উসমানীয় খিলাফত মিশরের আব্বাসীয় খিলাফতের পর খিলাফতে আসীন হয়। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই খিলাফত টিকে ছিল। খিলাফতের সর্বশেষ খলিফা ছিলেন দ্বিতীয় আবদুল মজিদ।
উসমানীয়দের উত্থানের সময় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ খলিফার অধিকার দাবি করেন। তার নাতি প্রথম সেলিম মুসলিম ভূমিগুলো জয় করে ইসলামের পবিত্র স্থানসমূহের রক্ষক হন। পরবর্তীতে ইউরোপের সাথে প্রতিযোগীতায় ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের পতন হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায়। শেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদ দুই বছরের জন্য দায়িত্ব পান। কিন্তু কামাল আতাতুর্কের সংস্কারের সময় খিলাফত বিলুপ্ত করে দেয়া হয়।
ওয়েস্টফিলিয়ার শান্তি ও শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপীয়দের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং উসমানীয় কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। দুর্বল নেতৃত্ব, প্রাচীন রাজনৈতিক প্রথা এবং ইউরোপের সাথে প্রযুক্তিগত বিষয়ে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় উসমানীয় সাম্রাজ্য ইউরোপের সাথে প্রতিযোগীতায় টিকতে ব্যর্থ হয় এবং পূর্বের বৃহৎ শক্তির অবস্থান থেকে স্থানচ্যুত হয়।
উনিশ শতাব্দীর শেষের দিকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সমস্যাগুলো যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ইউরোপীয় অগ্রগতিকে ধারণ করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কিছুকাল ধারণ করা হয়। এসময় পাশ্চাত্য দন্ডবিধি গ্রহণ করা হয়েছিল[১] এবং ঐতিহ্যবাহী আইনগুলো ইউরোপীয় আইন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল। রুশ-তুর্কি যুদ্ধের মত সংঘর্ষে হারানো অঞ্চলসমূহের কারণে উসমানীয়দের ক্ষমতা ও প্রভাব অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়াও গৃহীত ঋণের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে।
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ অনুধাবন করেন যে সাম্রাজ্যের দুর্বল অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হল শক্ত ও যোগ্য নেতৃত্ব। তিনি তার পূর্বসূরিদের সময় দায়িত্বপালন করা তার মন্ত্রী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেন এবং তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। সাম্রাজ্যের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ তিনি নিজের হাতে নেন। উসমানীয় বিষয়ে পাশ্চাত্যের প্রভাবের বিপরীতে গিয়ে তিনি সাম্রাজ্যের ইসলামি চরিত্রের উপর জোর দেন এবং নিজ খলিফা পদকে জোর দিয়ে খিলাফতের অধীনে মুসলিম ঐক্যের ডাক দেন।
আবদুল হামিদের সাম্রাজ্য সংহতকরণ কাজ সংক্ষিপ্তকালের জন্য সফল হয়। এসময় অনেক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, জাতীয় ঋণ কমানো হয় এবং সাম্রাজ্যের অবনতিশীল কাঠামো পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা চালানো হয়। তার পতনের জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ইহুদিরা নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তার শাসনের অবসান ঘটায়।
উসমানীয় সামরিক বাহিনীর পাশ্চাত্যপন্থি অফিসাররা আবদুল হামিদের শাসনের বিরোধী ছিলেন। তারা সাম্রাজ্যের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন গুপ্তসমিতি গঠন করেন। ১৯০৬ সাল নাগাদ আন্দোলন সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন লাভ করে। এর নেতারা কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেস গঠন করেন। এটি তরুণ তুর্কি পার্টি বলে পরিচিত ছিল। তরুণ তুর্কিরা ইসলাম বিদ্বেষী সেকুলারপন্থীরা সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থাকে পাশ্চাত্য ধাচে সাজাতে উৎসাহী ছিল। তাদের আদর্শ চরিত্রে ছিল জাতীয়তাবাদি। কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেসের নেতারা জনতার সামনে তাদের ধারণা তুলে ধরেন। তুর্কি সামরিক অফিসার আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে কমিটি ১৯০৮ সালে সুলতানের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। ৬ জুলাই নতুন শাসন ঘোষণা করা হয়। আবদুল হামিদকে ক্ষমতায় রেখে তরুণ তুর্কিরা তাকে ত্রিশ বছর পূর্বে স্থগিত করা সংসদ ও সংবিধান পুনপ্রবর্তনের দাবি জানায়। এর মাধ্যমে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের সৃষ্টি হয়।
সুলতানের প্রতি অনুগত সৈনিকরা একটি পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটন করে। তবে এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। নতুন সংসদীয় মেয়াদের নয় মাস পর পাল্টা বিপ্লবী ৩১ মার্চ ঘটনা সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহের অনেক দিক এখনো আলোচনায় আসে।
দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে ১৯০৯ সালের ১৩ এপ্রিল ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তার স্থলে তার ভাই রশিদ এফেন্দি ক্ষমতায় বসেন। ২৭ এপ্রিল পঞ্চম মুহাম্মদ নাম ধারণ করেন।
পঞ্চম মুহাম্মদ, ১৯০৯-১৯১৮
লিবিয়া
১৯১১ সালে ইটালিলিবিয়াকে কেন্দ্র করে উসমানীয়দের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উসমানীয়রা এই অঞ্চল ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ১৯১২ সালে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো ও গ্রীস মিলে তুর্কি বিরোধী বলকান লীগ গঠন করে এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যৌথ আক্রমণ করে। বলকান যুদ্ধের ফলে ইউরোপে উসমানীয়দের অবস্থান সমাপ্ত হয় এবং বলকান লীগের অভ্যন্তরীণ লড়াইএর ফলে তাদের আনাতোলিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়া থেমে যায়।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উসমানীয়রা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে সমস্যায় পড়ে। সাম্রাজ্যব্যপী জাতীয়তাবাদিদের উত্থান বৃদ্ধি পায়। কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেসের ১৯১৩ সালে দ্বিতীয় একটি অভ্যুত্থান ঘটায় এবং সরকারের সব ক্ষমতা গ্রহণ করে। পরবর্তী পাঁচ বছর সাম্রাজ্য কমিটির অধীন একটি একদলীয় রাষ্ট্র ছিল। এসময় নেতৃত্বে ছিলেন আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও জামাল পাশা। সুলতান তার পদে বহাল থাকলে কোনো নির্বাহী ক্ষমতাহীন ছিলেন। ফলে পঞ্চম মুহাম্মদের অধীনে খলিফার পদ আনুষ্ঠানিক হিসেবে থাকে। মূল কর্তৃত্ব তরুণ তুর্কিদের হাতে ছিল।
ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তরুণ তুর্কিরা জার্মান সাম্রাজ্যের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। এই পদক্ষেপের ফলাফল পরবর্তীকালে বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়। ১৯১৪ সালের নভেম্বরে উসমানীয় সাম্রাজ্য অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। এরপরে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধ চলাকালীন সময় সাম্রাজ্যের অবস্থার আরো অবনতি হয় এবং পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে হাতছাড়া হয়ে যায়।
জিহাদ আহ্বান
তরুণ তুর্কিরা সুলতানকে জিহাদ আহ্বান করতে বাধ্য করে। এতে মিত্রশক্তিকে প্রতিহত করার ডাক দেয়া হয়। তবে এই আহ্বান সফল হয়নি। তরুণ তুর্কি সরকার পদত্যাগ করে এবং তিন পাশা বলে পরিচিত আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও জামাল পাশা জার্মান যুদ্ধজাহাজ করে তুরস্ক ছেড়ে পালিয়ে যান। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে পঞ্চম মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করলে সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ তার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯১৮ সালের ৩০ অক্টোবর একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজে উসমানীয়রা আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে স্বাক্ষর করে। মিত্রবাহিনী কনস্টান্টিনোপলে উপস্থিত হয় এবং সুলতানের প্রাসাদ দখল করে নেয়া হয়।[১]
যুদ্ধের শেষ নাগাদ উসমানীয়রা দৃশ্যত তাদের সমগ্র সাম্রাজ্য হারায়। সিংহাসন এবং উসমানীয় রাজবংশকে টিকিয়ে রাখার জন্য সুলতান মিত্রশক্তির সাথে সহযোগিতা করতে সম্মত হন। তিনি সংসদ বিলুপ্ত করেন এবং তরুণ তুর্কিদের ছেড়ে যাওয়া সরকারের স্থান নেয়ার জন্য মিত্রশক্তির সামরিক প্রশাসনকে অনুমতি দেন।
ব্রিটিশ ভারতের মুসলিমরা উসমানীয় খিলাফতের পক্ষে খিলাফত আন্দোলন শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার খিলাফতকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।
উসমানীয়দের পরাজয় ও মিত্রশক্তির কনস্টান্টিনোপল দখলের ফলে উসমানীয় সাম্রাজ্য তাদের সবল স্থান হারায়। খিলাফত আন্দোলন এই অবস্থা থেকে উত্তোরনের জন্য উৎসাহী ছিল। ১৯২০ সালে সেভ্রেস চুক্তির পর আন্দোলন গতি লাভ করে।[২]
তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের ফলে তুরস্কে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি গঠিত হয়। ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই লুসানের চুক্তিতে জাতির স্বাধীনতা ও সীমানা বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা লাভ করা হয়। ন্যাশনাল এসেম্বলি ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ও আঙ্কারাকে এর রাজধানী ঘোষণা করে। ফলে প্রায় ৭০০ বছর পর উসমানীয় সাম্রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়। তবে সুলতান এই আন্দোলন দমন করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং শাইখুল ইসলামের মাধ্যমে ফতোয়া জারি করেন যাতে তা অনৈসলামিক ঘোষণা করা হয়। তবে জাতীয়তাবাদিরা ধীরে ধীরে গতি পায় এবং ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। হুমকি দূর করার জন্য সুলতান নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাজি হন। এতে জাতীয়তাবাদিরা জয়ী হয়।
প্রথমদিকে ন্যাশনাল এসেম্বলি নতুন শাসনের ভেতর খিলাফতে স্থান দিতে ইচ্ছুক ছিল বলে মনে হয় এবং ষষ্ঠ মুহাম্মদের দেশত্যাগের পর তার এক ভাই দ্বিতীয় আবদুল মজিদকে খলিফা হিসেবে বসায়। কিন্তু এসময় এই পদে কোনো কর্তৃত্ব অবশিষ্ট ছিল না। আবদুল মজিদের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিক। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কউসমানীয় রাজবংশ ও এর ইসলামি অবস্থানের বিরোধী ছিলেন। আবদুল মজিদকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করার পর কামাল ঐতিহ্যবাহী উসমানীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার অনুমতি দেননি। তিনি বলেন,
আনুষ্ঠানিক প্রধান ছাড়া খলিফার কোনো ক্ষমতা বা অবস্থান নেই।
বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য আবদুল মজিদের একটি অনুরোধের জবাবে কামাল লেখেন,
আপনার কার্যালয় খিলাফত ঐতিহাসিক স্বারক ছাড়া বেশি কিছু না। এর অস্তিত্বের কোনো বৈধতা নেই। আমার কোনো সচিবকে লেখাটা একপ্রকার ঔদ্ধত্য!
এ পর্যন্ত লাভ করা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কামাল এসময় খিলাফত উচ্ছেদে আগ্রহী ছিলেন না। সাধারণ জনতার ভেতর খিলাফতের প্রতি সমর্থন ছিল।
ভারতের খিলাফত আন্দোলনের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলি ও মাওলানা শওকত আলি ইসলামের জন্য উসমানীয় খিলাফতকে রক্ষা করার জন্য তুরস্কের জনগণকে আহ্বান জানিয়ে লিফলেট বিলি করেন। তুরস্কের নতুন জাতীয়তাবাদি সরকার একে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে। একে তুরস্কের সার্বভৌমত্বের প্রতি অপমান ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা হয়। এরপর ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ ন্যাশনাল এসেম্বলি খিলাফত বিলুপ্ত করে। উসমানীয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ আবদুল মজিদকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ফলে উসমানীয় খিলাফতের অবসান ঘটে।