বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় হল প্রধান প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান যেখানে সামরিক আইন তৈরী ও বাস্তবায়ন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। সামরিক নীতিমালা এবং কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর একটি ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। এই উপদেষ্টা কমিটির সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর অন্তর্গত তিন বাহিনীর প্রধান, সামরিক বাহিনী বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিবগণ। এছাড়া এনএসআই, ডিজিএফআই, এবং বিজিবি এর সাধারণ পরিচালকগণ এই উপদেষ্টা পদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত।
১৯৭১-এর ২১শে নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গঠিত হয়। এ কারণে এই দিনটিকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এই দিনে বঙ্গভবন,সামরিক বাহিনী সদর দফতর, ঢাকা সেনানিবাস এবং দেশের প্রতিটি সামরিক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য, আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং আপামর জনগণ যে যেখানে পেরেছে সেখান থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উচ্চ মনোবল ও তীব্র দেশপ্রেমের শক্তিতে বলীয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরোধের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার সীমান্ত সংলগ্ন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ডাকবাংলোয় বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোর কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সেক্টর এবং সাবসেক্টরসমূহ
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সেক্টরসমূহ
• মেজর খালেদ মোশাররফ – (১০ এপ্রিল ১৯৭১ - ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)স্থানান্তরিত • মেজর এ.টি.এম. হায়দার (সেক্টর কমান্ডার ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ - ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২)
গঙ্গাসাগর, আখাউড়া এবং কসবা (মাহবুব, লেফটেন্যান্ট ফারুক এবং লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবির);
উত্তরে হবিগঞ্জ জেলা দক্ষিণে কানাইঘাট পুলিশ স্টেশনের মধ্যবর্তী ভারতের সাথে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বর্ডার এলাকা। প্রধান কার্যালয় ছিলো করিমগঞ্জে এবং পরবর্তীতে এটি মাসিমপুরে স্থানান্তর করা হয়।
এই সেক্টরের সীমানা ছিলো দুর্গাপুর থেকে সিলেটের ঢাকি(তামাবিল) পর্যন্ত এবং সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চলের সম্পূর্ণ বর্ডার। ভারতের সিলং-এ ছিলো এই সেক্টরের প্রধান কার্যলয়।
• মেজর মীর শওকত আলী – (৩০ জুলাই ১৯৭১ - ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই সেক্টরের আওতায় যেসকল জেলা সমূহ ছিলো সেগুলো হল কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, এবং পটুয়াখালী জেলা। মে মাসের শেষের দিকে সেক্টরসমূহের সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হয় এবং এই সময় সেক্টর ৮ এর অধিনে ছিলো কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা সাতক্ষীরা, এবং ফরিদপুর জেলার উত্তর অংশ। সেক্টরের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ছিলো বেনাপোলে
ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর, গাইবান্ধা, উলিপুর, কমলাপুর চিলমারী এলাকার কিছু অংশ। ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সেক্টরের প্রধান কার্যালয় ছিলো তপলঢালাতে পরবর্তীতে এটি মেহেন্দ্রগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়।
১৯৭১ সালের সামরিক বাহিনীর ব্রিগেড এবং রেজিমেন্ট কমান্ডারগণ
কে ফোর্স (ব্রিগেড) – ৩০ আগস্ট ১৯৭১ সালে গঠন করা হয়, নেতৃত্বে ছিলেন মেজরখালেদ মোশাররফ (কমান্ডার – সেক্টর ২)
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
এস ফোর্স (ব্রিগেড) – ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে গঠন করা হয় মেজরকে এম শফিউল্লাহ (কমান্ডার – সেক্টর ৪)
২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
জেড ফোর্স[৪] (ব্রিগেড) – ৭ জুলাই ১৯৭১ তারিখে গঠন করা হয় মেজরজিয়াউর রহমান (কমান্ডার – সেক্টর ১১)
১মইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট – সিও – মেজর জিয়াউদ্দিন। ৩১ জুলাই ১৯৭১ তারিখে কামালপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিওপি আক্রমণের পর ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিনিওর অফিসার মো: জিয়াউদ্দিনকে ১২ আগস্ট সিও পদে উন্নীত করা হয়।
'চার্লি' কোম্পানি কমান্ডার: ক্যাপ্টেন মোহসিন উদ্দিন আহমদ
৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট – সিও: মোজর আবু জাফর মোহাম্মদ আমিনুল হক
- ২আইসি: ক্যাপ্টেন খালেক উজ জামান চৌধুরী
- আরএমও: ড: বেলায়েত হোসেন
- ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার: সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইমদাদুল হক
- কোম্পানি অফিসার: সেকেন্ড লেফটেন্যান্টমুনিবুর রহমান
- প্লাটুন কমান্ডার: সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আবু জাফর
'আলফা' কোম্পানি কমান্ডার: ক্যাপ্টেন খালেক উজ জামান চৌধুরী
'ব্রাভো' কোম্পানি কমান্ডার: ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন
'চার্লি' কোম্পানি কমান্ডার: লেফটেন্যান্ট মোদাসসের হোসেন
'ডেলটা' কোম্পানি কমান্ডার: লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমান
২য়ফিল্ড আর্টিলারী ব্যাটারী (রওশনারা ব্যাটারী) – সিও: মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের ইকো সেক্টর থেকে আসামের মাসিমপুর জেলায় ৬টি ১.৫ মিলিমিটার হুউইটজার আনা হয়। প্রাথমিকভাবে এইগুলো নিয়েই ভারতের কইশালে গঠন করা হয় ২য় এফএ ব্যাটারী। এই এলাকাটি সিলেট এলাকার কাছাকাছি। ১০ অক্টোবরে ২য় এফএ ব্যাটারী জেড ফোর্সের সিলেট সেক্টরে নিযুক্ত করা হয়। পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ এবং অন্যন্য অপারেশনে গ্রাউন্ড সাপোর্ট হিসাবে এগুলো ব্যবহৃত হয়েছিলো।
১ম সিগনাল কোম্পানি – ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেমবর এই ইউনিটটি গঠন করা হয়। সিও: ক্যাপ্টেনআব্দুল হালি। অক্টোবর মাস থেকে প্রথম সিগনাল কোম্পানি জেড ফোস্টের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে সংযোজন করা হয় এবং পরবর্তীতে প্রতিটি মিশনে এটি অংশগ্রহণ করেছিলো। উল্লেখযোগ্য মিশনের মধ্যে রয়েছে সিলেটের৪র্থ এবং ৫ম সেক্টরের অধিনে বড়লেখা, ফুলতলা, আদমতলি, বিয়ানি বাজার ইত্যদি।
বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অভিযানে অংশগ্রহণ করে আসছে। ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে অধিকাংশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য নিযুক্ত ছিলেন গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, লাইবেরিয়া, লেবানন, সুদান, পূর্ব টিমোর, এবং কোত দিভোয়ার দেশগুলোতে।[৫] বাংলাদেশ এককভাবে সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য প্রেরণ করেছে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে। ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ১০,৭৩৬ জন সদস্য প্রেরণ করেছে।[৬] ইরাক যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ সত্ত্বেও বাংলাদেশ সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। ২০০৩ সাল থেকে লাইবেরিয়াতে শান্তিরক্ষী বাহিনী নিযুক্ত করেছে। এই সময় পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ২০০জন সদস্য নিয়োগ করেছে। শান্তিরক্ষি বাহিনীর সদস্যরা সে দেশে দাতব্য কার্যকলাপ, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি কাজে সহায়তা করে।
সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণসমূহ
সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ তিন বছর সময় পর্যন্ত ভাটিয়ারির বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, পতেঙ্গার বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি, এবং যশোরের বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। কর্মজীবনে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ডিফেন্স সার্ভিস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন। উচ্চ পদস্থ সামরিক অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্সেস। কর্ম জীবনে অনেকেই মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সামরিক বাহিনীর মেডিকেল কোরের সদস্যদের সাধারণ মেডিকেল কলেজ থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করার পর নিয়োগ করা হয়ে থাকে। নিয়োগ প্রাপ্তির পত মেডিকেল কোরের সদস্যগণ মিলিটারি একাডেমি থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। পরবর্তীতে পেশাদার পর্যায়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তারা মেডিকেল কোর সেন্টার এবং আর্মড ফোর্স মেডিকেল কলেজে অংশগ্রহণ করে থাকেন। সম্প্রতি আর্মড ফোর্স মেডিকেল কলেজ থেকে ক্যাডেটগণ সরাসরি কর্মজীবনে প্রবেশ করছেন।[৭]
↑"Z Force organogram"। Pdfcast.org। ২০১২-০৭-১২। ২০১৩-০৯-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০২-১৮।
↑UN Mission's Summary detailed by Country, Monthly Summary of Contributors of Military and Civilian Police Personnel, Department of Peacekeeping Operations, United Nations, 2007-5-31