কার্ক ডগলাস (ইংরেজি: Kirk Douglas; জন্ম: ইসুর দানিয়েলোভিচ, ৯ ডিসেম্বর ১৯১৬ - ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০) হলেন একজন মার্কিন অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক ও লেখক। তিনি মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পের স্বর্ণযুগের সর্বশেষ জীবিত তারকাদের একজন ছিলেন।[২] অভিবাসিত পিতামাতা ও ছয় বোন নিয়ে নিঃসম্বল শৈশব কাটানোর পর ১৯৪৬ সালে বারবারা স্ট্যানউইকের বিপরীতে দ্য স্ট্রেঞ্জ লাভ অব মার্থা আইভার্স (১৯৪৬) দিয়ে তার চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫০-এর দশকে তিনি সেরা বক্স-অফিস তারকা হয়ে ওঠেন এবং গম্ভীর নাট্যধর্মী, পশ্চিমা ধাঁচ ও যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। কর্মজীবনে তিনি নব্বইয়ের অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
অভিনেতা ও মানবহিতৈষী হিসেবে ডগলাস তিনটি একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন, একটি একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার, এবং প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম অর্জন করেন। লেখক হিসেবে তিনি দশটি উপন্যাস ও স্মৃতিকথা রচনা করেন। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট তাদের করা ধ্রুপদী হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের সেরা পুরুষ তারকা তালিকায় তাকে ১৭তম হিসেবে স্থান দিয়েছে। ২০১৬ সালের ৯ই নভেম্বর তার বয়স ১০০ বছর পূর্ণ হয়।[৩] তিনি ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ১০৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[৪] শতবর্ষী এই অভিনেতা হলিউডের স্বর্ণযুগের সর্বশেষ জীবিত তারকা ছিলেন।
প্রারম্ভিক জীবন
ডগলাস ১৯১৬ সালের ৯ই ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কের আমস্টারডামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মনাম ছিল ইসসুর দানিয়েলোভিচ। তার পিতা হার্শেল "হ্যারি" দানিয়েলোভিচ (আনু. ১৮৮৪-১৯৫০; বিভিন্ন সূত্রে তার ভিন্ন জন্মের তারিখ পাওয়া যায়) এবং ব্রাইনা "বার্থা" (বিবাহপূর্ব নাম স্যাংলেল; ১৮৮৪-১৯৫৮)।[৫][৬] তার পিতামাতা রুশ সাম্রাজ্যের মগিলেভ অঞ্চলের (বর্তমান (বেলারুশ) চাভুসি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগত ইহুদি অভিবাসী[৭][৮][৯][১০][১১][১২] এবং তাদের পরিবার বাড়িতে ইদ্দিশ ভাষায় কথা বলত।[১৩][১৪][১৫]
ডগলয়াসের পিতার ভাই তাদের পূর্বে অভিবাসিত হয়ে এসেছিলেন এবং তিনি তার বংশনাম ডেমস্কি ব্যবহার করতেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর ডগলাসের পরিবারও ব্যবহার করত।[১৬] ডগলাসের শৈশবে নাম ছিল ইজি ডেমস্কি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে প্রবেশের পূর্বে তিনি আইনসিদ্ধভাবে তার নাম পরিবর্তন করে কার্ক ডগলাস রাখেন।[১৭]
কর্মজীবন
১৯৪০-এর দশক
১৯৪৬ সালে বারবারা স্ট্যানউইকের বিপরীতে ওয়ালিসের দ্য স্ট্রেঞ্জ লাভ অব মার্থা আইভার্স (১৯৪৬) দিয়ে তার চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এতে তিনি ক্রূর স্ত্রীর কর্তৃত্বে তার জীবন অতিষ্ঠ একজন তরুণ, সশঙ্ক, অহংকারে নিমজ্জিত ব্যক্তি চরিত্রে অভিনয় করেন। এটিই শেষ চলচ্চিত্র যেখানে ডগলাস কোন দুর্বল চরিত্রে অভিনয় করেন।[১৮][১৯] সমালোচকগণ ডগলাসের এই কাজ দেখে তাকে "সহজাত চলচ্চিত্র অভিনেতা" হিসেবে বিবৃত করেন।
চ্যাম্পিয়ন (১৯৪৯) চলচ্চিত্রে একজন স্বার্থপর মুষ্টিযোদ্ধা চরিত্রে শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে ডগলাসের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লাভ করেন ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। এই চরিত্রে গ্রহণকালে তিনি এক ধরনের জুয়া খেলেন, কারণ তিনি মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের অধিক নির্মাণব্যয়ের দ্য গ্রেট সিনার চলচ্চিত্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যেটি থেকে তিনি এই চলচ্চিত্রের চেয়ে তিনগুণ বেশি পারিশ্রমিক পেতেন। চ্যাম্পিয়ন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ডগলাস তার প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন এবং চলচ্চিত্রটি মোট ছয়টি বিভাগে অস্কারের মনোনয়ন লাভ করে।[২০]
১৯৫০-এর দশক
১৯৫০ সালে ডগলাস লরেন বাকল ও ডরিস ডের বিপরীতে ইয়ং ম্যান উইথ আ হর্ন (১৯৫০) চলচ্চিত্রে রিক মার্টিন চরিত্রে অভিনয় করেন। এটি জ্যাজ কর্নেটিস্ট বিক্স বেইডারবেকের জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত ডরথি বেকারের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। সুরকার ও পিয়ানোবাদক হোয়াজি কারমাইকেল এতে একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন, যা চলচ্চিত্রটিতে আরও বাস্তবতা এনে দেয় এবং বেইডারবেকের বাস্তব জীবনের একজন বন্ধু থাকার কারণে গল্পটি ডগলাস আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারেন।[২১]
১৯৫১ সালে ডগলাস এইস ইন দ্য হোল (১৯৫১) চলচ্চিত্রে বড় গল্প খুঁজতে থাকা সংবাদপত্রের প্রতিবেদক চরিত্রে অভিনয় করেন। এতি পরিচালক বিলি ওয়াইল্ডারের লেখক ও প্রযোজক হিসেবে প্রথম কাজ। ছবিটিতে ডগলাস জ্যান স্টার্লিংয়ের বিপরীতে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তু ও গল্প সে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিতর্কিত ছিল এবং মার্কিন দর্শক এটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।[২২] তবে চলচ্চিত্রটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ বিদেশি চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কৃত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে চলচ্চিত্রটির মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কয়েকটি জরিপে এটি শীর্ষ ৫০০ চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।[২৩]
তিনি দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য বিউটিফুল (১৯৫২) চলচ্চিত্রে একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক চরিত্রে অভিনয় করেন, যে তার অভিনয়শিল্পী, লেখক ও পরিচালকদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করেন। এই চলচ্চিত্রে তার নাট্যধর্মী অভিনয়ের জন্য তিনি তার দ্বিতীয় অস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।[২৪]
তিনি ভিনসেন্ট মিনেলি পরিচালিত লাস্ট ফর লাইফ (১৯৫৬) চলচ্চিত্রে ভিনসেন্ট ভ্যান গখ চরিত্রে অভিনয় করেন। আরভিং স্টোনের সর্বোচ্চ বিক্রিত বই অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির অধিকাংশ দৃশ্যধারণ করা হয় ফ্রান্সে। ডগলাস শুধু ভ্যান গখের উপস্থাপনার সত্যনিষ্ঠাই নয়, এই চিত্রশিল্পীর আত্মিক দ্বন্দ্বেরও চিত্রায়নের জন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। এই কাজকে কয়েকজন পর্যালোচক নিজের কর্মের মধ্য দিয়ে জীবনের যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের খোঁজ করা একজন পীড়িত চিত্রশিল্পীর বিখ্যাত উদাহরণ বলে গণ্য করেন।[২৫]
১৯৬০ সালে তিনি স্পার্টাকাস চলচ্চিত্রে থ্রাসীয় দাস বিদ্রোহী স্পার্টাকাস চরিত্রে অভিনয় করেন। অনেকেই এই চরিত্রটিকে তার কর্মজীবনকে পৃথকভাবে বিবৃত করার মত চরিত্র বলে উল্লেখ করেন।[২৬] তিনি এই চলচ্চিত্রের নির্বাহী প্রযোজকও ছিলেন এবং এর নির্মাণ ব্যয় ছিল ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা সে সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রের একটি ছিল।[২৭] ডগলাস শুরুতে অ্যান্টনি মানকে পরিচালনার জন্য নির্বাচন করেন, কিন্তু পরে স্ট্যানলি কুবরিককে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। কুবরিকের সাথে তিনি পূর্বে প্যাথস অব গ্লোরি চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন।[২৮]
ডগলাস লেখক কেন কেসির নিকট থেকে তার রচিত ওয়ান ফ্লু ওভার দ্য কুকুস নেস্ট উপন্যাসের স্বত্ব কিনে নেন। তিনি ১৯৬৩ সালে উপন্যাসটি থেকে একটি মঞ্চনাটক নির্মাণ করেন এবং এতে অভিনয় করেন। মঞ্চনাটকটি পাঁচ মাস ব্রডওয়ে মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় এবং মিশ্র পর্যালোচনা অর্জন করে। ডগলাস চলচ্চিত্রের স্বত্বও নিয়ে রাখেন, কিন্তু প্রায় এক দশক কোন প্রযোজক না পাওয়ার পর তিনি তার পুত্র মাইকেল ডগলাসকে এর স্বত্ব প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালে মাইকেল ও সল জ্যান্ট্স এর চলচ্চিত্ররূপ নির্মাণ করেন। এতে শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেন জ্যাক নিকোলসন, কারণ কার্ক ডগলাস তখন এই চরিত্রের জন্য বেশি বয়স্ক বলে গণ্য হন। চলচ্চিত্রটি একাডেমি পুরস্কারের পাঁচটি প্রধান পুরস্কার জয় করে, অস্কারের ইতিহাসে কেবল দ্বিতীয়বারের মত এমনটি ঘটে।[২৯]
এলিয়া কাজান পরিচালিত নাট্যধর্মী দি অ্যারেঞ্জমেন্ট (১৯৬৯) চলচ্চিত্রে ডগলাস একজন বিজ্ঞাপন নির্বাহী চরিত্রে অভিনয় করেন। এতে তার সহশিল্পী ছিলেন ফে ডানাওয়ে। চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে নিম্নমানের ব্যবসা করে এবং অধিকাংশ নেতিবাচক পর্যালোচনা অর্জন করে। তবে ডানাওয়ে মনে করেন পর্যালোচনাগুলো পক্ষপাততুষ্ট ছিল এবং তিনি তার জীবনীতে লিখেন, "আমি বুঝতে পারিনি দর্শক কীভাবে কার্কের অভিনয়কে হেলা করেছিল, কারণ আমি মনে করি তিনি এই চলচ্চিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছেন," এবং আরও বলেন, "অভিনয় পেশায় আমি যাদের সাথে মিশেছি তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তি।"[৩০] তিনি বলেন "অভিনয়ে তার বাস্তবসম্মত বিচরণ" পরবর্তী কালে একটি দর্শন হয়ে ওঠে।[৩১]
মৃত্যু
ডগলাস ২০২০ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি ১০৩ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ারবেভারলি হিলসে তার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ গোপন রাখা হয়।[৩২][৩৩] ডগলাসের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি ওয়েস্টউড ভিলেজ মেমোরিয়াল পার্ক সেমাটেরিতে।[৩৪]
চলচ্চিত্রের তালিকা
প্রযোজিত চলচ্চিত্র
দ্য ইন্ডিয়ান ফাইটার
স্পিরিং রিইউনিয়ন
লিজি
দ্য কেয়ারলেস ইয়ার্স
রাইড আউট ফর রিভেঞ্জ
পাথস অব গ্লোরি
দ্য ভাইকিংস
টেলস অব ভাইকিংস
দ্য ডেভিলস ডিসিপেল
লাস্ট ট্রেন ফ্রম গান হিল
স্পার্টাকাস
স্ট্রেঞ্জার হোয়েন উই মিট
দ্য লাস্ট সানসেট
লোনলি আর দ্য ব্রেভ
দ্য লিস্ট অব অ্যান্ড্রিয়ান ম্যাসেঞ্জার
সেভেন ডেজ ইন মে
সেকেন্ডস
গ্র্যান্ড প্রিক্স
দ্য ব্রাদারহুড
ক্যাচ মি আ স্পাই
আ গানফাইট
দ্য লাইট অ্যাট দ্য এজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড
সামারট্রি
স্কালাওয়াগ
পোজ
দ্য ফাইনাল কাউন্টডাউন
সামথিং উইকড দিস ওয়ে কামস
ড্র!
আমোস
টাফ গাইজ
তথ্যসূত্র
↑"Douglas, Kirk, LTJG"। www.navy.togetherweserved.com। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১০, ২০১৮।
↑ভেলেন্টি, জ্যাক (২০০৭)। This Time, This Place: My Life in War, the White House, and Hollywood। ক্রাউন পাবলিশিং।