ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত একটি জয়েন্ট-স্টক কোম্পানি।[১] এর সরকারি নাম "ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি"।[২]১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাণী প্রথম এলিজাবেথ এই কোম্পানিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার রাজকীয় সনদ প্রদান করেছিলেন। এ সনদ কোম্পানিটিকে ১৫ বছর পর্যন্ত পূর্ব ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্য করার প্রাধিকার অর্পণ করেছিল। তবে পরবর্তীকালে এ কোম্পানি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৮৫৮ সালে বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিল। অত:পর ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারত শাসন শুরু করে।[৩]
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
১৬০০ সালে ভারত ও পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে। ৩১ ডিসেম্বর রাণী এলিজাবেথের সনদ বলে উক্ত কোম্পানি উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে সমগ্র পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করে।[৪] তারা ১৬০৮-এ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। পরে অন্যান্য স্থানসহ হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। ১৭১৫ সালে মুঘল দরবার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। ঐ মুদ্রা মুঘল সাম্রাজ্যেও চালু হয়। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদৌলা কোলকাতা দখল করে নেবার পরে (২০ জুন) লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজযোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন ও কোলকাতা পুনরায় দখল করেন (২ জানুয়ারি, ১৭৫৭)। কোম্পানির কেরানি, পরে ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। নিজের যোগ্যতায় পরে উঁচু পদ পান। চন্দননগর দখল করার পরে সিরাজউদৌলাকে উৎখাত করার জন্য সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ প্রমুখদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন। চুক্তি মতো কাজ হয় ও নদীয়ার পলাশির প্রান্তরে সিরাজউদৌলার সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধ হয়। সিরাজউদৌলা পরাজিত হয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে নিহত হন। চুক্তি মতো মীরজাফর নবাব হন এবং ক্লাইভ নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করেন। জায়গির থেকে ক্লাইভের বছরে তিন লক্ষ টাকা আয় হত। পরে ১৭৬০-এ ক্লাইভ দেশে ফিরে যান। এ দিকে তার অভাবে ইংরেজরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আবার ক্লাইভের ডাক পড়ে।
কোম্পানির দিওয়ানি লাভ
ক্লাইভ এ দেশে আবার ফিরে আসেন ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি তখন দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন (আগস্ট ১, ১৭৬৫)। এর পেছনে কারণও আছে। সম্রাট পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে বাংলা সুবা থেকে কোন রাজস্ব পেতেন না। বক্সারের যুদ্ধের পর থেকে তিনি এ আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। ইংরেজরাও এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি। তারা সুযোগ বুঝে বিপুল উপহার নিয়ে সম্রাটের কাছে যায় এবং তারা তাকে পরামর্শ দেয়, যদি বাংলা বিহার ওড়িশার দিওয়ান হিসেবে ইংরেজদের নিযুক্ত করেন তাহলে তারা সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ করে টাকা প্রদান করবেন রাজস্ব হিসেবে। আর সম্রাট কোন কিছু না ভেবেই ইংরেজদের এই দিওয়ানি দিয়েছিল।[৫] বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামমাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়।
১৭৭০-এ (বাংলা ১১৭৬) অনাবৃষ্টি হয়। দেশে দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ। কয়েক লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যান। এটাই ইতিহাসখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এরপর ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলেছিল মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতিপদ্ধতিতেই। কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল রপ্তানি বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা-বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভর করার কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলা নামের এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে ইংরেজদের সম্পূর্ণ করায়ত্ব হয় ১৮১৩ সালে। ব্রিটিশ সরকার এক চার্টার অ্যাক্ট বলে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার বিলুপ্ত করে এবং দেশের শাসনভার কোম্পানির উপর ন্যস্ত করে। ১৮৫৮ সালে কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে।
বণিক থেকে রাজন
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল বাণিজ্য করার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু অবস্থা বুঝে তারা ব্রিটিশ রাজের আনুকূল্যে শাসনকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়। এ জন্য কবি লিখেছেনঃ
↑The Register of Letters &c. of the Governor and Company of Merchants of London trading into the East Indies, 1600–1619. On page three, a letter written by Elizabeth I on 23 January 1601 ("Witnes or selfe at Westminster the xxiiijth of Ianuarie in the xliijth yeare of or Reigne.") states, "Haue been pleased to giue lysence vnto or said Subjects to proceed in the said voiadgs, & for the better inabling them to establish a trade into & from the said East Indies Haue by or tres Pattents vnder or great seale of England beareing date at Westminster the last daie of december last past incorporated or said Subjecte by the name of the Gournor & Companie of the merchaunts of London trading into the East Indies, & in the same tres Pattents haue geven them the sole trade of theast Indies for the terme of XVteen yeares ..."
↑করিম, আব্দুল (২০১২)। বাংলার ইতিহাস। ঢাকা: JS প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ২৭২। আইএসবিএন984-70000-0209-9|আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: invalid prefix (সাহায্য)।