তেলেঙ্গানা (তেলুগু: తెలంగాణ, উর্দু: تلنگانہ; /ˌtɛlənˈɡɑːnə/(শুনুনⓘ); তেলুগু: [ˈtelaŋɡaːɳa], হিন্দুস্তানি: [ˈtɪləŋɡɑːna](শুনুনⓘ)) হল দক্ষিণ ভারতের একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল নিজাম-শাসিত হায়দ্রাবাদ দেশীয় রাজ্যের (মেদক ও ওয়ারঙ্গল বিভাগ) অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারত অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল হায়দ্রাবাদ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল পরে এটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।। ১৯৫৬ সালে হায়দ্রাবাদ রাজ্য অবলুপ্ত হয়ে অন্ধ্র রাজ্য এবং হায়দ্রাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানা অঞ্চল যুক্ত হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হয়। ২০১৪ সালের ২ জুন অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন আইন অনুসারে, অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলা নিয়ে তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠিত হয়।[১]হায়দ্রাবাদ শহর তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের যৌথ রাজধানীর মর্যাদা পাবে দশ বছরের জন্য।[২]
তেলেঙ্গানা রাজ্যের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে মহারাষ্ট্র, পশ্চিমে কর্ণাটক, উত্তর-পূর্বে ছত্তিশগড় এবং দক্ষিণ ও পূর্বে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য। তেলেঙ্গানার আয়তন ১,১৪,৮৪০ বর্গকিলোমিটার (৪৪,৩৪০ মা২) ও জনসংখ্যা ৩৫, ২৮৬, ৭৫৭ (২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে)।[৩]হায়দ্রাবাদ, ওয়ারাঙ্গল, নিজামাবাদ ও করিমনগর এই রাজ্যের চারটি বৃহত্তম শহর।
নাম ব্যুৎপত্তি
মনে করা হয়, "তেলেঙ্গানা" নামটি "তেলুগু" শব্দটি থেকে এসেছে। এই শব্দের দ্বারা তেলুগু ভাষাভাষী-অধ্যুষিত অঞ্চলটিকে বোঝায়। "ত্রিলিঙ্গ দেশ" কথাটি "তেলেঙ্গানা" শব্দের মূল উৎস। এই শব্দের অর্থ "তিন লিঙ্গের দেশ"। প্রচলিত হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে, শিবলিঙ্গের আকারে কালেশ্বরম, শ্রীশৈলম ও দ্রাক্ষারাম পর্বতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই তিন পর্বতমালা ত্রিলিঙ্গ দেশের তিন সীমানা নির্দেশ করত। এই "ত্রিলিঙ্গ দেশ" কথাটি থেকেই "থেলিঙ্গ", "তেলুঙ্গা", "তেলুগু" কথাটি এসেছে।[৪][৫]
পূর্বতন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের মারাঠি-অধ্যুষিত অঞ্চল মারাঠওয়াড়ার থেকে তেলুগু-অধ্যুষিত অঞ্চলটিকে আলাদা করে বোঝাতে "তেলেঙ্গানা" কথাটি ব্যবহৃত হত।.[৬]
"তেলেঙ্গানা" শব্দটির সবচেয়ে পুরনো উল্লেখগুলির মধ্যে একটি হল মালিক মকবুলের নাম। তাকে "তিলঙ্গানি" বলা হত। এটির অর্থ ছিল, তিনি তিলঙ্গানা অঙ্গলের মানুষ ছিলেন। মালিক মকবুল হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার নাম ছিল যুগন্ধর। তিনি দাদি নগদেবের পুত্র এবং ওয়ারঙ্গল দুর্গের (তেলুগু নাম "কটক পালুডু") সেনানায়ক ছিলেন।[৭]
ইতিহাস
প্রাচীন যুগ
প্রাচীনকালে করিমনগরের কোটিলিঙ্গল ছিল ষোড়শ মহাজনপদের অন্তর্গত অস্মক জনপদের রাজধানী। এই অঞ্চলে প্রাক-সাতবাহন রাজাদের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা চিমুখ ও পরবর্তী রাজাদের তাম্রমুদ্রাও এখানে পাওয়া গিয়েছে।[৮]
১০৮৩ থেকে ১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তেলেঙ্গানা অঞ্চল শাসন করে কাকতীয় রাজবংশ। এই যুগটি তেলেঙ্গানার ইতিহাসে সুবর্ণযুগ নামে পরিচিত।[১০] ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বশ্রেষ্ঠ কাকতীয় রাজা গণপতিদেব ক্ষমতায় আসেন। সাতবাহন রাজাদের পর তিনিই প্রথম সমগ্র তেলুগুভাষী অঞ্চলকে একক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি তেলুগু চোল রাজ্যের শাসনের অবসান ঘটান। ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে তেলুগু চোলেরা তার সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েছিল। পূর্বে গোদাবরী বদ্বীপ থেকে পশ্চিমে রায়চুর (অধুনা কর্ণাটক রাজ্যে) এবং উত্তরে করিমনগর ও বস্তার (অধুনা ছত্তীসগঢ় রাজ্যে) থেকে দক্ষিণে শ্রীশৈলম ও ত্রিপুরান্তকম (ওঙ্গলের কাছে) পর্যন্ত অঞ্চল তিনি নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তার রাজত্বেই গোলকোন্ডা দুর্গ নির্মিত হয়েছিল।[১১] কাকতীয় রাজবংশের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শাসকেরা হলেন রুদ্রামা দেবী ও প্রতাপরুদ্র। ১৩০৯ খ্রিষ্টাব্দে মালিক কাফুরের আক্রমণের পর এই রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। মহম্মদ বিন তুঘলক ১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপরুদ্রকে পরাজিত করলে এই রাজবংশের পতন ঘটে।[১২][১৩]
কুতুবশাহি ও নিজাম
চতুর্দশ শতাব্দীতে তেলেঙ্গানা অঞ্চলটি দিল্লি সুলতানির অধীনে আসে। এরপর তেলেঙ্গানা অঞ্চল বাহমনি সুলতানির অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৫১৮ খ্রিষ্টাব্দে গোলকুন্ডার শাসনকর্তা কুলি কুতুব মুল্ক বাহমনি সুলতানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে কুতুবশাহি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ এক বছর গোলকুন্ডা দুর্গ অবরোধের পর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব গোলকুন্ডা সুলতানি দখল করেন।[১৪]
১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে কামারুদ্দিন খানকে "নিজাম-উল-মুল্ক" (অর্থাৎ, "রাজ্যের শাসনকর্তা") উপাধি দিয়ে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ১৭২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মুবারিজ খানকে পরাজিত করে "দাক্ষিণাত্য সুবা"র স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আসিফ জাহ নাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সময় থেকেই আসিফ জাহি রাজবংশের সূচনা।[১০] তিনি অঞ্চলটির নাম দেন হায়দ্রাবাদ দাক্ষিণাত্য। তাঁর পরবর্তী শাসকেরাও "নিজাম-উল-মুল্ক" উপাধিটি ব্যবহার করতেন। এই জন্য তাদের আসিফ জাহি নিজাম বা হায়দ্রাবাদের নিজাম বলা হত। মেদক ও ওয়ারঙ্গল শাসন করতেন নিজামরা।[১৫]
১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আসিফ জাহের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের অধিকার নিয়ে বিরোধ বাঁধে। সুযোগসন্ধানী প্রতিবেশী রাজ্য ও সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি শক্তিগুলিও এই বিরোধে সমর্থন জানায়। ১৭৬৯ সালে হায়দ্রাবাদ শহরটি নিজামদের আনুষ্ঠানিক রাজধানীতে পরিণত হয়। ব্রিটিশ আমলে হায়দ্রাবাদ রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের করদ রাজ্যে পরিণত হয়।[১৫]
স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগ
১৯৪৭ সালে ভারত যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন হায়দ্রাবাদের নিজামভারত অধিরাজ্যে যোগ না দিয়ে দেশীয় রাজ্যের বিশেষ স্বীকৃতি ভোগ করতে চান। ১৯৪৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অপারেশন পোলোর মাধ্যমে ভারত সরকার হায়দ্রাবাদ রাজ্য অধিগ্রহণ করে।[১০] ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি, ভারত সরকার এম. কে. ভেল্লোডি নামে এক সরকারি আধিকারিককে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করে।[১৬] তিনি মাদ্রাজ রাজ্য ও বোম্বাই রাজ্যের ইংরেজি-শিক্ষিত প্রশাসকদের সাহায্যে রাজ্য পরিচালনা করতেন। কারণ, নিজাম-শাসিত হায়দ্রাবাদ রাজ্যের সরকারি ভাষা উর্দু ছিল বলে সেখানকার প্রশাসকেরা ভারতীয় প্রশাসন সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন না।
১৯৫২ সালে, ভারতের প্রথম নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হলে বুরগুলা রামকৃষ্ণ রাও এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই সময় তেলেঙ্গানাপন্থীরা মাদ্রাজ রাজ্যের প্রশাসকদের বদলে স্থানীয় প্রশাসক নিয়োগের দাবিতে হিংসাত্মক আন্দোলন করেছিলেন।[১৭]
তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ ছিল কমিউনিস্ট-সমর্থিত একটি কৃষক বিদ্রোহ। ১৯৪৬ ও ১৯৫১ সালে হায়দ্রাবাদ রাজ্যে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)।[২০]
নালগোন্ডা জেলায় জমিদার রেড্ডি ও ভেলম জাতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হয়। খুব শীঘ্রই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ওয়ারাঙ্গল ও বিদার জেলায়। কৃষক ও খেতমুজররা জায়গিরদার ও দেশমুখ উপাধিধারী সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে এবং পরে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজাম ওসমান আলি খানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ হিংসাত্মক আকার ধারণ করলে কেন্দ্রীয় সরকার সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। এরপরই বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে।[২১] ১৯৫১ সালের বিদ্রোহে সিপিআই মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিজমকে ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা।[২২]
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন
১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের উদ্দেশ্যে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয়।[২৩] ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তেলেঙ্গানার নেতৃবৃন্দ ও অন্ধ্রের নেতৃবৃন্দের মধ্যে তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রের সংযুক্তি বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত ছিল, তেলেঙ্গানার স্বার্থ বজায় রাখা হবে।[২৪] ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র রাজ্য যুক্ত হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হয়।[১৮][২৫][২৬]
তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রের সংযুক্তি রদ করার দাবিতে একাধিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে প্রধান আন্দোলনগুলি হয় ১৯৬৯, ১৯৭২ ও ২০০৯ সালে। এই সব আন্দোলনের ফলে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের দাবি জোরালো হয়।[২৭] ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারত সরকার ঘোষণা করে, পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। এই ঘোষণার পরই উপকূলীয় অন্ধ্র ও রায়ালসীমা অঞ্চলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়। সেই জন্য ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর সরকার তাদের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে। যদিও হায়দ্রাবাদ সহ তেলেঙ্গানা অঞ্চলের অন্যান্য জেলায় পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে।[২৮]
২০১৩ সালের ৩০ জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের জন্য একটি দাবিসনদ পাস করে।[২৯] ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিলটি ভারতের সংসদে উত্থাপিত হয়। এই মাসেই সংসদের উভয় কক্ষে অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন আইন পাস হয়। এই আইন অনুসারে, উত্তর-পশ্চিম অন্ধ্রপ্রদেশের ১০টি জেলা নিয়ে তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।[৩০] ২০১৪ সালের ১ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সাক্ষর করে এবং সেটি গেজেটে প্রকাশ করেন।[৩১]
২০১৪ সালের ২ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠিত হয়। কে. চন্দ্রশেখর রাও তেলেঙ্গানার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। জয় জয় হে তেলেঙ্গানা গানটিকে রাষ্ট্রীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।[৩২] পরবর্তী ১০ বছরের জন্য হায়দ্রাবাদ শহরটিকে তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের যৌথ রাজধানী ঘোষণা করা হয়।[৩৩]
ভূগোল
তেলেঙ্গানা রাজ্যটি ভারতীয় উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল ঘেঁষে দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলের মধ্য অংশে অবস্থিত। এই রাজ্যের আয়তন ১,১৪,৮০০ বর্গকিলোমিটার (৪৪,৩০০ মা২)। এই রাজ্যের প্রধান নদী দুটি - গোদাবরী নদী ও কৃষ্ণা নদী। গোদাবরী অববাহিকার ৭৯% এলাকা এবং কৃষ্ণা অববাহিকার ৬৯% এলাকা এই রাজ্যের অন্তর্গত। তবে রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলই অনুর্বর।[৩৪] ভীমা, মঞ্জীরা ও মুসি নদী এই রাজ্যের অন্যান্য নদী।
আবহাওয়া
তেলেঙ্গানার আবহাওয়া প্রধানত উষ্ণ ও শুষ্ক প্রকৃতির। মার্চ মাসে গ্রীষ্মের সূত্রপাত হয়। মে মাসের সর্বাধিক তাপমাত্রা হয় ৪২ °সে (১০৮ °ফা)। জুন থেকে সেপ্টেম্বর বর্ষাকাল। এই সময় গড় বৃষ্টিপাত হয় ৭৫৫ মিলিমিটার (২৯.৭ ইঞ্চি)। শীতকাল শুষ্ক। নভেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির গোড়া পর্যন্ত শীতকাল থাকে। শীতকালের গড় তাপমাত্রা হয় ২২–২৩ °সে (৭২–৭৩ °ফা)।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো তেলেঙ্গানা রাজ্যেও প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক পরিষদীয় ব্যবস্থা প্রচলিত। রাজ্যের অধিবাসীরা সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। সরকারের তিনটি শাখা রয়েছে।
সরকার পরিচালনার কার্যনির্বাহী ক্ষমতা মুখ্যমন্ত্রীর অধীনস্থ মন্ত্রিপরিষদের হাতে ন্যস্ত। যদিও রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রধান। রাজ্যপালকে নিয়োগ করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি।বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতাকে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমেই তিনি মন্ত্রিপরিষদকে নিয়োগ করেন। মন্ত্রিপরিষদ তাদের কাজকর্মের জন্য বিধানসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকেন।
তেলেঙ্গানার আইনবিভাগ তেলেঙ্গানা বিধানসভা ও তেলেঙ্গানা বিধান পরিষদ নিয়ে গঠিত। এই দুই বিভাগের সদস্যরা অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে নির্বাচিত করেন। তারা সভার পৌরোহিত্য করেন। আইনবিভাগ দ্বিকক্ষীয়। বিধানসভায় ১১৯ জন এবং বিধান পরিষদে ৪০ জন সদস্য আছে। বিধানসভার স্বাভাবিক মেয়াদ ৫ বছর। বিধান পরিষদ একটি স্থায়ী সংস্থা। এই সংস্থার এক-তৃতীয়াংশ সদস্য প্রতি দুই বছর অন্তর অবসর নেন।
বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা হায়দ্রাবাদ হাইকোর্টের হাতে ন্যস্ত।
অনগ্রসর অঞ্চল অনুদান তহবিল ২০০৯-১০ অনুসারে, পূর্বতন অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে ১৩টি অনগ্রসর জেলা ছিল। তার মধ্যে বর্তমান তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদ জেলা ছাড়া বাকি নয়টি জেলাই অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৪০]
তেলেঙ্গানার অধিবাসীদের ৮৬ % হিন্দু, ১২.৪% মুসলমান, ১.২ % খ্রিস্টান ও ০.৪% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।[৪১]
তেলেঙ্গানার অধিবাসীদের ৭৬ % তেলুগু ভাষায় কথা বলেন। ১২ % উর্দুতে এবং ১২ % অন্যান্য ভাষায় কথা বলেন।[৪২][৪৩] ১৯৪৮ সালের আগে উর্দু ছিল হায়দ্রাবাদ রাজ্যের সরকারি ভাষা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সেই সময় তেলুগু ভাষায় শিক্ষার সুবন্দোবস্ত না থাকায়, তেলেঙ্গানা অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত মহলের ভাষা হিসেবে উর্দুই প্রচলিত ছিল। ১৯৪৮ সালের পর হায়দ্রাবাদ ভারতে যোগ দিলে, তেলুগু সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়। তারপর বিদ্যালয় ও কলেজগুলিতে তেলুগু মাধ্যমে শিক্ষা প্রচলিত হলে, অমুসলমানদের মধ্যে উর্দু শিক্ষার প্রবণতা কমে যায়।[৪৪]
সাক্ষরতা
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, তেলেঙ্গানার সাক্ষরতার হার ৬৭.২২ %।[৪৫] পুরুষ ও মহিলা সাক্ষরতার হার যথাক্রমে ৭৫.৬% ও ৫৮.৭৭%। সাক্ষরতার হার সর্বাধিক হায়দ্রাবাদ জেলায় (৮০.৯৬%) এবং সর্বনিম্ন মেহবুবনগর জেলায় (৫৬.০৬%)।[৪৬] ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে, পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রকের দ্বারা ভারতে শিক্ষার উপর পারিবারিক সামাজিক খরচের মূল সূচক , তেলঙ্গানার সাক্ষরতার হার ৭২.৮% যা বড় রাজ্যগুলির মধ্যে চতুর্থ সর্বনিম্ন।
সামাজিক ন্যায়
গার্হস্থা হিংসার ক্ষেত্রে এই রাজ্যের পরিসংখ্যান ভালো নয়। অধিকাংশ বিবাহিত মহিলারা নানাবিধ কারণে গার্হস্থা হিংসার শিকার হন , যা গোটা দেশে সর্বোচ্চ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় - ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ ভারতের তৃতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় । বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাগুলির মধ্যে একটি যার ক্যাম্পাস এবং অধিভুক্ত কলেজগুলিতে ৩ লক্ষের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে৷
তেলেঙ্গানার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটটি বিশ্বজনীন। কারণ, এই অঞ্চলে ভারত ও বহির্ভারতের নানা অঞ্চলের মানুষ বসবাস করেন। দক্ষিণ ভারতীয় প্রথা ও রীতিনীতিগুলি এখানে প্রধান। তবে মুঘল ও নিজাম শাসনে কিছু কিছু পারস্য প্রথাও এখানে চালু হয়েছিল।
শিল্প ও সাহিত্য
তেলেঙ্গানার অধিবাসী কবি পোতানা শ্রীমদ্ অন্ধ্র মহা ভাগবতমু (ভাগবত পুরাণ-এর তেলুগু অনুবাদ) রচনা করেছিলেন।[৪৭] মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ ছিলেন প্রথম সাহেব-এ-দেওয়ান উর্দু কবি।[৪৮] তেলেঙ্গানার প্রথম যুগের অন্যান্য কবিরা হলেন কাঞ্চেরলা গোপান্না বা ভক্ত রামদাসু, গোনা বুদ্দা রেড্ডি, পালকুরিকি সোমনাথ, মল্লিনাথ সূরি ও হুলুক্কি ভাস্কর। আধুনিক কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্মবিভূষণ সম্মান-প্রাপ্ত কালোজি নারায়ণ রাও, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার-প্রাপক দাশরথি কৃষ্ণমারার্যুলু, বাচস্পতি পুরস্কার-প্রাপক শ্রীভাষ্যম বিজয়সারথি ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কার-প্রাপক সি. নারায়ণ রেড্ডি। ভারতের নবম প্রধানমন্ত্রী পি. ভি. নরসিমা রাও ছিলেন একজন বিশিষ্ট কবি।[৪৯]
তেলেঙ্গানার ভূগর্ভে প্রচুর পরিমাণে কয়লা সঞ্চিত আছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বৃহৎ শিল্পের প্রয়োজনে এই কয়লা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছে সিঙ্গারেনি কোলিয়ারিজ কোম্পানি।[৫৩] এই রাজ্যের খনিজ চুনাপাথর সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহৃত হয়। তেলেঙ্গানায় বক্সাইট ও মাইকাও পাওয়া যায়। কোঠাগুদেম, জাম্মাইকুন্টা ও পালওয়াঞ্চা হল রাজ্যের প্রধান শিল্প শহরগুলির অন্যতম।
পরিবহণ
সড়কপথ
তেলেঙ্গানা রাজ্য সড়ক পরিবহন সংস্থা হল রাজ্যের প্রধান সরকারি পরিবহন সংস্থা।[৫৪] হায়দ্রাবাদের মহাত্মা গান্ধী বাস স্টেশন হল এশিয়ার বৃহত্তম বাসস্টত্যান্ডগুলির একটি।[৫৫] সেকেন্দ্রাবাদের জুবিলি বাস স্টেশন আন্তঃমহানগরীয় বাস পরিষেবার কাজে ব্যবহৃত হয়। হায়দ্রাবাদের মিয়াপুরে তৈরি হচ্ছে এশিয়ার বৃহত্তম ইন্টারসিটি বাস টার্মিনাস।[৫৬]
রেলপথ
তেলেঙ্গানা অঞ্চলে রেলপথ স্থাপিত হয়েছিল ১৮৭৪ সালে।[৫৭] ১৯৬৬ সাল থেকে এটি ভারতীয় রেলেরদক্ষিণ মধ্য রেল অঞ্চলের অন্তর্গত। সেকেন্দ্রাবাদের রেল নিলয়ম এই অঞ্চলের প্রধান কার্যালয়। দক্ষিণ মধ্য রেলের প্রধান বিভাগদুটি হল হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদ।[৫৮]
বিমানবন্দর
রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হল হায়দ্রাবাদ শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটি ২০০৯ ও ২০১০ সালে ৫-১৫ মিলিয়ন যাত্রী বিভাগে বিশ্বের এক নম্বর বিমানবন্দর পুরস্কার পেয়েছে।[৫৯] এটিই রাজ্যের বৃহত্তম বিমানবন্দর ও সারা দেশের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর। বর্তমানে সরকার ওয়ারাঙ্গল, নিজামাবাদ, করিমনগর, রামাগুন্ডাম ও কোঠাগুদেম শহরেও বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।[৬০]
↑"Notification"(পিডিএফ)। The Gazette of India। Government of India। ৪ মার্চ ২০১৪। ২৭ মার্চ ২০১৪ তারিখে মূল(PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ মার্চ ২০১৪।