খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি শহর। চট্টগ্রাম বিভাগীয় শহর থেকে ১১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে এ শহরটি অবস্থিত। এ শহরটি খাগড়াছড়ি জেলা ও খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার প্রশাসনিক সদরদপ্তর। এটি খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে বড় শহর। এর আয়তন ৬৩.৩০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৬৯,৪৩৪ জন। এটি খাগড়াছড়ি পৌরসভা নামক একটি স্থানীয় সরকার সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। শহরের একমাত্র যোগাযোগের উপায় সড়কপথ। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং কক্সবাজার বিমানবন্দর যথাক্রমে এ শহরের সবচেয়ে নিকটবর্তী আন্তর্জাতিক এবং আভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর। শহরটি সমুদ্র সমতল থেকে ৪৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এ শহরটির আবহাওয়া গরম ও আর্দ্র জলবায়ু বিশিষ্ট।
নামকরণ
খাগড়াছড়ির প্রাচীন নাম ছিল ‘তারক’। ‘খাগড়াছড়ি’ নামের উৎপত্তি হয়েছিল নল খাগড়ার বন থেকে। খাগড়াছড়ি শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে একটি ছড়া নদী। ওই ছড়া নদীর দু’পাড়ে গভীর নল খাগড়ার বন ছিল। এই নল খাগড়ার বন থেকেই ‘খাগড়াছড়ি’ নামের উৎপত্তি।[১]
ইতিহাস
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত অত্র এলাকাটি কখনো ত্রিপুরা, কখনো বা আরকান রাজন্যবর্গ দ্বারা শাসিত হয়েছে। তন্মধ্যে ৫৯০ হতে ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৩৬৩ বছর ধরে ত্রিপুরা রাজাগণ বংশপরম্পরায় পার্বত্য চট্টগ্রাম (খাগড়াছড়িসহ) ও চট্টগ্রাম শাসন করে। অতঃপর ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আরকান রাজাগণ ২৯৭ বছরব্যাপী এ এলাকা শাসন করলেও তদ্পরবর্তীতে ১০২ বছরব্যাপী (১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) পুনরায় ত্রিপুরা রাজাগণ এ এলাকার কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। দশম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজাগণ আট বার, আরাকান রাজাগণ নয় বার এবং গৌড়ের সুলতানগণ (মুসলিম) ছয় বার এ এলাকাটি দখলে নেন। অবশেষে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ হতে ত্রিপুরা রাজার শাসন ক্ষমতার আওতা হতে মুসলিম শাসক সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ্ চট্টগ্রামসহ এ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন। মুসলিম শাসনের ধারাবাহিকতায় ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক বাংলার মসনদ দখল পরবর্তীকালে নবাব মীর কাশিম আলী খানের রাজত্বকালে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার নবাব মীর কাশিমের করতল থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। অতঃপর ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সরকারের সাথে স্বাধীন ত্রিপুরা মহারাজার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ত্রিপুরা রাজার পরাজয়ের প্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে এক চুক্তি সম্পাদিত হয়। উক্ত চুক্তির ‘৩’ নম্বর ধারা অনুসারে ‘‘চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের রাজস্ব ও প্রশাসনিক নির্বাহী ক্ষমতা ইংরেজ সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে’’ বলে উল্লেখ থাকায় প্রকৃতপক্ষে তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্রিপুরা মহারাজার শাসন ক্ষমতা ও ত্রিপুরা রাজ্য হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতঃপর ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জুনের পার্বত্য চট্টগ্রামকে চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন ও রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার্থে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে ১লা সেপ্টেম্বর মং সার্কেল, চাকমা সার্কেল ও বোমাং সার্কেল নামে তিন সার্কেলে বিভক্ত করে। অধিকন্তু, ব্রিটিশ সরকার ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ অ্যাক্ট’’ প্রবর্তন করে স্থানীয় আদিবাসীদের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র একটি পুলিশ বাহিনীও গড়ে তোলে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা হিসেবে ঘোষিত হবার পর ব্রিটিশ সরকারের বিধি অনুসারে শাসিত হতো। ১লা মে, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন আইন ১৯০০ নামে আরও একটি আইন জারী করে। উক্ত আইন মূলে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা শাসিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন পাশ হলেও ১৯০০ সালের উক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি-আইন এ অঞ্চলে অব্যাহত থাকে; যাতে অন্য জেলা থেকে আগত অউপজাতীয়দের, এ জেলায় জমি বন্দোবস্ত পাবার ব্যাপারে কড়া বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। ব্রিটিশ রাজত্বকালে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক্সক্লুডেড এরিয়া, ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে উপজাতি অঞ্চল, ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ বাতিল হয়ে এ অঞ্চল সাধারণ এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দাবীর প্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার এক নির্বাহী আদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ পুনর্বহাল করত: এ এলাকাকে উপজাতীয় এলাকা নামে ঘোষণা প্রদান করে। এ সময় তৎকালীন সরকার কর্তৃক অত্র এলাকায় বাঙ্গালী ও উপজাতীয়দের মধ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্য আনয়নের প্রচেষ্টায় উক্ত বিধির ব্যাপক সংশোধনের মাধ্যমে অউপজাতীয়দের এ অঞ্চলে জমির মালিকানা লাভের পথ সুগম করে দেয়াসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে সংশ্লিষ্ট উপজাতীয়দের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতাত্তোরকালে বিভিন্ন সময়ে সরকার উপজাতি ও অউপজাতীয়দের মধ্যে জনসংখ্যা সংক্রান্ত ভারসাম্য আনয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। পার্বত্যাঞ্চলের রাজনৈতিক পটভূমির ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং এ চুক্তির ফলে পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি স্থাপিত হয়। জনসংখ্যা সংক্রান্ত ভারসাম্য রক্ষার কার্যক্রমও বর্তমানে সীমিত আকারে অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতার উত্তরকালে খাগড়াছড়ি জেলায় সামগ্রিক উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মিত হয়। এছাড়া রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে জেলা সদরের সাথে সকল উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। অধিকন্তু, স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নান্দনিক সংস্কৃতির সাথে দেশের বৃহত্তর সংস্কৃতির সংযোগ স্থাপিত হওয়ায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রাজনৈতিক, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ৩১ শে ডিসেম্বর তারিখে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের একাংশ নিয়ে খাগড়াছড়ি পৌরসভা গঠিত হলে এ শহর পৌর শহরের মর্যাদা লাভ করে। [২]
প্রশাসন
খাগড়াছড়ি শহর খাগড়াছড়ি পৌরসভা দ্বারা শাসিত হয়। পৌরসভার অধীনে ৯টি ওয়ার্ড এবং ৭১টি মহল্লা রয়েছে যা পুরো জেলা শহরের ১৩.০৫ বর্গ কিমি এলাকা বিশিষ্ট। এছাড়াও অন্যান্য শহর অঞ্চল হিসেবে ৫০.২৫ বর্গ কি.মি. এলাকা সংলগ্ন অঞ্চল হিসেবে রয়েছে।
দর্শনীয় স্থান
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
কলেজ
উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়
প্রাথমিক বিদ্যালয়
জনসংখ্যার উপাত্ত
বাংলাদেশের আদমশুমারি ও গৃহগণনা-২০১১ অনুসারে খাগড়াছড়ি শহরের জনসংখ্যা ছিল ৬৯,৪৩৪ জন যার মধ্যে ৩৬,৯০৫ জন পুরুষ এবং ৩২,৫২৯ জন নারী। এ শহরের লিঙ্গ অনুপাত ছিল ১০০:১১৩। [৪]
২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৌরসভার জনসংখ্যা ৫৮,৮৭৫জন। এর মধ্যে ৩৪,৫৬১ জন মুসলিম, ১৫,৯২৫ জন বৌদ্ধ, ৭,৯৩৬ জন হিন্দু, ৪৩৭ জন খ্রিস্টান ও ১৬ জন অন্যান্য ধর্মের অনুসারী।[৫]
ভূগোল
যোগাযোগ
খাগড়াছড়ি যোগাযোগের প্রধান সড়ক চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক। এ শহরে বাস, অটো রিক্সা, রিক্সা ইত্যাদি সব ধরনের যানবাহনের চলাচল রয়েছে।
তথ্যসূত্র