মাজুলী (অসমীয়া: মাজুলী)[১][২][৩] ভারতের অসমেরব্রহ্মপুত্র নদীর মধ্যে থাকা বিশ্বের সর্ববৃহৎ নদীদ্বীপ এবং অসমের নবগঠিত জেলা। ২৭ জুন ২০১৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোণোয়াল মাজুলীকে জেলা ঘোষণা করায় মাজুলী ভারতের প্রথম নদীদ্বীপ জেলা হয় আর অসমের মোট জেলার সংখ্যা হয় ৩৩।[৪]
আগে এটি যোরহাট জেলার একটা মহকুমা ছিল। মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শংকরদেব এবং মাধবদেবের উদ্যোগের সত্রসমূহ নিয়ে এটি মহাপুরুষীয়া বৈষ্ণবধর্ম ও সত্রীয়া সংস্কৃতির পীঠকেন্দ্র। মাজুলীকে 'সত্র নগরী' বলেও ডাকা হয়। আগে মাজুলীর মোট আয়তন ১২৫০ বর্গমাইল[৫] (৪৮৩ বর্গমাইল) ছিল, কিন্তু খননের ফলে ২০০১ সালে এর ক্ষেত্রফল হয় ১৬৩ বর্গমাইল। একে ঘিরে থাকা নদীর বিস্তৃতি বেড়ে আসার সাথে মাজুলীর সংকোচন হয়েছে।
দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদী ও উত্তরে শোবনশিরি নদীর মিলন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। যোরহাট থেকে ফেরীর সাহায্যে জলপথে মাজুলিতে যাতায়ত করার ব্যবস্থা আছে। মাজুলী দ্বীপ অসমের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে প্রায় ২০০ দূরত্বে অবস্থিত।
ইতিহাস
মাজুলী নদী দ্বীপের সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে এই স্থান মাজালী বা মজালী নামে পরিচিত ছিল। নকুল চন্দ্র ভুইয়ার ইতিহাস মতে, আহোম রাজাজয়ধ্বজ সিংহের সময় এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা যায়ছে[৬]।
অতুল চন্দ্র হাজরিকার মতে, মা+জুলী নাম একত্রিত হয়ে মাজুলী নামের উৎপত্তি হয়েছে। এখানে মা অর্থে লক্ষ্মী ও অসমীয়া ভাষায় জুলী অর্থ ভাণ্ডার। একসময়ে এই দ্বীপ শস্য ও মাছে পরিপূর্ণ থাকায় মাজুলী নামকরণ হয়েছে। ড. জে পি ওয়েড অষ্টাদশ শতকে মাজুলী শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
এর দৈর্ঘ ১৬০ এবং প্রস্থ ৬০ ব্রিটিশ মাইল বলেও ওয়েড উল্লেখ করে গেছেন। Gazetter of Bengal and North East India-র তথ্য মতে, ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে মাজুলীর আয়তন ছিল ৪৮৫ বর্গমাইল।
মাজুলীর জলবায়ু
মাজুলীতে সারা বৎসর মৌসুমী জলবায়ু প্রবাহিত হয়। জলবায়ু বিজ্ঞানীর মতে এই অঞ্চল উপক্রান্তীয় জলবায়ুর অন্তর্গত। শীতকালে বৃষ্টি ও তাপের মাত্রা কম হওয়ার জন্য এই অঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেশি। গ্রীষ্মকালে মাজুলীর তাপমাত্রা ২০-৩৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও শীতকালে১০-১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস হয়। নিয়মীত মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের ফলে মাজুলীতে ২০০ থেকে ৩০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়।
ভৌগোলিক তথ্য
মাজুলী ২৬° ৪৮′ থেকে ২৭° ১২′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯৩° ৩৯′ থেকে ৯৪° ৩৫′ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত[৭] অসমের যোরহাট জেলার উত্তর দিকে মাজুলী অবস্থিত। মাজুলীর সমতলভূমির আকার একটা শিলিখা ফলের মত। একসময় মাজুলীর ভৌগোলিক ক্ষেত্রফল ১২৫০ বর্গ কিলোমিটার ছিল যদিও ব্রহ্মপুত্রের খনননে এই মাজুলীর ভূখণ্ড সংকীর্ণ হয়ে ২০১২ সালে ৫০৮°১৩ বর্গ কিলোমিটার হয়ে গেছে।
মাজুলীর বর্তমান জনসংখ্যা ১৪০০০০, এখানে বিভিন্ন জনজাতির লোকেরা বসবাস করে। মিসিং জনজাতির লোকেরা এখানে সংখ্যা গরিষ্ঠ। তাছাড়াও বৃহৎ সংখ্যায় নেপালী, বাঙালী ও সোনোয়াল কছাড়ী লোকেরা এখানে বসবাস করে।
সংস্কৃতি
লোক সংস্কৃতির দিকে মাজুলী অতি মনোহর। বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রনে মাজুলীর সংস্কৃতি সুমধুর হয়েছে। মিশ্রীত জনজাতির নানান উৎসব মাজুলীর পরিবেশকে সর্বদা আনন্দময় করে রাখে। সত্রীয়া সংস্কৃতি মাজুলীর অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি।
যাতায়াত
যোরহাট ও লক্ষীমপুর উভয় স্থান থেকে মাজুলীর যাওয়ার সুব্যাবস্থা আছে। যোরহাট শহরের নিমাতী ঘাট থেকে জলপথে ফেরীর সাহায্যে মাজুলী যাওয়া এক আমোদজনক যাত্রার অনু্ভব করায়। নিমাতী ঘাট থেকে মাজুলীর কমলাবারী, দক্ষীনপাট,সুমৈমারী, অফলামুখ, শালমরা, ফুলনী(বগরীগুরী) ইত্যাদি স্থানে ফেরী চলাচল করে। অন্যদিকে লক্ষীমপুর থেকে মাজুলী যাওয়ার সময় লুইত ও খাবলু নামক দুইটি ঘাট পার হতে হয়।
প্রতিষ্ঠান
পঞ্চদশ শতকে মহাপুরুষ শংকরদেব মাজুলীর ধুয়াহাট-বেলগুড়িতে প্রথম সত্র প্রতিষ্ঠা করে অসমীয়া সংস্কৃতি তথা ভক্তিধর্মকে স্বকীয় মাত্রা প্রদান করেছিলেন।অসমের বৈষ্ণব সংস্কৃতির বিকাশর স্থলস্বরূপ সত্রসমূহ অসমীয়া সমাজের প্রাণকেন্দ্র। অসমের সত্রসমূহ ভক্তি আন্দোলনের বাহক। চারসত্র আউনীআটী, কমলাবাড়ি, গড়মূর ও দক্ষিণপাট সত্র অসমীয়া সমাজে উচ্চ আসন অধিকার করে আছে।