আকিরা কুরোসাওয়া (জাপানি ভাষায়: 黒澤 明 কুরোসাওয়া আকিরা) (২৩শে মার্চ, ১৯১০[১] - ৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮) প্রখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, সম্পাদক এবং চিত্রনাট্যকার। বিংশ শতাব্দীর সেরা পরিচালকদের মধ্যে একজন তিনি। তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ১৯৪৩ সালের সানশিরো সুগাতা এবং শেষ চলচ্চিত্র ছিল ১৯৯৩ সালের মাদাদাইয়ো। তার দুটি চলচ্চিত্র সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কার লাভ করে। তিনি একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার, লেজিওঁ দনর সহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
প্রাথমিক জীবন
আকিরা কুরোসাওয়া ১৯১০ সালের ২৩শে মার্চ জাপানের রাজধানী টোকিওর শিনাগাওয়া উপশহর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। ইসামু কুরোসাওয়া ও শিমা কুরোসাওয়া[২] আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তার জন্মের সময় তার বাবার বয়স ছিল ৪৫ আর মায়ের বয়স ছিল ৪০। তার তিন ভাই এবং চার বোন ছিল। ভাইদের মধ্যে একজন তার জন্মের আগেই মারা যান এবং একজন তার জন্মের সময়ই কাজের সন্ধানে শহরে চলে যান। বোনদের মধ্যেও একজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার জন্মের আগে। কুরোসাওয়ার ঠিক বড় যে বোন ছিলেন তাকে তিনি "ছোট আপা" বলে ডাকতেন। দশ বছর বয়সে তার এই বোনটিও রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
কুরোসাওয়া পরিবার প্রাক্তন সামুরাইদের বংশধারা বহন করে আসছিল। তার বাবা জাপানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত একটি জুনিয়র হাই স্কুলের পরিচালকের দায়িত্ব নিয়োজিত ছিলেন। এই পরিবারের অর্থাভাব কোনও কালেই ছিল না। বাবা ইসামু কুরোসাওয়া পশ্চিমা সংস্কৃতির অনেক কিছুই পালন করতেন, যেমন স্কুলে পরিচালিত অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতা ও সপরিবারে সিনেমা দেখতে যাওয়া। উল্লেখ্য জাপানি নাট্যাঙ্গণে এই সিনেমাগুলো তখন কেবলমাত্র আসতে শুরু করেছিল। পরবর্তীতে জাপানি সংস্কৃতি যখন পশ্চিমা চলচ্চিত্রের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠে তখন ইসামু মনে করতেন, চলচ্চিত্র এক ধরনের ইতিবাচক শিক্ষাগত অভিজ্ঞতা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আকিরার এক শিক্ষক তাকে আঁকতে উৎসাহ দিতেন। [৩] তিনি আকিরার মেধা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং তাকে চোখে চোখে রাখতেন। তার উপর তার বড় ভাই হেইগোর বিশাল প্রভাব ছিল। হেইগো খুব মেধাবী ছিলেন এবং স্কুলের অনেক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। অবশ্য চরিত্রের দিক দিয়ে তিনি একটু নৈরাশ্যবাদী ছিলেন। ১৯২৩ সালে কান্তো ভূমিকম্পে টোকিওর এক লক্ষ মানুষ মারা যায়। ভূমিকম্পের পর ১৭ বছর বয়সী হেইগো ও ১৩ বছর বয়সী আকিরা হেঁটে হেঁটে বিধ্স্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছিলেন। তারা দেখেছিলেন সর্বত্র স্তূপ হয়ে থাকা মানুষের লাশ। আকিরা যখনই মৃত্যু দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে নিতে চাইছিলেন, তখনই হেইগো তাকে এমনটি করতে নিষেধ করছিলেন। আকিরার ভাষ্যমতে এই অভিজ্ঞতা তাকে একটি সত্য শিখিয়েছিল, সেটি হল: ভীতিকর কিছুর দিকে সরাসরি তাকালে তার ভয় দেখানোর ক্ষমতা চলে যায়।[৪][৫]
হেইগো এক সময় টোকিও চলচ্চিত্র থিয়েটারে বেনশি হিসেবে কাজ করা শুরু করে। বেনশিরা নির্বাক চলচ্চিত্রের দর্শকদের জন্য পেছন থেকে কাহিনী ও কথোপকথন বর্ণনা করত। এই বিষয়টা নির্বাক চলচ্চিত্রে জাপানিদের বিশেষ সংযোজন হিসেবে প্রশংসা অর্জন করেছিল। কিন্তু সবাক চলচ্চিত্রের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে জাপান জুড়ে বেনশিরা চাকরি হারাতে থাকে। হেইগো একটা বেনশি আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এ সময় আকিরা শ্রমিক ব্যবস্থাপনা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং একটি পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি করেন। একই সাথে চিত্রকর এবং সাহিত্য পাঠক হিসেবে তার দক্ষতার ভিত গড়ে উঠতে থাকে। জীবনে বেশ কিছু কাজে প্রতিফলিত হলেও আকিরা কখনও নিজেকে সাম্যবাদী বলেন নি।
আকিরার বয়স যখন বিশের একটু উপরে তখন তার বড় ভাই হেইগো আত্মহত্যা করেন।[৬] এর চার মাস পড়ে কুরোসাওয়া পরিবারের বড় ছেলে মারা যান। চারজন ছেলের মধ্যে তখন কেবল আকিরাই বেঁচে থাকেন। তখন তার বয়স ছিল ২৩ [৭][৮]
প্রাথমিক কর্মজীবন
১৯৩৬ সালে কুরোসাওয়া জাপানের একটি মূলধারার চলচ্চিত্র স্টুডিওতে পরিচালনার জন্য আয়োজিত একটি শিক্ষানবিশি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। পিসিএল নামের এই স্টুডিওটি পরবর্তীতে তোহো নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরিচালক কাজিরো ইয়ামামোতো তাকে সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আকিরা তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করেন যার নাম ছিল সানশিরো সুগাতা। এর পর তার করা সব ছবিই যুদ্ধকালীন জাপানি সরকার খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। এ কারণে এ সময়ের ছবিগুলোতে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা উঠে এসেছে। যেমন তার "দ্য মোস্ট বিউটিফুল" নামের ছবিটি সামরিক অপটিক্সের কারখানায় কাজ করে এমন এক নারীর জীবন নিয়ে করা। "জুডো সাগা ২" ছবিতে জাপানি জুডোকে পশ্চিমা তথা মার্কিন বক্সিং থেকে উত্তম হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
যুদ্ধের পর তার করা প্রথম ছবিতে এ ধরনের কোনও প্রভাব ছিল না, বরং এতে পূর্বতন জাপান রাজতন্ত্রকে কটাক্ষ করা হয়েছে। "আমার যুবকাল নিয়ে অক্ষোভ" (わが青春に悔なし ওয়াগা সেইশুং নি কুইনাশি, ইংরেজি নাম No Regrets for Our Youth) নামের এই সিনেমাটি বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত এক ব্যক্তির স্ত্রীকে নিয়ে করা। এই বামপন্থী রাজনীতিবিদ পুলিশের হাতে আটক হওয়া থেকেই কাহিনীর শুরু। সমসাময়িক জাপান নিয়ে কুরোসাওয়া আরও কিছু ছবি করেছেন যার মধ্যে আছে "মাতাল দেবদূত" (酔いどれ天使 য়োইদোরে তেন্শি) এবং "স্ট্রে ডগ"। কিন্তু তার পিরিয়ড চলচ্চিত্র "রাশোমোন" (羅生門 রাশোওমোং) তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এই ছবিটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবেগোল্ডেন লায়ন পুরস্কার অর্জন করে এবং পরবর্তীতে একাডেমি পুরস্কার ও লাভ করে।
পরিচালক হিসেবে আকিরা
১৯৫০-এর দশকের মধ্যে কুরোসাওয়া এমন কিছু কৌশল রপ্ত করেছিলেন যা তার ছবিগুলোকে অনন্য করে তুলতো। ছবির শুটিংয়ের সময় তিনি "টেলিফটো লেন্স" ব্যবহার করতেন কারণ তার বিশ্বাস ছিল অভিনেতার কাছ থেকে ক্যামেরা দূরে রাখলে অভিনয় ভাল হয়। এছাড়া তিনি একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। একাধিক ক্যামেরা ব্যবহারের জন্যই অ্যাকশন দৃশ্যগুলো বিভিন্ন কোণ থেকে দেখানো সম্ভব হতো। কুরোসাওয়ার ছবির আরেকটি বড় ট্রেডমার্ক হল ভাব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আবহাওয়ার সাহায্য নেয়া। যেমন: রশোমনের শুরুর দৃশ্যের অঝোরে বৃষ্টিপাত, সাত সামুরাইয়ের (七人の侍 শিচিনিং নো সামুরাই) শেষ যুদ্ধের দৃশ্য, "স্ট্রে ডগ" এর প্রচণ্ড উত্তাপ, "ইয়োজিম্বো"-তে প্রচণ্ড শীত, ইকিরু-তে তুষারপাত এবং "রক্তের সিংহাসনে" (蜘蛛巣城 কুমোনোসুজো, "মাকড়জাল দুর্গ") কুয়াশা। এছাড়া কুরোসাওয়া ওয়াইপ ব্যবহার করতেন।
একনায়কসুলভ পরিচালনার জন্য আকিরা চলচ্চিত্র মহলে "টেনো" বা "সম্রাট" হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কাঙ্ক্ষিত ভিজুয়াল ইফেক্ট তৈরির জন্য তিনি বিপুল সময় ও শ্রম ব্যয় করতেন। এক্ষেত্রে তাকে পারফেকশনিস্ট বলা চলে। রশোমনের শুরুর দৃশ্যে ভারী বৃষ্টিপাতকে ফুটিয়ে তোলার জন্য শুটিং এলাকার স্থানীয় পানির পুরো সাপ্লাই শেষ করে ফেলেছিলেন। আর এই পানির সাথে ক্যালিগ্রাফির কালি মিশিয়ে কালো রঙের সৃষ্টি করেছিলেন। কারণ কালো রঙে বৃষ্টির গাঢ়তা বোঝা যায়। "রক্তের শিংহাসনের" শেষ দৃশ্যে মিফুনে তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই শটের জন্য কুরোসাওয়া দক্ষ তীরন্দাজদের দিয়ে প্রকৃত তীর ব্যবহার করিয়েছিলেন। দক্ষ তীরন্দাজেরা মিফুনের শরীরের কয়েক সেন্টিমিটার দূরে তীর নিক্ষেপ করেছিল। রান (乱 রাং অর্থাৎ "গোলমাল", "যুদ্ধ", "বিদ্রোহ") ছবির একটি দৃশ্যে বিশাল দুর্গ প্রাসাদ আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল। এজন্য মাউন্ট ফুজির উপরে একটি আলাদা দুর্গ সেট তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। এই দুর্গটি তৈরিই করা হয়েছিল পুড়িয়ে দেবার জন্য।
তার পরিচালনার আরও কিছু কাহিনী আছে। যেমন, সামনের অতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এই ভিজুয়াল ইফেক্ট আনার জন্য তিনি উল্টো দিক থেকে ঝোড়ো হাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ছবির একটি দৃশ্যে ট্রেন থেকে বাড়ির শট নেয়া হচ্ছিল। আকিরা মনে করেছিলেন সেই বাড়ির ছাদ থাকার কারণে শটটা দেখতে ভালো লাগছে না। এজন্য তিনি বাড়ির পুরো ছাদ সরিয়ে ফেলেছিলেন। পরে বাড়ির ছাদ অন্য কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।
পোশাক সজ্জার ব্যাপারেও তার পারফেকশনিস্ট চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছিল। তিনি মনে করতেন অভিনেতাকে সিনেমার শটের জন্য সম্পূর্ণ নতুন পোশাক দিলে বিষয়টা বাস্তবসম্মত হয় না। এজন্য অনেক সময় তিনি অভিনেতাদেরকে শুটিঙের এক সপ্তাহ আগে পোশাক দিয়ে দিতেন। অভিনেতাদের প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই পোশাক পরতে হত এবং পোশাকের সাথে নিজের বন্ধন বাড়িয়ে তুলতে হত। বিশেষ সেভেন সামুরাই ছবিতে এটার দরকার পড়েছিল। কারণ এ ছবির লোকজন অধিকাংশই ছিল গরিব কৃষক। এ কারণে অভিনেতাদেরকে বারবার বলে দেয়া হয়েছিল, তারা যেন কাপড় এমনভাবে পরে যে শুটিঙের সময় বোঝাই যায় সেটার অবস্থা ভালো না।
পরিপূর্ণ সঙ্গীত চলচ্চিত্রের সাথে যায় না বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। এ কারণে ছবির জন্য গান ও সুর নির্বাচনের বেলায় তিনি সেটাকে একটি মাত্র বাদ্যযন্ত্রে নামিয়ে আনতেন। অর্থাৎ একটি সুরের জন্য কেবল একটি সুরই ব্যবহৃত হত। অবশ্য ছবির শেষের দিকে পরিপূর্ণ সঙ্গীতের ব্যবহার বাড়িয়ে দিতেন তিনি।
সানশিরো সুগাতা·The Most Beautiful·Sanshiro Sugata Part II·The Men Who Tread on the Tiger's Tail·Those Who Make Tomorrow·No Regrets for Our Youth·One Wonderful Sunday·Drunken Angel·The Quiet Duel·স্ট্রে ডগ
১৯৫০-এর দশক
Scandal·রাশোমোন·The Idiot·ইকিরু·সেভেন সামুরাই·I Live in Fear·Throne of Blood·The Lower Depths·The Hidden Fortress
১৯৬০-এর দশক
The Bad Sleep Well·Yojimbo·Sanjuro·High and Low·Red Beard