ক্যাপ্টেন ডাক্তার লক্ষ্মী সেহগল (তামিল: லட்சுமி சாகல், মালয়ালম: ലക്ഷ്മി സൈഗാൾ) (জন্ম: ২৪ অক্টোবর, ১৯১৪ - মৃত্যু: ২৩ জুলাই, ২০১২) ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ডাঃ লক্ষ্মী ছিলেন সিঙ্গাপুরের এক বিশিষ্ট স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ। পরে তিনি তার লোভনীয় কর্মজীবন ত্যাগ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন (১৬ জুলাই , ১৯৪৩ )এশিয়ায় এ ধরনের নারীবাহিনী ছিল সর্বপ্রথম এবং এক সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। এ দায়িত্বের পাশাপাশি ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী সংগঠন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী (Minister of Women's Affairs) ছিলেন। বিবাহ-পূর্ব সময়কালীন তার নাম ছিল লক্ষ্মী স্বামীনাথন। আজাদ হিন্দের এক সেনানায়ক শ্রী প্রেম সেহেগলকে বিবাহ করে লক্ষ্মী সেহেগল নামে পরিচিত হন তিনি। লক্ষ্মী সেহগলকে ভারতের জনগণ ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী হিসেবে চিনে থাকেন। বার্মারকারাগারে অবস্থানকালীন সময়ে র্যাংক হিসেবে তাকে এ পদবী দেয়া হয়েছিল।
২৪ অক্টোবর, ১৯১৪ সালে অবিভক্ত ভারতের মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) লক্ষ্মী স্বামীনাথন জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এস. স্বামীনাথন মাদ্রাজ হাইকোর্টে অপরাধ আইন চর্চা করতেন। তার মা এ.ভি. অম্মুকুট্টি যিনি পরবর্তীতে অম্মু স্বামীনাথনরূপে পরিচিত, তিনি একজন সমাজকর্মী ছিলেন। পাশাপাশি কেরালার পালঘাট এলাকার আনাক্কারায় ঐতিহ্যবাহী বদক্কাথ পরিবার থেকে স্বাধীনতা কর্মী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।[১]
১৯৪০ সালে পি.কে.এন. রাও নামীয় একজন পাইলটের সাথে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে এবং সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান।[১] পরবর্তীতে মার্চ, ১৯৪৭ সালে লাহোরে পুনরায় কর্ণেল প্রেম সেহগালের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিবাহ-পরবর্তী সময়কাল তারা কানপুরে স্থায়ীভাবে আবাস গড়েন। সেখানে তিনি চিকিৎসা চর্চা ও ভারত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে আগত ব্যাপকসংখ্যক শরণার্থীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।
সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালীন সময়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু'র ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি দরিদ্র বিশেষতঃ অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে অভিবাসিতশ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যে একটি ক্লিনিক স্থাপন করেন। ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৪২ সালে সিঙ্গাপুরের পতনের ফলে জাপানী বাহিনী সিঙ্গাপুর দখল করে। আহতযুদ্ধবন্দীদের সেবাকালীন তিনি দেখতে পান যে তাদের অনেকেই ভারতীয় স্বাধীনতা সেনাবাহিনী গঠনে বেশ আগ্রহী। সিঙ্গাপুরে তখন অনেক ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে কে. পি. কেসভা মেনন, এস. সি. গুহ এবং এন. রাঘবন একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করেন। কিন্তু তাদের নেতৃত্বে গঠিত ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী বা আজাদ হিন্দ ফৌজ দখলকৃত জাপানী সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে কোনরূপ সাহায্য-সহযোগিতা কিংবা অনুমোদন পায়নি।[৪]
সুভাষচন্দ্র বসু ২ জুলাই, ১৯৪৩ সালে সিঙ্গাপুর গমন করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নারী রেজিমেন্ট গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন যাতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীরা অংশগ্রহণ করবে। লক্ষ্মী সেহগাল এ বিষয়টি শোনেন এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু'র নারী রেজিমেন্ট গঠনের খসড়া নীতিমালা সম্পর্কে অবগত হন। এ নারী বাহিনীই পরবর্তীকালে ইতিহাস বিখ্যাত ঝাঁসির রাণী বাহিনী নামে পরিচিতি পায়। নেতাজীর উদাত্ত আহ্বানে অনেক নারী বিভিন্ন ব্রিগেডে অংশ নেয়। ডঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথনও ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নামে সারাজীবন পরিচিতি পান।[৪]
আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপান সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর সাথে বার্মা অভিমুখে ডিসেম্বর, ১৯৪৪ সালে রওয়ানা দেয়। কিন্তু মার্চ, ১৯৪৫ সালে প্রবল যুদ্ধে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরফলে আইএনএ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের বাহিনী ইম্ফলে প্রবেশ করবে। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী মে, ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং মার্চ, ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বার্মায় কারাগারে আটক ছিলেন। দিল্লীতে আইএনএ সদস্যদের বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি অবিভক্ত ভারতে ফিরে আসেন।[৪]
১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে ভূপালের গ্যাস দূর্ঘটনায় চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দেন। একই বছর শিখবিরোধী দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে কানপুরে জনসংযোগ করেন। ১৯৯৬ সালে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ডপ্রতিযোগিতা আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে গ্রেফতার বরণ করেন।[৪] ৯২ বছর বয়সী হয়েও ২০০৬ সালে পর্যন্ত কানপুরে নিয়মিতভাবে নিজ ক্লিনিকে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেন তিনি।[৪]
২০০২ সালে ভারতের চারটি বামপন্থী দল - সিপিআই, সিপিআই (এম), বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল এবং অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক লক্ষ্মী শেহগালকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেয়। তিনি বিজয়ী রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আব্দুল কালামের ঘোর বিরোধী ছিলেন।[৬][৭]
দেহাবসান
১৯ জুলাই, ২০১২ সালে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল হৃদযন্ত্রজনিত রোগে আক্রান্ত হন। অতঃপর ৯৭ বছর বয়সে ২৩ জুলাই, ২০১২ তারিখে ১১:২০ ঘটিকায় কানপুরে মৃত্যুবরণ করেন।[৮][৯] কানপুর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রয়োজনে তার দেহ দান করা হয়।[১০]