ভারতে সুফিবাদ

মারা যাওয়ার আগে, সম্রাট জাহাঙ্গীর অন্য সকলের চেয়ে সুফিদের বেছে নেন ( বিচিত্র, ১৬৬০)

ভারতে সুফিবাদের ইতিহাস ১০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত হয়েছে। [] ভারতে সুফিবাদের উপস্থিতি ইসলামকে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। [] ৮ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইসলামের প্রবেশের পর, ১০ম এবং ১১শ শতাব্দীর দিল্লি সালতানাতের সময় এবং তার পরে ভারতে সুফি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। [] দিল্লি সালতানাতের প্রাথমিক পর্যায়ে তুর্কি এবং আফগান ভূমি থেকে আগত শাসকরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। [] এই পারসিক প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম, সুফি চিন্তা, সমন্বয়মূলক মূল্যবোধ, সাহিত্য, শিক্ষা এবং বিনোদন নিয়ে আসে, যা আজকের ভারতে ইসলামের উপস্থিতিতে একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। [] সুফি প্রচারক, বণিক এবং ধর্মপ্রচারকরা সামুদ্রিক যাত্রা ও বাণিজ্যের মাধ্যমে গুজরাতের উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী হয়েছিলেন।

সুফি তরিকাগুলির বিভিন্ন নেতা, তরিকা, স্থানীয় মানুষদের সুফিবাদের মাধ্যমে ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রথম সংগঠিত কার্যক্রম শুরু করেন। সুফি ব্যক্তিত্ব এবং পৌরাণিক কাহিনী প্রায় ক্ষেত্রেই ভারতের গ্রামীণ জনপদগুলোতে হিন্দু জাতি সম্প্রদায়গুলির কাছে সান্ত্বনা এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করেছিল। [] সুফিবাদের শিক্ষাগুলি - দেবতাত্মক আধ্যাত্মিকতা, মহাজাগতিক সাদৃশ্য, প্রেম এবং মানবতা - সাধারণ মানুষের সাথে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এবং আজও তা করে। [][] নিম্নলিখিত বিষয়বস্তুটি সুফিবাদের বিস্তার এবং ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক বোঝাপড়ার সহায়ক বিভিন্ন প্রভাবগুলি নিয়ে আলোচনা করবে, যা আজকের দিনে ভারতে সুফি সংস্কৃতির একটি সমকালীন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করেছে।

ইতিহাস

প্রাথমিক ইতিহাস

ইসলামের প্রভাব

৭১২ খ্রিষ্টাব্দে আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে মুসলমানরা ভারতে প্রবেশ করে সিন্ধুমুলতান অঞ্চল বিজয় করেন। এই ঐতিহাসিক অর্জন দক্ষিণ এশিয়াকে মুসলিম সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করে।[][] একই সময়ে, আরব মুসলমানদের ব্যবসা ও বাণিজ্যের জন্য হিন্দুস্তানি (ভারত) সমুদ্রবন্দরগুলিতে স্বাগত জানানো হয়েছিল। তৎকালীন খলিফার ইসলামি সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ভারতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

এই বাণিজ্য পথটি ভারতকে ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্ব এবং এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে শান্তিপূর্ণভাবে যুক্ত করে রেখেছিল ৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়কালে, আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০ – ১২৫৮) বাগদাদে অবস্থিত ছিল; এই শহরটি সুফিবাদের জন্মস্থানও, যেখানে আব্দুল কাদির জিলানি, হাসান আল বাসরি এবং রাবেয়া বসরীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা ছিলেন।[১০]

মুসলমানরা সিন্ধুর রাজধানী মুলতান জয় করে এবং এর মাধ্যমে ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তার করে।

৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই বাণিজ্য পথটি ভারতকে ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্ব এবং এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে শান্তিপূর্ণভাবে যুক্ত করে রেখেছিল।[১১] এই সময়কালে, আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০ – ১২৫৮) বাগদাদে বিরাজ করছিল; এই শহরটি সুফিবাদের জন্মস্থানও, যেখানে আব্দুল কাদির জিলানী, এবং হাসান আল বসরির মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা বসবাস করতেন।[১২][১৩]

বাগদাদ থেকে পারস্য এবং আফগানিস্তান হয়ে কাশ্মীরে বিভিন্ন আক্রমণের মাধ্যমে ইসলামের মরমী ঐতিহ্য উল্লেখযোগ্যভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ৯০১ খ্রিষ্টাব্দে, তুর্কি সামরিক নেতা সবুক্তগিন গজনিতে একটি তুর্কো-পারসিয়ান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র মাহমুদ গজনভি ১০২৭ খ্রিষ্টাব্দে তাদের শাসন ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে সম্প্রসারিত করেন।[১৪] পাঞ্জাব থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ও ধন-সম্পত্তি গজনির কোষাগারে জমা করা হত যা দিয়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নিজেদের শাসন আরও প্রসারিত করেন।[১৫] ১১শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, গজনভিরা ভারতের সীমানায় অসংখ্য মুসলিম পণ্ডিত প্রেরণ করেন, যারা সেখানে পূর্বের আরব প্রভাবের পর প্রথম পারস্য-অনুপ্রাণিত মুসলিম সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে।[১৬]

১১৫১ খ্রিষ্টাব্দে, আরেকটি মধ্য এশীয় দল, যারা ঘুরি রাশবংশ নামে পরিচিত ছিল, গজনভিদের- যারা ভারতে তাদের ভূমি পর্যবেক্ষণ তেমন মনোযোগী ছিল না, পরাজিত করে তাদের ভূমি দখল করে।[১৭] তুর্কি বংশোদ্ভূত গভর্নর মুইজউদ্দিন মুহাম্মাদ ঘুরি, ঘুরি সাম্রাজ্যের সুলতান, ভারতে একটি বড় আক্রমণ শুরু করেন যার মাধ্যমে তিনি পূর্ববর্তী গজনভিদের শাসনকে দিল্লি এবং আজমির পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ১১৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, উত্তর ভারত ছিল অদৃশ্যমান; বাগদাদের বিশ্বজনীন সংস্কৃতি গজনি আদালতের পারস্য-তুর্কি ঐতিহ্যের সাথে মিশে সুফি বুদ্ধিজীবিতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।[১৮] মধ্য এশিয়া এবং ইরানের পণ্ডিত, কবি এবং সুফি ব্যক্তিরা ভারতে একীভূত হয়ে যায়। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, ঘুরিরা বেনারস (বারাণসী), কনৌজ, রাজস্থান এবং বিহারে শাসন প্রতিষ্ঠা করে, যার ফলে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে।[১৫]

আরবিপারস্য পাঠ্য (কুরআন, হাদিসের সংকলন, সুফি সাহিত্য) স্থানীয় ভাষায় অনুবাদের ওপর জোর দেওয়া ইসলামিকরণের গতি বাড়িয়েছিল ভারতে।[১৯] বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, সুফিরা পূর্ববর্তী বহুঈশ্বরবাদী জনসংখ্যার মধ্যে ইসলামকে উদারভাবে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। ফলস্বরূপ, পণ্ডিতদের মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য হল যে এই প্রাথমিক ইতিহাস সময়কালে কখনও কোনো প্রকারের জোরপূর্বক গণ ধর্মান্তরের ইতিহাস নেয়।[২০] ১২শ শতাব্দীর শেষ এবং ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে, সুফিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো উত্তর ভারতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[২১]

দিল্লি সালতানাত

১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের সময়কালটি দিল্লি সালতানাত হিসাবে পরিচিত।[১৭][২২] এই সময়সীমায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচটি পৃথক রাজবংশ শাসন করেছিল, এগুলো হল মামলুক বা দাস, খিলজি, তুগলক, সৈয়দ এবং লোদি রাজবংশ। ইতিহাসে, দিল্লি সালতানাত সাধারণত পরবর্তী মুঘল সাম্রাজ্যের তুলনায় কম গুরুত্ব পেয়েছে।[২৩] দিল্লি সালতানাতের সবচেয়ে ভালো সময়ে তারা উত্তর ভারত, আফগান সীমান্ত এবং বাংলাকে শাসন করত। মঙ্গোলরা যখন ১২০৬ থেকে ১২৯৪ খ্রিষ্টাব্দ, এ সময়কালে মধ্যে এশিয়ার অন্যান্য অংশে নিজেদের শাসন বিস্তৃতি করছিল তখন দিল্লি সালতানাত নিজেদের অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল।[২৪] মঙ্গোলরা যখন আক্রমণ মাধ্যেমে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করে, তখন পালিয়ে আসা শরণার্থীরা নিরাপদ গন্তব্য হিসাবে ভারতকে বেছে নিয়েছিল।[২৫] পণ্ডিত, শিক্ষার্থী, শিল্পী এবং সাধারণ মানুষ মামলুক-দিল্লি সালতানাতের প্রথম রাজবংশ, শাসকদের সুরক্ষার অধীনে চলে আসে। দিল্লির দরবারে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারস্য এবং মধ্য এশিয়া থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্মীয়তা এবং সাহিত্যের বিশাল আগমন ঘটে; যেগুলোর মধ্যে সুফিবাদ ছিল অন্যতম প্রধান উপাদান। মধ্যযুগের এই সময়ে, সুফিবাদ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং তুগলক রাজবংশের (১২৯০ – ১৩৮৮) শাসনের বিস্তৃতির সাথে সাথে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতেও সুফিবাদ প্রভাব বিস্তার শুরু করে।[১৭][২৬] এই সময়কালে, সালতানাতের মুসলিম শাসকরা অপরিহার্যভাবে প্রথাগত ইসলামের অনুসারী ছিলেন না; তবুও, তারা শক্তিশালী বলে বিবেচিত হতেন। রাজবংশীয় সুলতানদের উপদেষ্টাদের মধ্যে মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিত (উলামা) এবং বিশেষ করে মুসলিম মরমী ব্যক্তিত্ব (মাশাইখ) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।[২৭] যদিও সুফি সাধকরা সাধারণত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা রাখতেন না, সৈয়দ রাজবংশ এবং লোদি রাজবংশের (১৪১৪ – ১৫১৭) নৈতিক শাসনের অবনতির কারণে নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়েছিল।[২৮]

শিক্ষার উন্নয়ন

ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি

৯০১ থেকে ১১৫১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, গজনভিদের শাসনকালে প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ শুরু হয়, যা মসজিদের সাথে সংযুক্ত এবং সংশ্লিষ্ট ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মােনের এই ব্যাপকতা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে।[২০] তৎকালীন পণ্ডিতরা কুরআন এবং হাদিস পাঠের গুরুত্ব প্রচার শুরু করেন, যা উত্তর-পশ্চিম ভারত খেকে শুরু হয়েছিল।[২৯] দিল্লি সালতানাতের সময়, মঙ্গোল আক্রমণের কারণে ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে বুদ্ধিভিত্তিক বৈচিত্র্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ইরান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা দিল্লির রাজধানীর সাংস্কৃতিকসাহিত্য জীবনকে সমৃদ্ধ করতে শুরু করেন।[৩০]

সালতানাত আমলে ধর্মীয় অভিজাতদের মধ্যে দুটি প্রধান শ্রেণিবিন্যাস ছিল। উলামা ছিলেন বিশেষভাবে ধর্মীয় পণ্ডিত, যারা ইসলামি আইনের নির্দিষ্ট শাখায় পারদর্শী ছিলেন। তারা শরিয়া-ভিত্তিক ছিলেন এবং মুসলিমদের ইবাদত ও আচার- আচরণের বিষয়ে অনেক বেশি প্রথাগত ছিলেন। অন্য শ্রেণিটি ছিল সুফি মরমী সাধক বা ফকির। এই দলটি ছিল অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অন্য ধর্মের ঐতিহ্যগুলির প্রতি প্রায় ক্ষেত্রেই সহনশীল ছিলেন। যদিও শরিয়া অনুশীলনের প্রতি প্রতিশ্রুতি সুফিবাদের একটি ভিত্তি, এই অঞ্চলের প্রথম দিককার সুফিরা ভারতে সেবা কাজের মাধ্যমে প্রচার এবং দরিদ্রদের সাহায্য করার উপর মনোনিবেশ করেন।

দিল্লি সলতানাতের সময়, সুফিবাদের উদীয়মান মরমী দৃষ্টিভঙ্গি মাদ্রাসা শিক্ষার বা প্রথাগত পাণ্ডিত্যের বিকল্প ছিল না।[৩১] সুফিবাদের শিক্ষা কেবল মাদ্রাসা শিক্ষার ভিত্তির উপর নির্মিত হয়েছিল। সুফিবাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি কেবল "ঈশ্বরীয় চেতনার উন্নতি, ধর্মভীরুতা বৃদ্ধিকরণ এবং মানবতাবাদী মনোভাবের শিক্ষা, স্রষ্ঠারস্বরুপ উন্মোচন, স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ" বিষয়ক জ্ঞান অর্জনকে উৎসাহিত করে।[৩১]

সুফি খানকাহ

ভারতে ইসলাম আরও বেশি জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল খানকাহের প্রতিষ্ঠা। খানকাহ (এছাড়াও খানেগাহ বা খানেকাহ (যেমন বর্ণান্তরিত ফার্সি: خانقاه ), এটি রিবাট নামেও পরিচিত ( رباط ) - অন্যান্য পরিভাষার মাঝে - এটি এমন একটি একটি ভবন বা দালান যা বিশেষত একদল সুফি সম্প্রদায় বা তরিকা জমায়েতের জন্য ডিজাইন করা এবং এটি আধ্যাত্মিক দীক্ষা এবং চারিত্রিক দিক সংস্কারের জন্য একটি জায়গা।[১৫][২৪] অতীতে এবং বর্তমানে কিছুটা কম পরিমাণে তারা সালেক (সুফি ভ্রমণকারী), মুরিদ (দীক্ষিত) এবং তালিবদের (ইসলামী শিক্ষার্থীদের) আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহার করত।[২১][২৩] খানকাহগুলি বেশিরভাগ সময়ে দরগাহ (সুফি সাধুদের মাজার), মসজিদ এবং মাদ্রাসা (ইসলামী বিদ্যালয়) এর সাথে সংযুক্ত থাকে। যদিও কিছু খানকাহ প্রতিষ্ঠা রাজকীয় অর্থায়ন বা পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে ছিল, অনেকগুলোই তাদের পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের জন্য ওয়াকফ এবং দাতাদের অনুদান পেতো।[১৫][৩২] সময়ের সাথে সাথে, সুফিবাদ ভারতে দৃঢ় হওয়ার সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী সুফি খানকাহের কার্যক্রমও বিবর্তিত হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে, সুফি খানকাহে পীর-মুরিদ এবং তাদের ভক্তদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ এবং ফলপ্রসূ সম্পর্কের উপর জোর দিত।[৩১] উদাহরণস্বরূপ, খানকাহের ভক্তরা একসাথে ইবাদত, জিকির করতেন, গবেষণা করতেন এবং সাহিত্য পড়তেন।[৩৩] মাদ্রাসায় শেখানো ফিকাহ এবং ধর্মতাত্ত্বিক কাজের পাশাপাশি সুফি সাহিত্যে একাডেমিক বিষয়ে আরা গভীর ও সুক্ষ্ম আলোচনা করা হয়।[৩১] দক্ষিণ এশিয়ায় আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান বিষয়ে গবেষণা করা হত: তাজকিরা বা পীরের জীবনীরচনা, পীরের বাণী এবং মুরশিদের চিঠিপত্র।[৩১] এছাড়াও, সুফিরা ইসলামের বিভিন্ন নির্দেশিকাও অধ্যয়ন করতেন যা ইসলামিক শিষ্টাচার (আদব) সম্পর্কিত ছিল। আসলে, পারস্যের সুফি সাধক নাজম আল-দীন রাজীর লেখা "পাথ অফ গড'স বন্ডসম্যান ফ্রম অরিজিন টু রিটার্ন" নামক গ্রন্থটি লেখকের জীবদ্দশায়ই ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।[২৪] এই বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ভারতেও সুফি চিন্তাধারা অধ্যয়নের জন্য ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এমনকি আজও সংরক্ষিত মরমী সাহিত্য সুফি মুসলমানদের ধর্মীয় এবং সামাজিক ইতিহাসের অমূল্য উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।[৩১]

খানকাহের আরেকটি প্রধান কাজ ছিল একটি কমিউনিটি শেল্টার বা আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করা।[২৩] ভারতে চিশতিয়া তরিকার সুফিরা সর্বোচ্চ বিনম্র আতিথেয়তা এবং উদারতার সাথে খানকাহগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।[৩৪] "অতিথি স্বাগত" নীতিকে বজায় রেখে, ভারতের খানকাহগুলো সকলের জন্য উন্মুক্ত আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা, মানসিক সহায়তা এবং পরামর্শ প্রদান করতো।[১৫][২১] আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষুধার্ত এবং হতাশাগ্রস্ত সদস্যদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করত এবং প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হতো।[২৩] এইভাবে, সুফিরা তাদের ভালবাসা, আধ্যাত্মিকতা এবং ঐক্যের শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে বর্ণবাদী সমাজে সমতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এই সুফি ভ্রাতৃত্ব এবং সাম্যের উদাহরণই মানুষকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছিল।[২৩] অল্প সময়ের মধ্যেই এই খানকাহগুলো সমস্ত জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গের মানুষের জন্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।[১৫][৩৫] খানকাহের সেবার মাধ্যমে, সুফিরা এমন এক ধরনের ইসলাম উপস্থাপন করেছিলেন যা নিম্নবর্ণের হিন্দুস্তানিদের মধ্যে স্বেচ্ছায় ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরের পথ তৈরি করেছিল।[৩৬]

অটোমান সাম্রাজ্যে ভারতীয় সুফি খানকাহ

১৪শ থেকে ১৯শ শতাব্দী পর্যন্ত, ভারত থেকে মুসলিম দরবেশরা উসমানীয় সাম্রাজ্যে আসেন এবং সাম্রাজ্যের বড় বড় শহরগুলোতে সুফি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। উসমানীয় তুর্কি ভাষায় এই খানকাহগুলোকে বলা হতো 'হিন্দি তেক্কেলর'। ইস্তাম্বুলের হোরহোর তেক্কে হল সবচেয়ে পুরনো হিন্দি তেক্কে। ইস্তাম্বুলে তাদের বংশধরদের বলা হয় 'হিন্দি' (হিন্দিলার), যারা তুর্কি ভাষায় কথা বলত এবং তুর্কি সংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণভাবে মিশে গিয়েছিলেন।[৩৭][৩৮][৩৯][৪০][৪১][৪২]

সুফি তরিকা

তরিকা (বা তরিকাহ; আরবি: طريقة ṭarīqah) বলতে সুফিবাদের একটি ধারা বা মতাদর্শকে বুঝায়, অথবা হাকীকত লাভের উদ্দেশ্যে এই জাতীয় ধারার নিগূঢ় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের একটি ধারণাকে বুঝায়।

তরিকাতে একজন মুর্শিদ বা পীর বা ইমাম থাকেন যিনি আধ্যাত্মিক নেতার ভূমিকা পালন করেন। তরিকার অনুসারীদেরকে মুরিদ বলা হয়। মুরিদ বা ভক্তরা পীরের দরবারে আসেন তাদের আর্শীবাদের জন্য এবং স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য দীক্ষা গ্রহণ করতে।

১৮৬০ এর দশকে পূর্ব বাংলার একজন মাদারিয়া ফকির

মাদারিয়া

মাদারিয়া তরিকা উত্তর ভারত, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, মেওয়াত অঞ্চল, বিহার, গুজরাতপশ্চ৮িমবঙ্গে জনপ্রিয় এবং একইসাথে নেপালেবাংলাদেশেও জনপ্রিয় সুফি তরিকা, যা প্রচলিত প্রথা ভাঙা, বাহ্যিক ধর্মীয় অনুশীলনের উপর শিথীলতা এবং আত্ম যিকিরের উপর জোর প্রয়োগের করনে সুপরিচিত। এটি প্রখ্যাত সুফি সাধক সৈয়দ বদিউদ্দীন জিন্দা শাহ মাদার (ওফাত ১৪৩৩খ্রি:) কর্তৃক প্রবর্তিত সূফি তরিকা এবং উত্তরপ্রদেশের কানপুর জেলার মকানপুরে তার মাজার কেন্দ্রিক পরিচালিত তরিকা। ভারত থেকে হজ্বে গিয়ে পুনরায় তিনি তেরো শতকে আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনাণী সহ ভারতে আগমন করেন।[৪৩]

শাহ মাদার সর্ব প্রথম ভারতের গুজরাটে আসেন ২৮২হিজরী সনে । এবং তার ৫৯৬ বছর হায়াতের জীবনে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করেন। এবং সর্বশেষ মাকানপুরে মৃত্যুবরণ করেন।

কাদেরিয়া

আবদুল কাদের জিলানীর সমাধি

কাদেরিয়া (আরবি: القادريه) হল একটি সুফি তরিকাআবদুল কাদের জিলানির নাম থেকে এই তরিকার নামকরণ করা হয়েছে। এর বেশ কিছু শাখা রয়েছে। আরবভাষী অঞ্চলসহ তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বলকান, ফিলিস্তিন, চীন,[৪৪] পূর্বপশ্চিম আফ্রিকাতে এর বিস্তার রয়েছে।[৪৫] তরিকাটি সুন্নি ইসলামী আইনের মৌলিক বিষয়গুলি মেনে চলার উপর দৃঢ়ভাবে নির্ভর করে থাকে বলে জানা গেছে।

পশ্চিম ভারতে কাদিরিয়ার প্রসারে সুলতান বাহু অবদান রেখেছিলেন। তিনি নিজের লেখার মাধ্যমে এ তরিকাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।[৪৬] তিনি যিকিরের পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছিলেন এবং জোর দিয়েছিলেন যে সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছানোর উপায় তপস্বী বা অত্যধিক বা দীর্ঘ প্রার্থনার মাধ্যমে নয় বরং সৃষ্টিকর্তাকে নিঃস্বার্থে ভালবাসার মাধ্যমে অর্জিত হয়, একে তিনি ফানা বলে অভিহিত করেন।

রায্যাক্বীয়্যাহ্ তরিকা

রায্যাক্বীয়্যাহ্ তরিকা পৃথিবীর প্রাচীনতম সুফি তরিকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। রায্যাক্ব আলী গিলানীর (১০৯৩-১২০৮খৃঃ) নাম থেকে এই তরিকার নামকরণ করা হয়েছে। গিলন ইরানের একটি প্রদেশের নাম এবং এর অধিবাসীদের গিলানী বলা হয়ে থাকে। এই তরিকা ইসলামি বিশ্বে সর্বাধিক বিস্তৃততম সুফি তরিকাগুলো একটি এবং মধ্য এশিয়া, হিন্দুস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে এই তরিকার অনুসারী রয়েছে। অনেকেই এই তরিকাকে "জালালী" তরিকা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, কারণ এই তরিকায় জিকির (স্রষ্ঠাকে স্মরণ করা) জালালতভাবে করা হয়ে থাকে যদিও অন্যান্য তরিকাগুলোতে উচ্চস্বরে বা হালকা উচ্চস্বরে জিকির করা হয়ে থাকে।

শাযিলিয়া

মাদুরাই মাকবারা, যা ভারতের মাদুরাই শহরে অবস্থিত শাযিলিয়া সুফিদের সমাধি।

শাযিলিয়া তরিকা হল আবুল-হাসান-আশ-শাযিলি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সুফি তরিকা। এই তরিকার মুরিদরা (অনুসারী) প্রায়শ শাযূলিয়া নামে পরিচিত। ফাসিয়া তরিকা, শাযিলিয়া তরিকার একটি শাখা, মক্কার ইমাম আল ফাসি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই তরিকার অসংখ্য অনুসারী সৌদি আরব, মিশর, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে রয়েছে।

এটি ভারতে আনা হয়েছিল কায়ালপট্টনমের শেখ আবুবকর মিসকিন সাহিব রাযি এবং মাদুরাইয়ের শেখ মীর আহমদ ইব্রাহিম রাযি দ্বারা। মীর আহমদ ইব্রাহিম হলেন মাদুরাই মাকবারায় চর্চিত তিনজন সুফি সাধকদের মধ্যে প্রথমজন। শাযিলিয়ার ৭০ টিরও বেশি শাখার মধ্যে ফাসিয়াতুশ শাযিলিয়া হল সবচেয়ে ব্যাপকভাবে অনুশীলিত তরিকা।[৪৭]

চিশতিয়া

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সমাধি (ডানে) এবং জামাত খানা মসজিদ (পটভূমিতে), নিজামুদ্দিন দরগাহ কমপ্লেক্সে, পশ্চিম দিল্লিতে
ভারতের আজমীরে মইনুদ্দিন চিশতীর দরগাহ

চিশতিয়া তরিকা মধ্য এশিয়াপারস্য থেকে উদ্ভূত হয়। এই তরিকার প্রথম সুফি ছিলেন আবু ইসহাক শামী (৯৪০-৪১) যিনি আফগানিস্তানের চিশত-ই-শরিফে চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৪৮] চিশতিয়ার প্রসার ঘটে ভারতের বিখ্যাত সুফি মইনুদ্দিন চিশতির (ওফাত ১২৩৬) মাধ্যমে, যিনি ভারতে এই তরিকার প্রচার করেন এবং এটি ভারতের বৃহত্তম সুফি তরিকাগুলোর একটি হয়ে ওঠে।[৪৯] গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে তিনি আংশিকভাবে আবু নাজিব সোহরাওয়ার্দীয়ার শিষ্য ছিলেন।.[৫০] খাজা মইনুদ্দিন চিশতি মূলত সিস্তান (পূর্ব ইরান, দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তান) থেকে এসেছিলেন এবং মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যদক্ষিণ এশিয়ার অনেক জায়গায় ভ্রমণকারী একজন পণ্ডিত ছিলেন।[৫১] তিনি ১১৯৩ সালে দিল্লিতে পৌঁছান এবং ঘুরিদের শাসনের শেষের দিকে রাজস্থানের আজমির এ স্থায়ী হন। মইনুদ্দিন চিশতির সুফি এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কার্যক্রম অজমিরকে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের ইসলামীকরণের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে অভিহিত করেছিল।[৫০]

চিশতিয়া তরিকা স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য খানকাহ তৈরি করেছিল, যার ফলে দাতব্য কার্যক্রমের মাধ্যমে ঐ অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতে ইসলাম প্রচার প্রসার বেড়েছে দরবেশদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে, রক্তপাত বা জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে নয়।[২১] তবে এটি এমন কোন কিছু বোঝায় নাই যে চিশতিয়া তরিকার অনুসারিরা ইসলামের চিরায়ত রাীতিনীতির প্রশ্নে কখনো উলামার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এমন নয়। চিশতিয়া তরিকার অনুসারিরা খানকাহ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং মানবতা, শান্তিউদারতার সরল শিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এই গোষ্ঠী আশেপাশের নিম্ন ও উচ্চ বর্ণের অসংখ্য হিন্দুকে আকর্ষণ করেছিল।[৫০] মইনুদ্দিন চিশতির বিখ্যাত মাজারে মুসলমান এবং অমুসলিম উভয়েই যান; এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন এবং তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। তৃতীয় মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর (ওফাত ১৬০৫) মইনুদ্দিন চিশতির বিখ্যাত মাজারে প্রায় জিয়ারতের উদ্দেশ্যে প্রায়ই যেতেন, যা তার প্রজাদের জন্য একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল।[৫২] খাজা মইনুদ্দিন চিশতির প্রচুর বিখ্যাত উত্তরসূরি রয়েছেন, যাদের মধ্য বিখ্যাত আটজন সুফি যাদেরকে মধ্যযুগীয় চিশতিয়া তরিকার আট বিশিষ্ট সুফি হিসাবে বিবেচিত করা হয়। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (ওফাত ১২৩৩, আজমির, ভারত), কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (ওফাত ১২৩৬, দিল্লি, ভারত), ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার (ওফাত ১২৬৫, পাকপাতান, পাকিস্তান), নিজামুদ্দিন আউলিয়া (ওফাত ১৩৩৫, দিল্লি, ভারত)[২], নাসিরউদ্দিন চিরাঘ দেহলভি[৫৩], বন্দে নেওয়াজ (ওফাত ১৪২২, গুলবার্গা, ভারত)[৫৪], সৈয়দ বকাউল্লাহ শাহ কারিমি সাফিপুর, উন্নাও (১২৬৯ হিজরি-১৩৬২ হিজরি), আখি সিরাজ আইন-এ-হিন্দ (ওফাত ১৩৫৭, বেঙ্গল, ভারত)[৫৫], আলাউল হক পাণ্ডভি,[৫৬] শাহ আবদুল্লাহ কিরমানি (খুশতিগিরি, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ), আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনানি (ওফাত ১৩৮৬, কিচাউচা, ভারত)।[৫৭]

সোহরাওয়ার্দীয়া

এই সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল-ওয়াহিদ আবু নজিব আস-সোহরাওয়ার্দী (মৃত্যু ১১৬৮)।[৫৮] তিনি মূলত আহমদ গাজ্জালীর শিষ্য ছিলেন, যিনি আবার আবু হামিদ গাজ্জালীর ছোট ভাই। আহমদ গাজ্জালীর শিক্ষা এই সিলসিলার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সিলসিলা মধ্যযুগীয় ইরানে প্রসিদ্ধ ছিল, বিশেষ করে মঙ্গোলদের আক্রমণের সময় পারস্য থেকে ভারতে অভিবাসনের পূর্বে।[২৪] তবে, এই সিলসিলাকে মূলধারায় আনতে সাহায্য করেছিলেন আবু নজিব আস-সোহরাওয়ার্দীর ভাতিজা।[৫৯] আবু হাফস উমর আস-সোহরাওয়ার্দী (মৃত্যু ১২৪৩) সুফি তত্ত্বের উপর বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো "গিফট অফ ডিপ নলেজ: আওয়ারিফ আল-মা'আরিফ" নামক গ্রন্থটি, যা এতই জনপ্রিয় ছিল যে এটি ভারতীয় মাদ্রাসাগুলিতে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যবহৃত হতো।[৫৮] এটি সোহরাওয়ার্দীয়া সিলসিলার সুফি শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছিল। আবু হাফস তার সময়ের একজন বৈশ্বিক দূত ছিলেন। বাগদাদে শিক্ষা প্রদান থেকে শুরু করে মিশরসিরিয়ার আয়্যুবিদ শাসকদের মধ্যে কূটনীতিতে জড়িত ছিলেন আবু হাফস। ইসলামি সাম্রাজ্যের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আবু হাফসের অনুসারীরা ভারতে তার নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং সুফি সিলসিলার রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সমর্থন করেছিলেন।[৫৮]

কুবরাভিয়া

এই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবুল জানাব আহমদ, যিনি নাজমুদ্দীন কুবরা (মৃত্যু ১২২১) নামে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের সীমান্ত অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।[৬০] এই সুফি সাধক ছিলেন একজন বিখ্যাত শিক্ষক, যিনি তুরস্ক, ইরান এবং কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলেন। তার তরিকতমারেফাতের শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে তিনি অনেক শিষ্য গড়ে ওঠেন, যারা নিজেরাই পরবর্তীকালে তার থেকে খেলাফত প্রাপ্তি মাধ্যম সুফি সাধক হন।[২৪]

এই সিলসিলা ১৪শ শতাব্দীর শেষের দিকে কাশ্মীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।[৬১] কুবরা এবং তার ছাত্ররা সুফি সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তারা মরমী লেখা, মরমী মনস্তত্ত্ব, এবং নির্দেশমূলক সাহিত্যের ক্ষেত্রে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যেমন "আল-উসুল আল-আশারা" এবং "মিরসাদ উল ইবাদ"।[৬২] এই জনপ্রিয় গ্রন্থগুলো আজও ভারত এবং অন্যান্য স্থানে সুফি অনুসারীদের মধ্যে অত্যন্ত পছন্দের এবং অধ্যয়নে ব্যবহৃত হয়। কুবরাভিয়া সিলসিলা এখনও কাশ্মীর-ভারত এবং চীনের হুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমান।[২৪]

নকশবন্দি

আহমদ সিরহিন্দীর সমাধি (১৫৬৪–১৬২৪) যিনি নকশবন্দি তরিকার একজন বিশিষ্ট সদস্য।

এই সিলসিলার উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় খাজা আবু ইয়াকুব ইউসুফ হামদানি (মৃত্যু ১৩৯০) থেকে, যিনি মধ্য এশিয়ার ইরানের হামাদান প্রদেশের বুজানজিড়ে জন্মগ্রহণ করেন করতেন।[২৪][৬৩] পরবর্তীতে এই তরিকাটির সূচনা মূলত হয়েছে শায়খ বাহাউদ্দীন নকশবন্দীর মাধ্যমে।[২৪] তাকে সাধারণত নকশবন্দি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খাজা মুহাম্মদ আল-বাকি বিল্লাহ বেরাং (মৃত্যু ১৬০৩) নকশবন্দিয়া সিলসিলাকে ভারতে পরিচয় করিয়ে দেন।[২৪][৪৯] এই সিলসিলা মুঘল সাম্রাজ্যের অভিজাতদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল, কারণ এর প্রতিষ্ঠাতা খাজা আল-হামাদানির সঙ্গে বংশগত সম্পর্ক ছিল।[৬৪] [৬৫]

১৫২৬ সালে দিল্লি সালতানাত জয় করার আগে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ইতিমধ্যেই নকশবন্দি সিলসিলায় দীক্ষিত হয়েছিলেন। এই রাজকীয় সম্পর্ক সিলসিলার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।[৩][১৭] এই সিলসিলাকে সুফি সিলসিলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সর্বজনগৃহীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মুজাদ্দিদিয়া

মুজাদ্দিদিয়া তরিকা মুজাদ্দিদে আলফে সানি খ্যাত আহমেদ সিরহিন্দি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি সুফি তরিকা। এটি নকশবন্দি তরিকা থেকে উদ্ভুত হয়েছে। এ তরিকায় সুফিবাদে প্রচলিত গজল, কাওয়ালী ও সামা শুনা নিষিদ্ধ। আহমেদ সিরহিন্দির খলিফাদের নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান ইতিহাসে উল্লেখ নেই। তবে তিনি উপমহাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে খলিফাগণের প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। তার অন্যতম দুজন খলিফা যাদের মাধ্যমে মুজাদ্দিদিয়া সিলসিলার প্রসিদ্ধি পেয়েছে এবং ভারতবর্ষে সূলুক, তরবিয়াত দ্বারা জনসাধারণের ঈমান-আকিদা পরিশুদ্ধ করেছেন তারা হলেন; খাজা মাসুমআদম হুসাইনী বানুরী। তারা মাসুমিয়্যা সিলসিলা ও আহসানিয়া’ সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা। এ তরিকার বিশ্বব্যাপী প্রচার-প্রসার হয়েছে শাহ গুলাম আলী বাটালভীর মাধ্যমে। ভারতবর্ষের এমন কোন শহর ছিলো না যেখানে তার মুরিদ ছিলো না। কেবল আম্বালা শহরে তার পঞ্চাশ জন খলিফা ছিলো। এ তরিকার অন্যতম সিলসিলা আহসানিয়া, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, শাহ আবদুল আজিজ এবং তার থেকে সৈয়দ আহমদ বেরলভিমিয়াজি নূর মুহাম্মদ খেলাফত প্রাপ্ত হোন।[৬৬][৬৭]

সরওয়ারী কাদেরিয়া

সরওয়ারী কাদেরিয়া সিলসিলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুলতান বাহু দ্বারা, যা কাদেরিয়া সিলসিলার একটি শাখা। এই সিলসিলা মূলত কাদেরিয়া সিলসিলার পথ অনুসরণ করে, তবে বেশিরভাগ সুফি সিলসিলার মতো নির্দিষ্ট পোশাক বিধি, নির্জনতা, বা অন্যান্য দীর্ঘ সময় ধরে চলা সাধনা এরা অনুসরণ করে না। এর মূলধারার দর্শন সরাসরি ক্বলবের সাথে সম্পর্কিত এবং আল্লাহর নামের উপর ধ্যান করা, অর্থাৎ, الله (আল্লাহ) শব্দটিকে নিজের ক্বলবে ধারণ করে তার উপর ধ্যান করা।[৬৮]

ফিরদৌসিয়া

ফিরদৌসী বা ফিরদৌসিয়া সিলসিলা হল সোহরাওয়ার্দীয়া সিলসিলার একটি শাখা। এটি শেখ বদরুদ্দিন সামারকান্দি দ্বারা শুরু হয়েছিল, তবে এটি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করে শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরির সময়কালে।[৬৯] এই সিলসিলা মূলত বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের এলাকায় প্রসার লাভ করে।

বারকাতিয়া

বারকাতিয়া সিলসিলা হল কাদেরিয়া সিলসিলার একটি শাখা, যা প্রায়শই কাদেরি-বারকাতি নামে লেখা হয়। এটি উত্তর প্রদেশের মারেহারার শাহ বারকাতুল্লাহ মারেহারবি দ্বারা শুরু হয়েছিল।[৭০]

সুফি সংস্কৃতি

সমন্বয়ী মরমীবাদ

মধ্যযুগীয় ভারতে আধ্যাত্মিকতা কেবল ইসলাম এবং সুফিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ভক্তি আন্দোলন, যা হিন্দু ধর্মের একটি ভক্তিমূলক পুনর্জাগরণ, এই অঞ্চলে আধ্যাত্মিক অনুশীলনগুলি ছড়িয়ে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।.[৭১] ৭ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ ভারতে উদ্ভূত হওয়া এই আন্দোলনটি ভক্তিমূলক উপাসনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল এবং ভক্তদের সঙ্গে তাদের দেব-দেবীর মধ্যে আবেগময় সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছিল, যা প্রায়ই গানকবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হতো।[৭১] এই আন্দোলনটি আঞ্চলিক ভাষা, ভৌগোলিক এলাকা এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে একত্রিত করেছিল, যা এটিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।

ভক্তি আন্দোলনের ধর্মতাত্ত্বিক ধারণাগুলির সাথে সুফিবাদের দর্শনের উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য ছিল, যা হিন্দুমুসলিম অনুশীলনের মধ্যে পার্থক্যকে ম্লান করে দিয়েছিল। উভয় ঐতিহ্যই একটি গভীর, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর জোর দেয় এবং পার্থিব জগতের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। ভক্তি দর্শন, ঠিক যেমন সুফি শিক্ষা, মনে করত যে এই জগৎ একটি মায়া এবং উচ্চতর বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য অপরিহার্য (হিন্দুধর্মে মোক্ষ, যা সুফি ধারণার আখিরাত বা পরকালের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ)।[৭২]

সুফিবাদ দিল্লি সুলতানাতের আফগান শাসকদের বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের সঙ্গে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক একীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সুফি সাধুরা, যারা অমুসলিমদের প্রতি সহনশীল একীভূত সংস্কৃতির প্রচার করেছিল, একটি স্থিতিশীল সমাজের বিকাশে অবদান রেখেছিল যা আঞ্চলিক সাহিত্য এবং ভক্তিমূলক সঙ্গীতে সমৃদ্ধ ছিল। এই ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ভারতে একটি অনন্য মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটিয়েছিল।[৭৩]

সপ্তদশ শতাব্দীতে সুফি সাধক সাইয়িদ মুহাম্মদ গউস গওয়ালিওরি সুফি সম্প্রদায়ের মধ্যে মোরাকাবা মোশাহেদার (ধ্যান) অনুশীলন জনপ্রিয় করেছিলেন, যা সুফিবাদ ও হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মধ্যে আরও সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিল।[৭৪] এছাড়াও, একেশ্বরবাদের ওপর গুরুত্বারোপকারী ভক্তি আন্দোলনের সাহিত্য ঐতিহাসিকভাবে একত্রীকৃত সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।

যদিও এই ঐতিহাসিক সংমিশ্রণ থাকা সত্ত্বেও, ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলি মাঝে মাঝে সংঘাতের সৃষ্টি করেছে, যা আজও ভারতের কিছু অংশে বিরাজমান। তবুও, এই সংমিশ্রিত আধ্যাত্মিকতার উত্তরাধিকার এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ, আন্তঃসংযুক্ত আধ্যাত্মিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।[৭৩]

আচার

সুফিবাদের অন্যতম জনপ্রিয় আচার হল সুফি সাধুদের মাজার পরিদর্শন যাকে সুফিবাদের ভাষায় জিয়ারত বলা হয়ে থাকে। মাজারগুলো ধীরে ধীরে সুফি দরগাহে রূপান্তরিত হয়েছে এবং ভারতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এগুলোর ব্যাপকতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যে কোনও পবিত্র স্থান পরিদর্শন করার আচারকে বলা হয় "জিয়ারত"। এর সবচেয়ে প্রচলিত উদাহরণ হল সৌদি আরবের মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা, মসজিদে নববী পরিদর্শন করা।[৭৫]

একজন সুফি সাধকের মাজার একটি অত্যন্ত সম্মানীয় স্থান, যেখানে কিছু মানুষের বিশ্বাস মতে, বরকত বা আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ মৃত পবিত্র ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে থাকে এবং এটি জিয়ারতকারী ভক্তদের জন্য উপকারে আসে। সুফি সাধুদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য রাজা ও অভিজাতরা বড় বড় দান বা ওয়াকফ প্রদান করতেন, যা মাজারগুলিকে সংরক্ষণ এবং স্থাপত্যগতভাবে সংস্কার করতে সাহায্য করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই দান, আচার এবং বার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানগুলি (উরস) গৃহীত নিয়মের একটি বিস্তৃত ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল।[৭৬]

এই ধরনের সুফি অনুশীলন নির্দিষ্ট তারিখগুলিতে মাজারের চারপাশে আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।[৭৭] যদিও অনেক কট্টরপন্থী ইসলামীরা এই মাজার জিয়ারত এবং সুফি সাধুদের কাছ থেকে বরকত পাওয়ার প্রত্যাশাকে নিন্দা (শিরক) করে থাকে, তবুও এই আচারগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে আছে এবং এখনও শক্তভাবে টিকে আছে।[৭৭]

বাদ্যযন্ত্রের প্রভাব

ভারতীয় সব ধর্মেই সঙ্গীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সবসময়ই উপস্থিত ছিল।[৭৮] চিন্তা ও দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে, সঙ্গীত প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভারতের শ্রোতারা ইতোমধ্যেই স্থানীয় ভাষায় ভক্তিগীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এই কারণে সুফি ভক্তিগীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে তৎক্ষণাৎ সাফল্য অর্জন করে। সুফি আদর্শ সঙ্গীতের মাধ্যমে খুব সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। সুফিবাদে, সঙ্গীতকে "সামা -সুফিদের একটি আচার অনুষ্ঠান, যা জিকির নামক ধ্যান ও প্রার্থনার অংশ হিসেবে পালন করা হয়" বা সাহিত্যের শ্রবণ বলা হয়। এখানে কবিতা বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গাওয়া হত; এই আচার প্রায়ই সুফিদের আধ্যাত্মিক উন্মত্ততায় নিয়ে যেত। সাদা পোশাকে আবৃত ঘূর্ণায়মান দরবেশদের চিত্রটি "সামা"র সঙ্গে মিলে যায়।[৭৮]

অনেক সুফি প্রথায় শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কবিতা ও সঙ্গীতকে উৎসাহিত করা হয়। সুফিবাদের শিক্ষা ও দর্শন জনপ্রিয় কাওয়ালি সঙ্গীতের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৃহৎ জনগণের কাছে পৌঁছায়। মহিলারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন; মহিলারা তাদের সমাবেশে সুফি গান গাইতেন।[৩৩] বর্তমানে সুফি গানের সমাবেশগুলি "কাওয়ালি" নামে পরিচিত। সঙ্গীতের সুফি ঐতিহ্যে সবচেয়ে বড় অবদানকারীদের একজন হলেন আমির খসরু (মৃত্যু ১৩২৫)। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য হিসেবে পরিচিত আমির খসরু প্রাচীন মুসলিম যুগের ভারতের সবচেয়ে প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী ও কবি হিসেবে পরিচিত। তাকে ভারতীয়-মুসলিম ভক্তিমূলক সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। "ভারতের তোতা" নামে পরিচিত আমির খসরু এই উদীয়মান জনপ্রিয় সুফি সংস্কৃতির মাধ্যমে চিশতিয়া তরিকাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান।[৭৮]

সুফিবাদের প্রভাব

গুলের একটি চিত্রে কল্পনাপ্রসূত একটি বৈঠকে উপস্থিত সুফি সাধকদের চিত্রায়ণ করা হয়েছে। নিচ থেকে বাঁ দিকে ঘড়ির কাঁটার দিকে ক্রমানুসারে উপস্থিত সুফিরা হলেন: বাবা ফরিদ, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, মইনুদ্দিন চিশতী, হযরত দস্তগির, বু আলী শাহ কালান্দার এবং নিজামুদ্দিন আউলিয়া

ভারতে ইসলামের ব্যাপক ভৌগোলিক উপস্থিতির কারণ হিসেবে সুফি প্রচারকদের অক্লান্ত পরিশ্রম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[৭৯] সুফিবাদ দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। সুফি সাধুরা ইসলামের এই আধ্যাত্মিক রূপটি প্রবর্তন করেন।[৮০] বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সুফি পণ্ডিতরা ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।[৮১][৮২]

প্রধান শহর এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রগুলিতে সুফিবাদের প্রচার ছাড়াও, সুফিরা গ্রামীণ দরিদ্র এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে স্থানীয় উপভাষায়, যেমন উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি ভাষায় ধর্ম প্রচার করেন, যা ফারসি, তুর্কি এবং আরবির বিপরীতে ছিল।.[৭৯] সুফিবাদ "নৈতিক এবং সামগ্রিক সামাজিক-ধর্মীয় শক্তি" হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, যা হিন্দুধর্মের মতো অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।[৮৩][৮৪]

সুফিদের ভক্তিমূলক চর্চা এবং সরল জীবনের ঐতিহ্য সব শ্রেণীর মানুষের আকর্ষণ ছিল। মানবতা, আল্লাহ এবং নবীর প্রতি ভালোবাসার তাদের শিক্ষা আজও আধ্যাত্মিক গল্প এবং লোকগানে পাওয়া যায়।.[৭৯] সুফিরা ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত থেকে দৃঢ়ভাবে বিরত ছিলেন এবং শান্তিপূর্ণ সমাজের অংশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।[৮২] তাদের চারিত্রিক মাধুর্য, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, ধর্মনিষ্ঠতা এবং ব্যক্তিত্বের কারণে সুফিবাদ আজও ভারতে আধ্যাত্মিক ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

আরো দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Jafri, Saiyid I Zaheer Husain (২০০৬)। The Islamic Path: Sufism, Politics, and society in India.। Konrad Adenauer Foundation। 
  2. Schimmel, p.346
  3. Schimmel, Anniemarie (১৯৭৫)। "Sufism in Indo-Pakistan"। Mystical Dimensions of Islam। University of North Carolina Press। পৃষ্ঠা 345 
  4. Walsh, Judith E. (২০০৬)। A Brief History of India। State University of New York। পৃষ্ঠা 58। 
  5. Jafri, Saiyid Zaheer Husain (২০০৬)। The Islamic Path: Sufism, Politics, and Society in India। Konrad Adenauer Foundation। পৃষ্ঠা 4। 
  6. Zargar, Cyrus Ali। "Introduction to Islamic Mysticism"। 
  7. Holt, Peter Malcolm; Ann K. S. Lambton (১৯৭৭)। The Cambridge History of Islam। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 2303। আইএসবিএন 978-0-521-29135-4 
  8. Schimmel, Anniemarie (১৯৭৫)। "Sufism in Indo-Pakistan"। Mystical Dimensions of Islamবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। Chapel Hill: University of North Carolina। পৃষ্ঠা 344 
  9. Alvi, Sajida Sultana (২০১২)। Perspectives on Mughal India: Rulers, Historians, Ulama, and Sufis। Karachi: Oxford University Press। 
  10. Morgan, Michael Hamilton (২০০৭)। Lost History: The Enduring Legacy of Muslim Scientists, Thinkers, Artists। Washington D.C.: National Geographic। পৃষ্ঠা 76 
  11. Walsh, Judith E. (২০০৬)। A Brief History of India। Old Westbury: State University of New York। 
  12. Dr. Cyrus Ali Zargar
  13. Walsh, Judith E. (২০০৬)। A Brief History of India। Old Wesbury: State University of New York। পৃষ্ঠা 59। 
  14. Walsh p. 56
  15. Alvi
  16. Schimmel p. 344
  17. Walsh
  18. Alvi 46
  19. Alvi 10
  20. Alvi 9
  21. Schimmel 345
  22. Morgan 78
  23. Aquil
  24. Zargar
  25. morgan77
  26. Aquil 9
  27. Aquil 11
  28. Aquil 13
  29. Alvi 11
  30. Alvi 12
  31. Alvi 14
  32. Schimmel
  33. Schimmel 347
  34. Schimmel 232
  35. Schimmel 231
  36. Aquil 16
  37. Osmanlı Devleti'nde Hindî Tekkeleri (Indian Dervish Lodges in Ottoman State) ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১২ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে
  38. "India and Türkiye: Thread of sufism binds two great countries"। ২ সেপ্টেম্বর ২০২২। 
  39. "India-Turkey: Bound together by Sufi connection | Opinion"Daily Sabah। ১৬ ডিসেম্বর ২০২১। 
  40. Choudhury, Rishad (২০১৬)। "The Hajj and the Hindi: The ascent of the Indian Sufi lodge in the Ottoman empire"Modern Asian Studies50 (6): 1888–1931। এসটুসিআইডি 148184698জেস্টোর 44158302ডিওআই:10.1017/S0026749X15000530 
  41. "Horhor Hindiler Tekkesi Tarihçesi, Özellikleri, Hakkında Bilgi – Sosyolojisi.com"। মে ২৮, ২০১৮। জুন ২৭, ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ৮, ২০২৪ 
  42. ""Hindis" in Istanbul: Field Notes on the Making of an Archival Subject" 
  43. 'Hayate Makhdoom Syed Ashraf Jahangir Semnani(1975), Second Edition(2017)
  44. Gladney, Dru. "Muslim Tombs and Ethnic Folklore: Charters for Hui Identity"[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] Journal of Asian Studies, August 1987, Vol. 46 (3): 495-532; pp. 48-49 in the PDF file.
  45. Abun-Nasr, Jamil M. "The Special Sufi Paths (Taqiras)." Muslim Communities of Grace: The Sufi Brotherhoods in Islamic Religious Life. New York: Columbia UP, 2007. 86-96.
  46. Cuthbert, Mercy (২০২২-০৬-১৪)। "Qadiriyya Tariqa | Founder, History, Beliefs and More"World Religions (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-০৫ 
  47. "Fassiyathush Shazumliya | tariqathush Shazuliya | Tariqa Shazuliya | Sufi Path | Sufism | Zikrs | Avradhs | Daily Wirdh | Thareeqush shukr |Kaleefa's of the tariqa | Sheikh Fassy | Ya Fassy | Sijl | Humaisara | Muridheens | Prostitute Entering Paradise"। Shazuli.com। ২০২০-০১-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৭-১০ 
  48. Durán, Khalid; Reuven Firestone; Abdelwahab Hechiche। Children of Abraham: An Introduction to Islam for Jews। Harriet and Robert Heilbrunn Institute for International Interreligious Understanding, American Jewish Committee। পৃষ্ঠা 204। 
  49. Alvi 13
  50. Schimmel 346
  51. Aquil 6
  52. Walsh 80
  53. Aquil 8
  54. Askari, Syed Hasan, Tazkira-i Murshidi—Rare Malfuz of the 15th-Century Sufi Saint of Gulbarga. Proceedings of the Indian Historical Records Commission (1952)
  55. 'Akhbarul Akhyar' By Abdal Haqq Muhaddith Dehlwi (d. 1052H/1642 CE). A short biography of the prominent sufis of India have been mentioned in this book including that of Akhi Siraj Aainae Hind)
  56. 'Akhbarul Akhyar' By Abdal Haqq Muhaddith Dehlwi (d. 1052H/1642 CE). A short biography of the prominent sufis of India have been mentioned in this book including that of Alaul Haq Pandavi
  57. Ashraf, Syed Waheed, Hayate Syed Ashraf Jahangir Semnani, Published 1975, India
  58. Schimmel 245
  59. Zargar, Schimmel
  60. Schimmel 254
  61. Schimmel 255
  62. Schimmel 256, Zargar
  63. Lal, Mohan। Encyclopædia of Indian literature5। পৃষ্ঠা 4203। 
  64. Ohtsuka, Kazuo। "Sufism"OxfordIslamicStudies.com। জুন ৩, ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০২-১১ 
  65. Alvi 15
  66. "মুজাদ্দিদিয়া তরীকা - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৬-২৫ 
  67. "ভারতবর্ষে নকশবন্দিয়া সিলসিলার ইতিহাস"Jugantor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৬-২৫ 
  68. Sult̤ān Bāhū, Jamal J. Elias (১৯৯৮)। Death Before Dying: The Sufi Poems of Sultan Bahu। University of California Press। আইএসবিএন 978-0-520-92046-0 =
  69. Khan, Maksud Ahmad। Firdausi Silsilah During Sultanate Period (গবেষণাপত্র)। Aligarh Muslim University। 
  70. Lanzillo, Amanda (২০২৪-০১-২৩)। Pious Labor: Islam, Artisanship, and Technology in Colonial India (ইংরেজি ভাষায়)। Univ of California Press। পৃষ্ঠা 107। আইএসবিএন 978-0-520-39857-3 
  71. Walsh 64
  72. Walsh 66
  73. Aquil 34
  74. Aquil 35
  75. Schlemiel 238
  76. The Islamic Path: Sufism, Politics, and Society in India (2006)
  77. The Islamic Path: Sufism, Politics, and Society in India. (2006)
  78. The Islamic Path: Sufism, Politics, and Society in India p.15 (2006)
  79. Schimmel 240
  80. Tarling, Nicholas (১৯৯২)। The Cambridge History of Southeast Asia: From early times to c. 1800 (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-35505-6 
  81. "Role of Sufis in Spreading Islam"। ১১ জুলাই ২০০৮। 
  82. The Islamic Path: Sufism, Politics, and Society in India (2006) p. xi
  83. Medieval Islamic Civilization: L-Z, index By Josef W. Meri, Jere L. Bacharach|url=[১]|pg=773
  84. Cour, Ajeet; Zaheer, Noor; Khan, Refaqat Ali (২০১২)। SUFISM A CELEBRATION OF LOVE (পিডিএফ)। INDIA: FOSWAL। আইএসবিএন 978-81-88703-28-9 

গ্রন্থপঞ্জি

  • Islam, সিরাজুল (২০০৪)। সুফিজন এন্ড ভক্তিSufismআইএসবিএন 1-56518-198-0 
  • শিমেল, অ্যানেমারি (১৯৭৮)। মাইস্টিক্যাল ডাইমেনসন্স অব ইসলাম। ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা প্রেস। আইএসবিএন 0-8078-1271-4 
  • আলভি, সাজিদা সুলতানা (২০১২)। পারস্পেক্টিভস অব মোঘল ইন্ডিয়া:রোলারস, হিস্টোরিয়ানস, উলামা এন্ড সুফিস। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। 
  • একুয়িল, রাজিউদ্দিন (২০০৭)। সুফিজম, কালচার এন্ড পলিটিক্স: আফগানস এন্ড ইসলাম ইন মেডিয়েভাল নর্থ ইন্ডিয়া। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। 
  • মর্গান, মাইকেল হ্যামিলটন (২০০৭)। লস্ট হিস্টোরি: দি এন্ডুয়েরিং লিগ্যাসি অব মুসলিম সাইয়েন্টিস, থিংক্যারস, আর্টিস্টস। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। আইএসবিএন 9781426202803 
  • ওয়ালস, জুডিথ ই। (২০০৬)। এ ব্রিফ হিস্টোরি অব ইন্ডিয়া। নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি। 
  • শিমেল, অ্যানেমারি (১৯৭৫)। "Sufism in Indo-Pakistan"। মাইস্টিক্যাল ডাইমেনসন্স অব ইসলাম। University of North Carolina Press। 
  • Schimmel, Anniemarie (১৯৭৫)। "সুফি অর্ডারস এন্ড ফ্রেটারনিটিস"। Mystical Dimensions of Islam। ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা প্রেস। 
  • দি ইসলামিক পাথ: সুফিজম, পলিটিক্স এন্ড সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া। কনরাড অ্যাডেনাউয়ার ফাউন্ডেশন। ২০০৬। 
  • জারগার, সাইরাস আলী (২০১৩)। "রিলিজিয়ন ৩৭৯: ইসলামিক মাইস্টিসিজম"। অগাস্টানা কলেজ 
  • সেলস, মাইকেল এ. (১৯৯৬)। প্রাথমিক ইসলামিক রহস্যবাদ: সুফি, কোরান, মি'রাজ, কাব্যিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক লেখা। পলিস্ট প্রেস। 
  • আবিদি, এস এ এইচ (১৯৯২)। সুফিজম ইন ইন্ডিয়া। বিশ্ব প্রকাশন। 
  • আব্বাস, শামীম বার্নি (২০০২)। দ্য ফিমেল ভয়েস ইন সুফি রিচুয়াল: ডেভোশনাল প্র্যাকটিসেস ইন পাকিস্তান অ্যান্ড ইন্ডিয়া। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস প্রেস। 
  • আনজুম, তানভীর (২০১১)। চিশতি সুফিস ইন দ্য সুলতানাত অব দিল্লি ১১৯০-১৪০০: ফ্রম রেস্ট্রেইন্ড ইন্ডিফারেন্স টু ক্যালকুলেটেড ডিফায়েন্স। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। 
  • চোপড়া, আর. এম., 'দ্য রাইজ, গ্রোথ অ্যান্ড ডিক্লাইন অফ ইন্দো-পার্সিয়ান লিটারেচার', ২০১২, ইরান কালচার হাউস, নিউ দিল্লি অ্যান্ড ইরান সোসাইটি, কলকাতা। ২য় এড. ২০১৩।
  • চোপড়া, আর. এম., 'গ্রেট সুফি পোয়েটস অফ দ্য পাঞ্জাব' (১৯৯৯), ইরান সোসাইটি, কলকাতা।
  • চোপড়া, আর. এম., 'সুফিজম' (অরিজিন, গ্রোথ, ইক্লিপস, রিসারজেন্স), ২০১৬, অনুরাধা প্রকাশন, নিউ দিল্লি।" আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৮৫০৮৩-৫২-৫

Read other articles:

Joint that interlocks blocks Joggling above a window lintel of the Damascus Gate, Jerusalem Mausoleum of Theodoric, Ravenna: joggles[1] resembling rabbets (rebates) A joggle is a joint or projection that interlocks blocks (such as a lintel's stone blocks or an arch's voussoirs). Often joggles are semicircular and knob-shaped, so joggled stones have a jigsaw- or zigzag-like pattern. Joggling can be found in pre-Frankish buildings, in Roman Spain and Roman France.[2] In Islamic ...

 

Сміттєспалювальний завод  Сміттєспалювальний завод у Вікісховищі Сміттєспалювальний завод в Мальмьо (Швеція), продуктивністю 25 тонн побутових відходів на годину Диспетчерська сміттєспалювального заводу Спалювання твердих побутових відходів в печі на рухомій реші...

 

Themis in der Rolle der Pythia prophezeit dem Aigeus einen Sohn. Attisch-rotfigurige Kylix des Kodros-Malers, um 435 v. Chr., gefunden in Vulci, heute in der Antikensammlung Berlin. Das Orakel von Delphi war eine Weissagungsstätte des antiken Griechenlands. Sie befand sich am Hang des Parnass bei der Stadt Delphi in der Landschaft Phokis. Die Kultstätte von Delphi mit dem Orakel war die wichtigste der hellenischen Welt und bestand bis in die Spätantike. Delphi galt lange Zeit sogar al...

حرب صلاة الغروب الصقلية جزء من حرب صلاة الغروب الصقلية    التاريخ وسيط property غير متوفر. بداية 1282  نهاية 1302  تعديل مصدري - تعديل   بدأت حرب صلاة الغروب الصقلية مع ثورة صلاة الغروب الصقلية على تشارلز أنجو في 1282 وانتهت بسلام كالتابيلوتا في 1302.[1][2][3] نشبت

 

У Вікіпедії є статті про інших людей із прізвищем Левчин.Рафаель ЛевчинЛевчин Рафаель Залманович Ім'я при народженні Левчин Рафаель ЗалмановичНародився 27 вересня 1946(1946-09-27)Джанкой, СРСРПомер 7 серпня 2013(2013-08-07) (66 років)Чикаго ,СШАГромадянство СРСР (1946-1970), УРСР (1970-1991), США (1...

 

National monument in Nanjing, China This article needs additional citations for verification. Please help improve this article by adding citations to reliable sources. Unsourced material may be challenged and removed.Find sources: Sun Yat-sen Mausoleum – news · newspapers · books · scholar · JSTOR (January 2014) (Learn how and when to remove this template message) Sun Yat-sen MausoleumThe main hall of the Sun Yat-sen Mausoleum.Chinese中山陵Transcrip...

Brimless cylindrical cap with a flat crown A traditional Kofia. The kofia is a brimless cylindrical cap with a flat crown, worn mainly by some men in East Africa. Description Kofia is a Somali word that means hat.[1] The kofia is a round cap with no brim and a flat crown. The traditional kofia has tiny pin holes in the cloth that allows the air to circulate.[citation needed] The kofia is worn by Somali and Swahili men in East Africa, especially in Somalia, Kenya, Uganda, Tanza...

 

1982 Indian filmKurukkante KalyanamTheatrical release posterDirected bySathyan AnthikadWritten byP. BalakrishnanProduced byRasheeda RasheedStarringSukumaran MadhaviCinematographyAnandakuttanEdited byG. VenkitaramanMusic byZero Babu Guna SinghProductioncompanyRiyas FilmsDistributed bySoori FilmsRelease date 12 November 1982 (1982-11-12) Running time120 minutesCountryIndiaLanguageMalayalam Kurukkante Kalyanam (transl. Fox's wedding) is a 1982 Indian Malayalam-language comed...

 

Long distance, multiday, off-road racing A Norwegian rally team trying to complete one of the more difficult stages of the Budapest-Bamako rally in 2014. 2017 Kalahari 1000km Desert Race Rally raid is a type of off-road motorsport event for automobiles and motorcycles. Along with shorter baja rallies, rally raid constitutes cross-country rallying. Both the Fédération Internationale de l'Automobile (FIA) and Fédération Internationale de Motocyclisme (FIM) co-organise a common World Rally-R...

1859 historical novel by Charles Dickens For other uses, see A Tale of Two Cities (disambiguation). The Golden Thread redirects here. For the 1965 Indian film, see Subarnarekha (film). You can help expand this article with text translated from the corresponding article in French. (April 2022) Click [show] for important translation instructions. View a machine-translated version of the French article. Machine translation, like DeepL or Google Translate, is a useful starting point for tran...

 

2015 embroidery artwork Magna Carta (An Embroidery)Detail of the top left of Magna Carta (An Embroidery)ArtistCornelia ParkerYear2015 (2015)TypeEmbroiderySubjectThe Magna Carta English Wikipedia article as of 15 June 2014Dimensions1.5 m × 13 m (4.9 ft × 43 ft) Documentary film on the making of Magna Carta (An Embroidery) Magna Carta (An Embroidery) is a 2015 work by English installation artist Cornelia Parker.[1] The artwork is an embro...

 

この記事は検証可能な参考文献や出典が全く示されていないか、不十分です。出典を追加して記事の信頼性向上にご協力ください。(このテンプレートの使い方)出典検索?: 機神大戦ギガンティック・フォーミュラ – ニュース · 書籍 · スカラー · CiNii · J-STAGE · NDL · dlib.jp · ジャパンサーチ · TWL(2014年7月) 機神大戦ギガン...

Esta página cita fontes, mas que não cobrem todo o conteúdo. Ajude a inserir referências. Conteúdo não verificável pode ser removido.—Encontre fontes: ABW  • CAPES  • Google (N • L • A) (Abril de 2020) Presidente da República das Seicheles President of the Republic of SeychellesPrezidan Repilik SeselPrésident de la République des Seychelles Selo Presidencial No cargoWavel Ramkalawandesde 26 de outubro de 2020 Resid...

 

Native American women's organization Part of a series onNative Americans in the United States History Paleo-Indians Lithic stage Archaic period in the Americas Formative stage Classic stage Post-Classic stage Woodland period Age of Discovery European colonization of the Americas Population history of Indigenous peoples of the Americas Slavery Slavery in the United States Partus sequitur ventrem Indian Removal Act Trail of Tears Native American slave ownership Indian Territory American Civil W...

 

Ahmadiyya by country Africa Algeria Angola Benin Botswana Burkina Faso Burundi Cameroon Cape Verde Central African Republic Chad Comoros Côte d'Ivoire DR of Congo Republic of Congo Djibouti Egypt Equatorial Guinea Eritrea Ethiopia Gabon Gambia Ghana Guinea Guinea-Bissau Kenya Lesotho Liberia Libya Madagascar Malawi Mali Mauritania Mauritius Morocco Mozambique Namibia Niger Nigeria Rwanda São Tomé and Príncipe Senegal Seychelles Sierra Leone Somalia South Africa Sudan Swaziland Tanzania To...

Disused railway station in Cilfrew, Neath Port Talbot CilfrewThe site of the station in 1990General informationLocationCilfrew, GlamorganWalesCoordinates51°41′17″N 3°46′40″W / 51.688°N 3.7779°W / 51.688; -3.7779Grid referenceSN772003Platforms1Other informationStatusDisusedHistoryOriginal companyNeath and Brecon RailwayPost-groupingGreat Western RailwayKey datesDecember 1888 (1888-12)Opened15 October 1962 (1962-10-15)ClosedLocationCi...

 

This article needs additional citations for verification. Please help improve this article by adding citations to reliable sources. Unsourced material may be challenged and removed.Find sources: Mars-class combat stores ship – news · newspapers · books · scholar · JSTOR (June 2019) (Learn how and when to remove this template message) USS Mars (AFS-1), lead ship of the class Class overview BuildersNational Steel and Shipbuilding Company Operators U...

 

Genus of spiders Parawixia Abandoned web orb-weaver (P. dehaani) in Taman Negara National Park, Malaysia Scientific classification Domain: Eukaryota Kingdom: Animalia Phylum: Arthropoda Subphylum: Chelicerata Class: Arachnida Order: Araneae Infraorder: Araneomorphae Family: Araneidae Genus: ParawixiaF. O. Pickard-Cambridge, 1904[1] Type species P. destricta(O. Pickard-Cambridge, 1889) Species 31, see text Parawixia is a genus of orb-weaver spiders first described by F. O. Pickard-Camb...

2006 video gameXiaolin ShowdownNorth American PlayStation 2 cover artDeveloper(s) BottleRocket Entertainment (PS2, Xbox, PSP) Razorback Developments (NDS) Publisher(s) Konami Warner Bros. Interactive Entertainment Writer(s) Christy Hui Stephen Sustarsic Composer(s) Kevin Manthei Allister Brimble (NDS) Anthony N. Putson (NDS) Platform(s) PlayStation 2 Xbox PlayStation Portable Nintendo DS Release PlayStation 2 PlayStation Portable Xbox NA: November 14, 2006EU: June 29, 2007 Nintendo DS NA: No...

 

2000 studio album by PaloaltoPaloaltoStudio album by PaloaltoReleasedSeptember 19, 2000GenreAlternative rockLength53:15LabelAmerican RecordingsPaloalto chronology Sonny(2000) Paloalto(2000) Heroes and Villains(2003) Professional ratingsReview scoresSourceRatingAllMusic[1] Paloalto is the debut album by alternative rock band Paloalto. It was produced by Rick Rubin and released by American Recordings in 2000. Scott Weiland of Stone Temple Pilots covered Some Things Must Go This ...

 

Strategi Solo vs Squad di Free Fire: Cara Menang Mudah!