২০১১ বাংলাদেশ শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি বলতে ২০০৯ থেকে ২০১১ সময়কালীন বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের অস্থির পরিস্থিতিকে বুঝানো হয়; নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয় বাংলাদেশের ঢাকা এবং চট্টগ্রাম উভয় শেয়ার বাজারে। ২০০৯ সালে বাজার ৬২% এ উন্নীত হয় যা ২০১০ ৮৩% এ পৌছায়, কিন্তু ২০১১ জানুয়ারীতে ১০% এ নেমে আসে। পরবর্তীতে ২০১১ ফেব্রুয়ারিতে ৩০% এ উন্নীত হয়।[১] এই দর পতনটি কেলেঙ্কারি হিসাবে পরিচিতি পায় [২] এবং সরকারের তৎকালীন ব্যর্থতায় বৃদ্ধি পায়।
২০০৯ সালের বেশিরভাগ সময় স্টক মার্কেটে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়[৩] দুই বছরের রাজনৈতিক সংকট শেষে এবং গণতন্ত্র পুনঃ উদ্ধারের (ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় লাভের মাধ্যমে) সময় থেকেই বুলিশ ট্রেন্ড (শেয়ার দরের উদ্ধগতি) এর প্রবণতা শুরু হয়েছিল [৪] এবং এটি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার মাঝেও অপরিবর্তিত ছিল[৫] পুঁজি বাজারে গ্রামীণফোন প্রবেশের মাধ্যমে সমগ্র বাজারে ব্যপকভাবে সহায়তার সুযোগ তৈরি হয়েছিল, ১৬ নভেম্বর ২০০৯ একদিনে মূল্যসূচক ২২% বৃদ্ধি পেয়েছিল [৬] শেয়ার মূল্যের অস্থিরতা চলতে থাকে এবং ২০০৯ এর মধ্যভাগে এই হার বাৎসরিক সর্বোচ্চে পৌছায়।[৭] ২০০৯ এর শেষভাগে দর পতনের [৮] পূর্ব মুহুর্তে খুচরা বিনিয়োগকারীরা অনশন ধর্মঘট এর হুমকি দেয় [৮] উল্লেখ্য যে, এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে শেয়ার বাজার পতনের আরো একটি অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাকতালীয় বিষয়, দুইটি পতনই সংগঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের শাসন আমলে[৯] সম্পূর্ণ ২০১০ শেয়ার বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করে, ডিএসই একই মাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ্য সূচক স্পর্শ করা [১০] এবং ১৯৯৬ সালের পরবর্তি সময়ের বিচারে কোন একক দিবসে সর্বোচ্চ্য দর পতনের [১১] অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
২০১০ এর শেষভাগে এটা নিশ্চিতভাবে স্বীকৃত হয়ে যায় যে, বাংলাদেশের শেয়ার বাজার অতিমূল্যায়িত এবং অতিচাঙ্গা[১২] কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্দা দুর এবং বাজার পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে সমগ্র শেয়ার বাজার পরিমাপ করে এবং কিছু কঠোর নিতিমালা প্রয়োগ করে। [১৩][১৪]
রক্ষণশীল আর্থিক নিতিমালা পুঁজি বাজারের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং ফলাফল হিসাবে ১৩ ফেব্রুয়ারি পুনরায় বাজার ২৮৫ পয়েন্ট মুল্য সূচক হারায়,[১২] ডিজিএন সূচক ৩% এর অধিক হারিয়ে ৮,৫০০ পয়েন্ট এর কাছাকাছি এসে পৌছায়। ১৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বারের মতো শেয়ার বাজারে ধস নামে, সূচক ৫৫১ পয়েন্ট হারায় যা প্রায় ৭% এর কাছাকাছি।[১২][১৩][১৪] কোন একক দিনে শেয়ার বাজারের এই ৭% ধস ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ৫৫ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ্য পতন[১৪] যা ১৯৯৬ এর বাজারকে অতিক্রম করে।[১৪] বিশ্লেষক যারা বিশ্বাস করেন বাজারকে অতিমূল্যায়িত করা হয়েছে তাদের কাছে এই ধস স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে দেখেন।[১২]
বিনিয়োগকারীরা অবরোধের কর্মসুচি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে, মতিঝিলের ডিএসই এর সামনে কাগজ, কাঠ এবং আরও বিভিন্ন বস্তুতে আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ জানায়।[১৪][১৫]
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে সম্মিলিতভাবে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাৎক্ষনিকভাবে পতন রক্ষা করতে পূর্ববর্তী কঠোর নীতিমালাকে শিথিল করা হয়।[১৩] ফলাফল স্বরূপ, বাজার পরবর্তী দিনই সূচক ১.৯% বৃদ্ধি পায়।[১৫]
সুপরিকল্পিতভাবে ধস নামান ধসের বা কেলেঙ্কারির আনুমানিক টাকা ৫০ বিলিয়ন ($ ৬৬৭ মিলিয়ন)[১৬] এর মুল অংশই ডিসেম্বর ২০১০ থেকে জানুয়ারী ২০১১ এর মাঝে সংগঠিত হয় যা ডিজিইএন সূচকে ৮,৫০০ থেকে ১,৮০০ পয়েন্টে নেমে আসে, এবং শতকরা হিসাবে ২১% পতন।[১৬]
১২ জুন বাজারের ৫% পতন [১৭] এবং পরবর্তী ১১ অক্টোবরের ৪% পতন[১৭] শেয়ার বাজারকে পুনরায় অস্থির করে তোলে। এই পতনের সাথে সাথে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরণ অনশনে যায়[১৮] বিরোধী দলের রাজনীতিবিদগণ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্ততা ঘোষণা করেন।[১৮] অক্টোবর ২০১১ এ বাজার, পয়েন্ট সূচক ৫,৫০০ এর কাছাকাছি পৌছায় [১৯] যা ঠিক একবছর আগে ছিল ৮,৯০০।[২০]
বিক্ষোভ কর্মসুচি সম্পূর্ণ মাস জুড়ে সক্রিয় ছিল, নভেম্বর ২০১১ ডিএসই -এর সামনে সারা রাত্রি অবস্থান সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিল।[২১][২২]
ডিএসই অফিসের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়ে উঠে তৎকালীন সাধারন ঘটনা।[১৪][১৫] আন্দোলন সক্রিয় থাকে সম্পূর্ণ জানুয়ারী এবং ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে।[২০][২৩][২৪] প্রায়শই আন্দোলনকারী এবং পুলিশের মাঝে সংঘর্ষ বেধে যেত।[২০][২৩]
পরবর্তীকালে মার্কেটে পুনরায় ধস নামলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অনশন ধর্মঘটে যায়, বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ গঠিত হবার পূর্ব পর্যন্ত পৃথক পৃথক ভাবে এবং পরবর্তীতে ১৬ অক্টোবর সম্মিলিত ভাবে আমরণ অনশনে যায়।[১৮] বিরোধী দলের রাজনীতিবিদগণ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্ততা ঘোষণা করেন।[১৮]
১৬ অক্টোবর থেকে আন্দোলনকারীরা ডিএসই এর সামনে সারারাত অবস্থান করে[১৮][১৯] এবং অনশনের দ্বিতীয় দিনে পুলিশে লাঠি চার্জে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।[১৯] ঐক্য পরিষদের প্রধানসহ বেশকিছু আন্দোলনকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, যদিও পুলিশের পক্ষথেকে কোন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।[১৯] আন্দোলনকারীদের দাবি থাকে প্রধানমন্ত্রী দ্বারা সরাসরি বাজার নিয়ন্ত্রিত হবার পূর্ব পর্যন্ত ডিএসই এর সকল ধরনের লেনদেন বন্দ থাকবে।[২৫]
অর্থমন্ত্রী মুহিত বাজার ধসের জন্যে প্রবলভাবে সমালোচনার মুখোমুখি হন।[২৬][২৭] তিনি সাংবাদিকদের সামনে তার ব্যর্থতা স্বীকার করেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।[২৮] এপ্রিল ২০১১, তদন্ত কমিটি কর্তৃক অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানালে পুনরায় সমালোচনার মুখোমুখি হন। অক্টোবর ২০১১, অর্থমন্ত্রীর সেকেন্ডারি বাজার সম্বন্ধে বক্তব্য "বাজার কীভাবে ঠিক হবে আমি জানি না" আন্দোলনকারীদের পুনরায় তাঁতিয়ে তোলে[২৯] বিরোধীদল এবং আন্দোলনরত বিনিয়োগকারীররা তার পদত্যাগ দাবী করে[২৭][৩০]
পুজিবাজারের ধসের তদন্ত করার জন্যে ২৪ জানুয়ারী ২০১১ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে চার উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সদস্যের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়,[২] তিন মাস পর, ০৭ এপ্রিল কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে ৬০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে যাদের সম্মিলিত কারসাজিতে বাজারে এই ধস নেমেছে।[৩১] কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে ডিএসই এবং সিএসই উভয় পুজিবাজারের সকল সদস্যের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের সাথে আলোচনা করেন।[২] কমিটি বিভিন্ন অনিয়মের সন্ধান পায়, এরমধ্যে অমনিবাস একাউন্ট অন্যতম, যার সাহায্যে কিছু বাজারের কৌসুলি খুচরা বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের উপর মাত্রাতিরিক্ত লাভ দেখাতে করতে সক্ষম হয়।[৩১] চিহ্নিত প্রাথমিক ৬০ জনের মধ্যে ছিলেন ১৯৯৬ এর বাজার ধসের অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং বেক্সিমকো এর চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, ডিএসই এর সাবেক সভাপতি রাকিবুর রহমান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকার, এসইসির সাবেক সদস্য মনসুর আলম এবং বিএনপির রাজনীতিবিদ মোসাদ্দেক আলী ফালু।[৩১] প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে সালমান এবং রাকিবুর এর মতো সহ-সরকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারগন এসইসি এ সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে অনৈতিক প্রভাব প্রয়োগ করেছে।[৩১] প্রতিবেদনটির শেষে, এসইসি কে ব্যাপকভাবে সংস্কারের সুপারিশ[১৬] এবং দায়ী ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ ও তাদের প্রভাব সমন্ধে সরকারকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।[৩১]
প্রতিবেদনের ফলাফল সরূপ, এসইসি এর চেয়ারম্যান জিয়াউলসহ অপর এসইসি এর সদস্যদের বরখাস্ত করা হয় The report resulted in the dismissal of SEC chairman Ziaul along with other SEC members accused.[৩২] তবে অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত জানান যে, পরবর্তী তদন্ত ব্যতীত সরকার কোন দোষী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করবে না বা কোন প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গরন করবে না,[৩৩] যদিও নতুন তদন্তের জন্যে এখানে কোন প্রকার সময়ের উল্লেখ করা হয়নি।
অক্টোবর ২০১১ এর শেষভাগে, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ ব্যাংক (বিএবি) কর্তৃক গৃহীত বাজার স্থিতিশীল তহবিলের (এমএসএফ) সাহায্যে শেয়ার মুল্য বৃদ্ধির (মূল্যমান টাকা ৫০ বিলিয়ন বা $ ৬৬৭ মিলিয়ন) মাধ্যমে বাজারে তারল্য বৃদ্ধির পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়।[৩৪] ব্যাংকগুলি নিজেদের তারল্য সংকটের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও কোন প্রকার শেয়ার বিক্রয় ব্যতীত প্রতিবেদন অনুসারে শুধুমাত্র শেয়ার কিনতে থাকে [৩৫] প্রধানমন্ত্রীর জরুরী মিটিং সামনে রেখে বাজার মুল্য ৭% বৃদ্ধি পায়।[৩৬]
|শিরোনাম=