খুলনা হলো বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত খুলনা বিভাগের দশটি জেলার বিভাগীয় সদর দপ্তর। এটি খুলনা বিভাগের কেন্দ্রীয় শহর। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের পরে এটি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এটি বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলার মধ্যে অন্যতম। খুলনা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে রূপসা, ভৈরব এবং ময়ুর নদীর তীর জুড়ে অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং ব্যস্ততম নদী বন্দরগুলোর মধ্যে খুলনা নদী বন্দর অন্যতম। খুলনা বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় খুলনাকে শিল্প নগরী হিসেবে ডাকা হয়। খুলনার সমুদ্র বন্দর মংলা খুলনা নগরীর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পশুর নদীর তীরে অবস্থিত যেটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং দ্বিতীয় ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর যার কারণে খুলনাকে চট্টগ্রামের পর ২য় বৃহত্তম বন্দর নগরীও বলা হয়ে থাকে। ইউনেস্কো স্বীকৃতি প্রাপ্ত পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত। খুলনাকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার বলা হয়।[৩][৪] রাজধানী ঢাকা থেকে খুলনা শহরের দূরত্ব সড়কপথে পদ্মাসেতু হয়ে ২১২ কি.মি.। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সংগে স্থলপথ, আকাশপথ, জলপথ ব্যবহার করা যায়। ১৮৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত রেলওয়ে পরিসেবা চালু করা হয় যা ছিল খুলনার প্রথম রেলওয়ে, এই রেলপথ টি খুলনা জংশন রেলওয়ে স্টেশন-এর মাধ্যমে খুলনায় প্রবেশ করে।রাজধানী ঢাকার সাথে ১৯১২ সালে খুলনা থেকে নদীপথে ঐতিহাসিক স্টিমার চলাচল শুরু করে।অর্থনৈতিক উন্নতি,ভৌগলিক অবস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুবিধার কারণে খুলনা কে বাংলার কুয়েত সিটি বলা হয়।
নামকরণ
খুলনা সদরের নামে খুলনা বিভাগের নামকরণ করা হয়েছে। প্রচলিত মতানুসারে খুলনা শহর থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ভৈরব নদীর তীরে খুল্লেনেশ্বরী দেবীর মন্দির ছিলো এবং এই দেবীর নামানুসারে খুলনা অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে।
গ্রীষ্মকালে খুলনার আবহাওয়া উষ্ণ এবং আর্দ্র। শীতকালে খুলনা নগরীর আবহাওয়া থাকে কিছুটা শীতল ও মনোরম। খুলনার বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৬.৩ °সে (৭৯.৩ °ফা) এবং মাসের তাপমাত্রা জানুয়ারিতে ১২.৪ °সে (৫৪.৩ °ফা) এবং মে মাসে ৩৪.৩ °সে (৯৩.৭ °ফা) এর মাঝে থাকে। খুলনায় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১,৮০৯.৪ মিলিমিটার (৭১.২৪ ইঞ্চি)। বছরের মোট বৃষ্টিপাতে ৮০ ভাগ সংঘটিত হয় মে এবং অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে।
খুলনা শহরে ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি বি. এল কলেজ এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার চাহিদা মিটিয়ে আসছে। ১৯৯১ সালে খুলনাতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। ২০০৩ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যা পূর্বে বাংলাদেশ ইনিষ্টিটিউট অব টেকনোলজি, খুলনা নামে পরিচিত ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০১২ সালে সর্বপ্রথম নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে। ২০১৭ সালে যাত্রা করে নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি।এছাড়া নগরীর শিরোমণিতে জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।আরও রয়েছে দৌলতপুর দিবা-নৈশ কলেজ,আজম খান কমার্স কলেজ,মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ,সুন্দরবন কলেজ, শাহপুর মধুগ্রাম কলেজ,খুলনা পাবলিক কলেজ,বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজ খুলনা,মিলিটারি কলেজিয়েট স্কুল খুলনা(এমসিএসকে),জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজ,খুলনা কলেজিয়েট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ,সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পল্লিমঙ্গল বয়েজ ও গার্লস স্কুল, খুলনা জিলা স্কুল, পাইওনিয়ার কলেজ, আফিল উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাইওনিয়ার স্কুল, মন্নুজান স্কুল, রটারি স্কুল,খুলনা কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সেন্ট জোসেফ্স উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট জেভিয়ারস স্কুল, খুলনা কলেজিয়েট স্কুল, সরকারি ইকবালনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, এছাড়া মাদ্রাসার মধ্যে দারুল কুরআন সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা-খুলনা, ডব্লিউ এফ এইচ ফাউন্ডেশন স্কুল এ্যন্ড কলেজ, খুলনা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা খুলনার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। মাধ্যমিক শিক্ষার পর কারিগরি শিক্ষার জন্য খুলনা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ও সিটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট আছে।খুলনা পাবলিক কলেজ এছাড়া সাউথ-ইস্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ,খুলনা ও অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলার মধ্যে অন্যতম।
খুলনা দেশের অন্যতম শিল্প নগরী। খুলনাকে বলা হয় রুপালি শহর। খুলনা নগরীর হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শিল্পের কারণে খুলনা এই নামটি দ্বারা পরিচিত হয়েছে।[৬] এখন কৃষির দিক বাদ দিয়ে মানুষের শিল্পের দিকে ঝোক বেশি, তারপরও খুলনার গ্রামাঞ্চলে এখনো নোনা পানি, মিষ্টি পানির বিভিন্ন জাতের চিংড়ি, সাদা মাছ চাষ হচ্ছে। এই কারণে খুলনার গ্রামাঞ্চলে অনেক ঘের দেখতে পাওয়া যায়। খুলনায় বর্তমানে মাছ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে খুলনা মহানগরীতে মংলা সমুদ্র বন্দর যা কিনা দেশের ২য় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর এবং নোয়াপাড়া নদী বন্দর,দেশের সব থেকে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল এবং খুলনার নিজস্ব নদী বন্দরের বদৌলতে এবং পদ্মা সেতুকে ঘিরে খুলনায় একাধিক বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ায় খুলনাঞ্চলের অর্থনীতি শিল্প বাণিজ্য বেশ দ্রুত এগোচ্ছে।
পূর্বে খুলনায় সব থেকে বেশি ছিল পাটপাটজাত উৎপাদন শিল্প, তবে বর্তমানে সারা দেশের ন্যায় খুলনায়তেও পাটশিল্পের অবনতি হচ্ছে যদিও এখনো বড় বড় পাট শিল্পকারখানার মধ্যে সব কারখানা বন্ধ হয়নি,এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।কয়েকটি পাট শিল্প কারখানা পিপিপি এর ভিত্তিতে বেসরকারি খাতে দেওয়ার কারণে অত্র অঞ্চলের শ্রমিক ও সাধারণ মানুষেরা নতুনভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।টিকে থাকা বড় পাট কলকারাখানা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো স্পিনিং মিলস (সেনহাটি) যা তার উৎপাদন রপ্তানি ও বাজারজাতকরণ ধরে রেখেছে সুনামের সাথে।
বর্তমানে খুলনার উল্লেখযোগ্য শিল্প হলো বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা রপ্তানীযোগ্য চিংড়ী মাছ এবং হিমায়িত খাদ্য রপ্তানি শিল্প।দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত তারশিল্প কারখানা বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেড খুলনায় অবস্থিত। খুলনায় বর্তমানে সহজ উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, বন্দর সুবিধা এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং পদ্মা সেতুকে ঘিরে বড় সব প্রকল্প হাতে নেওয়ায় খুলনায় অনেক শিল্প গড়ে উঠছে।নতুন গড়ে ওঠা শিল্পের মধ্যে অন্যতম হলো সিমেন্ট শিল্প ও এক্সপার্ট-ইমপোর্ট শিল্প।
এ ছাড়া খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া তে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম্য শিল্প বিদ্যমান রয়েছে যেমন মৃৎশিল্প,হস্তশিল্প ইত্যাদি।খুলনাঞ্চলের সব থেকে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প হলো মাদুড় বা পাটি, এটি বেতের তৈরী একধরনের কার্পেট যা মাটিতে বসার ক্ষেত্রে কিংবা অন্যান্য হরেক কাজে লাগে।
নদ নদী
খুলনায় রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদী। এখানকার নদীগুলো হচ্ছে:[৭][৮][৯]
খুলনা শহরের রাস্তাঘাট মোটামুটি ভালো এবং প্রশস্ত।উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য বর্তমানে খুলনা মহানগরীতে বিভিন্ন সড়ক প্রশস্তকরণ এবং ড্রেন ফুটপাত নির্মাণ কাজ চলছে এবং সম্পন্ন হচ্ছে পর্যায়ক্রমে।
মিডিয়া
সংবাদপত্র
দৈনিক পূর্বাঞ্চল, দৈনিক খুলনাঞ্চল, সময়ের খবর, দৈনিক খুলনা, দৈনিক জন্মভূমি, দৈনিক প্রবাহ, দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন, দৈনিক প্রবর্তন, দৈনিক তথ্য, দৈনিক অনির্বাণ, খুলনা টাইমস, দ্য ডেইলি ট্রিবিউন (ইংরেজি)।
↑ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ৩৮৯, আইএসবিএন৯৭৮-৯৮৪-৮৯৪৫-১৭-৯।
↑মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক (ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি। ঢাকা: কথাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ৬০৯। আইএসবিএন984-70120-0436-4।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: ISBN ত্রুটি উপেক্ষিত (link)