অ্যালান অ্যান্থনি ডোনাল্ড (ইংরেজি: Allan Donald; জন্ম: ২০ অক্টোবর, ১৯৬৬) অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের ব্লুমফন্তেইন এলাকায় জন্মগ্রহণকারী সাবেক এবং বিখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ও কোচ। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৯০-এর দশকের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে ২০০০-এর দশকের সূচনাকাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছেন।
ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটে ফ্রি স্টেট, অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট এবং ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে ওয়ারউইকশায়ার ও ওরচেস্টারশায়ার দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। দলে তিনি মূলতঃ ডানহাতে ফাস্ট বোলিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে নিচেরসারিতে ব্যাটিং করতেন ‘হোয়াইট লাইটনিং’ ডাকনামে পরিচিত অ্যালান ডোনাল্ড।
খেলোয়াড়ী জীবন
১৯৮৫-৮৬ মৌসুম থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অ্যালান ডোনাল্ডের প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান ছিল। ১৯৯০-এর দশকে ওয়ারউইকশায়ারের বিদেশী খেলোয়াড় ছিলেন।
সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে বাহাত্তরটি টেস্ট ও একশত চৌষট্টিটি একদিনের আন্তর্জাতিকে অংশগ্রহণ করেছেন অ্যালান ডোনাল্ড। ১৮ এপ্রিল, ১৯৯২ তারিখে ব্রিজটাউনে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০০২ তারিখে জোহেন্সবার্গে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে অংশ নেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে বর্ণবাদবৈষম্যের অবলোপনের পর ১৮ এপ্রিল, ১৯৯২ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্টে তার অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। বার্বাডোসে অনুষ্ঠিত টেস্টে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দলটি ৫২ রানে পরাজিত হয়। খেলায় তিনি ২/৬৭ ও ৪/৭৭ লাভ করেন। তন্মধ্যে, ব্রায়ান লারা’র উইকেটও লাভ করেছিলেন তিনি।
১৯৯৮ সালে ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে অংশ নেন। দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের প্রথম ইনিংসে ৩৭৪ রান তুলে। ডোনাল্ড ৫-উইকেট নিলে স্বাগতিক ইংল্যান্ড দল ৩৩৬ রানে গুটিয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা দল ২০৮ তুললে ইংল্যান্ড দলের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২৪৭। মাইকেল অ্যাথারটন ক্রিজে থাকাকালে ডোনাল্ড তার দূরন্ত বোলিং কর্ম শুরু করেন। পরবর্তীতে উভয়েই তাদের আত্মজীবনীতে অন্যতম সেরা টেস্ট খেলা হিসেবে এ মুহুর্তগুলো তুল ধরেন। অ্যাথারটনকে লক্ষ্য করে অনেকগুলো বাউন্সার দেন। সৌভাগ্যবশতঃ কয়েকটি সুযোগ থেকে মুক্তি লাভ করে ঐ দিন অ্যাথারটন অপরাজিত অবস্থায় মাঠ ত্যাগ করেন। পরদিন অ্যালেক স্টুয়ার্টকে সাথে নিয়ে বাদ-বাকী রানগুলো তুলে নেন। অ্যাথারটন ৯৮ রানে আউট হয়েছিলেন। কয়েক বছর পর অ্যাথারটন তার গ্লাভস ডোনাল্ডের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের নিলামের জন্যে দান করেন।[১]
ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ
১৯৯৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার সর্বশেষ ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি।[২] ডোনাল্ডের ৪/৩২ ও পোলকের ৫/৩৬ বোলিং পরিসংখ্যানে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ২১৩ রান তুলতে সমর্থ হয়। তবে, খেলাটি দুলতে থাকে। শেষ ৮ বলে ১৬ রানের দরকার ছিল ও হাতে ছিল মাত্র এক উইকেট। ল্যান্স ক্লুজনার ছক্কা হাঁকানোর পর এক রান নিয়ে স্ট্রাইক নিজের কাছে রাখেন। এরপর দুইটি চার মারেন। রান সমান হলে চার বল বাকী থাকে। পরের বলে কোন রান হয়নি। ক্লুজনার সোজা মারেন ও এক রান নেয়ার চেষ্টা চালান। ডোনাল্ড বলটির দিকে তাকিয়ে থাকেন ও দৌঁড়ুতে পারেননি। উভয় ব্যাটসম্যানই বোলার প্রান্তে অবস্থানের পর ডোনাল্ড দৌঁড়ুতে শুরু করেন ও ব্যাট ফেলতে ব্যর্থ হন। বলটি বোলারের কাছে আছে ও অপর প্রান্তে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট স্ট্যাম্প ভেঙ্গে ফেলেন। তখন ডোনাল্ড পিচের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলেন।
যদিও খেলাটি টাই হয়েছে; তবে, সুপার সিক্স পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হবার সুবাদে জয় পেতে ব্যর্থ হওয়ায় চূড়ান্ত খেলায় উপনীত হতে পারেনি।
মূল্যায়ন
তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সফল পেস বোলার হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আধুনিক যুগে দক্ষিণ আফ্রিকার সফলতায় যদি কোন খেলোয়াড়কে কৃতিত্ব দেয়া হয়, তাহলে তা নিঃসন্দেহে অ্যালান ডোনাল্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ধ্রুপদী ভঙ্গীমা সহযোগে দূর্দান্ত পেস বোলিং নিয়ে নিজের সেরা দিনগুলোয় যে-কোন দলে তাকে ঠাঁই করে নিতে পারবেন। খেলোয়াড়ী জীবনের অধিকাংশ সময়ই দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র বিশ্বমানের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। টেস্টে তার স্ট্রাইক রেট ৫০-এর নিচে ও একদিনের আন্তর্জাতিকে ৩০-এর কাছাকাছি। পাশাপাশি স্বর্ণালী সময়ে অতিরিক্ত বোলিং ও আঘাত প্রাপ্তি শুরু হয় তার।
টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ফাস্ট বোলার ছিলেন। ১৯৯৮ সালে আইসিসি প্রণীত টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে পৌঁছেন। পরের বছর ৮৯৫ পয়েন্ট লাভ করেছিলেন। ১৯৯৮ সালের ওডিআইয়ে ৭৯৪ পয়েন্ট লাভ করে দলীয় সঙ্গী শন পোলকের পর দ্বিতীয় স্থান দখল করেন। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে সফরকারী ভারতের বিপক্ষে নতুন বল নিয়ে শন পোলকের সাথে জুটি গড়ে বোলিং আক্রমণ শানতেন। এ ধারা ২০০২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব-পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
২০০১-০২ মৌসুমে জোহেন্সবার্গে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরাজিত হবার পর টেস্ট ক্রিকেট থেকে সড়ে আসেন। এর এক বছর পর ওডিআই থেকেও অবসর নেন। ২০০৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায়ের পর সকল স্তরের ক্রিকেট থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। অবসর গ্রহণকালীন তিনি টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বাধিকসংখ্যক উইকেট শিকারীতে পরিণত হয়েছিলেন। ২২.২৫ গড়ে ৩৩০ উইকেট পান। ২১.৭৮ গড়ে ২৭২টি ওডিআই উইকেট লাভ করেন। পরবর্তীতে উভয় রেকর্ডই শন পোলক নিজের করায়ত্ত্বে নিয়ে নেন।
অবসর গ্রহণের পর কোচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আন্তর্জাতিক দলসহ বেশ কয়েকটি দলের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের কেন্ট কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের সহকারী কোচ ছিলেন।
ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর সাউথ আফ্রিকান ব্রডকাস্ট কর্পোরেশন (এসএবিসি)তে ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এসএবিসি’র পক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত টেস্ট খেলাগুলো দলীয় সাবেক সঙ্গী ড্যারিল কালিনানের সাথে প্রচার করছেন। মে, ২০০৭ সালে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অস্থায়ী বোলিং পরামর্শক হিসেবে মনোনীত হন। তার যুক্ত হবার ফলে অনেক খেলোয়াড়ই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সাল পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত চুক্তি নবায়ণ করা হয়। তবে, সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সালের পর তিনি আর এ দায়িত্ব পালন না করার সিদ্ধান্ত নেন। এর কারণ হিসেবে পরিবারকে সময় দেয়ার কথা জানান তিনি।[৪] ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের কোচের দায়িত্ব পালন করেন ও ২০০৮ সালের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপের দ্বিতীয় বিভাগে সতীর্থ কোচ অ্যাশলে জাইলসকে কাউন্ট দলের শিরোপা বিজয়ে সহায়তা করেন।
২০১০ সালে জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া প্রতিযোগিতার পূর্বতন শিরোপাধারী মাউন্টেইনিয়ার্সের কোচের দায়িত্ব পালন করেন।[৫]২০১০-১১ মৌসুমে নিউজিল্যান্ডে সফররত পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের ওডিআই সিরিজ ও ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড দলের বোলিং কোচ ছিলেন তিনি।[৬]
জুলাই, ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলে গ্যারি কার্স্টেনের পরিচালনায় কোচিং বিভাগে তিনি অন্তর্ভুক্ত হন। মে, ২০১৩ সালে কার্স্টেন এ দায়িত্ব ত্যাগ করলে রাসেল ডোমিঙ্গোকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। প্রধান কোচ ডোমিঙ্গো’র অধীনে তিনি বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে, চার্ল ল্যাঙ্গেভ্যাল্ট তার স্থলাভিষিক্ত হন। এছাড়াও, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বোলিং কোচ ছিলেন তিনি।[৭]
২০১৭ সালের শুরুরদিকে কেন্ট দলের সহকারী কোচ হিসেবে মনোনীত হন। ২০১৭ সালের শুরুতে কাউন্টি দলে যুক্ত হবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করলেও ওয়ার্ক পারমিট পাননি। ফলশ্রুতিতে, উপযুক্ত কোচিং শিক্ষা লাভে অগ্রসর হন।[৮] ফলশ্রুতিতে, এপ্রিল, ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা দল আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে ঘিরে তাকে বোলিং পরামর্শক হিসেবে ধার করে নিয়ে আসে।[৯] ২০১৭ সালে কেন্টের সাথে কাজ করেননি। তবে, এ সময়ে তৃতীয় পর্যায়ের কোচিং প্রশিক্ষণ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন। ২০১৮ সালের শুরুতে আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্টে যোগ দেন। ২০১৮ মৌসুমকে ঘিরে ২০১৭-১৮ মৌসুমের রিজিওন্যাল সুপার৫০ প্রতিযোগিতায় দলকে পরিচালনা করেন।[১০][১১] জুলাই, ২০১৯ সালে তাকে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সালে বিশেষ প্রাধিকারপ্রাপ্ত নাইটস দলের প্রধান কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন।[১২]