জ্যাকব ১৯২৩ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। লে. জেনারেল জ্যাকবের পূর্বপুরুষেরা ১৮শতকে বাগদাদ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। তারা মূলত ছিলেন ইহুদি ধর্মের অনুসারী।" [২] জ্যাকবের পিতা ইলিয়াস ইমানুয়েল ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। শৈশবে যখন জ্যাকবের পিতা অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন, ৯ বছর বয়সে তাঁকে দার্জিলিংয়ের সন্নিকটে কাশিয়াংয়ে ভিক্টোরিয়া বোডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তখন থেকে তাঁর পরিবারের সাথে একটিনারে দুরত্বের সৃষ্টি হয়। তিনি কেবল বন্ধের দিনগুলোতেই পরিবারের সাথে দেখা করতে যেতেন। জ্যাকব ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হলোকস্ট( দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের উপর চালানো গণহত্যা)র নির্মমতা থেকে অনুপ্রাণীত হন এবং ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী তে যোগদান করেন। তাঁর পিতা তাঁকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে আপত্তি জানান কিন্তু তাও তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ২০১২ সালে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, "আমি গর্বিত আমি ইহুদি, তার থেকেও বেশি ও অনেক বেশি গর্বিত যে আমি ভারতীয়।"[২]
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান
১৯৬৮ সালের ১০ই জুন তিনি ভারপ্রাপ্ত মেজর-জেনারেল থেকে প্রকৃত (স্থায়ী) মেজর-জেনারেল হন এবং ১৯৬৯ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চীফ অব স্টাফের দায়িত্ব পান; এই পদে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি প্রশংসাসূচক অনেক সম্মান লাভ করেছেন।
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী যখন অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয়ের খোঁজে আসতে থাকে। চীফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যাকব তখন উক্ত সমস্যা নিরসনের উপায় খুঁজতে থাকেন। কিন্তু অন্যদিকে পাকিস্তানিদের অত্যাচার আরো বাড়তে থাকে। এসব দেখে জ্যাকব তৎক্ষণাৎ তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, এই সমস্যা নিরসনের একমাত্র উপায় হচ্ছে পাকিস্তানিদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর প্রধান শ্যাম মানেকশ’ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে প্রথমেই চট্টগ্রাম এবং খুলনা শহর দখল করতে নির্দেশ দেন। জাতিসংঘ এবং চীনের প্রবল চাপের মুখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণে আপত্তি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু জ্যাকব সব ধরনের চাপের উর্দ্ধে গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সচেষ্ট ছিলেন।
প্রথমেই তিনি ঢাকাকে দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। এর জন্য তিনি সুচারুভাবে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে অগ্রসর হন।
তার পরিকল্পনা অবশেষে সফল হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে হটাতে সফল হয়। দখলের পর তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সকল যোগাযোগ মাধ্যম ধ্বংস করেন। তিনি তিন সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা দখলের পরিকল্পনা করেন, কিন্তু তা হয়ে যায় এক রাতের ভিতরেই। তারপর ধীরে ধীরে আরো অনেক স্থান দখল করতে সক্ষম হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী।
জ্যাকব বুঝতে পারেন যে, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো ফলাফল লাভ সম্ভব হবে না। তাই তিনি জেনারেল নিয়াজিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীসহ ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি নিয়াজির কাছে আত্মসমর্পণের খসরা পাঠিয়ে দেন। উক্ত দিন সকালে জ্যাকব শ্যাম মানেকশর ফোন পান এববং তিনি তাকে বলেন ঢাকায় গিয়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিতে। তারপর তিনি আত্মসমর্পণ দলিল হাতে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান এবং আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সংগঠিত করতে তিনি জেনারেল নাগরাকে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল জোগাড় করতে এবং ঢাকা শহর বিমানবন্দর, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ও একটি যৌথ গার্ড অব অনারের আয়োজন করতে বললেন। তারপর পাকিস্তান বাহিনী ৩০মিনিট সময়ে এক বিনাচুক্তির আত্মসমর্পণ সম্পন্ন করে।
নিয়াজি পরবর্তীতে দাবি করেন যে, জ্যাকব তাকে ব্লাকমেইলের মাধ্যমে আত্মসমর্পণে রাজী করেছিলেন। [৩] ৯৩ হাজার সৈন্য সাথে নিয়ে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন। এখানে আরেকটি বড় ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকায় তখন প্রায় ৩০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য উপস্থিত ছিল, অপরদিকে ভারতীয় সৈন্য ছিল মাত্র ৩ হাজার। অর্থাৎ অনুপাতে ১০:১। এক্ষেত্রে জ্যাকব অনেক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। জেনারেল নিয়াজি এ সম্পর্কে মোটেই অবগত ছিলেন না। জেনারেল জ্যাকব ২০১২ সালে ২৭শে মার্চ বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন। মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান এর জন্য তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন। তার এই অবদান বাংলাদেশিরা কখনোই ভুলবে না। তিনি আমাদের মাঝে চির স্মরণীয় থাকবেন।
অবসর
ভারতীয় সমাজে গ্রহণযোগ্য সামরিক নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি সফলতার সাথে কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন বলে জ্যাকব দাবী করেন।[৪] ৩৭ বছর সেবা দেয়ার পর ১৯৭৮ সালে সামরিকবাহিনী থেকে অবসর নেন। ভারত রক্ষক ওয়েবসাইটে জ্যাকব বারংবার উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ যুদ্ধে কেবলমাত্র তার নিজ চেষ্টার মাধ্যমে সফলতা পেয়েছেন। এতে, মানেকশ’ অথবা পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরা’র কৃতিত্ব ছিল না।[৫] ব্যবসায় জগতে প্রবেশের পর ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেন। দলে তিনি অনেক বছর নিরাপত্তা পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। গোয়া রাজ্যের গভর্নর হন ও পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের গভর্নর হন।
দেহাবসান
দীর্ঘদিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি নতুন দিল্লির সেনা গবেষণা ও রেফারেল হাসপাতালে দেহাবসান ঘটে তার।[৬] ১ জানুয়ারি, ২০১৬ তারিখে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।[৭]