সেন রাজবংশ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম দিকের মধ্যযুগীয় একটি হিন্দু রাজবংশ ছিল, যা বাংলা থেকে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সেন সাম্রাজ্য[২] হিসেবে শাসন করেছিল।[৩] বল্লাল সেন রচিত গ্রন্থ অনুসারে সেন রাজবংশ এর গোরাপত্তন ৯০০ শতকেরও পূর্বে। বাংলার পাল রাজাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে করতে তারা একসময় পাল রাজাদেরকে পরাজিত করে পাল সাম্রাজ্য করায়ত্ত করেন। [৪] সেন রাজাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তারা রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা হতে পরিচালিত সেন সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে উত্তরভারত (কনৌজ) পর্যন্ত। সেন রাজাদের আদি বাসস্থান ছিল রাঢ়ভূমের আদি কর্ণসুবর্ণে।[৫] সেনরা জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন [৬][৭][৮] কিন্তু ব্রাহ্মণ হয়ে রাজন্যধর্ম/ক্ষত্রিয়বৃত্তি পালনের জন্য বল্লাল সেনের অদ্ভুতসাগর গ্রন্থে ক্ষত্রচরিত্রাচার্য্য ব্রাহ্মণ ও লক্ষণ সেনের তাম্রশাসন অনুসারে রাজন্যধর্মাশ্রয়ী ব্রাহ্মণ( উভয়ের ভাবার্থ একই ) বলে শিলালিপিতে উল্লেখ করে গেছেন।[৯] রাজশাহীতে প্রাপ্ত বিজয় সেনের আমলের দেওপাড়া প্রশস্তিতে উমাপতিধরের শ্লোকে ব্রহ্মক্ষত্রিয় শব্দটি পন্ডিতদের কাছে সেনদের জাতি বর্ণনায় অধিক সমাদৃত। কৌলিন্য বিচার সেন রাজারা কুলশ্রেষ্ঠ রাজন্যব্রাহ্মণ[১০] ছিলেন ।[১১] প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে একাদশ শতাব্দীর অন্তিমলগ্নে পাল রাজবংশের বিশৃঙ্খলতার সুযোগ নিয়ে সেনদের উত্থান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূ্র্ণ অধ্যায়। বাংলার পাল রাজবংশের রাজা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে বারেন্দ্র 'সামন্তচক্রের' বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করেন এবং অবশেষে বাংলার পাল রাজবংশের রাজা মদনপালের রাজত্বকালে স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশ ঘটিয়ে সেন-ব্রাহ্মণতান্ত্রিক সেন সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।[১২] ভারতবর্ষের ইতিহাসে বাংলার সেন বংশীয় রাজাদের মধ্যে বীর সেন,সামন্ত সেন,হেমন্ত সেন, বিজয় সেন, সুখ সেন, বল্লাল সেন, ও লক্ষ্মণ সেন বিশিষ্ট স্থান অধিকার করছেন। বিশ্বরূপ সেন—তিনি বঙ্গের সেন বংশীয় নরপতি বল্লাল সেনের পৌত্র। লক্ষ্মণ সেনের অন্যতম পত্নী তন্দ্রাদেবী বা তাড়াদেবীর গর্ভে বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন নামে দুই পুত্র জন্মে। লক্ষ্মণ সেনের পরলোক গমনের পরে তার পুত্র মাধব সেন প্রথমে বাঙ্গালার রাজা হয়েছিলেন। তৎপরে তার ভ্রাতা কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন পর পর বাঙ্গালার রাজা হয়েছিলেন এবং এসময় রাজকুমারগণ রাজ্যসমূহের দায়িত্বভার বণ্টন করেন। মাধব সেন ভ্রাতা কেশব সেনের হাতে বঙ্গ রাজ্য তুলে দিয়ে হিমালয় রাজ্যে গমন করেন (মতান্তরে কেশবসেনপূত্র সূর্য সেন[১৩] ) এবং সেখানে রাজ্য বিস্তার করেন,উত্তরাখণ্ডের আলমোড়ার কোটেশ্বর মন্দির গাত্রের শিলালিপিতে মাধব সেনের কীর্তি বর্ণিত আছে যে,ধর্মরক্ষার্থে দূর্গম হিমালয় রাজ্যের (অধুনা ভারতের উত্তরপ্রদেশ,হিমাচল প্রদেশ এবং নেপাল) শাসন ভার গ্রহণ করেন এবং অনেক কুলীন এবং শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে যান।[১৪] লক্ষণ সেনের পরেও যে গৌড়ে সেন রাজগণের আধিপত্য অক্ষুদ্র ছিল,বেঙ্গল গভর্ণমেণ্ট কর্তৃক সংগৃহীত একটি হস্ত লিখিত প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে উল্লেখ আছে,—পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরম সৌগত "মধুসেন” ১১৯৪ শকাব্দে (১২৭২ খ্ৰী: ) বিক্রমপুরে আধিপত্য করতেন। ‘’ কথিত আছে, ইনি তুরস্কদিগকে বারংবার পরাজিত করেছিলেন।[১৫] এছাড়াও এই রাজবংশের রাজা হিসেবে পুরুষোত্তম সেন, সুর সেন/সূর্য সেন,নারায়ণ সেন,লক্ষণ সেনII, বল্লাল সেন II, দামোদর সেন।[১] নাম পাওয়া গেছে।
সেন সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে জানা গেলেও সেন রাজবংশের পতন সম্পর্কে জানা যায়না কারণ তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় (বিশেষত উত্তর ভারত, হিমাচল, নেপাল)[১৬] রাজকার্য চালিয়ে এসেছিল।[১৭] সর্বশেষ দুটি সেন রাজ্য(অধুনা হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত ছিল) ১৯৪৭ সনে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে যোগ দেয়,উক্ত রাজ্যের রাজাদের পূর্বপুরুষ বাংলার সেন বংশীয় ছিলেন বলে গেজেটে তাদের কুলপঞ্জিকা উপস্থাপন করেছিলেন।[১৮][১৯]
লক্ষ্মণ সেন ছিলেন বৈষ্ণব মতবাদের কঠোর অনুসারী। তিনি 'পরমবৈষ্ণব' বা 'পরমনরসিংহ' উপাধি ধারণ করেন। তার ধর্মমত পরিবর্তন সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। তার শাসনকালের শেষ দিকে অবশ্য রাজকার্য পরিচালনায় অশক্ত হয়ে পড়েন। এই সময় সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা ও সংহতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। সমসাময়িক লেখসূত্রে সেন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কতগুলি বিদ্রোহী প্রধানের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আভাস পাওয়া যায়।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে সেন রাজবংশের রাজত্বকাল দীর্ঘস্থায়ী না হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। তাই এই সময় বাংলায় হিন্দুধর্ম রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং সমাজে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সেন রাজাদের সাম্রাজ্য ধ্বংস হলে বিভিন্ন ছোট রাজ্য শাসন করতে থাকে। সেন বংশীয় এসব রাজার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুন্ড্র ও বরেন্দ্র রাজ রাজা অচ্যুত সেন,কামরুপ রাজ কামতেশ্বর নীলাম্বর সেন প্রমূখ।
আদি ইতিহাস
বাংলার পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর সেন রাজবংশের শাসনকালের সূচনা হয়। অষ্টম শতকে সেন রাজারা একটি ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। কালক্রমে এই রাজ্যটিই বিশাল আকার ধারণ করে।
সেন রাজাদের আদি বাসস্থান ছিল বাকাটক সেন সাম্রাজ্যের কর্ণাটকে। সেন রাজারা বীর সেনকে তাঁদের বংশের আদিপুরুষ বলে দাবি করেছিলেন। বৈদিক ব্রাহ্মণ কুলপঞ্জিকা গ্রন্থ "বিপ্ৰকুলকল্পলতিকা” মতে, দাক্ষিণাত্য-বৈদিক ব্রাহ্মণ রাজা অশ্বপতি সেনের বংশে চন্দ্রকেতু সেন জন্মগ্রহণ করেন, তার বংশে বীরসেন উৎপন্ন হন ; বীরসেনের বংশজাত বিক্রমসেন বিক্রমপুর নগর স্থাপন করেন ।[২০]
দেওপাড়া প্রশস্তি থেকে জানা যায়, তারা ছিলেন বৈদিক ব্রাহ্মণ এবং চন্দ্রবংশীয় ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’। এছাড়া কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে সেন রাজারা ছিলেন বৈদ্যব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের।[২১] যাঁরা ব্রাহ্মণ কুলে জন্মগ্রহণ করে একই সাথে ব্রাহ্মণ্য আচার এবং ক্ষত্রিয়ের পেশা রাজ্যশাসন ও যুদ্ধবিদ্যা অনুশীলন করে তাকে "ব্রহ্মক্ষত্রিয়" বলে।সেনদের জীবনাচরণে এর প্রভাব দৃশ্যমান। তারা যেমনি ছিলেন রাজ্যশাসন আর অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী তেমনি শাস্ত্র বিদ্যায়ও সিদ্ধহস্ত।রচণা করেছেন দানসাগর অদ্ভুতসাগরের মত গ্রন্থাবলি।
আদি বাসস্থান
দেবীপুরাণে বীরসেন নামক রাজার নাম আছে দেখিয়া হাণ্টার সাহেব মনে করেন, বীরসেন অযোধ্য হইতে বাঙ্গালায় আগমন করেন। দাক্ষিণাত্যের বাকাটক সেন সাম্রাজ্যেকে সেন বংশের আদি বংশ হিসেবে প্রতীয়মান হয় কারণ উভয় বংশের গোত্র একই "বৃষ্ণেয় /বীরসেনয়" উভয় বংশ নামান্তে সেন পদবী ধারণ করতেন ।
রাজনৈতিক ক্ষমতালাভ
সেনরা কখন বাঙলায় এসেছিলেন এ নিয়ে সর্ব প্রাচীণ যে নিদর্শন তা হলো ভাস্করবর্মার ব্রাহ্মণদেরকে ভূমিদানের তাম্রশাসন।৬ষ্ঠ শতকের ভাস্করবর্মার তাম্রশাসনে সেন পদবীর অনেক ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের বিবরণ লিখিত আছে।
দেবপাল থেকে মদনপাল পর্যন্ত পালরাজাদের লেখনি থেকে জানা যায়, তারা অনেক সময় বিদেশি কর্মচারীদের প্রশাসনিক কাজকর্মে নিযুক্ত করতেন। অনুমিত হয়, সেই সময়েই সেনরা বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সামন্ত সেনের নামের সাথে কোন রাজা সূচক কোন উপাধি পাওয়া যায় নি। তাই বলা যায় যে সামন্ত সেন বাংলার কোন শাসন ক্ষমতায় ছিলেন না। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন তিনি পাল রাজাদের কোন মহা সামন্ত ছিলেন। পরে পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা বাংলার সিংহাসন দখল করেন।
সেন রাজবংশ
সামন্ত সেন ও হেমন্ত সেন
বাংলায় সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন সামন্ত সেন। তিনি বর্ধমান অঞ্চলে বাস করতেন। সামন্ত সেন অবশ্য রাজা উপাধি ধারণ করেননি। তার পুত্র হেমন্ত সেন স্বাধীন সেন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে প্রথম ‘মহারাজা’ উপাধি ধারণ করেন।
বিজয় সেন (১০৯৫-১১৫৮ খ্রিস্টাব্দ)
হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন ক্ষুদ্র সেন রাজ্যকে একটি বিরাট সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। ‘বারাকপুর তাম্রপট্ট’ ও ‘দেওপাড়া লেখ’ থেকে বিজয় সেন সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়। বিজয় সেন পশ্চিমবঙ্গের এক শূরবংশীয় রাজকন্যাকে বিয়ে করে বর্ধমান অঞ্চলে নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। তিনি উড়িষ্যার রাজা অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গের সঙ্গে মিত্রতা করেন এবং সমগ্র রাঢ়ে নিজের একাধিপত্য স্থাপন করেন। বিজয় সেন মিথিলার নান্যদেব, গৌড়রাজ মদন পাল ও কোশাম্বীর সামন্তরাজা দ্বোরপবর্ধনকেও পরাজিত করেছিলেন। ভোজবর্মণকে পরাজিত করে বিজয় সেন পূর্ববঙ্গ জয় করেন। এছাড়া কলিঙ্গ ও মগধের কিয়দংশও তিনি জয় করেছিলেন।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বিজয় সেনের রাজত্বকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনিই ছিলেন সেন রাজবংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য শাসক। তিনি সমগ্র রাঢ়, গৌড়, মিথিলা ও পূর্ববঙ্গ জয় করেছিলেন। পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলার রাষ্ট্রীয় ঐক্য ভেঙে গিয়েছিল। বিজয় সেন পুনরায় বাংলাকে রাষ্ট্রগতভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।
বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ)
বিজয় সেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র বল্লাল সেন বাংলার সিংহাসনে বসেন। বল্লাল সেন মগধ ও মিথিলা জয় করেছিলেন। তার রাজ্য পূর্বে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে মগধ, উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। দিনাজপুরের পাথরঘড়ার বল্লালদিঘি, বিক্রমপুরের বল্লালবাড়ি আজও তার স্মৃতি বহন করছে। বল্লাল সেনের রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায় ‘নৈহাটি তাম্রপট্ট’, বিজয় সেনের ‘দেওপাড়া লেখ’, বল্লাল সেন রচিত ‘অদ্ভুত সাগর’ ও ‘দানসাগর’ গ্রন্থ, ও আনন্দভট্ট রচিত ‘বল্লালচরিত’ গ্রন্থ থেকে।
বল্লাল সেন পাল রাজাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিলেন। তার রাজত্বকালে বাগড়ি অঞ্চল (পাঞ্জাব,হিমাচল,রাজস্থান,হরিয়ানা) সেন সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। বল্লাল সেন চালুক্য রাজকন্যা রমাদেবীকে বিয়ে করেছিলেন।
অনেকের মতে বল্লাল সেন বাংলায় কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এই তথ্য অস্বীকার করেছেন। বল্লাল সেন ধর্ম ও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বেদ, স্মৃতি ও পুরাণে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি তান্ত্রিক হিন্দুধর্মেরও অনুরাগী ছিলেন। শেষ জীবনে পুত্র লক্ষ্মণ সেনের হাতে শাসনভার তুলে দিয়ে ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গাতীরে শাস্ত্রচর্চায় শেষ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।
লক্ষ্মণ সেন (১১৭৯-১২০৬)
গোবিন্দপুর (চব্বিশ পরগনা), আনুলিয়া (নদিয়া), তপনদিঘি (দিনাজপুর), মাধাইনগর (পাবনা), শান্তিপুর (নদীয়া), ভাওয়াল (ঢাকা) ও সুন্দরবন অঞ্চলে লক্ষ্মণ সেন সম্পর্কে অনেকগুলি তাম্রলিপি পাওয়া গিয়েছে। মিনহাজউদ্দিন সিরাজের ‘তবকৎ-ই-নাসিরি’ ও ইসামির ‘ফুতুহ্-অউস-সালাতিন’ বইয়েও লক্ষ্মণ সেন সম্পর্কে অনেক কথা জানা যায়।‘তবকৎ-ই-নাসিরি’তে মিনহাজউদ্দিন লক্ষণ সেন কে "হিন্দুদের খলিফা" বলে উল্লেখ করেছেন এবং তৎকালে উত্তরভারত সেন সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। মিনহাজউদ্দিন লিখেছেন, লক্ষ্মণ সেন ৬০ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন এবং গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেন। কথিত আছে, লক্ষ্মণ সেন পুরী, কাশী ও এলাহাবাদে বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। তিনি তার পিতার রাজ্যসীমা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। লক্ষ্মণ সেন কনৌজের গাড়োয়ালবংশীয় রাজাকে পরাজিত করেছিলেন এবং গয়া অধিকার করেছিলেন। তিনি বাংলার বাইরেও একাধিক সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। তার রাজত্বকালে বাংলা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছিল। ১১৯৬ সালে সুন্দরবনের একাংশের প্রজাগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। মহারাজাধিরাজ শ্রী কোম্মনপাল এখানে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বল্লাল সেনের মতো লক্ষ্মণ সেনও বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। ‘গীতগোবিন্দম্’ রচয়িতা জয়দেব, ‘পবনদূত’ রচয়িতা ধোয়ী, ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’ রচয়িতা হলায়ূধ তার সভাসদ ছিলেন। লক্ষ্মণ সেন নিজেও অনেক শ্লোক রচনা করেছিলেন পূর্বপুরুষদের ন্যায় তিনিও রাজর্ষি ছিলেন,মিনহাজ তাঁকে "হিন্দুদের খলিফা" বলে লিপিবদ্ধ করেন॥ তিনি ‘পরম বৈষ্ণব’ উপাধি ধারণ করেন। তিনি দানশীল রাজা ছিলেন বলে জানা যায়।
মাধব সেনের =আলমোড়া কোটেশ্বর মন্দির শিলালিপি (উত্তরাখণ্ড অধুনা উত্তর প্রদেশ)
পতন
১২০৬ সালে মহম্মদ ঘোরি দিল্লিতে তুর্কি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগেই ১২০২ সালে তুর্কি সামরিক নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলা আক্রমণ করেন। এর কিছুদিন আগে লক্ষ্মণ সেন নদিয়ায় অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। নদিয়া তুর্কিদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন সসৈন্যে বাধা দিয়ে অগ্রসর হন, কিন্তু প্রাসাদে উপযুক্ত পরিমাণ সৈন্য না থাকায় নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।[২২] প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়, সেন আমলের লেখাপত্র থেকে জানাচ্ছেন, লক্ষ্মণ সেন এর সাথে বখতিয়ার খিলজির একটা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হয়েছিল, লক্ষ্মণসেন পূর্ববঙ্গ থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে ফিরে এসে একবার ভীষণ যুদ্ধ করেছিলেন, সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল, এবং তাতে লক্ষ্মণ সেন, বখতিয়ার খিলজি কে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে বাঙ্গালা থেকে তাড়িয়ে দেন ও গৌড় পুনরুদ্ধার করেন।
তার মৃত্যুর পর পুত্র মাধব সেন প্রথমে বাঙ্গালার রাজা হইয়েছিলেন । তৎপরে তার ভ্রাতা কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন পর পর বাঙ্গালার রাজা হয়েছিলেন। তারা বহিরাগত তুর্কিযোদ্ধাদের পরাস্ত করে "গর্গযবনান্বয়প্রলয়কালরুদ্র" উপাধি নেন এবং পূর্ববঙ্গে স্বাধীন হিন্দু শাসন স্থাপন করেন। তিনি ১২২৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। বিশ্বরূপ সেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র সূর্য সেন রাজা হয়েছিলেন।
তবে লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলায় সেন শাসন দুর্বল হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্ত বিদ্রোহের ফলে সেন সামাজ্যের পতন ঘটে এবং চন্দ্রদ্বীপের দেব রাজবংশ ক্ষমতায় আসে ।
সেন রাজবংশ মধ্যযুগে কামরূপ রাজ্য ও শাসন করেছিল । সেন রাজবংশকে "ক্ষৌণীদ্র বংশ" ও বলা হত। সেন সাম্রাজ্যের পতন হলেও এই রাজবংশের রাজারা বিচ্ছিন্ন ভাবে ভারত,বাংলাদেশ, নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে শাসন চালিয়েছিলো। গৌড়, পুন্ড্র ও বরেন্দ্র পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সেন রাজবংশের অধীনে ছিল।তদ্বংশীয় গৌড়ের একটি ভূমের শাসক নীলধ্বজ সেন কামরুপ অধিকার করেন।[২৩]আরিমত্তর বংশধর শেষ রাজা মৃগাংক (১৪১৫-১৪৪০) অপুত্রক হওয়ার কারণে তার মৃত্যুর পর নীলধ্বজ সেন ১৪৪০ সালে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন। তিনি কামরূপ-কামতায় সেন রাজ্য পত্তন করেন।[২৪] নীলধ্বজের পর তার এক পুত্র চক্রধ্বজ এবং তার পরে চক্রধ্বজের পুত্র নীলাম্বর সেন রাজা হন। নীলধ্বজ সেন গৌড়, কুচবিহার, নিম্ন আসাম ও বৃহত্তর রংপুর প্রভৃতি নিয়ে কামতা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। নীল ধ্বজ এর পর যথাক্রমে চক্রধ্বজ সেন ও নীলাম্বর সেন কামতা রাজ্যের অধিশ্বর হন। রাজা নীলাম্বর তার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। পীরগঞ্জের চতরাহাটের পশ্চিম পার্শ্বে নীল দরিয়ার দুর্গ তাদের অন্যতম। কামতা রাজ্য করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পর্যন্ত ছিল তার রাজ্যের দক্ষিণ সীমা। রাজধানী কামতাপুর থেকে ঘোড়াঘাট পর্যন্ত যে মেঠো রাজপথটি দৃষ্ট হয়, তা রাজা নীলাম্বর কর্তৃক নির্মিত।সুপ্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র চতরা হাটের পশ্চিম পার্শ্বে এই রাজ পথটি অতিক্রম করে অর্দ্ধ কি.মি. পথ সামনে অগ্রসর হলেই রাজা নীলাম্বরের দুর্গ বা নীল দরিয়ার দূর্গের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টি গোচর হয়। এখানে ৯২.০০ একর সুবিশাল জলাধার বেষ্টন করে আছে ৪৮ একর স্থল ভাগকে। [২৫] গৃহ কোন্দলের সুযোগে মুসলমানরা আক্রমণ করায় এই রাজবংশ বেশিদিন শাসন করতে পরেনি। ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে নীলাম্বরের মৃত্যুতে তার রাজ্যের অন্ত হয়। সেন বংশীয় রাজা নীলাম্বর কামতেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি কামতেশ্বর নামে পরিচিত ছিলেন। [২৬]
↑মুটাটকার, সুমতি (১৯৯৪)। সুমতি সঙ্গীতাভরণম: জেমস অফ ইন্ডিয়ান মিউসিন অ্যান্ড মিসিওলজি। চেন্নাই: জগদীশ সহায়. ১৯৯৪, আইএসবিএন ৮১-৮৫২৬৮-৩১-২। পৃষ্ঠা ১০২। আইএসবিএন৮১-৭৮৭১-০৯৬-X|আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: invalid character (সাহায্য)।
Flood, Gavin D. (১৯৯৬), An Introduction to Hinduism (ইংরেজি ভাষায়), কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসউদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Michaels, Axel (২০০৪), Hinduism. Past and present (ইংরেজি ভাষায়), Princeton, New Jersey: Princeton University Pressউদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Samuel, Geoffrey (২০১০), The Origins of Yoga and Tantra. Indic Religions to the Thirteenth Century (ইংরেজি ভাষায়), কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসউদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)