ম্যালকম ডেঞ্জিল মার্শাল (ইংরেজি: Malcolm Denzil Marshall; জন্ম: ১৮ এপ্রিল, ১৯৫৮ - মৃত্যু: ৪ নভেম্বর, ১৯৯৯) বার্বাডোসে জন্মগ্রহণকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তারকা ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ সময়কালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে বার্বাডোস ও ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে হ্যাম্পশায়ারসহ দক্ষিণ আফ্রিকায় নাটাল দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে ‘ম্যাকো’ ডাকনামে পরিচিত ম্যালকম মার্শাল প্রধানত ফাস্ট বোলার ছিলেন। এছাড়াও, মাঝারীসারিতে ডানহাতে কার্যকরী ব্যাটিং করে দলে সবিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।
টেস্ট ক্রিকেটে তাকে অত্যন্ত সুন্দর বোলিং ভঙ্গীমার অধিকারী ও দ্রুতগতির পেসার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[১][২][৩][৪] প্রতি উইকেট লাভে তাকে গড়ে ২০.৯৪ রান দিতে হয়েছে যা ২০০ বা ততোধিক উইকেটলাভকারী বোলারদের মধ্যে অন্যতম সেরা বোলিং গড়।[৫]বোলিংয়ে তার এ সফলতা আসলেও তিনি অন্যান্য ফাস্ট বোলারের তুলনায় কম উচ্চতাসম্পন্ন ছিলেন। যেখানে তার উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি (১.৮০ মিটার); সেখানে অন্যান্য পেসারের গড় উচ্চতা ৬ ফুটের (১.৮ মিটার) চেয়ে বেশি।[১] ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথিতযশা ফাস্ট বোলার জোয়েল গার্নার, কার্টলি অ্যামব্রোস এবং কোর্টনি ওয়ালশের উচ্চতা ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি (১.৯৮ মিটার)। বিপজ্জনক বাউন্সার প্রদানে তার সবিশেষ খ্যাতি ছিল। মাঝারিসারির ব্যাটসম্যানরূপে তিনি ১০টি টেস্ট অর্ধ-শতক এবং সাতটি প্রথম-শ্রেণীর শতক করেছেন।
প্রারম্ভিক জীবন
মার্শাল বার্বাডোসের ব্রিজটাউনে জন্মগ্রহণ করেন। একবছর বয়সে ডেঞ্জিল ডিকস্টার এডজিল নামীয় পুলিশবাহিনীতে কর্মরত পিতাসড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন। তার মাতা এলিনর (বিবাহ-পূর্ব ওয়েলচ) পুনরায় বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ সংসারে তিন সৎভাই ও তিন সৎবোন রয়েছে। বার্বাডোসের উপকণ্ঠে সেন্ট মাইকেলে তিনি তার শৈশবকাল অতিবাহিত করেন। সেন্ট জাইলস বয়েজ স্কুলে ১৯৬৩-১৯৬৯ পর্যন্ত এবং পার্কিনসন কম্প্রিহেনসিভে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন।[৬]
বাবার মৃত্যুর পর তার দাদা তাকে ক্রিকেট খেলা শেখাতে সহায়তা করেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ব্যাংকস ব্রিউরি দলে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন তিনি। আগস্ট, ১৯৭৬ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর পয়েন্টে-এ-পিঁয়েরে এলাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ যুব ক্রিকেট দলের পক্ষে ও সমমানসম্পন্ন ইংরেজ দলের বিপক্ষে ৪০ ওভারের খেলায় প্রথমবারের মতো প্রতিনিধিত্ব করেন। খেলায় তিনি শূন্য রান করেন ও আট ওভারে ৫৩ রান দেন।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮ তারিখে বার্বাডোসের পক্ষে লিস্ট এ ক্রিকেটের গেডেস গ্র্যান্ট/হ্যারিসন লাইন ট্রফিতে প্রথমবারের মতো বড়দের খেলায় অংশ নেন। কিন্তু পুনরায় তিনি শূন্য রানে ফিরে আসেন ও উইকেট লাভে ব্যর্থ হন। চারদিন পর জ্যামাইকার বিপক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। রান করতে ব্যর্থ হলেও জামাইকার প্রথম ইনিংসে ৬/৭৭ নিয়ে ধ্বস নামান। ফলশ্রুতিতে একটিমাত্র প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নিয়ে ভারত সফরের জন্য মনোনীত হন তিনি।
টেস্ট ক্রিকেট
বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তারকা খেলোয়াড়গণ অংশগ্রহণ করলে দলে শূন্যতা দেখা দেয়। এরফলে ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ভারত সফরে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ব্যাংকস ব্রিউয়েরির স্টোররুমে কর্মরত অবস্থায় রেডিওতে নিজের অন্তর্ভুক্তির কথা জানেন। পরবর্তীতে জানিয়েছিলেন যে, ভারত কোথায় তিনি তা জানেন না।
১৯৮৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে ৫ টেস্টের সিরিজে ৪-০ ব্যবধানে জয়লাভ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল।[৭] ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস আক্রমণই মূলতঃ উভয় দলের মধ্যকার ব্যবধান গড়ে দেয়। তন্মধ্যে মার্শাল ছিলেন সর্বাপেক্ষা বিপজ্জ্বনক ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির বোলার। সিরিজে তিনি মাত্র ১২.৬৫ রান খরচায় ৩৫ উইকেট দখল করেছিলেন।[৮] তৃতীয় টেস্টে ভাঙ্গা বামহাত নিয়েও বোলিং করে ৭/২২ লাভ করেন যা তার নিজস্ব সেরা সংগ্রহ।[৯] তাকে যোগ্য সঙ্গ দেয়া কার্টলি অ্যামব্রোসের ছিল ২২ উইকেট। এ সফর শেষেই দল দু’টি ভিন্ন পথে চলতে শুরু করে। রিচার্ডস, মার্শালসহ বেশ কয়েকজন তারকা খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন।[১০][১১] ফলে বিশ্ব ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্টে একাধিপত্যবাদ শেষ হয়ে যেতে থাকে।
৩৭৬টি টেস্ট উইকেট দখল করে বার্বাডিয়ানদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছেন ম্যালকম মার্শাল। এছাড়াও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের মধ্যে তাঁর এ সংগ্রহটি তৃতীয় শীর্ষস্থানীয়।[১২] এছাড়াও ১৫৭টি ওডিআই উইকেট নিয়ে শীর্ষস্থান দখল করে আছেন।[১৩]
কাউন্টি ক্রিকেট
১৯৭৯ সালে ম্যালকম মার্শালহ্যাম্পশায়ার ক্লাবে যোগদান করেন। এরপর থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরবর্তী ১৪ বছর সাফল্যের সাথে ক্লাবের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। এ সময়কালে ১৮.৬৪ গড়ে ৮২৪টি প্রথম-শ্রেণীর উইকেট দখল করেছিলেন তিনি।[১৪] এছাড়াও, একদিনের ক্রিকেটে ২৪.৮৮ গড়ে ২৩৯টি উইকেট পেয়েছিলেন তিনি।[১৫]
১৯৮৫ সালে হ্যাম্পশায়ার দল কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। এ পর্যায়ে শিরোপা বিজয়ী মিডলসেক্সের সাথে তারা ১৮ পয়েন্টের ব্যবধানে পিছিয়ে ছিল। ক্রিস স্মিথ ১,৭২০ রান তুলে দলের অগ্রযাত্রায় সবিশেষ ভূমিকা রাখেন।[১৬] তাঁকে বোলিং করে যোগ্য সঙ্গ দেন ম্যালকম মার্শাল। দূর্দান্ত ১৭.৬৮ গড়ে ৯৫ উইকেট দখল করেছিলেন তিনি।[১৭]
দেহাবসান
১৯৯৬ সালে মার্শাল হ্যাম্পশায়ার এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ ছিলেন। কিন্তু এ সময়কালে কোচিংয়ের মান নিয়ে বেশ সমালোচনায় পড়তে হয় তাঁকে। ১৯৯৯ সালেরক্রিকেট বিশ্বকাপপ্রতিযোগিতা চলাকালে তিনি কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এরফলে তিনি দ্রুত কোচের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেন ও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তিনি আরোগ্যলাভ করতে পারেননি। এ অবস্থায় দীর্ঘদিনের সঙ্গীনি কনি রবার্তা আর্লিকে রমসে এলাকায় ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯ তারিখে বিবাহ করেন ও নিজ শহরে ফিরে আসেন। ২৫ কেজিরও কম ওজন নিয়ে ৪১ বছর বয়সে ৪ নভেম্বর, ১৯৯৯ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।[১৮]
সম্মাননা
উইজডেন ট্রফির পাশাপাশি ২০০০ সাল থেকে ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট লাভকারী বোলারকে তাঁর নামানুসারে ‘ম্যালকম মার্শাল স্মারক ট্রফি’ প্রদান করা হচ্ছে।[১৯][২০] একই নামে বার্বাডোস এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর মধ্যকার বার্ষিক খেলায় পুরস্কার প্রদান করা হয়।
বার্মিংহামের হ্যান্ডসওর্থ পার্কে ম্যালকম মার্শাল স্মারক ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হয়। রবিবার যুক্তরাজ্যের আগস্ট ব্যাংক ছুটির দিনে আমন্ত্রিত একাদশ বনাম নির্বাচিত একাদশের মধ্যে খেলা হয়। হ্যাম্পশায়ারের রোজ বোলকে মার্শাল স্মরণে মার্শাল ড্রাইভ ও রয় মার্শাল নামে ডাকা হয়।