স্যার এভারটন ডিকার্সি উইকস, কেসিএমজি, জিসিএম, ওবিই (ইংরেজি: Everton Weekes; জন্ম: ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫ - মৃত্যু: ১ জুলাই, ২০২০) বার্বাডোসের সেন্ট মাইকেল এলাকার ওয়েস্টবারিতে জন্মগ্রহণকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের শীর্ষস্থানীয় ও বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তারকা ছিলেন। ফ্রাঙ্ক ওরেল ও ক্লাইড ওয়ালকটের সাথে তিনিও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের পক্ষে অংশগ্রহণ করে বৈশ্বিক ক্রিকেটে একাধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাসে তারা একত্রে ‘থ্রি-ডব্লিউজ’ নামে খ্যাতি পান।
ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে বার্বাডোস দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দলে এভারটন উইকস মূলতঃ ডানহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন। পাশাপাশি ডানহাতে লেগ ব্রেক ও উইকেট-রক্ষণে দক্ষ ছিলেন তিনি।
প্রারম্ভিক জীবন
ইংরেজ ফুটবল দল এভারটন থেকে তার বাবা নামকরণ করেছিলেন।[১] কিন্তু তিনি তার ডিকার্সি নামের উৎস সম্পর্কে অবগত নন। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে, তার পরিবার ফরাসী ভাষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।[১] উইকসের পরিবার গরিব ছিল। ফলে ৮ বছর বয়সেই তার বাবা পরিবার ফেলে রেখে ত্রিনিদাদের তৈলক্ষেত্রে কাজের সন্ধানে চলে যান। এরপর তিনি এগারো বছর পর পরিবারের সাথে মিলিত হয়েছিলেন।[২] পিতার অবর্তমানে উইকস এবং তার বোন মা লেনোর ও এক কাকীর সান্নিধ্যে শৈশবকাল অতিবাহিত করেন।[২]
সেন্ট লিওনার্ড বয়েজ স্কুলে অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি কোন পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হননি। পরবর্তীকালে অবশ্য হোটেল ম্যানেজম্যান্ট বিষয়ে কৃতকার্য হয়েছেন।[৩] এসময় তিনি কেবলমাত্র খেলাধূলাতেই মনোযোগী ছিলেন।[৪] ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবল খেলাতেই তার দক্ষতা ছিল। ফুটবলার হিসেবে বার্বাডোসের প্রতিনিধিত্ব করেন।[৫]
ক্রিকেট খেলা বিনামূল্যে দেখার লক্ষ্যে বালক অবস্থায় কেনসিংটন ওভালে গ্রাউন্ডসম্যানদেরকে সহায়তা করতেন। সেখানে প্রায়শঃই তিনি পরিবর্তিত ফিল্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন।[৬] এরফলে শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ লাভ করেছেন।[৭] ১৩ বছর বয়সে বার্বাডোস ক্রিকেট লীগে (বিসিএল) ওয়েস্টশায়ার ক্রিকেট ক্লাবের পক্ষে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তিনি স্থানীয় পিকউইক ক্রিকেট ক্লাবে খেলার জন্য আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ঐ ক্লাবে কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দেরকেই অন্তর্ভুক্ত করা হতো।[৮]
১৯৩৯ সালে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ১৪ বছর বয়সে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন। এরফলে তিনি ক্রিকেট খেলায় সফলতার জন্য আরও অনুশীলনের সুযোগ পান।[৯] ১৯৪৩ সালে ল্যান্স-কর্পোরাল পদে বার্বাডোস রেজিম্যান্টে চাকরি করেন।[৮] ১৯৪৭ সালে চাকরি ত্যাগ করেন।[৭] সামরিক বাহিনীতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বিধায় বার্বাডোস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের স্বীকৃতপ্রাপ্ত গ্যারিসন স্পোর্টস ক্লাবে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পান।[৮]
থ্রি-ডব্লিউজ
বার্বাডোস থেকে ক্লাইড ওয়ালকট ও ফ্রাঙ্ক ওরেলের সাথে ১৯৪৮ সালে একত্রে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক ঘটে উইকসের। ঐ দেশ থেকে তারা অসাধারণ ব্যাটসম্যান হিসেবে মর্যাদা পান। সকলের বয়সই ১৭ মাসের পার্থক্যে জন্মগ্রহণ করেন ও কেনসিংটন ওভালের ১ মাইলের মধ্যে তারা বসবাস করতেন।[১০] এছাড়াও ওয়ালকট বিশ্বাস করেন যে, তারা সকলেই একই ধাত্রীর হাতে জন্মেছেন।[১১]
১৬ বছর বয়সে দলের অনুশীলনীর সময়ে উইকস ওয়ালকটের সাথে প্রথম স্বাক্ষাৎ করেন।[১২] কোন সফরে যাবার সময় তার একত্রে একই কক্ষে অবস্থান করতেন।[১২] ক্রিকেট খেলার পর শনিবার রাতে ওরেলের সাথে একত্রে নাঁচতেন।[১৩]
১৯৫০ সালে ইংল্যান্ড সফরে ইংরেজ সাংবাদিকগণ তাদেরকে ‘থ্রি-ডব্লিউজ’ নামে নামাঙ্কিত করেন।[১৪] তবে, ওয়ালকট বিশ্বাস করেন যে, তিনজনের মধ্যে উইকসই সেরা ব্যাটসম্যান, ওরেল সেরা অল-রাউন্ডার ও নিজে সেরা উইকেট-রক্ষক ছিলেন।[১৫]
ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ১৯৬৭ সালে ওরেলের মৃত্যুর পর উইকস তার শবযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।[১৬] ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভ হিল ক্যাম্পাসে থ্রি-ডব্লিউজ ওভাল তাদের সম্মানে তৈরি করা হয়। এছাড়াও ওভালের বিপরীতে একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়।[১৭] ওভালের বাইরে ওরেল ও ওয়ালকটকে সমাধিস্থ করা হয়।[১৮] কিন্তু এখনও উইকস নিজ সমাধির ব্যাপারে কোন ইচ্ছা প্রকাশ করেননি।
'থ্রি ডব্লিউজ' নামে খ্যাত এভারটন উইকস, ফ্রাঙ্ক ওরেল ও ক্লাইড ওয়ালকটের সম্মানার্থে বার্বাডোস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ কেনসিংটন ওভালের একটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করে।[১৯]
পরবর্তী দুই টেস্টে তার অংশগ্রহণ তেমন সুখকর ছিল না।[২১] চতুর্থ ও চূড়ান্ত টেস্টে তাকে বাদ দেয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছিল। কিন্তু জর্জ হ্যাডলি আঘাত পেলে তাকে পুনরায় দলে ফিরিয়ে আনা হয়।[২২]শূন্য রানে আউট হওয়া থেকে বেঁচে গিয়ে মহামূল্যবান ১৪১ রান তোলেন। এটি ছিল তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি।[২৩] এরফলে ভারত, পাকিস্তান ও সিলন সফরের জন্য তিনি মনোনীত হন।
ভারত গমন, ১৯৪৮
দিল্লিতে ভারতের বিপক্ষে তিনি তার পরবর্তী শতক হাঁকান। নভেম্বর, ১৯৪৮ সালে ভারতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে প্রথম সফরে[২৩] প্রথম টেস্টে ১৯৪, বোম্বেতে দ্বিতীয় টেস্টে ১৬২ ও কলকাতায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় টেস্টে ১০১ রান তোলেন। মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ৪র্থ টেস্টে ৯০ রান সংগ্রহকালে বিতর্কিতভাবে রান-আউটের শিকার হন তিনি।[২৩]
টেস্ট সিরিজ শেষে সিলনের বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেন ও পাকিস্তানের বিপক্ষে অর্ধ-শতক করেন। কিন্তু ঐ সময় দলগুলো টেস্ট মর্যাদাবিহীন ছিল। দ্বাদশ ইনিংস শেষে ৮২.৪৬ ব্যাটিং গড়ে সহস্রাধিক রান সংগ্রহ করেন যা কেবলমাত্র ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের তুলনায় কম ছিল।[২৪]
১৯৫০ সালে ইংল্যান্ড সফরে তিনি তার ক্রীড়াশৈলী অক্ষুণ্ন রাখেন। ৫৬.৩৩ গড়ে ৩৩৮ রান তোলেন ও ৩-১ ব্যবধানে দলকে জয়লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[২৫] সিরিজ শেষে ১,৪১০ টেস্ট রান তোলেন ৭৪.২১ গড়ে। এছাড়াও পুরো সিরিজে ১১ ক্যাচ নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে সেরা স্লিপ ফিল্ডার ছিলেন। পাশাপাশি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে অপরাজিত ৩০৪* রান তুলেন যা অদ্যাবধি ইংল্যান্ড সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দলের একমাত্র ত্রি-শতক।[২৫]
সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে একটিমাত্র টেস্ট উইকেট পেয়েছিলেন এভারটন উইকস। ১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ গমন করে। জ্যামাইকার কিংস্টনে সিরিজের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তার বলে ১ রান করা আর্থার মরিসের ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন গ্লেনডন গিবস। ১৯৫৫-৫৬ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬ তারিখে ক্রাইস্টচার্চে ৪-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে এভারটন উইকস ১৫৬ মিনিটে ১৬টি চারের মারে ১০৩ রান তুলেন ইয়ান সিনক্লেয়ারের বলে বোল্ড হন। এটিই সিনক্লেয়ারের খেলোয়াড়ী জীবনের একমাত্র উইকেট ছিল। ঐ খেলায় তার দল ইনিংস ও ৬৪ রানে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড দলকে পরাজিত করে সিরিজে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়।[২৬]
রিচি বেনো মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘যে সকল অস্ট্রেলীয় উইকসের রুদ্রমূর্তি প্রদর্শনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করবেন - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের সাথে তাঁকে তুলনা করা চলে।’[২৭]
অবসর
১৯৫৮ সালে উরুর আঘাতের কারণে টেস্ট খেলা থেকে অবসর নিতে বাধ্য হন। অবসর পরবর্তীকালে অনেকগুলো দাতব্য ও প্রদর্শনী খেলায় অংশ নেন। ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে রোডেশিয়া সফরে বর্ণবৈষম্যবাদের শিকার হন ও শ্বেতাঙ্গ এলাকায় স্থানীয় আইনে কৃষ্ণাঙ্গদের নিষিদ্ধতার কবলে পড়ার অভিযোগ আনেন।[২৮] উইকস ও সতীর্থ রোহন কানহাই সফর বানচালের হুমকি দিলে রোডেশীয় সরকারের কর্মকর্তারা তাদের কাছে ক্ষমা চান।[২৯]
১৯৬০-এর দশকে বার্বাডোস ডেইলি নিউজে কাজ করতেন তিনি।[৩০] ঐ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন টনি কোজিয়ার।[৩১]
১৯২৯ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে আর্থার রিচার্ডসনের সর্বাধিকসংখ্যক ১১৯৩ রানের রেকর্ড পরবর্তীতে এভারটন উইকস নিজের করে নিয়েছিলেন।[৩৯] এরপর ১৯৯১ সালে পিটার স্লিপ ল্যাঙ্কাশায়ারের পক্ষে এক মৌসুমে ১,৬২১ রান তুলেন। এরফলে ৪০ বছর আগেকার ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে গড়া তার ব্যাটিং রেকর্ড ভঙ্গ হয়ে যায়।
সম্মাননা
১৯৪৯ সালে ভারতীয় ক্রিকেট কর্তৃক বর্ষসেরা ক্রিকেটারের মর্যাদা পান উইকস।[৪০] তার অপূর্ব ক্রীড়া নিদর্শনের প্রেক্ষিতে উইজডেন কর্তৃপক্ষ ১৯৫১ সালে বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে মনোনীত হন।[২১][৪১] খেলোয়াড়ী জীবন শেষে উইকস অনেকগুলো সম্মানসূচক পদবী লাভ করেন। তন্মধ্যে ওবিই, জিসিএম এবং ১৯৯৫ সালে কেসিএমজি লাভ করেন।[৪২] জানুয়ারি, ২০০৯ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভূক্তকারী ৫৫জন খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনিও অন্তর্ভুক্ত হন। এরফলে তিনিও নতুন খেলোয়াড়দেরকে এতে অন্তর্ভুক্ত করতে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন।
জুন, ২০১৯ সালে বার্বাডোসে হৃদযন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত হলে এভারটন উইকসকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়।[৪৬] ১ জুলাই, ২০২০ তারিখে ৯৫ বছর বয়সে বার্বাডোসের ক্রাইস্টচার্চে এভারটন উইকসের দেহাবসান ঘটে।[৪৭]
↑Sandiford, K. (1995) Everton DeCourcey Weekes, Famous Cricketers Series: No 29, Association of Cricket Statisticians and Historians, Nottingham. আইএসবিএন০-৯৪৭৭৭৪-৫৫-৬
Armstrong, G. (2006) The Greatest 100 Cricketers, New Holland: Sydney. আইএসবিএন১-৭৪১১০-৪৩৯-৪.
Bailey, T. (1968) The Greatest of My Time, Eyre & Spottiswoode: London. SBN 41326910.
Beckles, H. (1998) The Development of West Indian Cricket, Pluto Press আইএসবিএন০-৭৪৫৩-১৪৬২-৭.
Belson, F. (1951) "Cricketer of the Year – 1951 Everton Weekes", Wisden Cricketer's Almanack.
Dyde, B. (1992) Caribbean Companion: The A-Z Reference, MacMillan Press, আইএসবিএন০-৩৩৩-৫৪৫৫৯-১.
Edmundson, D. (1992) See the Conquering Hero: The Story of the Lancashire League 1892–1992, Mike McLeod Litho Limited, Accrington. আইএসবিএন০-৯৫১৯৪৯৯-০-X.
McGilvray, A. (1989) Alan McGilvray's Backpage of Cricket, Lester Townsend Publishing, Paddington.
Majumdar, B. & Mangan, J. (2003) Cricketing Cultures in Conflict: World Cup 2003, Routledge. আইএসবিএন০-৭১৪৬-৮৪০৭-৪.
Sandiford, K. (1995) Everton DeCourcey Weekes, Famous Cricketers Series: No 29, Association of Cricket Statisticians and Historians, Nottingham. আইএসবিএন০-৯৪৭৭৭৪-৫৫-৬.
Sandiford, K. (1998) Cricket Nurseries of Colonial Barbados: The Elite Schools, 1865–1966, Press University of the West Indies, আইএসবিএন৯৭৬-৬৪০-০৪৬-৬.