জিরা (বৈজ্ঞানিক নাম: Cuminum cyminum[২][৩][৪][৫][৬]), জীরা বা কথ্যভাষায় জিরে[৭] হলো অ্যাপিয়াসি গোত্রের একটি পুষ্পক উদ্ভিদ। এটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের স্থানীয় প্রজাতি।[৮] এর বীজ ফলের ভেতরে থাকে। বিভিন্ন দেশে জিরার ফল শুকিয়ে গোটা অথবা গুঁড়ো মশলা হিসেবে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। বহু পূর্ব থেকেই জিরা চিরাচরিত চিকিৎসাব্যবস্থার একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এর নিরাপত্তা বা কার্যকারিতার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৯]
সংস্কৃত শব্দ জীরক থেকে বাংলা “জিরা” বা “জীরা” নামের উৎপত্তি হয়েছে।[১০] এছাড়া, মূল সংস্কৃত “জীরক” শব্দটিও ইতোপূর্বে বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
জিরার ইংরেজি প্রতিশব্দ cumin (কিউমিন, ক্যুমিন বা কামিন) লাতিন শব্দ cuminum (কিউমিনাম) থেকে মধ্যযুগীয় ইংরেজি ও প্রাচীন ফরাসি ভাষার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় এসেছে। লাতিন কিউমিনাম আবার প্রাচীন গ্রিক শব্দ κύμινον (কিউমিনন) থেকে এসেছে, যা সেমিটিক ভাষা থেকে আগত একটি কৃতঋণ শব্দ। এর সাথে হিব্রু כמון (কাম্মোন) ও আরবি كمون (কাম্মূন) শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই সমস্ত শব্দ আরও পেছনে গিয়ে আক্কাদীয় 𒂵𒈬𒉡 (কামূনু) থেকে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে বলে জানা যায়।[১১][১২]
জিরা হলো পার্সলে গোত্রের বিরুৎজাতীয় কিউমিনাম সাইমিনাম উদ্ভিদের শুকনো বীজ৷ জিরা হাত দিয়ে চাষ করতে হয়। এরা প্রায় ৩০–৫০ সেমি (১২–২০ ইঞ্চি) লম্বা হয়ে থাকে। জিরা গাছ একবর্ষজীবী বিরুৎজাতীয় উদ্ভিদ। এদের কাণ্ড সরু, রোমহীন ও শাখান্বিত এবং ২০–৩০ সেমি (৮–১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা ও ৩–৫ সে.মি. (১+১⁄৪–২ ইঞ্চি) ব্যাসবিশিষ্ট হয়ে থাকে।[১৩] প্রতিটি শাখায় দুই থেকে তিনটি উপশাখা থাকে। প্রতিটি শাখা প্রায় সমান উচ্চতা লাভ করে এবং এজন্য এদের পত্রাচ্ছাদন সুষম হয়ে থাকে।[১৩] কাণ্ডের রং ধূসর থেকে কালচে সবুজ হয়। এদের পাতা ৫–১০ সেমি (২–৪ ইঞ্চি) লম্বা, পিনেট অথবা বাইপিনেট এবং উপপত্র সূচিবৎ। এদের সাদা বা গোলাপি রঙের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুল পুষ্পছত্রে বিন্যস্ত থাকে। প্রতি পুষ্পছত্রে পাঁচ থেকে সাতটি পুষ্প থাকে।[১৩] এদের ফল পার্শ্বীয়ভাবে ফিউজিফর্ম বা ডিম্বাকার অ্যাকিন। ফলগুলো ৪–৫ মি.মি. (১⁄৬–১⁄৫ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়। এরা দ্বিগর্ভপত্রী; এদের প্রতিটি গর্ভপত্রে একটি করে বীজ থাকে।[১৩] জিরার বীজে তৈলনালি-সহ আটটি খাঁজ থাকে।[১৩] জিরার বীজ দেখতে অনেকটা কারোয়ার মতো— গোলাকার লম্বাটে গঠন, আড়াআড়ি খাঁজ এবং হলুদাভ-বাদামি রঙে অ্যাপিয়াসি (আম্বেলিফেরি) গোত্রের অন্যান্য উদ্ভিদের (যেমন: কারোয়া, পার্সলে ও সোয়া বা সালফা প্রভৃতির) সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
কারোয়া (ক্যারাম কারভি) বীজের সাথে জিরার অনেক সাদৃশ্য থাকায় মশলা দুইটিতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। কারোয়া পার্সলে গোত্রেরই (অ্যাপিয়াসি) আরেকটি প্রজাতি। কারোয়ার তুলনায় জিরা বেশি ঝাল; জিরার রঙ কারোয়ার তুলনায় কিছুটা হালকা এবং আকারে জিরা কিছুটা বড়। অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষায় এদের সাধারণ নামে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। অনেক স্লাভীয় ও ইউরালীয় ভাষায় জিরাকে “রোমক কারোয়া” বা “স্পাইস কারোয়া” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া দূরসম্পর্কযুক্ত বুনিয়াম পার্সিকা (শাহী জিরা বা শাজিরা) ও বুনিয়াম বালবোক্যাস্টানাম (কালো শাজিরা বা কালো কারোয়া) এবং সম্পর্কবিহীন নিজেলা স্যাটিভা-কে অনেক ক্ষেত্রে কালোজিরা নামে আখ্যায়িত করা হয়।[১৪]
জিরা খুব সম্ভবত পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের লেভান্তে উৎপত্তি লাভ করেছিল।[১৫] প্রায় সহস্রাধিক বছর ধরে জিরা মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[১৪] সিরিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের জিরার বীজ পাওয়া যায়।[১৬] প্রাচীন মিশরের নব্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানেও জিরার নমুনা পাওয়া গেছে।[১৫][১৭] প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় জিরা মশলা হিসেবে এবং মমীকরণের সংরক্ষক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হতো।[১৩][১৫]
প্রাচীন ক্রিটের মিনোয়ান সভ্যতায় জিরা একটি গুরুত্বপূর্ণ মশলা হিসেবে বিবেচিত হতো। মিনোয়ান সভ্যতার শেষ যুগে বিভিন্ন প্রাসাদে জমাকৃত বস্তুর আর্কাইভে লিনিয়ার এ চিত্রলিপিতে লিখিত জিরার বর্ণনা পাওয়া যায়।[১৮] প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীরা খাওয়ার সময় টেবিলে একটি কৌটায় জিরা রাখত (বর্তমান যুগে গোলমরিচ রাখার মতো)। এই প্রথা আধুনিক মরক্কোতে অদ্যাবধি চলিত আছে। প্রাচীন রোমান সভ্যতাতেও জিরার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক হাজার বছর ধরে রান্নার উপকরণ হিসেবে জিরার ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়া উপমহাদেশের রান্নায় ব্যবহৃত বিশেষ মশলার মিশেলেও জিরার ব্যবহার লক্ষণীয়।
স্প্যানীয় ও পর্তুগিজ ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে আমেরিকা অঞ্চলে জিরা পরিচিতি লাভ করে। পারস্য রন্ধনশৈলীতে কালো ও সবুজ জিরা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে আবাদকৃত জিরার সিংহভাগ চাষ হয় ভারতীয় উপমহাদেশ, উত্তর আফ্রিকা, মেক্সিকো, চিলি ও চীনে।[১৪] এছাড়াও, পাখির খাদ্য হিসেবে জিরা ব্যবহৃত হওয়ায় বিভিন্ন দেশে এটি রপ্তানি করা হয়। ফলে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অভিযোজিত উদ্ভিদ হিসেবে জিরার আবাদ হতে দেখা যায়।[১৯]
জিরা সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় চীন[২০] ও ভারতে। জিরার প্রায় ৯০% ভোক্তাও এই দুই দেশই। কেবলমাত্র দক্ষিণ এশিয়াই সারা বিশ্বের জিরার মোট উৎপাদনের ৬৩% ভোগ করে। এছাড়া মেক্সিকোও জিরার অন্যতম উৎপাদক।[১৪] প্রতি বছর সারা বিশ্বে মোট প্রায় ৩,০০,০০০ টন জিরা উৎপাদিত হয়।
জিরা খরা-সহিষ্ণু, ক্রান্তীয় বা উপক্রান্তীয় অঞ্চলের ফসল। জিরার বর্ধনশীল ঋতু ১০০ থেকে ১২০ দিন স্থায়ী হয়। জিরার বৃদ্ধির জন্য সর্বানুকূল তাপমাত্রা হলো ২৫ থেকে ৩০ °সে।[১৩] ভূ-মধ্যসাগরীয় জলবায়ু জিরার উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে অনুকূল। জিরার উৎপাদনের জন্য তিন থেকে চার মাস দীর্ঘ উষ্ম গ্রীষ্মকালের দরকার হয়। নিম্ন তাপমাত্রায় জিরার পাতা সবুজ থেকে বেগুনি বর্ণ ধারণ করে। আবার, উচ্চ তাপমাত্রায় জিরার বর্ধনশীল মৌসুমের দৈর্ঘ্য কমে আসে এবং ফলের পাকা ত্বরান্বিত হয়। ভারতে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জিরা রোপণ করা শুরু হয় এবং ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ফসল তোলা আরম্ভ হয়।[১৩] সিরিয়া ও ইরানে মধ্য-নভেম্বর থেকে মধ্য-ডিসেম্বর পর্যন্ত জিরা রোপণ করা হয়। এই সময় মধ্য-জানুয়ারি পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে। জুন-জুলাই মাসে জিরা উত্তোলন করা হয়।[১৩]
বীজের প্রকার, তেলের পরিমাণ ও গন্ধের ভিত্তিতে বাজারে জিরার মোটামুটি তিনটি প্রধান প্রকরণ দেখা যায়।[২১]
জিরার বীজ থেকে নতুন উদ্ভিদ জন্মায়। বীজের পরিস্ফূটনের জন্য অন্তত ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩৬ থেকে ৪১ ডিগ্রি ফারেনহাইট) প্রয়োজন হয়; তবে সর্বানুকূল তাপমাত্রা হিসেবে ২০–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৬৮–৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। শৈত্যজনিত ক্ষতের প্রতি জিরা অত্যন্ত সংবেদনশীল। বিশেষত পুষ্পায়ন ও প্রাক-বীজায়ন দশায় জিরা শৈত্যের প্রতি অত্যধিক সংবেদন প্রদর্শন করে।[১৩] শৈত্যজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনতে ০.১% সালফিউরিক অ্যাসিড স্প্রে, শৈত্য মৌসুমের পূর্বে সেচ প্রদান, উইন্ডব্রেক কিংবা ভোরে ধোঁয়াচ্ছন্ন রাখার প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।[১৩] জিরার চারা অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং এদের জীবনীশক্তি কম। বীজ বপনের পূর্বে ৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরোদ্গমের হার বৃদ্ধি পায়।[১৩] আদর্শ জমিতে প্রতি হেক্টরে ১২–১৫ কিলোগ্রাম জিরার বীজ বপন করা হয়।[১৩] যথেষ্ট বায়ুপ্রবাহযুক্ত, পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থাসম্পন্ন এবং অক্সিজেন সুপ্রাপ্য উর্বর বেলে-দোআঁশ মাটিতে জিরার উৎপাদন ভালো হয়। জিরার জন্য মাটির অনুকূল পিএইচ মান ৬.৮ থেকে ৮.৩।[১৩] জিরা লবণাক্ততার প্রতি সংবেদনশীল। শক্ত মাটিতে চারার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এ কারণে জিরার চারার বৃদ্ধির জন্য নরম মাটির উপযুক্ত বীজতলা তৈরি জরুরি।
জিরার বীজ বপনের জন্য দুইটি পৃথক পদ্ধতি প্রচলিত: বীজ ছড়ানো এবং সারিতে রোপণ।[১৩] প্রথম পদ্ধতিতে জমিতে বেড স্থাপন করে তারপর বীজ ছড়ানো হয়। এরপর বীজগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। সারিতে বপনের জন্য মাটিতে ২০ থেকে ২৫ সেমি (৮ থেকে ১০ ইঞ্চি) দূরত্বে অগভীর খাল তৈরি করা হয়। এরপর সেখানে বীজ বপন করে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে আগাছা দমন, নিড়ানি দেওয়া কিংবা কীটনাশক স্প্রে করায় বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়।[১৩] মাটির ১–২ সে.মি. গভীরে এবং বীজতলার প্রতি বর্গমিটারে গড়ে ১২০টি বীজ বপন করা হয়। অন্যান্য সমগোত্রীয় উদ্ভিদের চেয়ে জিরায় পানি তুলনামূলক কম প্রয়োজন হয়।[১৩] তাসত্ত্বেও, বপনের পর চারার বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতে যথেষ্ট পরিমাণে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। সেচের পরিমাণ জলবায়ু ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করতে হয়।[১৩]
জিরার মূল উৎপত্তিস্থলের আপেক্ষিক আর্দ্রতা তুলনামূলক কম। আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি হলে (বর্ষা মৌসুমে কিংবা অধিক বৃষ্টিপাতে) ছত্রাকজনিত সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়। অল্টারনারিয়া-জনিত ধ্বসা এবং ফিউসারিয়াম-জনিত উইল্টের প্রতি জিরা অত্যধিক সংবেদনশীল। দেরিতে রোপণকৃত চারার তুলনায় প্রাক-মৌসুমে রোপণকৃত চারা রোগের প্রতি অত্যধিক সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে। ফিউসারয়াম-জনিত উইল্ট জিরা চাষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। এই সংক্রমণে ৮০% পর্যন্ত ফসলহানি হয়ে থাকে।[১৩] ফিউসারিয়াম সাধারণত বীজ বা মাটিবাহিত হয়ে সংক্রমণ ঘটায় এবং কেবলমাত্র মাটির নির্দিষ্ট তাপমাত্রাতেই বংশবিস্তার ঘটিয়ে জিরা উদ্ভিদের মহামারি রূপ নেয়।[১৩] অপর্যাপ্ত সার প্রয়োগে ফিউসারিয়াম মহামারিতে রূও নিতে পারে।[১৩] জিরায় ধ্বসা রোগ (অল্টারনারিয়া ছত্রাকের সংক্রমণে) হলে, প্রথমে পাতা ও কাণ্ডে গাঢ় বাদামি দাগ পড়ে।[১৩] গাছে ফুল আসার পর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ধ্বসা রোগ সংক্রমণ হতে পারে।[১৩] তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও, জিরার আরেকটি রোগ হলো পাউডারি মিলডিউ। আবাদের একদম শুরুতে পাউডারি মিলড্রিউ সংক্রমণে ক্ষেত্রবিশেষে কোনো বীজ উৎপন্ন না হওয়ায় উৎপাদন মারাত্মক হ্রাস পায়।[১৩] আবার, মৌসুমের শেষ দিকে সংক্রমণ হলে বীজ আকারে ক্ষুদ্র ও বর্ণহীন হতে পারে।[১৩]
জীবাণুর সংক্রমণেও জিরার উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। এফিড (মাইজুস পার্সিকি) নামক মাছি জিরার গাছকে আক্রমণ করে। এরা গাছের কচি অংশ ও ফুল থেকে রস চুষে খায়। ফলে গাছ হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে এবং উৎপাদন কমে যায় ও ফসলের মান হ্রাস পায়। ব্যাপক আক্রান্ত উদ্ভিদ খেত থেকে অপসারণ করা উচিত। এছাড়া কিছু কিছু মাইটও (পেট্রোবায়া ল্যাটেন্স) জিরা উদ্ভিদকে আক্রান্ত করে। মাইট প্রধানত কচি পাতা খেয়ে থাকায় মৌসুমের শুরুতেই মাইটের আক্রমণ দেখা যেতে পারে।
জিরার পত্রাচ্ছাদনের বৈশিষ্ট্যও উৎপাদনের জন্য কিছুটা প্রতিকূল। আগত সূর্যালোকের অতি সামান্য অংশই পাতা শোষণ করতে পারে। জিরার পাতার আয়তন সূচক অনেক কম (প্রায় ১.৫)। ফলে পানি ও সূর্যালোকের প্রাপ্যতায় আগাছা সহজেই জিরার উদ্ভিদকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ফলশ্রুতিতে উৎপাদন হ্রাস পায়। ধীরগতির বৃদ্ধি এবং স্বল্পদৈর্ঘ্যের কারণেও আগাছা বিশেষ সুবিধা পায়।[১৩] ফলে আগাছা দমনের জন্য দুইবার (যথাক্রমে বপনের ৩০ ও ৬০ দিন পর) নিড়ানি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। প্রথম দফা নিড়ানি দেওয়ার সময় অতিরিক্ত উদ্ভিদ অপসারণ করে ঘনত্ব কমিয়ে আনতে হয়। আগাছা দেখা দেওয়ার পূর্বেই উপযুক্ত আগাছানাশক ভারতে বেশ কার্যকরী।[১৩] কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় কার্যকরভাবে আগাছা দমনের জন্য মাটিতে যথেষ্ট আর্দ্রতা থাকা জরুরি।
জিরা হলো ১৪ ক্রোমোজোমবিশিষ্ট ডিপ্লয়েড জীব (অর্থাৎ, ২n = ১৪)। বিভিন্ন প্রকরণের উদ্ভিদের শারীরতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে মিল রয়েছে। এদের বীজে দৈর্ঘ্য বা আয়তনে কোনো বিশেষ পার্থক্য নেই। বর্তমানে লভ্য অধিকাংশ প্রকরণই নির্বাচিত।[১৩] এদের ফলন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। নির্বাচিত পরাগায়ন[১৩] বা জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে প্রকরণগুলো সৃষ্ট। জিরা উদ্ভিদ পরপরাগী। ফলে উদ্ভিদে সাধারণভাবেই সংকরিত বৈশিষ্ট্যের আগমণ ঘটে। এ কারণে, জিরার জাত সৃষ্টিতে যে সমস্ত পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, তা হলো: ইন ভিট্রো রিজেনারেশন, ডিএনএ প্রযুক্তি ও জিন স্থানান্তর। ইন ভিট্রো পদ্ধতিতে জিনগতভাবে পৃথক উদ্ভিদ তৈরি হয়। ইন ভিট্রো পদ্ধতিতে ব্যবহৃত এক্সপ্লান্ট বা অণুচারার মূল উৎস হলো ভ্রূণ, বহুবীজপত্র, ভ্রূণমূলের পর্বমধ্য, পাতা ও বীজপত্র। জিরার সংকরণের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো জৈব (ছত্রাকের সংক্রমণ) ও অজৈব (শৈত্য, খরা ও লবণাক্ততা) সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য প্রতিকূলতা সহনশীল জাত তৈরি। তবে, জিরার জিনগত পরিবর্তিত উচ্চফলনশীল ও রোগসহনীয় জাত স্বল্প এবং এ সংক্রান্ত গবেষণাও অপ্রতুল।[২৩]
স্বতন্ত্র ফ্ল্যাভার বা গন্ধের জন্য জিরা প্রধানত মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[১৪][১৫] ফ্রান্সে কিছু কিছু পনির (যেমন লাইডেন পনির) ও ঐতিহ্যবাহী রুটিতে জিরা ব্যবহৃত হয়। মরিচ গুঁড়ার সমন্বয়ে বিভিন্ন মসলার মিশ্রণে (সাধারণত টেক্স-মেক্স বা মেক্সিকান-স্টাইলে) জিরা ব্যবহার করা হয়। অ্যাকিয়োট ব্লেন্ড, আদোবো, সোফ্রিতো, গরম মসলা, কারি পাউডার ও বাহারাত প্রভৃতি মসলার মিশ্রণ তৈরিতে ও বাণিজ্যিকভাবে ঝাঁজালো গন্ধের খাদ্য প্রণালিতে জিরার ব্যবহার আছে।[৯] দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অঞ্চলে ধনের সাথে জিরা মিশিয়ে ধনে জিরা নামে একটি মসলা ব্যবহার করা হয়।
জিরা গুঁড়া বা গোটা দুইভাবেই ব্যবহার করা যায়।[১৪][১৫] জিরার ব্যবহারে খাদ্যে ঈষৎ মেটো, ঝাঁজাল ভাব আসে, যার কারণে কিছু কিছু স্টু, স্যুপ, ও গ্র্যাভি বা ঘন ঝোল তৈরিতে মরিচ ও কারি মসলার সাথে জিরা অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে।[১৫] এছাড়া বিভিন্ন আচার ও প্যাস্ট্রি তৈরিতে অন্যতম উপাদান হিসেবে জিরা ব্যবহৃত হয়।[২৪]
ভারতীয় উপমহাদেশে কাষয় (ক্বাথজাতীয় পদার্থ), অরিষ্ট (সুগন্ধী ক্বাথ) ও বড়ি এবং ঘিয়ের সাথে প্রক্রিয়াজাতকৃত অবস্থায় জিরার গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। অনেক দেশেই সনাতনী চিকিৎসাব্যবস্থায় ওষুধ হিসেবে শুকনা জিরার ব্যবহার রয়েছে।[৯] তবে আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় ওষুধ হিসেবে জিরার কার্যকারিতা কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।[৯] দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে জিরা সিদ্ধ করে জিরা পানি নামে একটি পানীয় তৈরির রেওয়াজ প্রচলিত আছে।
জিরার তেলে মূলত কিউমিনালডিহাইড, সাইমিন ও টারপিনয়েড প্রভৃতি উদ্বায়ী পদার্থ থাকে। এগুলো বিভিন্ন সুগন্ধী, নির্যাসী তেল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।[১৪][২৫] কিছু কিছু প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে জিরার তেল ব্যবহৃত হতে পারে।[২৬]
বিভিন্ন নির্যাসী তেল, বিশেষত সুগন্ধী কিউমিনালডিহাইড জিরার ফ্ল্যাভার বা বিশেষ গন্ধের জন্য দায়ী।[২৫] ভাজা জিরার অন্যান্য সুগন্ধী উপাদান হলো মূলত পাইরাজিনের প্রতিস্থাপিত যৌগ; যেমন: ২-ইথোক্সি-৩-আইসোপ্রোপাইলপাইরাজিন, ২-মিথোক্সি-৩-সেক-বিউটাইলপাইরাজিন এবং ২-মিথোক্সি-৩-মিথাইলপাইরাজিন। এছাড়াও, অন্যান্য উপাদানের মধ্যে আছে গামা-টারপিনিন, স্যাফ্রান্যাল, প্যারা-সাইমিন ও বিটা-পাইনিন।[২৭][২৮][২৯]
প্রতি ১০০ গ্রাম জিরায় উচ্চ পরিমাণে দৈনিক চাহিদার চর্বি (বিশেষত এক-অসম্পৃক্ত চর্বি), প্রোটিন ও খাদ্য আঁশ রয়েছে (টেবিল দ্রষ্টব্য)। জিরায় ভিটামিন বি, ভিটামিন ই ও খনিজ পদার্থ, বিশেষত লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ রয়েছে। জিরায় পেট্রোসেলিনিক অ্যাসিডও বিদ্যমান।[২৫][৩০]
|name-list-style=