সরাইল উপজেলা আয়তন ২১৫.২৮ বর্গ কিলোমিটার (৫৩,১৯৬ একর)। উপজেলার ভৌগোলিক অবস্থান সরাইল উপজেলা ২৪°০০´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হতে ১২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এ উপজেলার উত্তরে নাসিরনগর উপজেলা, দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা, পূর্বে বিজয়নগর উপজেলা ও আশুগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে মেঘনা নদী, কিশোরগঞ্জ জেলারভৈরব উপজেলা ও বাজিতপুর উপজেলা। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা,তিতাস ও লাহুর নদী। সরাইল উপজেলা সদরের আয়তন ১৪.০৩ বর্গ কিলোমিটার। এটি ঢাকা-সিলেট ও কুমিল্লা সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত।[২]
নামকরণ ও ইতিহাস
সর অর্থ সরোবর বা হ্রদ। এটাকে ব্যাখ্যা করলে বুঝায় বিশাল জলাশয় আর আইল শব্দের অর্থ বাঁধ বা উঁচুভূমি। অর্থাৎ প্রাচীনকালে এ এলাকা ছিল বিশাল জলরাশিতে ভরা এক জলমগ্ন স্থান। কালের বিবর্তনে এখানে ধীরে ধীরে বেশ কিছু চর পড়তে থাকে যা দুর থেকে জমির আইল বা বাঁধের মত দেখাতো। এতে করে বিশাল জলাশয়ের সরঃ জেগে উঠা আইলে বা ভূখন্ডে জনপদ গড়ে উঠতে থাকে আর তাই অর্থাৎ বিশাল জলরাশিতে জেগে উঠা ভূখন্ডে সরঃ + আইল = সরাইল নামে পরিচিতি পায়। ওই বিশাল জলরাশিকে কালীধর সায়র বা কালীদহ সাগর বলে গবেষকরা চিহ্ণিত করেছেন,যা প্রাচীনকাল থেকে এ এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে কবি গান ও পুঁথি পাঠ আসরের গাওয়া বন্দনা- গীতির শুরুতেই উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্য একটি মতে, সরাইখানা শব্দের অর্থ ক্ষণস্থায়ী বসবাস। ফার্সী ঈল শব্দের অর্থ বিদ্রোহী বন্ধু। সরাইখানার সরাই ও ঈল শব্দ মিলে (সরাই+ঈল) সরাইল শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ বিদ্রোহী বন্ধুর বাসস্থান। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ, বাহরাম খানের শিলহদর (বর্মরক্ষক) অর্থাৎ দেহরক্ষী হিসেবে বিদ্রোহী হয়ে তিনি যে স্থানের সামরিক প্রস্ততির জন্য ক্ষণস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সেই স্থানটি দিল্লীর সুলতান ও সভাসদগণ এবং স্থপতিগণ কর্তৃক সরাই + ঈল = সরাইল নামে আখ্যায়িত হয়েছিল। দিল্লী থেকে প্রচারিত হতে হতে এটাই কালের আবর্তে পরবর্তী শাসন আমলে সরাইল নামে পরিচিত ও গৃহীত হয়েছিল। মোগল আমলে (১৩৩৮-১৫২৬) প্রায় দুইশত বৎসর এ নামটি সরাইল পরগণা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। বারো ভুঁইয়া দের অন্যতম ঈসা খাঁর জন্ম ১৫২৯ সালে সরাইল পরগণায়। ইসা খাঁর দাদা রাজপুত বংশীয় 'ভাগিরথ' অযোধ্যা হতে বাংলায় এসে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৫৩৩-৩৮) অধীনে দেওয়ান এর চাকরি লাভ করেন। তার পুত্র কালিদাস গজদানী পিতার মৃত্যুর পর দেওয়ানি লাভ করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান খাঁ নাম গ্রহণ করেন। সোলায়মান খাঁ সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের কন্যা সায়েদা মোমেনা খাতুনকে বিয়ে করে সরাইল পরগণা ও পূর্ব মোমেনশাহীর জমিদারি লাভ করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর সোলায়মান খাঁ নিজেকে সুলতানের উত্তরাধিকারি হিসেবে ঘোষণা দেন এবং সম্রাট শের শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি স্বাধীনভাবে তার জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন এবং তার জমিদারির প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সরাইল। ১৫৪৫ সালে শের শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসন লাভ করেন এবং সোলায়মান খাঁকে তার আনুগত্য মেনে নিতে বলেন। সোলায়মান খাঁ তা প্রত্যাখ্যান করলে ইসলাম শাহ তার দুই সেনাপতি তাজ খান কররানী ও দারিয়া খান কে যুদ্ধের জন্য পাঠান। যুদ্ধে সোলায়মান খাঁর পরাজয় হয় ও তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার দুই পুত্র ঈসা ও ইসমাইল কে বন্দি করে দাস হিসেবে ইরানি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। তারপর তাজ খান কররানী অধিকৃত এলাকার দখল লাভ করেন ও ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খানকে তার আদালতে নিয়োগ দেন। তিনি ঈসা ও ইসমাইল কে ইরানি বণিকদের কাছ থেকে মুক্ত করেন। তারপর ঈসা খাঁ তার চাচা কুতুব খানের সাহায্যে সরাইলের জমিদারী দখল করেন। ১৫৬৫ সালে তাজ খান কররানীর মৃত্যুর পর আফগান শাসকদের সাথে মিলে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৫৮০ সালের দিকে তিনি তার প্রশাসনিক কেন্দ্র সরাইল থেকে স্থানান্তর করে সোনারগাঁতে নেন।[৩]
প্রাচীনকালে এটি ভাটি (জলাবদ্ধ নিম্ন ভাগ) অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৮৩০ সালের পূর্বে সরাইল পরগণা ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৩০ সালে সরাইল পরগণা ময়মনসিংহ হতে বিচ্ছিন্ন করে ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৪] ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্তে পরগণার পরিবর্তে জেলা ও মহকুমা ব্যবস্থার প্রচলন করে। যার কারণে সরাইল পরগনা ভেঙ্গে দেয়া হয়। ১৮৬০ ত্রিপুরা জেলা ভেঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সৃষ্টি করার পর সরাইল পরগণাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সাথে যুক্ত করা হয়।[৫]
প্রতিষ্ঠাকাল
১৯৯০ সালে সরাইল উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশাসনিক এলাকা
সরাইল উপজেলায় বর্তমানে ৯টি ইউনিয়ন রয়েছে। সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম সরাইল থানার আওতাধীন।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সরাইল উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৩,১৫,২০৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১,৫২,৩৮৯ জন এবং মহিলা ১,৬২,৮১৯ জন। মোট পরিবার ৫৮,৬২২টি।[৬] জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,৪৬৪ জন।[৭]
শিক্ষা ব্যবস্থা
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সরাইল উপজেলার সাক্ষরতার হার ৪০.৯%।[৬]
অত্র এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, যা ১৮৭১ সালে সরাইল এস্টেটের জমিদার রাজা রায় বাহাদুর অন্নদা প্রসাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ১৯৪৪ সালে প্রফুল্ল চক্রবর্তী কর্তৃক স্থাপিত কালীকচ্ছ পাঠশালা (উচ্চ বিদ্যালয়), ১৯৭০ সালে স্থাপিত সরাইল কলেজ ও ১৯৫৩ সালে স্থাপিত সরাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।[৮] এখানে রয়েছে -
সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় - ৮১টি
বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় - ৪৩টি
মহাবিদ্যালয় - ২ টি (সরাইল সরকারি কলেজ ও আব্দুস সাত্তার ডিগ্রি কলেজ)
কিন্ডারগার্টেন - ০৮টি
এবতেদায়ী মাদ্রাসা - ০৪টি
দাখিল মাদ্রাসা - ০২টি
উচ্চ বিদ্যালয় - ১৫টি
স্বাস্থ্য
স্বাস্থ্য সেবাদানের জন্য রয়েছেঃ
উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র - ১টি
পশু চিকিৎসা কেন্দ্র - ১টি
দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র - টি
কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র - ১টি
কৃষি
এখানকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষক।
প্রধান ফসলঃ ধান, গম, পাট, সরিষা, আলু ও নানা রকম শাক-সবজি।
লুপ্ত বা লুপ্ত প্রায় শস্যাদিঃ কাউন, আউশ ও আমন ধান, পাট ও আড়হর ডাল।
প্রধান ফলঃ কলা, কাঁঠাল, আম, জাম।
অর্থনীতি
এ উপজেলার প্রায় ৬৮% লোক কৃষিজীবী, ৭% লোক মৎস্যজীবি এবং বাকি ২৫% বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে আছেন। এ অঞ্চলে প্রবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
কুটির শিল্প - মৃৎ শিল্প, সূচী-শিল্প।
রপ্তানি পণ্য - শাক-সবজি
এখানকার কলকারখানার মধ্যে রয়েছে - ময়দাকল, বরফকল, ইটভাটা, ওয়েল্ডিং কারখানা প্রভৃতি।
প্রাকৃতিক সম্পদ
সরাইলের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস। ২০১৬ সালের ১৮ই জুলাই বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) এর অধীনে সরাইলের কুট্টাপাড়া এলাকায় তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রের ২৪ নং কূপের খনন কাজের উদ্বোধন করা হয়। আগামী বছরে এ কূপের খনন কাজ শেষ হলে দৈনিক ২০-২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হবে।[৯]
যোগাযোগ ব্যবস্থা
সড়ক পথ : পাকা ও আধাপাকা - ১১৫.৫ কিলোমিটার। দুটি গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়ে রোড সরাইলকে অন্যান্য জেলার সাথে যুক্ত করেছে, এর একটি হল ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, যা এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এর অংশ এবং অন্যটি হল কুমিল্লা সিলেট মহাসড়ক। এ দুটি মহাসড়ক সরাইলের বিশ্বরোডে এসে মিলিত হয়েছে।[১০][১১]
নৌপথ - নৌপথে যোগাযোগের জন্য এখানে রয়েছে মেঘনা ও তিতাস নদী এবং আকাশি বিল ও শাপলা বিল। নৌপথের দৈর্ঘ্য - ১৪ নটিক্যাল মাইল
দ্বিজ কালিদাস - লেখক,কলকাতার বেথুন স্কুলের প্রধান শিক্ষক,কৃষিবিদ,ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি উল্লাসকর দত্তের পিতা ও সাধক আনন্দ স্বামীর জামাতা।[১৩]
দেওয়ান মাহবুব আলী (কুতুব মিয়া) - মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক [১৪][১৫]
সৈয়দ আকবর হোসেন (বকুল মিয়া) (১৯৩৫-১৯৭১) - শহীদ বুদ্ধিজীবী [১৬]
শেখ আবু হামেদ (১৯২৮-২০১৪) - ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ইতিহাসবিদ। ১৯২৮ সালের ১৮ই মে সরাইলের নোয়াগাও ইউনিয়নের আঁখিতারা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।[১৭] ১৯৫৩ সালে সরাইল কালচারাল এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন সরাইল কলেজ, সরাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সরাইল থানা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা।[৮]
ডক্টর অবিনাশ চন্দ্র সেন - অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রাপ্ত,দানবীর
আহমেদুর রহমান (১৯৩৩-১৯৬৫)- সরাইলের উচালিয়াপাড়াতে জন্ম। ইত্তেফাকের খ্যাতিমান সাংবাদিক, সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলনের বড় ভাই, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যেদের একজন। ১৯৬৫ সালের ২০ মে কায়রোতে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত।[২০]
আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী মাওলানা কাজী মাসুদুর রহমান[২১] - সাবেক রাষ্ট্রপতির ইমাম:- বঙ্গভবন জামে মসজিদ[২২], সম্মানিত প্রধান মুয়াযযিন:- জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম[২৩][২৪], মূল ক্বারী, প্রধান মুকাব্বির ও উপস্থাপক:-জাতীয় ঈদগাহ[২৫], গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের) ধর্ম গ্রন্ত পাঠক। ইসলামিক আলোচক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান গ্রন্তনা ও উপস্থাপক:-বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশন[২১][২৩]।
আনন্দ চন্দ্র নন্দী - সঙ্গীতজ্ঞ ও সাধক । সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নে জন্ম। আনন্দস্বামী নামে সুপরিচিত।
১৯৭১ সালের ৫ মে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে শাহবাজপুর পাকসেনা ক্যাম্পে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। সরাইলের কালীকচ্ছ বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরণে দুটি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পাকবাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও সরাইলের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিহত হন।
১৯৭১ সালে সরাইল উপজেলার বিটঘরে ৭০ জন লোক পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে এখানে ৩ টি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে - বিটঘর স্মৃতিস্তম্ভ, সরাইল ডিগ্রি কলেজ মাঠের স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শেখ মেজবাহউদ্দিন স্মৃতিস্তম্ভ। তাছাড়া স্মৃতিসৌধ রয়েছে ৪ টি - অাঁখিতারা স্মৃতিসৌধ, নোয়াগাঁও স্মৃতিসৌধ, কালীকচ্ছ-বারিউড়া সড়ক স্মৃতিসৌধ, শাহবাজপুর ইউপি অফিস স্মৃতিসৌধ।[৩৪]
দর্শনীয় এবং উল্লেখযোগ্য স্থান ও স্থাপনা
আড়িফাইল মসজিদ - সরাইল উপজেলা সদরের প্রায় ১ কি.মি. পশ্চিমে দক্ষিণ আরিফাইল গ্রামে অবস্থিত। এটি ১৬৬২ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল আমলে নির্মিত হয়। দরবেশ শাহ আরিফ কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। মসজিদটি আয়তাকার এবং এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ২৪.৩৮ মি x ৯.৩০ মি। মসজিদটি ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীন এই মসজিদটি প্রত্ন সম্পদ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এটির স্থাপত্যশৈলী অনন্য। মসজিদের পাশেই রয়েছে জোড়া কবর। এর পাশে সাগরদিঘী নামে একটি বিশাল পুকুর রয়েছে।
হাতিরপুল - সরাইল উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন বারিউড়া নামক স্থানে অবস্থিত। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত। দেওয়ান শাহবাজ আলী সরাইলের দেওয়ান থাকা অবস্থায় ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়। দেওয়ানরা হাতির পিঠে করে চলাচল করতো এবং পুলটির গোড়ায় হাতি নিয়ে বিশ্রাম নেয়া হতো বলে এটিকে হাতির পুল নামে অভিহিত করা হয়।
হাটখোলা মসজিদ (আরফান নেছার মসজিদ) - সরাইল উপজেলা চত্বরের নিকটে অবস্থিত। সরাইলের দেওয়ান নূর মোহাম্মদের স্ত্রী আরফান নেছা কর্তৃক ১৬৬২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত। ভিন্নমত রয়েছে যে মজলিশ শাহরাজের পুত্র নূর মোহাম্মদ কর্তৃক ১০৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয় বলে জানা যায়।
অরুয়াইল নদীঘাট - সরাইলের অরুয়াইল ইউনিয়নে অবস্থিত। নৌকা তৈরির জন্য বিখ্যাত।
ধরন্তী - সরাইলের কালীকচ্ছ ইউনিয়ন অবস্থিত। সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই সড়ক যাওয়ার পথে অবস্থিত। ঈদের সময় ব্যাপক লোকসমাগম হয়। বর্ষাকালে সড়কের দুই পাশের বিল পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে এবং আশেপাশের এলাকার পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। পর্যটকদের কাছে 'মিনি কক্সবাজার' নামে পরিচিত। বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত ছয়মাস পানিতে পরিপূর্ণ থাকে এই হাওর। বাকি সময় ধান চাষ করা হয়।[৩৫][৩৬]
আয়েত উল্লাহ শাহ এর মাজার - এটি সরাইলের পানিশ্বর ইউনিয়নের বিটঘর গ্রামে অবস্থিত।
শ্রী শ্রী কালাচাঁদ বাবাজীর মন্দির - সরাইলের পানিশ্বর ইউনিয়নের বিটঘর গ্রামে অবস্থিত।
মুক্তিযোদ্ধে নিহত ৭১ জন শহীদের নামে নির্মিত স্মৃতিসৌধ - সরাইলের পানিশ্বর ইউনিয়নের বিটঘর গ্রামে অবস্থিত।
কালিকচ্ছ দয়াময় আনন্দধাম - সরাইলের কালীকচ্ছ ইউনিয়নে অবস্থিত।
দেওয়ান শাহবাজ এর ঐতিহাসিক কুপ - সরাইলের শাহবাজপুর ইউনিয়নে অবস্থিত।
সেন বাড়ি - সরাইলের চূন্টা ইউনিয়নে অবস্থিত।
প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির - সরাইলের চুন্টা ইউনিয়নে অবস্থিত।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর - ১৯৭৮ সালের ৩০ এপ্রিল কালীকচ্ছ ইউনিয়নে তৎকালীন বিডিআর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি এখানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর উদ্ভোধন করা হয়।[৩৭][৩৮][৩৯]
গ্রে-হাউন্ড কুকুর - সরাইলের গ্রে-হাউন্ড কুকুর এক ধরনের শিকারি জাতের কুকুর। স্থানীয়ভাবে হাউন্ড কুকুর নামেও পরিচিত,তাছাড়া দেশব্যাপী 'সরাইলের কুকুর' নামেও সুপরিচিত। শিকারি বৈশিষ্ট্যের জন্য এই কুকুর দেশে-বিদেশে বিখ্যাত। সরাইল গ্রে-হাউন্ডের লেজ নিচের দিকে ঝুলে এবং লেজটি চিকন হয়। গ্রে-হাউন্ড জাতের কুকুরের কান ও লেজ লম্বা হয়। এদের মুখটা লম্বাটে ধরনের হয় ও গায়ে ডোরাকাটা দাগ রয়েছে। অন্যান্য প্রজাতির কুকুরের মত এটা আহ্লাদি নয়। এই কুকুর অত্যন্ত হিংস্র, এর নজর তীক্ষ ও দ্রুত দৌড়াতে পারে। এই জাতের পুরুষ কুকুরের উচ্চতা হয় ২৫-২৮ ইঞ্চি এবং ওজন ২৩-৩৩ কেজি আর নারী কুকুরের উচ্চতা হয় ২৩-২৬ ইঞ্চি এবং ওজন ১৮-২৮ কেজি। প্রতি ঘণ্টায় এই কুকুর প্রায় ৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়াতে পারে। এই কুকুর গড়ে ৮-১৪ বছর বাঁচে। এই কুকুরের রং দুই ধরনের হয় বাদামী-সাদা ও সাদা-কালো। ধারণা করা হয় মধ্যপ্রাচ্যের বণিকদের সাথে আনা আরবি জাতের কুকুর, যেমন সাইট হাউন্ড,সালুকি,আফগানি হাউন্ড এর সাথে ব্রিটিশদের গ্রে হাউন্ড এর সংমিশ্রণে এক জাতের কুকুরের উৎপত্তি হয় এবং সরাইলের এক দেওয়ান এজাতের কুকুর নিয়ে আসেন, তারপর বুনো জাতের কুকুরের সাথে মিলনে সরাইল হাউন্ডের উৎপত্তি [৪২]। এর উৎপত্তি নিয়ে আরও কয়েকটি কিংবদন্তি রয়েছে, যেমন - সরাইলের এক দেওয়ান হাতি নিয়ে সরাইল পরগনা থেকে ভারতের কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে একটি কুকুর দেখে তার অনেক পছন্দ হয়, কিন্তু কুকুরের মালিক (মতান্তরে ইংরেজ) এটি কিছুতেই বিক্রি করতে চাননি। তারপর দেওয়ান নিজের হাতির বিনিময়ে মালিকের কাছ থেকে কুকুরটি কিনে নেন। পরে কুকুরটি শিয়ালের সঙ্গে মিলন করে, যার ফলে সৃষ্টি বর্তমান এই জাতের কুকুরের। তাছাড়া আরও জনশ্রুতি আছে যে, সরাইলের এক দেওয়ান হাতি নিয়ে শিকারের জন্য বনে যান। সঙ্গে ছিল তার মাদী কুকুর। তারপর কুকুরটি বনে হারিয়ে যায়। কুকুরটি বনে বাঘের সঙ্গে মিলন করে এবং বাঘের সঙ্গে মিলনের ফলেই এই গ্রে-হাউন্ড কুকুরের উৎপত্তি [৪৩]। গবেষকদের মতে এরাবিয়ান শিকারি কুকুর,ইংরেজ গ্রে-হাউন্ড ও দেশি বন্য কুকুরের মিশ্রণে এই জাতের কুকুরের উৎপত্তি [৪৪]।
বর্তমানে সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চৌরাগোদা গ্রামের তপন পাল রবিদাস ও তার পরিবার এই জাতের কুকুর লালন পালন করেন এবং বিক্রি করেন। সমগ্র ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় শুধুমাত্র তাদের পরিবারেই এ জাতের কুকুরের সংরক্ষণ ও প্রজনন করা হয়। বর্তমানে কুকুরের বাচ্চা ২০-৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয় [৪৫]। তপন পাল রবিদাসের ভাষ্যমতে, শত বছর আগে তৎকালীন জমিদার দেওয়ান মনোয়ার আলি তার দাদা কালি চরন রবি দাসকে দুটি হাউন্ড কুকুর দিয়েছিলেন [৪৬]।
অন্যান্য কুকুরের তুলনায় এই জাতের কুকুর শিকারের জন্য ঘ্রানশক্তির বদলে দৃষ্টিশক্তি বেশি ব্যবহার করে। জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীর দুটি সরাইল হাউন্ড ছিল [৪৭][৪৮]। র্যাব ও পুলিশের ডগ স্কোয়াডে এই কুকুর যোগ করা হয়েছে [৪৯][৫০]।
সংরক্ষণ -
ডঃ শাহজাহান ঠাকুর নামে একজন গবেষক ২০০১ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সরাইলের কুকুর প্রজনন ও সংরক্ষণের চেষ্টা করেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। ২০০৬ সালে ঢাকার ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজী নামক একজন পশুপ্রেমিক এই জাতের কুকুর সংরক্ষণের জন্য ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দা সরাইল হাউন্ড প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিও সফলতা লাভ করতে পারেননি। ২০০৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য এড: মো: জিয়াউল হক মৃধা এই কুকুরের সংরক্ষণের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে চিঠি পাঠান এবং সংসদে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু পরবর্তীতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি। পরবর্তীতে র্যাব-৯ এর মেজর মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন ট্রেনিং এর জন্য ৪ টি কুকুর সংগ্রহ করেন। উন্নত জাতের কুকুরের বংশ সংরক্ষণ, প্রজনন ও চিকিৎসাসেবার জন্য ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত 'বাংলাদেশ কেনেল ক্লাব' বর্তমানে এই জাতের কুকুরের বংশবৃদ্ধি ও সংরক্ষণের চেষ্টা করছে [৪২][৫১]।
হাচলি/হাঁসলি/আসলি/আসিল মোরগ -
সরাইল মোরগ লড়াইয়ের জন্য বিখ্যাত। এই মোরগ লড়াইয়ে ব্যবহার করা হয় 'হাচলি মোরগ' যা শক্তিশালী দৈহিক গঠনের জন্য বিখ্যাত। এটি 'আসলি' বা আসিল নামেও উচ্চারন করা হয়। 'আসিল' শব্দের অর্থ আসল। 'আসিল মোরগ লড়াই' এর অর্থ 'আসল মোরগ লড়াই'।[৫২] কিংবদন্তি অনুসারে সরাইলের দেওয়ানরা ৪০০ বছর আগে ইরান থেকে এই জাতের মোরগ এনেছিল। আবার অনেকের মতে মুঘল আমলে ভারতের রায় বেরেলি থেকে এ জাতের মোরগ আনা হয় [৫৩][৫৪]। ‘সরাইল মিতালী শৌখিন আসিল মোরগ সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন সরাইলে মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করে থাকে।[৫৫]
বিবিধ
এনজিও
ব্রাক, আশা, গ্রামীণ ব্যাংক সক্রিয় এনজিওদের মধ্যে অন্যতম।
↑ কখউদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; ইউনিয়ন পরিসংখ্যান নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
↑"ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তথ্য উপাত্ত"(পিডিএফ)। web.archive.org। Wayback Machine। Archived from the original on ১৩ নভেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১৯।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: বট: আসল-ইউআরএলের অবস্থা অজানা (link)