খ্মের ভাষা (ភាសាខ្មែរ ফিয়াসা খ্মায়্) বা কম্বোডীয় ভাষা খমের জাতির লোকদের মুখের ভাষা এবং ক্যাম্বোডিয়ার সরকারি ভাষা। এটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের মন-খমের উপপরিবারের একটি ভাষা।
হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সুবাদে ভাষাটির উপর সংস্কৃত ও পালি ভাষার বড় প্রভাব পড়েছে। বিশেষত রাজকীয় ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এই প্রভাব বেশি দেখা যায়। এছাড়া ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় উপদ্বীপের অন্যান্য দেশে প্রচলিত থাই, লাও, ভিয়েতনামি ও চাম ভাষারও প্রভাব পড়েছে খমের ভাষার উপর। [৩] তবে ১৯৬০-এর দশকে উদ্ভূত খমের জাতীয়তাবাদের কারণে খমের ভাষা থেকে সংস্কৃত ও পালি শব্দগুলি দূরীকরণের একটি আন্দোলন হয়। খমের রুজ জান্তা সরকারও রাজনৈতিক অজুহাতে ভাষাটি থেকে কিছু বৈশিষ্ট্য দূর করার চেষ্টা নিয়েছিল।
বিস্তার
মাতৃভাষা বা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে খমের ভাষায় প্রায় ৬০ লক্ষ লোক কথা বলে, যারা ক্যাম্বোডিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৯০%। এছাড়া ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের অনেক লোক খমের ভাষাতে কথা বলে। এর বাইরে লাওস, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খমের ভাষাভাষী ক্ষুদ্র সম্প্রদায় আছে। খমের ক্যাম্বোডিয়ার সরকারি ভাষা। দেশটির গণমাধ্যম, সরকারী প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক উপলক্ষ নির্বিশেষে, খমের ভাষা ব্যবহার করা হয়।
ধ্বনিব্যবস্থা
আধুনিক আদর্শ খমের ভাষাটির ভিত্তি পনম পেন শহরের উপভাষা। খমের ভাষাটির স্বরধ্বনির সম্ভার ব্যাপক ও বিচিত্র। উপভাষাভেদে এতে ২৫ থেকে ২৭টি হ্রস্ব ও স্বরধ্বনি আছে। এছাড়াও আছে ১৭ থেকে ২১টি ব্যঞ্জনধ্বনি। প্রতিবেশী ভিয়েতনামি বা থাই ভাষা সুরপ্রধান হলেও খমের সুরপ্রধান ভাষা নয়। ঝোঁক বা শ্বাসাঘাত সাধারণত শব্দের শেষের সিলেবলে পড়ে।
যুক্তব্যঞ্জন কেবল খমের শব্দের শুরুতে বসতে পারে, শেষে নয়। আবার অনেক ব্যঞ্জনধ্বনি শব্দের শেষে একেবারেই বসে না।
ব্যাকরণ
অন্যান্য অস্ট্রো-এশীয় ভাষার মত খমের ভাষাও একটি বিশ্লেষণাত্মক ভাষা, অর্থাৎ এটিতে উপসর্গ, প্রত্যয় বা বিভক্তি ব্যবহার করে ব্যাকরণিক সম্পর্কগুলি প্রকাশ করা হয় না। সাধারণত বিভিন্ন অব্যয় এবং পদক্রম ব্যবহার করে ব্যাকরণিক সম্পর্কগুলি নির্দেশ করা হয়।
বিশেষ্য
খমের বিশেষ্যগুলিতে বচন, লিঙ্গ বা কারকনির্দেশকারী কোন প্রত্যয় বা বিভক্তি বা শব্দাংশ যুক্ত হয় না। বিশেষ্যের বচন সাধারণত প্রতিবেশ থেকে কিংবা “কিছু”, “সব”, “দুই”, ইত্যাদি শব্দের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি দেখে নির্ণয় করা হয়।
সর্বনাম
খমের ভাষাতে ব্যক্তিগত সর্বনামের একটি সুগঠিত ব্যবস্থা আছে, যাতে বক্তাদের আপেক্ষিক সামাজিক মর্যাদা, যেমন তাদের বয়স, মর্যাদা বা ঘনিষ্ঠতাকে গণনায় ধরা হয়। অর্থাৎ এই বৈশিষ্ট্যগুলিভেদে খমের ব্যক্তিগত সর্বনামের প্রকৃতি বদলে যায়।
ক্রিয়া
খমের ভাষার ক্রিয়ার সাথে সাধারণত পুরুষ, বচন, কাল, প্রকার বা ভাব প্রকাশকারী বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয় না। বিভিন্ন সহায়ক শব্দ ক্রিয়ার আগে বা পরে বসিয়ে এগুলি নির্দেশ করা হয়।
পদক্রম
খমের ভাষার বাক্যে স্বাভাবিক পদক্রম কর্তা-ক্রিয়া-কর্ম। বিশেষণস্থানীয় পদগুলি সাধারণত বিশেষ্যের পরে বসে।
শব্দভাণ্ডার
খমের ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে বহু শব্দ ধার নিয়েছে। ১৫শ শতকের শুরুতে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাবের পর খমের ভাষা পালি শব্দ ঋণ গ্রহণ শুরু করে। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ভাষাটি বহু ফরাসি শব্দ ধার নেয় এবং এগুলি কথ্য ভাষা ও কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক পরিভাষাতে আত্মীকৃত হয়ে যায়। কথ্য খমের ভাষাতে কিছু চীনা ও ভিয়েতনামি কৃতঋণ শব্দও রয়েছে।
লিখন পদ্ধতি
খমের লিপিটি সংস্কৃত ও অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষা লিখতে ব্যবহৃত ব্রাহ্মী লিপির উপর ভিত্তি করে উদ্ভাবিত। এটি একটি সিলেবলভিত্তিক লিপি যাতে প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে প্রতিবেশভেদে হয় “অ” অথবা “ও” ধ্বনিটি অন্তর্নিহিত আছে। স্বরধ্বনিগুলি আলাদা স্বরবর্ণ ব্যবহার করে কিংবা ব্যঞ্জনবর্ণের উপরে, নিচে, বামে বা ডানে কার-চিহ্ন আকারে বসিয়ে প্রকাশ করা হয়। যুক্তব্যঞ্জনবর্ণের বেলায় দ্বিতীয় বর্ণটি প্রথম বর্ণে নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হয়। খমের লেখাতে শব্দগুলির মধ্যে কোন ফাঁকা স্থান থাকে না। ফাঁকা স্থান দিয়ে বাক্যের শেষ বোঝানো হয়। খমের ভাষার বানান সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনও অনেক শব্দ একাধিক বানানে লেখা হয়।
তথ্যসূত্র