল। অপারেশনটির সময় ভারতীয় বাহিনীর ছোড়া দুইটি মিসাইলের মাত্র একটি সংরক্ষণাগারগুলোতে আঘাত করতে পেরেছিল। পরে এই ব্যর্থতার কারণ হিসেবে তিনটি মিসাইল বোটের কমান্ডিং অফিসারদের মধ্য সৃষ্ট বিভ্রান্তিকে দায়ী করা হয়। করাচী উপকূলের কামান থেকে গোলা ছোড়ার ফলে আগুনের যে ফুলকি তৈরী হয়েছিল সেটাকে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান থেকে সৃষ্ট ভেবে ভারতীয়রা উপকূলবর্তী কামানগুলোকে ধ্বংস না করেই দ্রুত পিছু হটে যায়।[১২] করাচী বন্দরে অপারেশন ট্রাইডেন্টের প্রথম হামলার পর প্রচুর ভারতীয় নৌ-জাহাজের উপস্থিতি দেখে অন্য আরেকটি হামলা পরিকল্পনার কথা আশঙ্কা করে পাকিস্তান তাদের উপকূলবর্তী এলাকায় আকাশপথে নজরদারি জোরদার করে[১১] এবং তাদের যুদ্ধ জাহাজগুলো বাণিজ্যিক জাহাজের সাথে মিশে গিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে।[১২]
হামলা
১৯৭১ সালের ৮/৯ ডিসেম্বরে পাকিস্তান মান সময় (পিকেটি) রাত ১০:০০টায় উত্তাল সমুদ্রে একটি আক্রমণকারী দল চারটি স্টাইক্স মিসাইল ধারণক্ষমতার মিসাইল বোট আইএনএস বিনাশ(কে৮৫) ও আইএনএস তলোয়ার(এফ১৪০) এবং আইএনএস ত্রিশূল(এফ১৪৩) নামের দুইটি মাল্টিপারপাস ফ্রিগেট নিয়ে করাচী বন্দরের দক্ষিণে অবস্থিত উপদ্বীপ মানোরার দিকে যাত্রা করে। যাত্রা পথে পাকিস্তানের একটি টহল জাহাজের মুখোমুখি হলে তারা জাহাজটিকে ডুবিয়ে দেয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর ঐতিহাসিক ভাইস অ্যাডমিরাল গুলাব মোহনলাল হিরানন্দানি তার বই ট্রানজিশন টু ট্রায়াম্পে উল্লেখ করেছেন যে, দলটি করাচী পৌঁছানোর পর ত্রিশূলের বৈদ্যুতিক নজরদারী ব্যবস্থায় ধরা পড়ে যে তাদের রাডারটি সরাসরি জাহাজটিকে শনাক্ত করে এবং এর অবস্থান নির্দেশ করে ঘোরা বন্ধ করে দেয়।[১৩]
রাত ১১:০০টা (পিকেটি) দলটি তাদের থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (২২ কিমি; ১৪ মা) দূরে কয়েকটি জাহাজ শনাক্ত করে। তাৎক্ষণিকভাবে বিনাশের মধ্যে থাকা চারটি মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। এদের মধ্যে একটি কিমারি অয়েল ফার্মের তেলের ট্যাংকারগুলোতে আঘাত করলে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। অন্য একটি মিসাইল পানামীয় তেলের ট্যাংকার এসএস গাল্ফ স্টারকে ডুবিয়ে দেয়। তৃতীয় ও চতুর্থ মিসাইলটি পাকিস্তানি নৌ ফ্লিট ট্যাংকার পিএনএস ঢাকা এবং ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ এসএস হারম্যাটেনকে ডুবিয়ে দেয়। বিনাশ তার সবগুলো মিসাইল ছোড়ার পর দলটি সবচেয়ে কাছের ভারতীয় বন্দরের দিকে দ্রুত রওনা দেয়।[১৪]
অপারেশন ট্রাইডেন্ট এবং পাইথনের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনী করাচির তেল ও গোলাবারুদের গুদামে হামলা চালিয়েছিল। এতে করাচী এলাকার চাহিদার মোট ৫০ শতাংশ তেল ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অধিকাংশ তেলের মজুদ,
গোলাবারুদের গুদাম ও কারখানা ধ্বংস হওয়ায় পাকিস্তানের আনুমানিক $৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছিল।[১] তেলের ক্ষয়ক্ষতি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর উপরও প্রভাব ফেলেছিল।[১২]
পরবর্তী অবস্থা
ভারতীয়দের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও উভয় অপারেশনের (ট্রাইডেন্ট ও পাইথন) মিসাইল হামলার পর পরবর্তীতে এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য পাকিস্তান নৌবাহিনী ব্যাপক প্রতিরক্ষামুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রিয়ার এডমিরাল প্যাট্রিক সিম্পসন তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। পাকিস্তানি নৌ-অফিসারদের মনোবল অটুট রাখার জন্য তাকে সিতারা-ই-জুরাত পদক প্রদান করা হয়।[১১] ভারতীয়রা এই অভিযানের জন্য বিনাশের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার বিজয় জেরাতকে বীর চক্র প্রদান করে।[১৫] পাকিস্তানের হাই কমান্ড বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য জাহাজগুলোকে তাদের পরিত্যক্ত গোলাবারুদের পরিমাণ কমানোর নির্দেশ দেয়।[১২] কোন প্রকার নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত জাহাজগুলোকে বিশেষ করে রাতের বেলা গভীর সমুদ্রে না যাওয়ার জন্য বলা হয়। এই দুইটি পদক্ষেপ পাকিস্তানি নৌকর্মীদের মনোবল ব্যাপকভাবে ভেঙে দেয়। ভারতীয় নৌবাহিনী সাধিত ক্ষয়ক্ষতির জন্য নিরপেক্ষ বাণিজ্যিক জাহাজগুলো করাচীর দিকে যাত্রা শুরুর পূর্বে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তা চাওয়া শুরু করে। নিরপেক্ষ জাহাজগুলো করাচীতে যাওয়া-আসা একপ্রকার বন্ধ করে দেয়। ফলে ভারত প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের ওপর এক ধরনের নৌ অবরোধ আরোপ করতে সক্ষম হয়েছিল।[১৬]
টীকা
↑পাকিস্তানি জাহাজ নয়। এগুলো ছিল করাচীতে নোঙর করা বিদেশী বাণিজ্য জাহাজ।