মাপ্পিলা মুসলিম যাদের সংক্ষেপে মাপিলা নামে ডাকা হয়, পূর্বে মোপলা/মোপলা নামে অভিহিত করা হতো এবং ঐতিহাসিকভাবেজোনাকা/চোনাকা মাপিলাবা মালয়ালামমুর নামে পরিচিত, ভারতের কেরালা ও লাক্ষাদ্বীপে বসবাসকারী একটি প্রাচীনতম মুসলিম জাতিগোষ্ঠী।[২][৮] মাপ্পিলারা কেরালা রাজ্যের মুসলিম জনসংখ্যার ২৬.৫৬% (২০১১) এবং ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী হিসাবে তারা হিন্দুদের ( ৫৪.৭৩%) পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী। [৯]কেরালার অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মতো মাপিলারাও মালয়ালম ভাষায় কথা বলে থাকে।[১০][১১] মাপ্পিলা শব্দ দ্বারা কখনো সকল মুসলিমকে বোঝানো হয় এবং তখন এই শব্দটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নির্দেশ করে না; বরং মাপ্পিলা ও মুসলিম শব্দ সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কখনো মাপ্পিলা শব্দ দ্বারা ভারতের প্রথম যুগের মুসলিমদের বোঝানো হয়।[১০]
কিছু ঐতিহাসিকের মতে মাপিলারা দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম বসতিস্থাপনকারী স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়। [২][১২] সাধারণভাবে একজন মাপ্পিলা হয়তো ইসলামে ধর্মান্তরিত কোনো আদিবাসীর বংশধর বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো আরব বা পারস্যিকের মিশ্র বংশধর। [১৩][১৪] মাপ্পিলারা কেরালার মুসলিম জনসংখ্যা গঠনকারী অনেক সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখ্যযোগ্য সম্প্রদায়। [১৫] মাপিলা সম্প্রদায়ের উৎপত্তি প্রাথমিকভাবে কেরলের সাথে পশ্চিম এশিয়ার যোগাযোগের ফলে হয় এবং এ যোগাযোগ মূলত বাণিজ্যের ( মশলা বাণিজ্য) উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[১৬]
স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে ইসলাম ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে মালাবার উপকূলে পৌঁছেছিল এবং এ অঞ্চলটি তখন কেরালা রাজ্যের একটি অংশ ছিল। [১০]মশলা বাণিজ্য ইউরোপীয়দের দ্বারা দখল হওয়ার আগে মাপ্পিলারা একটি সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ছিল। তারা প্রধানত কেরালার উপকূলীয় নগর-কেন্দ্রগুলিতে বসতি স্থাপন করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে মাপ্পিলাদের ক্রমাগত মিথস্ক্রিয়া তাদের জীবন, রীতিনীতি ও আচার সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব তৈরি করেছে এবং এর ফলে কেরালার সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প,খাদ্য, ভাষা ও সঙ্গীতে একটি অনন্য ইন্দো-ইসলামি সংশ্লেষণ তৈরি হয়েছে। [১০][১২]
কেরালার অধিকাংশ মুসলমান শাফিঈমাযহাবের অনুসরণ করে এবং একটি বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সালাফিবাদ অনুসরণ করে।[১৭][১৮] একটি জনপ্রিয় ভুল ধারণার বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অংশের মতো বর্ণপ্রথা কেরলের মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করে থাকে। যদিও সমস্ত মুসলমানকে কেরালার সকল মসজিদে নামাজ পরার অনুমতি দেওয়া হয়; তবে নাপিত ও জেলে সম্প্রদায়ের লোকেদের তুলনায় নিম্ন মর্যাদায় রাখা হয় বলে কিছু হিন্দু পণ্ডিত মনে করেন। [১৯] এটি মূলত হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথার সমর্থন বা তাকে হালকা করার উদ্দেশ্যে বলা হয়ে থাকতে পারে।[২০] তবে মুসলিমরা এমন বর্ণপ্রথার প্রচলন থাকা অস্বীকার করে। অনেক ইসলামি পণ্ডিত দাবি করেন যে, এ ভেদাভেদ মূলত সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় হয়ে থাকে এবং তা বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে বিদ্যমান এবং প্রতিটি সমাজে নিম্নশ্রেণীর সাথে উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দূরত্ব বজায় থাকে এবং এটিও তার অংশ হতে পারে।[২১]
ব্যুৎপত্তি
কেরালার মুসলিম সম্প্রদায়গুলির মধ্যে মাপ্পিলারা একটি উল্লেখ্যযোগ্য সম্প্রদায়। তবে কখনও কখনও কেরালার সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে "মপিলা" শব্দ দ্বারা পরিচিত করানো হয়। পর্তুগিজ লেখক ডুয়ার্তে বারবোসা (১৫১৫) কেরালার মুসলিমদের জন্য 'মুরস মোপুলার' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। [২]
"মাপ্পিলা" ( এর অর্থ মূলত "মহান সন্তান" এবং এখন প্রায়ই এটি জামাই/ বরের [২][১২] প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়) শব্দটি মালাবারে বিদেশী দর্শনার্থী, বণিক ও অভিবাসীদের দেওয়া একটি সম্মানজনক উপাধি ছিল। [১২] মুসলমানদের নাসরানি মাপিলা (সেন্ট থমাস খ্রিস্টান) এবং জুডা মাপিলা (কোচিন ইহুদি) থেকে আলাদা করার জন্য জোনাকা বা চোনাকা মাপিলা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। [২২]
২০১১ সালের ভারতীয় জনগণনা অনুসারে, কেরালার জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৬.৫৬%) মুসলমান। [২] কেরালা রাজ্যে গণনাকৃত মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৮৮,৭৩,৪৭২৷ গ্রামীণ এলাকায় মুসলমানের সংখ্যা মাত্র ৪২,৫১,৭৮৭ জন, যেখানে শহুরে জনসংখ্যা প্রায় ৪৬,২১,৬৮৫ জন। [১][২]
অবস্থান
উত্তর কেরালায় (সাবেক মালাবার জেলা) মুসলিমদের সংখ্যা বেশি।[২] আরব সাগরের লাক্ষাদ্বীপেও মাপ্পিলা জনসংখ্যা পাওয়া যায়। [১২] অল্প সংখ্যক মালয়ালি মুসলমান কর্ণাটকের দক্ষিণ জেলা এবং তামিলনাড়ুর পশ্চিম অংশে বসতি স্থাপন করেছে। অন্যদিকে ভারতের প্রধান শহরগুলিতেও এই সম্প্রদায়ের বিক্ষিপ্ত উপস্থিতি দেখা যায়।[২৩]মালাবার জেলায় যখন ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অনেক মাপ্পিলাকে বার্মা ও আসামে বৃক্ষরোপণ চাকরি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কায়িক শ্রমের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল।[১৫]সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতেও মাপ্পিলাদের প্রবাসী গোষ্ঠী পাওয়া যায়। [১২] অধিকন্তু মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উন্নত কর্মসংস্থানের জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ; বিশেষ করে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে কেরালা ছেড়েছে। [২৩]
আরব বা মক্কা থেকে আগত মুর (পর্তুগিজ: Mouros da Arabia/Mouros de Meca )।
পর্তুগিজরা মুসলমানদের মূর নামে অভিহিত করতো। ২য় ভাগের মুসলমানরা কেবল আরব থেকে নয়; বরং সমগ্র ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিল এবং তাদের মধ্যে তুর্কি, আরব, পারস্যিক, ইরাকি, খোরাসানি ও বাঙালি অন্তর্ভুক্ত ছিল। [২৫][২৬] এই মুসলমানরা কোনো নাবিক গোষ্ঠী ছিল না; বরং তারা কেরালায় অভিবাসী হয়ে বসতিস্থাপন করে। মালয়ালি ও তামিল মুসলিম সম্প্রদায় সামগ্রিকভাবে পরদেশী মুসলিমদের তুলনায় যথেষ্ট নিম্ন অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিল। [১৪][২৭]
একজন মাপিলা হয়তো:
যেকোনো স্থানীয় ইসলামে ধর্মান্তরিত (এদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল এঝাভার, থিয়ার, পুলায়ার ও মুক্কুভার) [২৮][২০][২৯] অথবা
১৬ শতক পর্যন্ত সমসাময়িক পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করে যে, মুসলমানরা প্রধানত কেরালার উপকূলীয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল (বিশেষ করে কেরালার প্রধান বন্দরগুলি; যেমন: কালিকট, কণ্ণুর, তানোর, পোনানি, কোচিন ও কুইলন) এবং [১৪][২৭] তারা ঐতিহ্যগতভাবে অভিজাত বণিক ছিল, যারা দ্রুত বিদেশী বাণিজ্যের অংশ হয়েছিল। [১৪] ইউরোপীয় সময় পর্যন্ত মুসলিমরা প্রায় একচেটিয়াভাবে বন্দর শহরগুলিতে কেন্দ্রীভূত ছিল। [৩১]মধ্যপ্রাচ্যের নাবিকদের মধ্যযুগে কেরালা বন্দরের বেশিরভাগ লাইটারেজের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এর ফলে তারা ঐতিহ্যবাহী সামুদ্রিক জেলে সম্প্রদায়ের সাথে পারস্পরিক উপকারী সম্পর্ক গড়ে তোলে। উত্তর কেরালায় এক সময়ের নিচু বর্ণের হিন্দুদের একটি বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলে এখন ইসলাম অনুসরণ করে। [৩১]
অভ্যন্তরীণ বৃদ্ধি
পর্তুগিজ আমলের পরের সময়ে কিছু মুসলিম বণিক বাণিজ্যের বিকল্প পেশার সন্ধানে মালাবার যেতে বাধ্য হয়।[২৭] তাদের কেউ জমি ক্রয় করে জমির মালিক হয়েছেন এবং কেউ কৃষি শ্রমিক হয়েছেন।[১৫] ১৬ থেকে ২০তম শতকের মধ্যে মালাবার জেলায় মাপিলাদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এটি প্রধানত দক্ষিণ মালাবারের স্থানীয় নিম্ন ও 'বহির্ভূত' হিন্দু গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মান্তরের মাধ্যমে হয়।[২৭][৩২]কেরালায় মুসলিম জনসংখ্যা ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ মালাবার জেলায় স্থানান্তরিত হয়। [১৪]১৮৭১ এবং ১৮৮১ সালের আদমশুমারির মধ্যে তুলনা করে উইলিয়াম লোগান বিশেষ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, দশ বছরের মধ্যে চেরুমা সম্প্রদায়ের (প্রাক্তন অস্পৃশ্য) প্রায় ৫০,০০০ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। [১৫] উচ্চ জন্মহারের কারণে ২০ শতকে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধিহার কেরালার সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়েছে। [১২][১৫]
ব্রিটিশ পার্থক্য
ব্রিটিশ আমলে ( ১৮৩৬ -১৯২১) তথাকথিত মাপিলা প্রাদুর্ভাব আধিকারিকদের অভ্যন্তরীণ মাপিলা এবং কালিকটের মতো উপকূলীয় শহরগুলির 'সম্মানিত' ম্যাপিলা ব্যবসায়ীদের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে এবং তা বজায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। অন্য দুটি আঞ্চলিক গোষ্ঠী হলো উত্তর মালাবারের কণ্ণুরের উচ্চ মর্যাদার মুসলিম পরিবার–যুক্তিযুক্তভাবে যারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের থেকে ধর্মান্তরিত–ও ত্রাভাঙ্কোর ও কোচিনের মুসলমানরা। [২৭] ঔপনিবেশিক প্রশাসনও দক্ষিণ মালাবারের উপকূলীয় এবং অভ্যন্তরীণ মাপ্পিলাদের মধ্যে পার্থক্য রেখেছিল।[১২][২৭] মুসলিমদের মাঝে এই পার্থক্য ব্রিটিশরা মূলত তাদের রাজনৈতিকভাবে দমন করার জন্য করেছিল। এতে তাদের ঐক্য বিনষ্ট হয়।
থাঙ্গাল ( সৈয়দ )– শীর্ষে ছিল অভিজাত থাঙ্গালরা (সায়্যিদ), যারা নবীর বংশধর বলে দাবি করে। [৩৩]
আরবি– থাঙ্গালদের নীচে আরবরা, (বেশিরভাগই উপকূলীয় শহর থেকে) যারা মালয়ালী মহিলাদের সাথে পশ্চিম এশীয় আন্তঃবিবাহ থেকে নিজেদের উৎপত্তির সন্ধান করে। [৩৩]
স্থানীয় অভিজাত - আরবদের পরে হল স্থানীয় অভিজাতরা। যারা উত্তর মালাবারের কণ্ণুরের স্থায়ী এবং তর্কযোগ্যভাবে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের থেকে ধর্মান্তরিত হয়। [২৭][১২]
সবশেষে ছিল অনগ্রসর ও তফসিলি হিন্দু জাতি থেকে ধর্মান্তরিতরা। যেমন : দক্ষিণ মালাবারের অভ্যন্তরীণ মাপিলা নাপিত ও জেলেরা। [২৭][১৪]
মধ্যপ্রাচ্য থেকে মশলা ও রেশম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বৃহত্তর ভারত মহাসাগরের অংশ মালাবার উপকূলে ইসলামের আগমন ঘটে। [৩৬] পণ্ডিতরা এতে সাধারণত একমত যে, মধ্যপ্রাচ্যের বণিকরা মালাবার উপকূলে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। কারণ এটি পশ্চিম এবং পূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলির মধ্যে সংযোগকারী ছিল; এমনকি আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই। [৩৭][৩৮] চতুর্থ শতাব্দী থেকে ৭ম শতাব্দীতে ভারতের পশ্চিম উপকূল মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং বেশ কিছু পশ্চিম এশীয় বণিক মালাবার উপকূলের কয়েকটি বন্দর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল। জনপ্রিয় ঐতিহ্য অনুসারে, ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে শেখ উবায়দুল্লাহমালাবার উপকূলের পশ্চিমে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপেইসলাম নিয়ে আসেন। তার কবর আন্দ্রোর্থ দ্বীপে অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়। [৩৯] বেশ কয়েকটি বিদেশী জনগণনায় কেরালার তৎকালীন উপকূলীয় শহরগুলিতে একটি উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যার উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাগদাদের মাসুদি (৯৬৫ খ্রি.), ইদ্রিসি (১১৬৫ খ্রি.), আবুল-ফিদা (১৩১৩ খ্রি.) এবং আল-দিমশকি (১৩২৫ খ্রি.) এর মতো আরব লেখকরা তৎকালীন কেরালার মুসলিম সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। [১৪] কিছু ইতিহাসবিদ অনুমান করেন, যে মাপিলাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম স্থানীয় বসতি স্থাপনকারী ইসলামি সম্প্রদায় হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। [৪০][৪১]
ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল পশ্চিম এশীয়দের কাছে "মালাবার" (তামিলমালাই ও আরবি বা ফার্সিবার এর মিশ্রণে গঠিত) নামে পরিচিত ছিল। পারস্য পণ্ডিত আল-বিরুনি (৯৭৩-১০৪৭ খ্রি.) এই অঞ্চলটিকে প্রথম এই নামে ডাকতেন বলে মনে হয়। বাগদাদের মাসুদি (৯৬৫ খ্রি.) মালাবার এবং আরবের মধ্যে যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছেন। ইবনে খোরদাদ বেহ ( ৮৬৯ –৮৮৫ খ্রি.), আহমদ আল বালাদুরি (৮৯২ খ্রি.) এবং জেরাফের আবু জায়েদ (৯১৬ খ্রি.) প্রমুখ লেখক তাদের রচনায় মালাবার বন্দরের নাম উল্লেখ করেছেন। [৪২]
মুসলিম পণ্ডিত সি এন আহমদ মৌলভি উল্লেখ করেন যে, তিনি ভালাপত্তনমের কাছে ইরিক্কালুরে ৬৭০ খ্রি/ ৫০ হিজরি তারিখের একটি সমাধি পাথর দেখেছেন। তবে এখন সম্ভবত পাথরটি এখন হারিয়ে গিয়েছে। [১২] পান্থলায়নি কোল্লামেরজামে মসজিদের বাইরে সমুদ্র সৈকতে একটি সমাধি পাথরের উপর পাওয়া কিছু শিলালিপি ১৬৬ হিজরিতে আবু ইবনে উদথরমানের মৃত্যু রেকর্ড করে। এই মসজিদটিতে দুটি মধ্যযুগীয় রাজকীয় সনদ রয়েছে ; একটি মসজিদের ট্যাঙ্কের ধাপে নির্মিত গ্রানাইটের একটি ব্লকে ও অন্যটি বাইরে কোদুঙ্গাল্লুর চেরা রাজা ভাস্কর রবি মানুকুলাদিত্যের (৯৬২-১০২১ খ্রি.) একটি আলগা পাথরে। মসজিদের অভ্যন্তরে রাজকীয় চেরা সনদের অবস্থান (পুরাতন মালায়ালাম ভাষায়) থেকে বোঝা যায় যে, এই শহরটি মুসলমানদের ছিল বা তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বা পরবর্তী পর্যায়ে তাদের দখলে এসেছে।[১২][১৫][৪২] এছাড়া এর্নাকুলাম জেলার পূর্ব অংশ কোথামঙ্গলম থেকে কয়েকটি উমাইয়া (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। [১২]
কেরালার মুসলমান বণিকদের প্রাচীনতম উপাখ্যানের প্রধান প্রমাণ হলো, কোডুঙ্গাল্লুর চেরা রাজার অধীনে কোল্লামের শক্তিশালী গভর্নর আয়ান আতিকালের একটি রাজকীয় সনদ। সিরীয় কুইলন তাম্রপাত্রে ( আনু. ৮৮৩ খ্রি.) [৩১] পুরাতন মালয়ালম ভাষায় লেখা এবং কুফি আরবি ও পাহলভি লিপিতে মধ্য ফার্সি এবং জুদাও-তে বেশ কয়েকটি "স্বাক্ষর" দিয়ে শেষ। সনদে আতিকাল দেখানো হয়, কোডুঙ্গাল্লুর রাজকীয় প্রতিনিধি এবং আঞ্চলিক বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মারসাপির ইসো দ্বারা নির্মিত তরিসাপল্লীকে জায়গা জমি ও দাসত্ব প্রদান করা এবং আঞ্চুভান্নাম ও মণিগ্রামামকে বিশেষাধিকার প্রদান করা হয়। [১২]
কুফি লিপিতে তাম্রপাত্রের প্রত্যয়নে লেখা হয়েছে যে, "[এবং সাক্ষী] এই মায়মুন ইবনে ইব্রাহিম, মুহাম্মদ ইবনে মানিহ/ সুলহ [?সালিহ ] ইবনে আলী, 'উসমান ইবনে আল-মারজুবান, মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া, 'আমর ইবনে ইব্রাহীম, ইব্রাহিম ইবনে আল-তায়, বকর ইবনে মনসুর, আল-কাসিম ইবনে হামিদ, মনসুর ইবনে ঈসা এবং ইসমাঈল ইবনে ইয়াকুব"। গর-খ্রিস্টান স্বাক্ষর থাকা এবং সনদে প্রাপ্ত নাম প্রমাণ করে যে, মার সাপির আইসোর সহযোগীদের মধ্যে ইহুদি এবং মুসলমানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুসলিম আরব এবং কিছু পারস্যিক অবশ্যই এই সময়ের মধ্যে কোল্লামে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিল। এই সনদটি কেরালায় বণিক সমিতিগুলির অবস্থা ও সুযোগ-সুবিধার প্রমাণ দেয়৷ [১৫][৪২][১২] তাম্রফলকে উল্লিখিত "অঞ্জুভান্নাম" মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বণিক সমিতি ছিল। [৩১]
মসলা ব্যবসায় কোডুঙ্গাল্লুরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার সাথে তাল মিলিয়ে কেরালার মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের লোককথা এই বন্দর শহরটিকে তাদের নিজ নিজ ধর্মের প্রসারের কেন্দ্র হিসাবে চিত্রিত করেছে। চেরামন পেরুমল উপকথা বা এর একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ অনুসারে, প্রথম ভারতীয় মসজিদটি ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে চেরা রাজবংশের শেষ শাসক চেরামন পেরুমালের আদেশে কোডুঙ্গাল্লুরে নির্মিত হয়েছিল, যিনি নবীজির জীবদ্দশায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। [৪৩][৪৪][৪০][৪৫] মালিক ইবনে দিনারের নেতৃত্বে ইসলাম প্রচারক ব্যক্তিরা পেরুমলের রাজ্য এবং এর উত্তরে একাধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এইভাবে তারা কেরালায় ইসলামের প্রসারকে সহজতর করেন।[১২][৪২]
ধারণা করা হয়, এই লোককথাগুলির প্রথম নথিভুক্ত সংস্করণটি " কিসাত শাকারওয়াতি ফরমাদ " নামে পরিচিত বেনামী লেখকের একটি আরবি পাণ্ডুলিপি। [৩১] যদিও এই ঐতিহ্যের কোনো সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই; তবে মালাবার উপকূলে প্রাথমিক মুসলিম উপস্থিতি এবং অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার উপর ভিত্তি করে ধর্মীয় সহনশীলতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ করা যায় না।[১২] তৎকালীন চেরামন পেরুমলের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রসিদ্ধ বিবরণকে মূলধারার মুসলিম লেখক ও পণ্ডিতরা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন। অনেকেই এটিকে নিছক কাহিনী হিসেবে গণ্য করেছেন। [৪৬]
কিসাত শাকারওয়াতি ফরমাদ অনুসারে মালাবারের প্রথম মসজিদগুলি[৪৭]
কিসাত অনুসারে প্রথম মসজিদটি মালিক ইবনে দিনার কোডুঙ্গাল্লুরে নির্মাণ করেছিলেন এবং বাকি মসজিদগুলি মালিক ইবনে হাবিব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। [১১]
ধারণা করা হয় যে, মালিক দিনারকাসারগর শহরের থালাঙ্গারায় মৃত্যুবরণ করেন। [৪৮] কোয়িল্যান্ডি জামে মসজিদে ভাটেলুট্টু ও গ্রন্থা লিপির মিশ্রণে লেখা একটি পুরানো মালায়ালাম শিলালিপি রয়েছে, যা খ্রিস্টীয় ১০ শতকের লেখা।[৪৯] এটি একটি বিরল জীবিত নথি, যা কেরালার মুসলমানদের কাছে একজন হিন্দু রাজার (ভাস্কর রবি) পৃষ্ঠপোষকতা রেকর্ড করে। [৪৯] মাদায়ি মসজিদের মধ্যে একটি তামার স্ল্যাবের উপর আরবি শিলালিপিটি ৫১৮ হিজরির (১১২৪ খ্রিস্টাব্দ) ভিত্তি বছর রেকর্ড করে। [৫০][১২][১৫][৪২] পুরানো চেরা রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কোডুঙ্গাল্লুর মসজিদে একটি গ্রানাইট ভিত্তি রয়েছে, যা ১১-১২ শতকের স্থাপত্য শৈলী প্রদর্শন করে। [১৫][৪২]
কেরালায় ইসলামের বৃদ্ধি
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্যবসায়ী এবং কেরালার বণিক সম্প্রদায় পর্তুগিজ অভিযাত্রীদের আগমন পর্যন্ত (১৬ শতকের গোড়ার দিকে) শান্তিপূর্ণ আন্তঃসাংস্কৃতিক হয়ে দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে।[২][১২] দক্ষিণ কেরালার কুইলোন (কোল্লাম) কালো মরিচের সাথে যুক্ত কেরালা বন্দরের দক্ষিণে ছিল এবং এটি পূর্ব ভারত মহাসাগর অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করেছিল। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছিল কেরালার মশসা শিল্প রপ্তানির প্রধাম ও প্রাথমিক বাজার।[৩১][২] মনে হয় ১৪০৩ সালে মিং রাজবংশ মালাক্কার অস্তিত্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম এক কালো মরিচ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে জানত পায় এবং তার ব্যাপারে ধারণা করা হয়, তিনি মালাবার উপকূল থেকে এসেছিলেন।
মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতাহ (১৪ শতক) কেরালার বেশিরভাগ বন্দরে মুসলমান ও বিদেশী ব্যবসায়ীদের বসতিগুলির বিশাল উপস্থিতি রেকর্ড করেছেন। [২] অভিবাসন, আন্তঃবিবাহ ও দাওয়াতের মতো মিশনারি কার্যকলাপ এমন উন্নয়নে সাহায্য করেছে। [১২]আরব সাগরে বিদেশী মশলা বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার মালাবার উপকূল থেকে আরব এবং পারস্য জাহাজের বিত্তশালীদের কাছে নিরাপদ ছিল। [৫১] এই বণিকদের ভাগ্য নির্ভর করত কালিকট (কোঝিকোড়), কান্নানোর (কান্নুর), কোচিন (কোচি) এবং কুইলন (কোল্লম) এর স্থানীয় প্রধানদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার উপর। [১২] এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির প্রধানরা তাদের রাজস্বের একটি বড় অংশ মসলা বাণিজ্যের উপর কর আরোপ করে লাভ করত। [১২] ১৪ শতকের একটি গ্রানাইট (পাথর ) শিলালিপি পুরানো মালায়ালাম এবং আরবি ভাষায কালিকটের মুচুন্দি মসজিদে রাজার একটি অনুদানের উল্লেখ রয়েছে। এই শিলালিপিটিই একমাত্র টিকে থাকা ঐতিহাসিক দলিল, যা একজন হিন্দু রাজা কর্তৃক কেরালার মুসলমান সম্প্রদায়কে রাজকীয় অনুদান দেওয়ার বিষয় রেকর্ড করে। [৫২][৩১]
১৪ শতকের প্রথম দশকে পর্যটকগণ কেরালার প্রধান বন্দর শহর হিসাবে কালিকট (কোঝিকোড়) এর কথা উল্লেখ করেন। [৩১] কালিকট রাজ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ; যেমন: বন্দর কমিশনার মুসলিমদের দ্বারা অধিষ্ঠিত ছিল। বন্দর কমিশনার বা 'শাহে বন্দর' মুসলিম বণিকদের বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করত। ইবনে বতুতা তার বিবরণে কালিকট ও কুইলনে শাহ বন্দরদের (ইবরাহিম শাহে বান্দর ও মুহাম্মদ শাহে বান্দর) নাম উল্লেখ করেছেন। নাখুদা নামী বিত্তশালী বণিকরা তাদের জাহাজগুলি ভারত মহাসাগর জুড়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ ছড়িয়ে দেয়। বিখ্যাত নাখুদা হলেন মিশকাল, যিনি চীন, ইয়েমেন এবং পারস্যের সাথে বাণিজ্যের জন্য তার জাহাজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন; ১৩৪০- এর দশকে কালিকটে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু ভারত মহাসাগরের অন্য কিছু অঞ্চলের মত কেরালা উপকূলে নাখুদারা বাণিজ্যিক, সাম্প্রদায়িক নেতৃত্বের কোনো পদে অধিষ্ঠিত ছিল না বলে জানা যায়নি। [৩১]কণ্ণুরের কাছে আরাক্কালের মুসলিম আলী রাজাদের বংশ লাক্ষাদ্বীপের উপর শাসন করেছিল। [৫৩] জয়ন উদ্দীন আল মাখদুম (আনু. ১৪৯৮- ১৫৮১) অনুমান করেন যে, ১৬ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মালাবারের জনসংখ্যার ১০% মুসলিম ছিল। [১২] সমরকান্দি বলেন যে, কালিকটে তিনি অমুসলিমদের দলের মধ্যে মুসলমানদের সাথে দেখা করেছিলেন এবং রাজা ও ভিক্ষুক উভয়ই একই জিনিস পরেন। তবে মুসলিমরাআরব ফ্যাশনে সুন্দর পোশাক পরেন। [৫৪]
অতীতে মালাবার বন্দরে অনেক মুসলিম ব্যবসায়ী ছিল। [৫৫] ১৪৯৮ সালে ইউরোপ থেকে কালিকট পর্যন্ত একটি সরাসরি সমুদ্র পথ আবিষ্কারের পর পর্তুগিজরা তাদের অঞ্চল প্রসারিত করতে শুরু করে এবং অর্মাস ও মালাবার উপকূল এবং দক্ষিণে সিলন পর্যন্ত সমুদ্র শাসন শুরু করে।[৫৬][৫৭] ১৬ শতকের প্রথম দুই দশকে (১৫০০-১৫২০) পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা কেরালার স্থানীয় হিন্দু প্রধান ও স্থানীয় মাপিলা মুসলিম বণিকদের সাথে চুক্তিতে পৌঁছাতে সফল হয়। প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল পর্তুগিজ রাষ্ট্র ও আরব / পারস্য ব্যবসায়ী ও কালিকট রাজ্যের মধ্যে।[১১]১৫০২ সালের জানুয়ারিতে জোয়াও দা নোভা এবং কোজিকোডের নৌবাহিনীর জামোরিনের অধীনে পর্তুগিজ তৃতীয় আরমাদা এবং কোচিন রাজ্যের মধ্যে ক্যানানোরের প্রথম যুদ্ধটি প্রথম ভারত মহাসাগরে পর্তুগিজদের সংঘাতের সূচনা করে। তখন কোচিনের বড় বড় মাপিলা ব্যবসায়ীরা পর্তুগিজ ক্যারাকে প্রচুর পরিমাণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মশলা সরবরাহ করত। [১১][২৫]সিরীয় খ্রিস্টানদের সাথে এই ব্যবসায়ীরা মসলা ক্রয় এবং ইউরোপ থেকে আনা পণ্য বিক্রিতে মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। [২৫]
মালাবার উপকূলের ধনী মুসলিম বণিকরা-মাপিলাসহ -পর্তুগিজদের বড় ঋণ প্রদান করেছিল এবং বিনিময়ে এসব ব্যবসায়ী বড় ধরনের ব্যবসায়িক ছাড়, উপবৃত্তি ও সুযোগ-সুবিধা পেতেন। ব্যক্তিগত পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও মাপিলা বণিকদের মধ্যে এমন মিথস্ক্রিয়াও পর্তুগিজ রাষ্ট্র মেনে নিতো।[৩১] কালিকট রাজ্য, যার নৌপরিবহন পর্তুগিজদের হাতে ক্রমবর্ধমান লুটপাট হচ্ছিল, সেটি মুসলিম প্রতিরোধের কেন্দ্রে বিকশিত হয়েছিল। [৩১] এভাবে ১৫০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দিউয়ের যুদ্ধে গুজরাতের সুলতান, মিশরের মামলুক সালতানাত ও কালিকটের জামোরিনের যৌথ নৌ-বহরের পরাজয় এবং দিউয়ের যুদ্ধে উসমানি সাম্রাজ্য এবং ভেনিস প্রজাতন্ত্রের সমর্থন পর্তুগিজদের মসলা বাণিজ্য এবং ভারত মহাসাগরে আধিপত্যের সূচনা করে।
এভাবে শীঘ্রই কণ্নুরের ধনী ম্যাপিলা ব্যবসায়ী এবং পর্তুগিজ রাজ্যের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও লোহিত সাগরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু মালদ্বীপের উপকূলে কণ্ণুররের মাপিলাদের জাহাজগুলি বারবার পর্তুগিজ নাবিকদের শিকার হয়। কোচিনে পর্তুগিজ কাসাডো মোরাডোরদের স্বার্থ তখন মান্নার উপসাগর এবং শ্রীলঙ্কায় মশলা ব্যবসা দখল করার পরিকল্পনা করে এবং ম্যাপিলা ও ( তামিল ) মারাইক্কায়ারদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বাংলায় (বিশেষ করে চট্টগ্রাম) তখন বাণিজ্যের চাবিকাঠি ছিল সংকীর্ণ উপসাগর। [১১] ১৫২০ সালে রামানাথপুরম ও থুথুকুডি থেকে উত্তর কেরালা এবং পশ্চিম শ্রীলঙ্কায় পর্তুগিজ এবং মাপিলাদের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘর্ষ একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে ওঠে। [৫৩][১১] ম্যাপিলা ব্যবসায়ীরা পর্তুগিজদের বিরোধিতা করার জন্য শ্রীলঙ্কা দ্বীপেও সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল। পর্তুগিজরা কেরালা বন্দর থেকে টহল স্কোয়াড্রন বজায় রেখেছিল এবং কালিকট ও কুইলনে মুসলিম নৌবহরের উপর তাদের অভিযান অব্যাহত রাখে। [২৫] এভাবে একের পর এক নৌ যুদ্ধের পর এক সময়ের শক্তিশালী মাপিলা প্রধান অবশেষে ১৫৪০ সালে পর্তুগিজদের সাথে শান্তির জন্য মামলা করতে বাধ্য হন। কণ্ণুরের কাজী আবু বকর আলীর (১৫৪৫) হত্যার সাথে শীঘ্রই শান্তি ভেঙে যায় এবং পর্তুগিজরা আবার ম্যাপিলাদের উপর কঠোর হয়ে নেমে আসে। এরই মধ্যে পর্তুগিজরাও মালাবার উপকূলে বসবাসকারী মধ্যপ্রাচ্যের কিছু নেতৃস্থানীয় বণিকদের সাথে বন্ধুত্ব করে নেয় ( ১৫৫০ )। মুসলিম প্রতিরোধের পতাকা তখন কণ্ণুরের আলী রাজারা গ্রহণ করেন এবং তারা কালিকটের রাজাকে আবার পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করে। [১১] ১৬ শতকের শেষের দিকে আলি রাজারা কেরালায় কোলাথিরি (চিরাক্কল রাজা) এর মতোই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসাবে আবির্ভূত হয়। [২৫]
১৬ শতকের আগে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা কেরালার মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ১৬ শতকের মধ্যে এই ব্যবসায়ীদের অনেকেই কেরালা থেকে পালিয়ে যায়। তাদের শূন্যতা কিছু ম্যাপিলা ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করে দেয়, যারা মালাবারে সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়েও বৃহত্তর ভূমিকা নিয়েছিল। [৩১] তখন লুটেরা পর্তুগিজরা হিংসাত্মক নৌ-যুদ্ধ ব্যবহার করে ভারতে মশলা ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল।[৫৮][৫৯][৬০] যখনই পর্তুগিজ ও কালিকট শাসকদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হত, পর্তুগিজরা সুযোগ মতো কেরালার মুসলিম বন্দরগুলো আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতো। ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজ জাহাজ চলাচলের জন্যে ম্যাপিলাদের ছোট, হালকা সশস্ত্র ও উচ্চ ভ্রাম্যমাণ জাহাজগুলি একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। [১১][২৫]পশ্চিম এশীয় মুসলমানদের জায়গায় তখন কালিকটে মরিচ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নেয় ম্যাপিলা বণিকরা। এমনকি কিছু ম্যাপিলা ব্যবসায়ী পর্তুগিজদের পশ্চিম ভারতীয় বন্দরগুলিতে নিজেদের বাণিজ্য পুনর্বিন্যাস করার চেষ্টা করেছিল। কেউ কেউ মসলা রপ্তানির জন্য পশ্চিমঘাট জুড়ে একটি নিরাপদ ওভারল্যান্ড রুট বেছে নেয়। [৩১] ১৬ শতকের শেষের দিকে পর্তুগিজরা অবশেষে ম্যাপিলাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। ১৬০০ এর শুরুর দিকে কণ্ণুরের আলী রাজাদের নিশ্চিত সহযোগিতা সত্ত্বেও কালিকট রাজ্যের শাসকের সাহায্যে পরাজিত এবং নিহত হন। [১১] এরপর কিছু নিরলস যুদ্ধ কেরালায় মুসলিম সম্প্রদায়কে শেষ অবনতির দিকে নিয়ে যায়। কারণ তারা ধীরে ধীরে মশলা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মুসলমানরা - যারা শুধুমাত্র বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল - তারা গুরুতর অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে যায়। কিছু ব্যবসায়ী বাণিজ্যের বিকল্প পেশার সন্ধানে দক্ষিণ মালাবারে চলে যান। তখন কেরালার মুসলমানরা ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভূমিহীন শ্রমিক ও দরিদ্র জেলেদের সমাজে পরিণত হয়। একসময়ের সমৃদ্ধশালী, শহুরে, মুসলিম জনসংখ্যা প্রধানত গ্রামীণ হয়ে ওঠে। [১২][২৭]
সুলতান হায়দার আলি দ্বারা শাসিত মহীশূর রাজ্য ১৮ শতকের শেষের দিকে উত্তর কেরালা আক্রমণ করে এবং একে তার সালতানাতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। [৬৫] মালাবারের পরবর্তী মহীশূরের শাসনে মুসলমানরা উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতী ছিল। কেউ কেউ কিছু জমির অধিকার এবং প্রশাসনিক পদ পেতে সক্ষম হয়। সম্প্রদায়ের বৃদ্ধিতে একটি তীক্ষ্ণ বৃদ্ধি ছিল। বিশেষ করে অন্যান্য সমাজের মানুষদের ধর্মের দাওয়াত দিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার মাধ্যম। মহীশূর শাসকদের এই ধরনের পদক্ষেপ মালাবারের সাম্প্রদায়িক ভারসাম্যহীনতাকে আরও প্রসারিত করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মহীশূর রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য হিন্দু উচ্চ বর্ণের সাথে জোট বাঁধে এবং ব্রিটিশরা পরবর্তীকালে মহীশূর শাসক টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে জয়লাভ করে। এর ফলস্বরূপ মালাবার মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অধীনে একটি জেলা হিসাবে সংগঠিত হয়। [৬৬]
তখন বৈষম্যমূলক ভূমি শাসনব্যবস্থা - প্রাক আধুনিক কেরালা থেকে এর উৎপত্তি - কেরালার মুসলমানদের (অন্যান্য ভাড়াটে এবং শ্রমিকদের) জমির মালিকানায় কোনো সুযোগ দেয়নি এবং[২] এটি উচ্চবর্ণের জমিদার ও ঔপনিবেশিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে একের পর এক সহিংস আক্রমণের দিকে পরিচালিত করে।[২৭] ১৯২১- ২২ সালে এটি একটি বিস্ফোরণের আকারে রূপ নেয়, যা মাপিলা বিদ্রোহ (মালাবার বিদ্রোহ) নামে পরিচিত। [৬৬][৬৭] এই বিদ্রোহটি –যা প্রাথমিকভাবে মোহনদাস কে. গান্ধীর মতো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল – ঔপনিবেশিক সরকার দ্বারা দমন করা হয় এবং এ অঞ্চলে সাময়িকভাবে সামরিক আইন জারি করা হয় সেই সাথে বিদ্রোহের নেতাদের বিচার ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। [১২]
উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগ
আধুনিক শিক্ষা, ধর্মতাত্ত্বিক "সংস্কার" এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণসহ বিভিন্নভাবে ১৯২১-২২ বিদ্রোহের পরে মুসলিমদের বস্তুগত শক্তি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হতে থাকে। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারি পদে মুসলিম সংখ্যা বিস্ময়করভাবে কম ছিল। ১৯৩১ সালে মাপিলা সাক্ষরতার হার মাত্র ৫% ছিল। এমনকি ১৯৪৭ সালে মালাবার অঞ্চলেরতালুক অফিসারদের মাত্র ৩% মুসলমান ছিল। [১২]
সম্প্রদায়টি পরবর্তী বছরগুলিতে অনেক বড় বড় উচ্চ-সম্মানিত নেতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ আবদুর রহিমান, কংগ্রেস পার্টির ই. মইদু মৌলভী ও সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা কে এম সেথি সাহেব (১৮৯৮-১৯৬০)। দেশ স্বাধীনের পর যদিও মুসলিম লীগ ভারতের বাকি অংশে স্মৃতিতে ম্লান হয়ে গিয়েছিল, তবে সৈয়দ আব্দুর রহমান বাফাকি টাঙ্গাল, পিএমএসএ পুক্কোয়া টাঙ্গাল এবং সিএইচ মোহাম্মদ কোয়ার মতো নেতাদের নিয়ে কেরালা রাজ্যে এটির একটি গুরুতর রাজনৈতিক শক্তি ছিল।[১২] কে ও আয়েশা বাই মুসলিম সম্প্রদায়ের আধুনিক কেরালায় সর্বজনীন খ্যাতি অর্জনকারী প্রথম মুসলিম মহিলা ছিলেন এবং তিনি ১৯৫৭ সালে কমিউনিস্ট কেরালা বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার হন [১২]
কোল্লমে আধুনিক মাপিলা ধর্মতাত্ত্বিক সংশোধন এবং সামাজিক সংস্কারের সূচনা করেন ওয়াক্কম মৌলভি (১৮৭৩-১৯৩২ )। মৌলভীরা প্রাথমিকভাবে মোহাম্মদ 'আব্দুহু ও রশিদ রিদা দ্বারা এবং কিছুটা জামালুদ্দীন আফগানি ও মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের দ্বারা প্রভাবিত হন বলে উল্লেখ করা হয়। ওয়াক্কম মৌলভি উল্লেখযোগ্যভাবে ম্যাপিলাদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করেন। [১২] কে এম শেঠি সাহিব, মুহাম্মদ কে এম মৌলভি (১৮৮৬-১৯৬৪), ই কে মৌলভি (১৮৭৯- ১৯৭৪) ও এম কে হাজির মতো উল্লেখযোগ্য সংস্কারক তার কাজকে আধুনিক যুগে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কে এম মৌলভি দক্ষিণ কেরালার নতুন ধারণাগুলি আরও গোটা মালাবার অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সিওটি কুনিপাক্কি সাহেব, মৌলভী আবুসাবাহ আহমেদ আলি ( মৃত্যু : ১৯৭১), কে এ জলিল, সি এন আহমদ মৌলভি ও কেও আয়েশা বাই বিংশ শতাব্দীর অন্যান্য বিশিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারক ছিলেন। মুসলিম এডুকেশনাল সোসাইটি (MES) নামে পরিচিত একটি সংগঠন, যা ১৯৬৪ সালে পিকে আব্দুল গফুর এবং তার বন্ধুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়, এটি সম্প্রদায়ের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করেছে। আইক্য সংঘম (১৯২২ সালে কোড়ুঙ্গাল্লুরে প্রতিষ্ঠিত) এবং ফারুক কলেজ (১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার প্রচার করে। [১২]
কেরালার বিপুল সংখ্যক মুসলিম পরের বছরগুলিতে (১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে) পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান খোঁজে পায়। উপসাগরীয় দেশগুলিতে এই ব্যাপক অংশগ্রহণ সম্প্রদায়ের জন্য বিশাল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুবিধা তৈরি করেছে। মাপিলাদের উপার্জন থেকে প্রাপ্ত একটি বড় তহবিল দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং শিক্ষাগত অনগ্রসরতার মতো বিষয়গুলো পরিবর্তন আনতে থাকে। [২] আধুনিক বিশ্বে ঘুরে দাঁড়নো , পরিবর্তন এবং ইতিবাচক সম্পৃক্ততায় চিহ্নিত ভারতীয় মুসলমানদের অংশ হিসেবে এখন মাপিলা সম্প্রদায়কে বিবেচনা করা হয়। মাপিলা মহিলারা এখন পেশাদার পেশায় যোগ দেওয়া এবং নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক নয়। [১২] সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মাপিলাদের কেন্দ্র মালাপ্পুরম জেলায় নারী সাক্ষরতার হার দাঁড়িয়েছে ৯১.৫৫% (২০১১ সালের জনশুমারি)৷ [৭২] ফোর্বস ম্যাগাজিন (২০১৮) অনুসারে লুলু গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ ইউসুফ আলী ভারতের ১৯তম ধনী ব্যক্তি এবং ১ম ধনী মালয়ালি ধনী। [৭৩] দুবাই-সদর দপ্তর Aster DM Healthcare এর চেয়ারম্যান আজাদ মুপেন কেরালার আরেকজন প্রধান মুসলিম উদ্যোক্তা। [৭৪] ২০১৬ সালে সৌদি আরবে তার রাষ্ট্রীয় সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি বাদশাহ সালমানকে কোডুঙ্গাল্লুর মসজিদের একটি সোনার প্লেট প্রতিরূপ উপহার দিয়েছিলেন। [৩১]
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ থেকে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে প্রাক্তন মালাবার জেলার সিংহভাগ মুসলমান মুসলিম লীগকে সমর্থন করেছে। দক্ষিণ কেরালায় সম্প্রদায়টি সাধারণত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন করে এবং উত্তর কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টির একটি ছোট অনুপাতে ভোট আছে। রাজনৈতিকভাবে কেরালার মুসলমানরা আধুনিক কেরালার অন্যান্য বড় সম্প্রদায়ের তুলনায় বেশি ঐক্যবদ্ধতা প্রদর্শন করেছে। [২৭]
এখানে যাদের সুন্নি বলা হয়েছে, তা তাদের প্রচলিত বিশ্বাস ও অনুশীলন এবং শাফিঈ মাযহাবের আনুগত্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যান্য ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে সালাফি মুজাহিদরা একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের সুন্নি ইসলামের মধ্যে আধুনিক সংস্কারপন্থী আন্দোলন হিসাবে দেখা হয়। সুন্নি ও মুজাহিদ উভয়ই আবার কয়েকটি উপ-পরিচয় বিভক্ত হয়েছে। [৭৫][১৭]
আলেমদের অনুপস্থিতির কারণে ১৯০০ সালের আগে বেশিরভাগ মাপিলাদের মধ্যে ইসলাম ছিল ইসলামি ও প্রাক ইসলামি রীতিনীতির সংমিশ্রণ। বিশেষ করে যারা নিম্ন হিন্দু বর্ণ থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তারা উভয়ের মাঝে অত্যন্ত সমন্বয় করত এবং আজো এই শ্রেণীর মাপিলারা এই জাতীয় অনেক অনুশীলন ধরে রেখেছে। যেমন: মাপিলারা প্রায়শ তাদের সাধক এবং পবিত্র পুরুষ (ওলি ) বা শহীদদেরমাজারে যাতাযাত করতেন এবং সেখানে মান্নত করতেন, যা ইসলামে বৈধ নয়। এখনো অনেকে এই অনুশীলন বজায় রাখে। নের্চা নামক উৎসবের সময় এই সাধুদের নামে মিছিল বের করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অনেক মুসলিম সংস্কারক এই উৎসবগুলিকে অনৈসলামি বলে প্রচার করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা সফল হলেও এসব অনুশীলন এখনো এই অঞ্চলের অনেক সম্প্রদায়ের জন্য ধর্মীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। [৩২]
মাপ্পিলা গান/কবিতা হল একটি বিখ্যাত লোককাহিনী মূলক ঐতিহ্য, যা ১৬ শতকে উদ্ভূত হয়। পাঁচালিগুলো মালায়ালাম/ তামিল ও আরবি, ফার্সি/ উর্দুর জটিল মিশ্রণে একটি পরিবর্তিত আরবি লিপিতে সংকলিত হয়েছে। [৭৭] মাপিলা গানের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় রয়েছে; কারণ তা দ্রাবিড়ীয় দক্ষিণ ভারতের পাশাপাশি পশ্চিম এশিয়ার নীতি ও সংস্কৃতির মিশ্রিত শব্দ। এতে প্রেমালাপ, ব্যঙ্গ, ধর্ম ও রাজনীতির মতো বিষয়ে কাজ করা হয়। ময়িনকুট্টি বৈদ্যরকে (১৭৭৫–৯১) সাধারণত মাপিলা গানের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে গণ্য করা হয়। [১২]
১৯২১-২২ বিদ্রোহের পর আধুনিক ম্যাপিলা সাহিত্যের বিকাশ হলে ধর্মীয় প্রকাশনাগুলি এক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে।[১২] ভাইকোম মুহাম্মদ বাশির (১৯১০-৯৪ ), ইউএ খাদের, কেটি মুহাম্মদ, এনপি মুহাম্মদ এবং মইদু পাদিয়াথ আধুনিক যুগের প্রধান মাপিলা লেখক।
মাপিলা সাহিত্য সাময়িকী এবং দৈনিকগুলিও– সব মালায়ালামে লিখিত–মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং সমালোচনামূলকভাবে পঠিত হয়। ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত "চন্দ্রিকা" নামে পরিচিত সংবাদপত্রটি মাপিলা সম্প্রদায়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। [১২]
মাপিলা লোকশিল্প
ওপ্পানা কেরালার মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক বিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল। এটি সাধারণত বিবাহের আগেের দিন বিবাহ অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে সঙ্গীতশিল্পীসহ প্রায় পনের জন মহিলা দ্বারা উপস্থাপন করা হয়। সোনার অলঙ্কারে আবৃত ও বিয়ের পোশাক পরিহিত নববধূ এর প্রধান দর্শক; সে একটি পীঠমে বসে, যার চারপাশে গান ও নাচ হয়। মহিলারা গান গাওয়ার তারা ছন্দময়ভাবে হাততালি দেয় এবং ধাপে ধাপে নববধূর চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। দুই বা তিনজন মেয়ে গান শুরু করে এবং বাকিরা কোরাসে যোগ দেয়। এই অনুষ্ঠানে সাধারণত মহিলা দর্শকরা উপস্থিত থাকেন।
কোলক্কালি ছিল কেরালার মুসলিমদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় নৃত্য। এটি গুজরাতের ডান্ডিয়া নৃত্যের অনুরূপ দুটি লাঠি নিয়ে ১২ জনের দলে বাজানো হয়।
ডাফ মুট্টু[৭৮] (ডুব মুট্টুও বলা হয়) একটি শিল্পরূপ, যা কেরালার মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এতে ঐতিহ্যবাহী ডাফ বা ডাফ ব্যবহার করা হত, যা টেপিট্টা নামেও পরিচিত। অংশগ্রহণকারীরা ডাফ বাজানোর সাথে তালে তালে নাচত।
মাপিলা খাবার
পাথিরি ; চালের আটা দিয়ে তৈরি একটি প্যানকেক। মালাবারের সাধারণ প্রাতঃরাশের খাবারগুলির মধ্যে একটি।
কাল্লুমক্কায়া নিরাচাথু বা আরিকাদুক্কা (ভাত দিয়ে ভরা ঝিনুক)।
হালওয়া কান্নুর, থালাসেরি, কালিকট ও পোন্নানির মতো শহরে জনপ্রিয়।
ম্যাপিলা রন্ধনপ্রণালী হল ঐতিহ্যবাহী কেরালা, ফার্সি, ইয়েমেনি এবং আরব খাবারের সংস্কৃতির মিশ্রণ। [৭৯] রন্ধনসম্পর্কীয় সংস্কৃতির এই সঙ্গমটি খাবার প্রস্তুতিতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। [৭৯]কাল্লুমক্কায়া ( ঝিনুক ) তরকারি, ইরাচি পুট্টু ( ইরাচি মানে মাংস), পরোটা (নরম ফ্ল্যাটব্রেড), [৭৯]পাথিরি (এক ধরনের চালের প্যানকেক) [৭৯] ও ঘি ভাত হল অন্যান্য বিশেষ খাদ্য। মশলার বৈশিষ্ট্যগত ব্যবহার হলো মাপিলা রান্নার মূল বৈশিষ্ট্য। রন্ধনে কালো মরিচ, এলাচ ও লবঙ্গ প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয়।
মান্দির মালাবার সংস্করণ, যা মালয়ালম ভাষায় কুঝি মান্দি নামে পরিচিত, এটি আরেকটি জনপ্রিয় খাবার, যা ইয়েমেনি রন্ধনশৈলীর প্রভাবে প্রচলিত হয়। এছাড়া তালসেরি বিরিয়ানি, কান্নুর বিরিয়ানি, [৮০] কালিকট বিরিয়ানি[৮১] এবং পোন্নানি বিরিয়ানি[৮২] ম্যাপিলা সম্প্রদায়ে ব্যাপক প্রচলিত আছে। [৭৯]
জলখাবারের মধ্যে রয়েছে উন্নাক্কায়া (গভীর ভাজা ও সিদ্ধ পাকা কলার পেস্ট, যা কাজু, কিশমিশ ও চিনির মিশ্রণে ঢেকে রাখা হয়),[৮৩] পাজম নিরাচাথু (নারকেল ঝাঁঝরি, গুড় বা চিনি দিয়ে ভরা পাকা কলা), [৮৩]ডিম দিয়ে তৈরি মুত্তামালা, [৭৯]চটি পাথিরি, ময়দা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি, শেঁকা ও মোটা চাপাতি,আরিকাদুক্কা, [৮৪] ইত্যাদি। [৭৯]
এস মুহম্মদ হোসেন নাইনার (১৯৪২), Tuhfat-al-Mujahidin: An Historical Work in The Arabic Language, মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link) ।(এটি ষোড়শ শতাব্দীতে ২য় জয়নুদ্দিন মখদুম কর্তৃক কেরালার সমাজ সম্পর্কে রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ তুহফাত উল মুজাহিদিনের ইংরেজি অনুবাদ)
আরও দেখুন
উইকিমিডিয়া কমন্সে মাপ্পিলা মুসলিম সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।
↑William Logan (১৮৮৭)। Malabar Manual (Volume-I)। Madras Government Press।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑Upadhyaya, U. Padmanabha. Coastal Karnataka: Studies in Folkloristic and Linguistic Traditions of Dakshina Kannada Region of the Western Coast of India. Udupi: Rashtrakavi Govind Pai Samshodhana Kendra, 1996.P- ix . আইএসবিএন৮১-৮৬৬৬৮-০৬-৩
First All India Conference of Dravidian Linguistics, Thiruvananthapuram,1973
↑Gulf Dream: For Indians The Golden Beaches Still gleam, Malayala Manorama Yearbook 1990;
↑ কখগঘRoland. E., "Mappila" in "The Encyclopedia of Islam". Volume VI. E. J. Brill, Leiden (1987) . pp. 458–56. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "brill" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
↑ কখগঘঙচছজঝঞট" "Oh! Calicut!" Outlook Traveller"Archived copy"। ১৫ জুলাই ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০২-১৭। December, 2009
↑Hafiz Mohamad, N. P. "Socioeconomic determinants of the continuity of matrilocal family system among Mappila Muslims of Malabar" Unpublished Ph.D. thesis (2013) Department of History, University of Calicut
↑ কখগঘঙচছP. P., Razak Abdul "Colonialism and community formation in Malabar: a study of Muslims of Malabar" Unpublished Ph.D. thesis (2013) Department of History, University of Calicut
↑Panikkar, K. N. (১৯৮৯)। Against Lord and State: Religion and Peasant Uprisings in Malabar 1836–1921। Oxford University Press। আইএসবিএন978-0-19562-139-6।
↑ কখগMiller, Roland. E., "Mappila" in "The Encyclopedia of Islam". Volume VI. E. J. Brill, Leiden. 1987 pp. 458–56.
↑Mathur, P. R. G. "The Mappila Fisherfolk of Kerala: a Study in Inter-relationship Between Habitat, Technology, Economy, Society, and Culture" (1977), Anthropological Survey of India, Kerala Historical Society, p. 1.
↑ কখ"Remittances and its Impact on the Kerala Economy and Society – International Migration, Multi-local Livelihoods and Human Security: Perspectives from Europe, Asia and Africa", Institute of Social Studies, The Netherlands, 30–31 August 2007
↑ কখগঘঙচMohammad, K.M. "Arab relations with Malabar Coast from 9th to 16th centuries" Proceedings of the Indian History Congress. Vol. 60 (1999), pp. 226–234.
↑Prange, Sebastian R. Monsoon Islam: Trade and Faith on the Medieval Malabar Coast. Cambridge University Press, 2018. 98.
↑Pg 58, Cultural heritage of Kerala: an introduction, A. Sreedhara Menon, East-West Publications, 1978
↑ কখAiyer, K. V. Subrahmanya (ed.), South Indian Inscriptions. VIII, no. 162, Madras: Govt of India, Central Publication Branch, Calcutta, 1932. p. 69.