রমনা গণহত্যা

রমনা হত্যাকাণ্ড
মৃত্যু বরনকারী ও অত্যাচারীতদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ, ২০১৫
স্থানরামনা, ঢাকা, বাংলাদেশ
তারিখ২৭ মার্চ ১৯৭১ (ইউটিসি +৬:০০)
লক্ষ্যবাঙালি হিন্দু
হামলার ধরনহত্যাকাণ্ড, গণহত্যা
ব্যবহৃত অস্ত্রমেশিনগান, পেট্রোল, বারুদের গুড়ো
নিহত২৫০
হামলাকারী দলপাকিস্তান সেনাবাহিনী

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রাতে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী রমনা কালী মন্দিরের চারপাশে বসবাসরত হিন্দুদের হত্যা করে যা রমনা হত্যাকাণ্ড বা রমনা গণহত্যা নামে পরিচিত।[][] অনুমান করা হয় যে এই গণহত্যায় ২৫০ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল।

পটভূমি

রমনা কালী মন্দিরের চারপাশের গ্রামটি ছিল ঢাকা রেস কোর্সের কেন্দ্রস্থলের একটি প্রাচীন হিন্দু পল্লী। এই গ্রামে প্রায় ২০০০ হিন্দু পুরুষ, নারী ও শিশু বাস করত।[] এমনকি ঢাকার সবচেয়ে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়ও গ্রামটি অক্ষত ছিল।

ঘটনাবলী

হত্যাযজ্ঞের সময় মেশিনগান দিয়ে পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয় এবং তারপর আগুন লাগানো হয়।[] পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পেট্রোল ও গানপাউডার দিয়ে মন্দিরটি পুড়িয়ে দেয়। মন্দিরে তখন প্রায় ৫০টি গরু বাধা ছিল, তারা গরুসহ মন্দিরটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে রমনা কালী মন্দিরের পুরোহিতসহ ১০১ জন হিন্দু নিহত হন।[]

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায় যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে এবং ২৬শে মার্চ সকাল ১১টার দিকে প্রথমে মন্দির ও আশ্রম প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। তারা বাসিন্দাদের মন্দির ও আশ্রম প্রাঙ্গণের বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই সময়েই পুরান ঢাকা এলাকা থেকে সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগ প্রার্থী এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সামরিক প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রবক্তা খাজা খায়েরউদ্দিনকে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পাওয়া যায়। তার প্ররোচনায় ২৭শে মার্চ রাতে রমনায় ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা সংঘটিত হয়।

ঘটনার দিন, বেলা ২:০০টায় সান্ধ্যকালীন কারফিউ কার্যকর করা হয়। কারফিউ কার্যকর থাকা অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী ২৭ মার্চ রাত ২:০০ টায় রমনা কালী মন্দির এবং মা আনন্দময়ী আশ্রম ঘেরাও করে। পুরো রমনা এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর সার্চলাইটে আলোকিত হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে শুরু হয় কামানের গোলা বর্ষণ। রমনা কালী মন্দিরে প্রবেশ করেই পাকিস্তানি বাহিনী একধরনের বিস্ফোরক ছুড়তে থাকে। তবে কেউ কেউ বলেছেন, তারা কামান দিয়ে গোলা বর্ষণ করে। ফলস্বরূপ, প্রতিমা এবং মন্দিরের প্রাচীরের পিছনের অংশ সম্পূর্ণরূপে উড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে, মন্দির এবং আশ্রম ধ্বংস করা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জল্লাদরা যখন মন্দির ও আশ্রমে প্রবেশ করে তখন অনেকে ঘুমিয়ে ছিল এবং কেউ কেউ জেগে ছিল। কোনো কোনো পরিবারের সদস্যরা তখনও রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করলে প্রাণের ভয়ে তারা এদিক ওদিক দৌড়াতে থাকে। প্রত্যেকে আতঙ্কে "পাকিস্তান জিন্দাবাদ" স্লোগান দিতে থাকে, মহিলারা তাদের শাঁখা ভেঙে ফেলেন এবং সিঁদুর মুছে ফেলেন। কেউ কেউ মন্দির ও আশ্রমের বিভিন্ন কোণে আত্মগোপন করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের খুঁজে বের করে মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পুরুষদের এক লাইনে দাঁড় করানো হয় এবং শিশুসহ নারীদের অন্য লাইনে দাঁড় করানো হয়।

সকলের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যরা মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে ‘কালেমা’ পাঠ করতে বাধ্য করে এবং তার পরপরই তার পেটে বেয়নেট বিদ্ধ করে এবং গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তীকালে অনেককে ‘কালেমা’ পড়তে বাধ্য করা হয় এবং পরে একইভাবে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ে এবং বলে যে এটি "নৌকা" মার্কায় ভোট দেওয়ার পরিণতি। বাকি পুরুষ লোকেদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় ৮০-১০০ জনকে হত্যা করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে নারীদের কেউ কেউ চিৎকার শুরু করলে তাদের বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। তাদের অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যান। পাকিস্তানিরা মৃতদেহ একত্রে স্তূপ করে পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। যারা আহত হয় তারাও আগুনে পুড়ে মারা যায়। আগুনে কয়েকজন নারী ও শিশু দগ্ধ হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা কয়েকজনকে “জয় বাংলা” বলতে বলে এরপর তাদের মুখে গুলি করে হত্যা করা হয়।

যখন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও তাণ্ডব চলছিল, তখন রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ীর আশ্রম আগুনে প্রচণ্ডভাবে জ্বলছিল।

মন্দির ও আশ্রমের গোয়ালঘরে প্রায় ৫০টি গরু ছিল। সেগুলো পুড়িয়ে মারা হয়। প্রচণ্ড আগুন, বন্দুকের গুলি, পোড়া মাংসের গন্ধ আর প্রাণহানির আর্তনাদে রমনা এলাকা নরকে পরিণত হয়।

ভোর ৪টার দিকে রমনায় অপারেশন শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন নারীকে তুলে নিয়ে যায়। এই নারীদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন যে প্রায় ১২ জন নারীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা রমনা ত্যাগ করার আগে, জীবিত লোকদের পরের দিন সকালে ভারতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

মন্দির ও আশ্রমের বাসিন্দারা আগের রাতের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনায় সবকিছু হারিয়ে সকালে নিরাপদ স্থানের সন্ধানে রমনা ছেড়ে চলে যান। মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরি মন্দির এবং আশ্রমের বাসিন্দাদের আশীর্বাদ এবং আশ্বাস দিয়েছিলেন যে এই পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক স্থানটি নিরাপদ থাকবে। এখানে কোনো ঝামেলা হবে না। তিনি বুঝতে পারেননি একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মন্দিরগুলো ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকবে না।

পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতা গিরি এবং মা আনন্দময়ী আশ্রমে বসবাসকারী তপস্বী জটালী মা, যারা গণহত্যা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের সাথে রমনা ছেড়েছিলেন। তদন্ত কমিশনে কয়েকজন সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্যের কিছু অংশ নিম্নে তালিকাভুক্ত করা হলো:

• কমলা রায় তখন রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম প্রাঙ্গণে থাকতেন। তিনি কমিশনকে বলেন, পাকিস্তানি হানাদাররা চারদিক থেকে ঘেরাও করার পর, আতঙ্কিত হয়ে ও ভয় পেয়ে মহিলারা 'সিঁদুর (কপালে সিঁদুরের চিহ্ন)' মুছে ফেলেন এবং তাদের বাহুতে থাকা 'শাঁখা (শঙ্খের খোলস থেকে তৈরি চুড়ি)' ভেঙে ফেলেন। পুরুষ ও মহিলারা আলাদাভাবে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর কিছু লোকেদের গুলি করে মাটিতে ফেলে রাখা হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অর্ধমৃত হয়ে পানির জন্য চিৎকার করছিল। পাকিস্তানিরা অর্ধমৃত মানুষের সাথে সমস্ত মৃতদেহ সংগ্রহ করে, বাড়িঘর থেকে তোলা বাঁশের বেড়া ফেলে সেইসব লাশের উপর আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা কিছু শিশুকে আগুনে নিক্ষেপ করে।

• লক্ষ্মী রানী ঠাকুর তার পিতাকে হারান। তিনি জানান, ২৫ মার্চ রাতে তার বাবা কিশোরী ঠাকুর তাকে দেখতে আসেন। কিশোরী বাবু থাকতেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। লক্ষ্মী রানীর বিয়ে হয়েছিল ঢাকায় এবং তিনি স্বামীর সাথে রমনা কালী মন্দিরের পাশে থাকতেন। পাকিস্তানিরা কিশোরী বাবুকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করে এবং গুলি করে হত্যা করে। তারপর তার লাশ আগুনে ফেলে দেওয়া হয়। দৈনিক ইত্তেফাকের সাব-এডিটর আহসানউল্লাহ কমিশনে দেওয়া সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন, রমনা মন্দির ধ্বংসের তিন দিন পর তিনি সেখানে এসে পোড়া মানব কঙ্কালের পাশাপাশি প্রায় ১৪টি পচনশীল লাশ দেখতে পান। সেই লাশগুলো ফুলে গিয়েছিল ও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ও আশ্রমের ভেতরে আরও ১০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়।

• প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল আলী ফকির, রমনা কালী মন্দিরের অদূরে অবস্থিত শাহবাজ মসজিদের খাদেম, বলেন যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরুর আগে, রমনা কালী মন্দির এবং মা আনন্দময়ী আশ্রমের প্রত্যেককে "পাকিস্তান জিন্দাবাদ" বলতে বাধ্য করে। তাদের "লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ" বলতে বলা হয়। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরুষ সবাই একজোট কন্ঠে ওই কথাগুলো উচ্চারণ করলে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ।[]

স্মৃতিসৌধ

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর উক্ত স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ বানানো হয়। স্মৃতিসৌধের গায়ে গণহত্যায় নিহত ৬৯ জনের নাম লেখা রয়েছে।[] ২৭ মার্চ ২০১১ সালে, রমনা কালী মন্দিরের গণহত্যায় নিহতদের সম্মানে রমনা কালী মন্দিরের সামনে প্রাঙ্গণে একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।[]

তথ্যসূত্র

  1. ঠাকুর, রাজেন (২১ সেপ্টেম্বর ২০০৯)। "Bangladesh: The Demolition Of Ramana Kali Temple In March 1971"এশিয়ান ট্রিবিউন (ইংরেজি ভাষায়)। ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ। ১১ (২৮৯)। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১২ 
  2. ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ (২৮ মে ২০০৭)। "April 1971: 'Recalling Massacres of Those Days in Faridpur'"এশিয়ান ট্রিবিউন (ইংরেজি ভাষায়)। ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ। ১১ (২৮৮)। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১২ 
  3. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র১৩। ঢাকা: হাক্কানী পাবলিশার্স। নভেম্বর ১৯৮২। পৃষ্ঠা 292। আইএসবিএন 9844330912। ১ মে ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ মে ২০১৩ 
  4. "মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে: তারানা হালিম"bangladeshnews24x7.com। সংগ্রহের তারিখ মে ১২, ২০১২ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  5. "রমনা কালী মন্দিরের নিরাপত্তা দেওয়ার আবেদন"banglanews24.com। ৫ মার্চ ২০১৩। ১৬ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মে ২০১৩ 
  6. "চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলতি বছরের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে ॥ আইন প্রতিমন্ত্রী"দৈনিক জনকণ্ঠ। মার্চ ২৮, ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১২ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

Strategi Solo vs Squad di Free Fire: Cara Menang Mudah!