১৯৩৭ সালে হাওড়া জেলা একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৩ সালে এই জেলাটি প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়। হাওড়া জেলা বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের জন্য বিখ্যাত। জেলার হুগলি নদীর তীরবর্তী শহরগুলি কার্পাস বয়ন, পাট, ধাতুশিল্প, কাগজ প্রভৃতি শিল্পে বিশেষ সমৃদ্ধ। হাওড়া পৌরসংস্থা পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি পৌরসংস্থার অন্যতম। ঐতিহাসিক উদ্ভিদ উদ্যান আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বটানিক্যাল গার্ডেন ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয় বেলুড় মঠ এই জেলার প্রধান পর্যটন কেন্দ্র।
নামকরণের পটভূমি
"হাওড়া" নামটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। একটি মতে, বর্তমান হাওড়া শহরের অদূরে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে হাড়িড়া নামে একটি গ্রামের অস্তিত্ব ছিল; "হাওড়া" নামটি এই "হাড়িড়া" নামেরই অপভ্রংশ।[২] অন্যমতে, "হাওড়া" নামটির উৎপত্তি "হাবড়" শব্দটি থেকে; যার অর্থ "যেখানে পাঁক ও কাদা বেশি হয়"।[১] আবার কেউ কেউ মনে করেন, "হাওড়া" শব্দটির অর্থ "যে নিচু বা অবনত অঞ্চলে বর্ষার জল সঞ্চিত হয়"। হাওড়ার ভূমিরূপ এই জাতীয় ছিল বলে অঞ্চলটির এইরূপ নামকরণ হয়।[১] ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেনের মতে, "হাওড়া" শব্দটি একটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে; এর অর্থ "যেখানে কেবল জল-কাদা"।[৩] হাওড়া জেলার নামকরণ করা হয়েছে জেলার জেলাসদরের নামে।[৪]
হাওড়া জেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুব বেশি পাওয়া যায় না। তবে বাগনান, শ্যামপুর, জগৎবল্লভপুর ইত্যাদি কয়েকটি থানার কয়েকটি গ্রামে খননকার্য চালিয়ে সামান্য কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য জেলার মতো হাওড়া জেলাতেও পোড়ামাটির কারুকার্য সহ অনেক প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে।[৫] প্রাচীন জৈন, বৌদ্ধ বা হিন্দু সাহিত্যে হাওড়া অঞ্চলের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। গ্রিক বা চৈনিক লেখকদের রচনাতেও এই অঞ্চলের কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।[২] তবে গবেষকদের ধারণা, প্রাচীনকালে রাঢ়ের অন্তর্গত সুহ্ম অঞ্চলের দক্ষিণাংশ হাওড়া ও অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা নিয়ে গঠিত ছিল।[২] প্রাচীনকালে দক্ষিণ রাঢ়ের ভূরী শ্রেষ্মীক নামক অঞ্চলটিও বর্তমান হাওড়ার আমতা-উদয়নারায়ণপুর-ডিহি ভুরশুট অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।[১] অনুমিত হয়, খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান হাওড়া অঞ্চলের ভূরিশ্রেষ্ঠ (অধুনা ভুরশুট) ছিল একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যনগরী।[৬] খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে বর্তমান হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল উড়িষ্যা রাজ্যের অধীনে ছিল।[১]
মধ্যযুগে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান বন্দর ছিল সপ্তগ্রাম। এই সময় সরস্বতী নদীপথে বর্তমান হাওড়া জেলার মধ্য দিয়েই সপ্তগ্রাম পর্যন্ত বাণিজ্যপথটি প্রসারিত ছিল। পরবর্তীকালে সরস্বতী নদীর নাব্যতা কমে গেলে ভাগীরথী ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হাওড়ার বেতর সপ্তগ্রামের বিকল্প বন্দর হিসেবে উন্নতি লাভ করে। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের (১৪১৭-১৪৯৫) মঙ্গলচণ্ডী কাব্যে (১৪৯৫ খ্রি.) বেতরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫৫৩ সালে ডি ব্যারোজ অঙ্কিত মানচিত্রে হাওড়া জেলার কয়েকটি স্থানের নাম পাওয়া যায়। ১৭৭৯-৮০ সালের রেনেলের মানচিত্রেও বেতোড় ও শিবপুর অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়।[১]
বিংশ শতাব্দীর পূর্বে পৃথক জেলা হিসেবে হাওড়ার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ১৭৬০ সালে এই অঞ্চলটি বর্ধমানের অন্তর্গত হয়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিবাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের পর হাওড়া ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়।[৭] ১৭৯৫ সালে বর্ধমান জেলা থেকে হুগলি জেলাকে পৃথক করা হয়। হাওড়া জেলা সেই সময় হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল।[১] ১৯১৭-১৮ সালে ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে হাওড়া জেলা হুগলি জেলা থেকে পৃথক ছিল। অবশ্য রাজস্ব ও দেওয়ানি বিচারের ক্ষেত্রে সেই সময়ও এই জেলা হুগলি জেলারই অন্তর্গত ছিল।[৭] ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি হাওড়া জেলা একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা পায়। স্বাধীনতার পরও হাওড়া জেলা বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত ছিল। ১৯৬৩ সালে এই জেলা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়।[১] ১৯৬৫ সালের ২৪ জুলাই হাওড়া শহর কলকাতার ন্যায় পৌরসংস্থা বা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মর্যাদা পায়।[১]
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই হাওড়া জেলার হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। ১৭৯৬ সালে সালকিয়ায় একটি জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ১৮১৭ সালে বাউড়িয়ায় স্থাপিত কটন মিলটি ছিল ভারতের প্রথম কার্পাস বয়ন কারখানা। বর্তমানে হাওড়ায় কটন মিলের সংখ্যা প্রায় ৪০। ১৮৩০ সালে জেসপ কোম্পানি হাওড়ায় একটি তেলকল চালু করার পর জেলায় তেলকলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৮৭৩ সালে ঘুসুড়ির কাছে ফোর্ট গ্লস্টারে একটি পাটকল চালু হয়। এটি ছিল জেলার প্রথম পাটকল। বর্তমানে জেলায় প্রায় ২০টি পাটকল রয়েছে। এছাড়া শিবপুর ও সালকিয়ায় গড়ে ওঠে দড়ি নির্মাণ কারখানা। বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি, হাওড়া ফাউন্ড্রি, জেনকিং কোম্পানি প্রভৃতি শিল্পোদ্যোগী সংস্থা হাওড়ায় ঢালাই ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকেন্দ্র গড়ে তোলে। ১৮৫৪ সালে হাওড়া স্টেশন প্রতিষ্ঠা, ১৮৬২ সালে মোগলসরাই পর্যন্ত রেলপথের প্রসার এবং ১৮৭৪ সালে হাওড়া পল্টুন ব্রিজ (পুরনো হাওড়া ব্রিজ) স্থাপনের ফলে হাওড়া জেলার শিল্পচিত্রে আমূল পরিবর্তন আসে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে হাওড়া, হুগলি ও মেদিনীপুরের তাঁতিদের অনুরোধে আন্দুলের মল্লিক পরিবার হাওড়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র তদনীন্তন চড়কডাঙা নামক এক স্থানে মঙ্গলা-হাট প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাটকে ঘিরেই হাওড়ার আজকের ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্রগুলি বিকাশলাভ করেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফাউন্ড্রি সহ বিভিন্ন ভারী শিল্পে হাওড়া শহরের উৎকর্ষ ও ব্যাপকতা বিচার করে একে বাংলার শেফিল্ড বলা হত। বর্তমানে হাওড়া জেলার শিল্পচিত্রে অনেক পরিবর্তন সাধিত হলেও, এখনও ভারী ও মাঝারি শিল্পে এই জেলা একটি অগ্রপদ জেলা হিসেবেই বিবেচিত হয়।[১][২]
ভূগোল
হাওড়া জেলায় ৩টি বিধিবদ্ধ শহর, ১৩৫টি আদমশুমারি শহর ও ৬৫০টি গ্ৰাম রয়েছে।
ভূপ্রকৃতি
হাওড়া জেলার বিস্তার দক্ষিণে ২২˚১২´ উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ২২˚৪৮´ উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত এবং পশ্চিমে ৮৭˚৫০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে পূর্বে ৮৮˚২৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত।[১][৮] পূর্ব সীমানায় অবস্থিত হুগলি নদী উত্তর চব্বিশ পরগনা, কলকাতা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার থেকে হাওড়াকে পৃথক করেছে; একই ভাবে পশ্চিম সীমানায় অবস্থিত রূপনারায়ণ নদ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে হাওড়া জেলার প্রাকৃতিক সীমানা নির্দেশ করছে।[২][৯]দামোদর নদ বিধৌত হাওড়া জেলা দক্ষিণবঙ্গের পলল সমভূমির উপর অবস্থিত। জেলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অংশ সামান্য উঁচু; ফলে নদীর স্বাভাবিক ঢাল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। হাওড়া জেলার ভূমিরূপের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উঁচু নদীপাড় ও দীর্ঘ জলাভূমি বা নিম্নভূমি। হাওড়া জেলায় এই রকম তিনটি অংশ রয়েছে। এগুলি হল: পূর্ব হাওড়ার হুগলি নদী থেকে প্রসারিত অংশ; মধ্য হাওড়ার দামোদর নদ বেষ্টিত অংশ এবং পশ্চিম হাওড়ার দামোদর ও রূপনারায়ণ নদের মধ্যবর্তী অঞ্চল। এই তিন অঞ্চলেরই মধ্যভাগ নিচু ও উঁচু পাড়বিশিষ্ট। এই ভূমিরূপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য অসংখ্য জলাভূমি ও নিম্নভূমি।[১] উদাহরণস্বরূপ, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ডানকুনি ও হাওড়া জলার নাম উল্লেখযোগ্য। এগুলি হুগলি নদী কর্তৃক সৃষ্ট উচ্চভূমির পশ্চিম পাড় ও সরস্বতী নদী কর্তৃক সৃষ্ট উচ্চভূমির মাঝে অবস্থিত। সরস্বতী ও কানা দামোদরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রাজপুর জলা এবং কানা দামোদর ও দামোদরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে আমতা জলাও উল্লেখযোগ্য। মাকড়দহ ও বড়াগাছিয়ার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি অত্যন্ত নিচু। কোলাঘাট থেকে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত অঞ্চলে নদীগুলি প্রশস্ত ও বেগবতী। এই সব নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলির জলমগ্ন হওয়া রুখতে এদের দুপাড়ে বাঁধ দেওয়া হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে জেলার অধিকাংশ অঞ্চলের উচ্চতা ১৫-২০ ফুটের বেশি উঁচু নয়। হাওড়া ময়দানের কাছাকাছি এই উচ্চতা ২০ ফুট; আবার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বটানিক্যাল গার্ডেন অঞ্চলে কাছে এই উচ্চতা ১৫ ফুট।[২]
নদনদী
হাওড়া জেলার প্রধান নদনদীগুলি হল হুগলি, রূপনারায়ণ, দামোদর, সরস্বতী প্রভৃতি। হুগলি জেলার পূর্ব প্রান্ত বরাবর ও রূপনারায়ণ জেলার পশ্চিম প্রান্ত বরাবর প্রবাহিত। দামোদর নদ জেলার মাঝবরাবর প্রসারিত। এছাড়া দামোদরের দুই শাখানদী কানা দামোদর (অপর নাম কৌশিকী নদী) ও পুরনো দামোদরও এই জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত।[১] এছাড়া অজস্র খাল ও খাড়ি গোটা জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে। জোয়ার-ভাঁটা এই নদীগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বর্ষাকালে নদীর পাড়ে ভাঙন ও বন্যাও এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের (ডিভিসি) স্লুইস গেটের মাধ্যমে জোয়ারের প্রকোপ থেকে জেলার জনবসতি ও কৃষিক্ষেত্রকে রক্ষা করা হয়।[১][২]আমতা, জগৎবল্লভপুর ও ডোমজুড় থানা এলাকায় ডিভিসির নিয়ন্ত্রণাধীন খালের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে জলসেচ করা হয়।[২]
জলবায়ু
হাওড়া জেলার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র প্রকৃতির। গ্রীষ্ম (মার্চ-জুন), বর্ষা (জুন-সেপ্টেম্বর), শরৎ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) ও শীত (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) – এই চারটি ঋতু এই জেলায় সুস্পষ্ট। গ্রীষ্মকাল এখানে উষ্ণ ও শুষ্ক; শীতকাল শুষ্ক। হাওড়া জেলায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৪০০-১৬০০ মিলিমিটার। বছরের অধিকাংশ বৃষ্টিপাত হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। জেলার গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা সর্বাধিক ৩৫˚ সেন্টিগ্রেড ও সর্বনিম্ন ২০˚ সেন্টিগ্রেড; শীতকালীন উষ্ণতা সর্বাধিক ৩০˚ সেন্টিগ্রেদ ও সর্বনিম্ন ৮˚ সেন্টিগ্রেড।[১]
মৃত্তিকা ও স্বাভাবিক উদ্ভিদ
হাওড়া জেলার হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে কঠিন কাদা-দোঁয়াশ মৃত্তিকা দেখা যায়। উত্তরাংশে কাদা ও গভীর দোঁয়াশের পরিমাণ বেশি; তবে দক্ষিণাংশে হালকা গভীরতাযুক্ত দোঁয়াশ মৃত্তিকা দেখা যায়। রূপনারায়ণ ও দামোদর নদের তীরবর্তী অঞ্চলে বেলে-দোঁয়াশ মৃত্তিকা দেখা যায়।[১]
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়া হাওড়া জেলার অন্যত্র বনভূমি প্রায় নেই বললেই চলে। তবে বর্তমানে সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পের অধীনে জেলার নানা স্থানে আবলুস, নারকেল, তেঁতুল, নিম, আম, লিচু, তাল, জারুল, শিমূল, বেল, কাঁঠাল, ছাতিম, বাঁশ প্রভৃতি গাছের কৃত্রিম বনভূমি সৃষ্টি করা হচ্ছে।[১]
সমগ্র হাওড়া জেলায় মোট একটি পৌরসংস্থা, একটি পুরসভা, ১১টি থানা[১১] ও ৫০টি সেন্সাস টাউন রয়েছে। হাওড়ার গ্রামীণ এলাকা মোট ১৪টি পঞ্চায়েত সমিতি, ১৫৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ২২৪৫টি গ্রাম সংসদে বিভক্ত।[১২] এর মধ্যে হাওড়া সদর মহকুমায় রয়েছে একটি পৌরসংস্থা, একটি পুরসভা, ৫টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ৯৮৫টি গ্রাম সংসদ; এবং উলুবেড়িয়া মহকুমায় রয়েছে একটি পুরসভা, ৯টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১২৬০টি গ্রাম সংসদ। হাওড়া সদর মহকুমায় ১৬৭টি মৌজা ও ১৬৫টি গ্রাম রয়েছে; অন্যদিকে উলুবেড়িয়া মহকুমায় রয়েছে ৫৬৭টি মৌজা ও ৫৬২টি গ্রাম।[১][১৩]
জনপরিসংখ্যান
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, হাওড়া জেলার মোট জনসংখ্যা ৪৮,৫০,০২৯। এর মধ্যে ২২,৪১,৮৯৮ জন পুরুষ (জনসংখ্যার ৫২.৪৭ শতাংশ) এবং ২০,৩১,২০১ জন মহিলা (জনসংখ্যার ৪৭.৫৩ শতাংশ)। হাওড়া জেলায় প্রতি ১০০০ জন পুরুষের অনুপাতে মহিলা ৯৩৫ জন।[১] এই জেলায় মোট তফসিলি জাতি জনসংখ্যা ৬,৫৮,৭০৭ (মোট জনসংখ্যার ১৫.৪২ শতাংশ); এর মধ্যে গ্রামীণ তফসিলি জাতি জনসংখ্যা ৪,৬৫,৮৩৭ (মোট তফসিলি জাতি জনসংখ্যার ৭০.৭২ শতাংশ) এবং নগরাঞ্চলীয় তফসিলি জাতি জনসংখ্যা ১,৯২,৮৭০ (মোট তফসিলি জাতি জনসংখ্যার ২৯.২৮ শতাংশ)। অন্যদিকে হাওড়া জেলার মোট তফসিলি উপজাতি জনসংখ্যা হল ১৯,১৬৮ (মোট জনসংখ্যার ০.৪৫ শতাংশ); এর মধ্যে গ্রামীণ তফসিলি উপজাতি জনসংখ্যা ৮,৫৪৩ (মোট তফসিলি উপজাতি জনসংখ্যার ৪৪.৫৭ শতাংশ) এবং নগরাঞ্চলীয় তফসিলি উপজাতি জনসংখ্যা ১০,৬২৫ (মোট তফসিলি উপজাতি জনসংখ্যার ৫৫.৪৩ শতাংশ)।[১] জেলার জনসংখ্যার ৫৭.৯১ শতাংশ হাওড়া সদর মহকুমার বাসিন্দা; এবং অবশিষ্ট ৪২.০৯ শতাংশ উলুবেড়িয়া মহকুমার বাসিন্দা। জেলার জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৯১৩ জন।[১০] হাওড়া জেলার সাক্ষরতার হার ৭৭.০১ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ সাক্ষরতার হার ৮৩.২২ শতাংশ; এবং মহিলা সাক্ষরতার হার ৭০.১১ শতাংশ। জেলার গ্রামীণ সাক্ষরতার হার ৭২.৮১ শতাংশ ও পৌর সাক্ষরতার হার ৮১.০২ শতাংশ।[১]
বাংলা ভাষা হাওড়া জেলার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ভাষা। হাওড়ার নগরাঞ্চলে মান্য চলিত বাংলার প্রচলন থাকলেও গ্রামাঞ্চলে ও মফস্বল অঞ্চলে জেলার নিজস্ব কথ্যভাষার প্রচলন রয়েছে। হাওড়া জেলায় প্রচলিত বাংলার উপভাষাগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: উত্তরের উদয়নারায়ণপুর-আমতা অঞ্চলের কথ্যভাষা, দক্ষিণের শ্যামপুর অঞ্চলের কথ্যভাষা ও পশ্চিমের বাগনান-জয়পুর নিম্ন দামোদর উপত্যকা অঞ্চলের কথ্যভাষা।[১৪] জেলার ভাষাগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে হিন্দি ও উর্দুভাষীরা উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নানা অঞ্চল থেকে মানুষ এই জেলার কলকারখানা ও অফিসে কাজ করতে আসেন বলে এখানে বিভিন্ন প্রকার ভাষার সংমিশ্রণ দেখা যায়।[১]
পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ অংশের মতো দুর্গাপুজো হাওড়া জেলারও বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলির মধ্যে কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, ঈদুল ফিতর, দোলযাত্রা, বড়দিন, পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, সরস্বতী পুজো, রথযাত্রা, পৌষপার্বণ ইত্যাদি মহাসমারোহে পালিত হয়। এছাড়াও বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো, রামকৃষ্ণ জয়ন্তী, কল্পতরু উৎসব প্রভৃতি রামকৃষ্ণ মিশনের নিজস্ব উৎসবগুলি উপলক্ষেও ব্যাপক জনসমাগম লক্ষিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের প্রচলিত উৎসবগুলি বাদে হাওড়া জেলায় চণ্ডীপূজা বিখ্যাত। এই জেলায় দেবী চণ্ডীর অসংখ্য লৌকিক রূপ লক্ষিত হয়। যথা: কল্যাণচণ্ডী, মঙ্গলচণ্ডী, মাকালচণ্ডী, ওলাইচণ্ডী ইত্যাদি। আমতার মেলাইচণ্ডীর মন্দির বাহান্ন পীঠের অন্যতম রূপে পরিগণিত হয়। জনস্রুতি এখানে সতীর মালাইচাকী পড়েছিল। মন্দিরটি নির্মিত হয় ১৬৪৯ সালে। এছাড়া মাকড়দহের মাকড়চণ্ডী ও কাসুন্দিয়ার ওলাইচণ্ডীর মন্দিরও বিখ্যাত।[১][২]
হাওড়া জেলায় সারা বছর ধরেই অসংখ্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলাগুলি প্রধানত দুই প্রকার। যথা: ধর্মীয় মেলা ও ধর্মনিরপেক্ষ মেলা। ধর্মীয় মেলাগুলি আবার তিন শ্রেণীর। যথা: হিন্দু দেবদেবীকেন্দ্রিক মেলা, মুসলমান পরবকেন্দ্রিক মেলা ও আদিবাসী উৎসবকেন্দ্রিক মেলা।[১৭] চারমাসব্যাপী হাওড়ার রামরাজাতলার মেলা পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘতম মেয়াদের মেলা।[১৮] ১৭৫১ সাল থেকে অদ্যাবধি রামনবমীর দিন থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার পর্যন্ত এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।[১৮] এই জেলার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মেলা হল উলুবেড়িয়ার রাসমেলা, উদয়নারায়ণপুর থানার সিংটি গ্রামে ভাঁইখাঁ পিরের মেলা, উলুবেড়িয়া থানার বাণীবন গ্রামে পির জঙ্গলবিলাসের মেলা, শ্যামপুর থানার সীতাপুর গ্রামের দেওয়ান সাহেবের মেলা, বাগনান থানার মালোড় কালীবাড়িতে মুলোকালীর মেলা, শ্যামপুর থানার রতনপুর গ্রামে মা রতনমেলার ঝাঁপমেলা, বাগনান, কল্যাণপুর ও আম্রগড়ির গাজনমেলা ইত্যাদি।[১৭] হাওড়া জেলার ধর্মনিরপেক্ষ মেলাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমতা থানার রসপুর গ্রামের দামোদর মেলা, বাগনান থানার কুলগাছিয়ার নবান্নমেলা,পানিত্রাস গ্রামের শরৎমেলা ইত্যাদি।[১৭]
জেলার প্রধান প্রধান ধর্মস্থানগুলি হল রামরাজাতলার রামঠাকুরের মন্দির, জলেশ্বরের শিবমন্দির, মধ্য হাওড়ার হাজার হাত কালীতলা, সুলতানপুরের খটিয়ালশিব মন্দির, রাউতাড়া গ্রামের মানিক পিরের দরগা, বেলুড় মঠ ইত্যাদি।
অর্থনীতি
কৃষি
২০০১ সালের জনগণনার তথ্য অনুসারে, হাওড়া জেলার মোট শ্রমশক্তির ৫.২ শতাংশ কৃষক ও ১০.২ শতাংশ কৃষিমজুর।[১] হাওড়া জেলায় মূলত খাদ্যশস্য উৎপাদিত হলেও, অর্থকরী ফসলও প্রচুর উৎপাদিত হয়। উর্বর পলিমৃত্তিকার কারণে হাওড়া জেলা কৃষিতে উন্নত। এই জেলার প্রধান খাদ্যশস্যগুলি হল ধান, গম, ডাল, তৈলবীজ, আখ, শুকনো লঙ্কা ও আলু। ধানের মধ্যে আউস, আমন ও বোরো তিন প্রকার ধানই উৎপাদিত হয়। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টনের জন্য হাওড়া জেলায় কৃষিতে জলসেচের প্রয়োজন হয়। খাল, জলাশয়, গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে জলসেচ করা হয়ে থাকে। জেলায় মোট ৭৭৬টি সার ডিপো ও ৩৫৪টি বীজ-ভাণ্ডার রয়েছে।[১] খাদ্যশস্যের পাশাপাশি জেলায় কলা, আম, আনারস, পেয়ারা, লিচু, জাম প্রভৃতি ফলের চাষ হয়। হাওড়ার অন্যতম অর্থকরী ফসল হল ফুল। এখানে গোলাপ, গাঁদা, গ্ল্যাডিওলাস, জুঁই ও নানা মরসুমি ফুলের চাষ হয়ে থাকে। কৃষি বিপননের জন্য হাওড়া জেলায় ৬টি উপবাজার ইয়ার্ড, ১টি বাজার ইয়ার্ড এবং ১৪টি পাইকারি বাজার, ১৩০টি বাজার ও ৪টি গ্রামীণ বাজার রয়েছে। এছাড়া হাওড়ায় মোট ২টি গুদামঘর ও ৮টি হিমঘর চালু আছে।[১]
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে হাওড়া জেলা বাংলার একটি প্রধান শিল্পকেন্দ্রে পরিণত হয় (ইতিহাস দ্রষ্টব্য)। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নতুন শিল্পনীতি অনুসারে, হাওড়া জেলা ‘খ’ শ্রেণীর অন্তর্গত। ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্পের জন্য এই জেলা দীর্ঘকাল ধরে বিখ্যাত।
হাওড়া জেলার বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পগুলি হল – কার্পাস বয়ন, পাট, রং, কেবল, দড়ি, ধাতুশিল্প, তেল , গ্রিজ, ছাপাখানা ইত্যাদি। জেলার প্রধান প্রধান শিল্পকেন্দ্রগুলি হল শিবপুর, বাউড়িয়া, অনন্তপুর, উলুবেড়িয়া, বালি, লিলুয়া, বেলুড়, আলমপুর, সাঁতরাগাছি, রামরাজাতলা, কদমতলা, সালকিয়া, দাশনগর, টিকিয়াপাড়া, বেলিলিয়াস রোড ও গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ।[১] হাওড়ার জাহাজ তৈরি ও মেরামত শিল্প ভারতে বৃহত্তম। জেলায় এই জাতীয় মোট চোদ্দোটি কারখানা রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সালকিয়ার হুগলি ডকিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, শিবপুরের শালিমার ওয়ার্কস, বটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে নাজিরগঞ্জের পোর্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস ইত্যাদি।[২]
২০০৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, হাওড়া জেলার একক ক্ষুদ্র শিল্পের সংখ্যা ৩২,২৮৫ এবং এই সব শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ১,৮৪,৬৬৮।[১] জেলার উল্লেখযোগ্য ক্ষুদ্রশিল্পগুলি হল কৃষিজাত পণ্যভিত্তিক শিল্প, ধাতব, অধাতব, ইলেকট্রিক্যাল, রাসায়নিক, রবার, প্ল্যাস্টিক, শাটলকক, পোলো খেলার বল, হোসিয়ারি ও মুদ্রণ শিল্প। এগুলির মধ্যে মেশিন ও যন্ত্রাংশ শিল্প প্রথম, ধাতব শিল্প দ্বিতীয় ও ইলেকট্রনিক শিল্প তৃতীয় স্থানের অধিকারী। খাদ্যপ্রস্তুতকারী শিল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধানকল, গম ও ময়দাকল, তেলকল, বেকারি শিল্প ইত্যাদি। ছোটো ছোটো ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানাগুলি গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের দুধারে অবস্থিত, মেশিন যন্ত্রপাতি কারখানাগুলি অবস্থিত মূলত বেলিলিয়াস রোডের উপর। পাঁচলা থানা এলাকায় অভিনয় সামগ্রী পুরচুলা প্রস্তুত হয়। দেউলপুরে পোলো খেলার বল তৈরির কারখানা রয়েছে। উলুবেড়িয়ার বাণীবনে ফুটবল ও শাটলকক এবং পাঁচলা, জগৎবল্লভপুর ও ডোমজুর থানায় ঘরে ঘরে তালাচাবি তৈরি হয়। জগৎবল্লভপুরের বড়াগাছিয়াতে রাজ্য সরকারের কেন্দ্রীয় তালা কারখানা অবস্থিত।
হস্তচালিত তাঁতশিল্প হাওড়া জেলার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি। এই জেলার মশারি, শাড়ি, তোয়ালে, চাদর ইত্যাদি বিখ্যাত। ডোমজুর, শ্যামপুর ও বালি-জগাছা অঞ্চল হস্তচালিত তাঁতের প্রধান কেন্দ্র। এই জেলায় মোট ৮১৬৪টি হস্তচালিত তাঁত রয়েছে এবং এই তাঁতশিল্পের সঙ্গে প্রায় ১৮,০০০ শ্রমিক জড়িত।[১] এছাড়া ধান প্রক্রিয়াকরণ, রুপোর গহনা নির্মাণ, মৃৎশিল্প ও দর্জিশিল্প ইত্যাদি খাদি ও গ্রামীণ শিল্পও এই জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক। তবে হস্তশিল্পে হাওড়া জেলা বিশেষ উন্নত নয়। কেবল কিছু কিছু অঞ্চলে পোষাক, গহনা, এমব্রয়ডারি, জরির কাজ, বাটিক প্রিন্ট, সফট টয়, বল ও কাঠের দ্রব্যাদি নির্মিত হয়ে থাকে।[১] হাওড়া জেলায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থও পাওয়া যায় না। নদীর পলি থেকে ইঁট, টালি ও মাটির দ্রব্য তৈরি করা হয়।[১]
অন্যদিকে, হাওড়া জেলায় মোট ৩৩টি সরকারি হাসপাতাল, ৫২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৮৯টি ক্লিনিক ও ৪৪টি ডিসপেনসরি অবস্থিত। এর মধ্যে হাওড়া সদর মহকুমায় ২৭টি হাসপাতাল ও উলুবেড়িয়া মহকুমায় ৬টি হাসপাতাল বর্তমান। বালি-জগাছা ব্লকে কোনো হাসপাতাল নেই।[১]
পরিবহন
ভারতের অন্যতম প্রধান রেলওয়ে স্টেশন তথা পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব রেলের প্রান্তিক স্টেশন হাওড়া এই জেলায় অবস্থিত। ১৮৫৪ সালে নির্মিত এই স্টেশন শুধু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই নয়, সমগ্র ভারতের সঙ্গে কলকাতা শহরের যোগাযোগ রক্ষা করছে। সম্প্রতি কলকাতার সঙ্গে এই স্টেশনকে মেট্রো রেলপথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। হাওড়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্টেশন হল শালিমার। এই স্টেশন থেকে মূলত পণ্যচলাচল হলেও কিছু যাত্রীবাহী ট্রেন এখান থেকে ছাড়ে।
হাওড়া জেলার মহকুমা, ব্লক, গ্রাম ও শহরগুলি সড়কপথে পরস্পরের সঙ্গে সুসংবদ্ধ। এই সড়কগুলির মধ্যে রয়েছে জাতীয় সড়ক (৬২.৫০ কিলোমিটার), রাজ্য সড়ক (১৩ কিলোমিটার), জেলা সড়ক (২৭৯ কিলোমিটার), গ্রামীণ সড়ক (১৮৩ কিলোমিটার)।[১] হাওড়ার শিবপুর অঞ্চল থেকে বর্তমান গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সূচনা।[১৯]দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে হাওড়ার বালির সঙ্গে হুগলি জেলার ডানকুনি ও বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরকে সংযুক্ত করেছে। এছাড়া ২ নং জাতীয় সড়ক (দিল্লি রোড), ৫ নং জাতীয় সড়ক (মুম্বই রোড) ও ৬ নং জাতীয় সড়ক (চেন্নাই রোড) এই জেলার মধ্য দিয়ে প্রসারিত।[২]রবীন্দ্র সেতু বিট্রিশ শাসনের সময় নির্মিত, বিবেকানন্দ সেতু, বিদ্যাসাগর সেতু এবং নবনির্মিত নিবেদিতা সেতু হাওড়া জেলার সঙ্গে রাজধানী কলকাতা মহানগরীর সংযোগরক্ষা করছে। বিবেকানন্দ সেতু আবার একমাত্র সেতু যেটি কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে রেল যোগাযোগ রক্ষা করছে।
হাওড়া জেলায় জলপথ পরিবহন ব্যবস্থা অন্যান্য জেলার তুলনায় উন্নত। জেলার হুগলি, দামোদর ও রূপনারায়ণ নদীতে মোট ৪১টি ফেরি সার্ভিস চালু আছে।[১] তবে এই জেলায় কোনো বিমানবন্দর নেই। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এই জেলার নিকটবর্তী বিমানবন্দর।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বা "শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেন" (পূর্বনাম "ইন্ডিয়ান বটানিক্যাল গার্ডেন")[২০]হাওড়ারশিবপুরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক উদ্ভিদ উদ্যান। ২৭৩ একর আয়তনবিশিষ্ট এই উদ্যানে বর্তমানে মোট ১৪০০ প্রজাতির প্রায় ১৭,০০০টি গাছ রয়েছে।[২১] এই উদ্যান নামেও পরিচিত। ১৭৮৭ সালে কর্নেল রবার্ট কিড নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সেনা আধিকারিক বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশ থেকে গাছপালা সংগ্রহ করে পরীক্ষানিরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেন। এই উদ্যানের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য বস্তু হল বিশাল বটবৃক্ষ নামে একটি ২৫০ বছরের প্রাচীন বটগাছ। এই সুবিশাল বটগাছটি দেড় একর জমির উপর শত শত ঝুরি নিয়ে বিরাজমান।[২১] এই বটগাছটি ছাড়াও বটানিক্যাল গার্ডেনে রয়েছে মেহগনি, সাল, সেগুন, বট, অশ্বত্থ, শিমূল, পিয়াল ও নানা প্রজাতির পাম গাছ। রয়েছে দারুচিনি, লবঙ্গ, জায়ফল, তেজপাতা, রবার ও নানা প্রকার ঔষধি বৃক্ষও। উদ্যানের মধ্যে যাতায়াতের জন্য রয়েছে ১৭ কিলোমিটার পাকা রাস্তাও।[২১] স্বাধীনতার পর বটানিক্যাল গার্ডেন ভারত সরকারেরপরিবেশ ও বন মন্ত্রকের অধীনে বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে।
বেলুড় মঠরামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয়। ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দহাওড়ারবেলুড়ে গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে এই মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। মঠের রামকৃষ্ণ মন্দিরটির স্থাপত্যে হিন্দু, ইসলাম ও খ্রিস্টীয় ধর্মচেতনার সংমিশ্রণ লক্ষিত হয়।[২২] ৪০ একর জমির উপর অবস্থিত মূল মঠপ্রাঙ্গনে রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দের দেহাবশেষের উপর অবস্থিত মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশনের সদর কার্যালয় অবস্থিত। এছাড়াও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিহাসকে তুলে ধরার লক্ষ্যে একটি সংগ্রহশালাও এখানে স্থাপিত হয়েছে। বেলুড় মঠ-সন্নিহিত একটি প্রাঙ্গনে গড়ে উঠেছে রামকৃষ্ণ মিশন অনুমোদিত বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র। রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় এখানেই অবস্থিত।[২৩] স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে মন্দিরের নকশা নির্মাণ করেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসের অপর সাক্ষাতশিষ্য স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। বেলুড় মঠ ভারতের একটি প্রধান পর্যটন আকর্ষণ এবং ভক্তদের নিকট একটি পবিত্র তীর্থ। বেলুড় মঠ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, নারীকল্যাণ, শ্রমিক ও অনগ্রসর শ্রেণীর স্বার্থে গ্রামোন্নয়ন, ত্রাণ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।[২৪] রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম ও প্রয়াণতিথি, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বড়দিন উৎসব উদ্যাপন করে এই কেন্দ্র। দুর্গাপূজা, বিশেষত মহাষ্টমীর কুমারীপূজা দেখতে এখানে প্রতি বছর প্রচুর জনসমাগম হয়।[২৫]
হুগলি নদীর উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর সেতু (পূর্বনাম "দ্বিতীয় হুগলি সেতু") হাওড়া ও কলকাতা শহরের সংযোগরক্ষাকারী একটি সেতু। এই সেতু ভারত তথা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও উচ্চতম সেতু। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি সংস্কারকঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে এই সেতু উৎসর্গিত হয়েছে। বিদ্যাসাগর সেতু একটি কেবল-স্টেইড বা ঝুলন্ত সেতু। এর প্রধান বিস্তার ৪৫৭ মিটারের কিছু বেশি এবং ডেকের প্রস্থ ৩৫ মিটার। এ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে এবং সেতুটির উদ্বোধন হয় ১০ অক্টোবর, ১৯৯২, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রয়াণশতবর্ষে। সেতুর তদারককারী সংস্থা হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশন (এইচআরবিসি)। তবে সেতু নির্মাণ করেছিল বিবিজি নামে ব্রেইথওয়েইট, বার্ণ ও জেশপ নামক তিন সংস্থার একটি যৌথ দল।[২৬]
হাওড়া সেতু (সরকারি নাম রবীন্দ্র সেতু) হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৮৭৪ সালে প্রথম হাওড়া সেতু নির্মিত হয়। পরে ১৯৪৫ সালে পুরনো সেতুটির বদলে বর্তমান বহির্বাহু সেতুটির উদ্বোধন হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র সেতু রাখা হয়।
রবীন্দ্র সেতু বঙ্গোপসাগরীয় প্রবল ঝড়ঝঞ্জাগুলি সহ্য করতে সক্ষম। এই সেতু দিয়ে দৈনিক ৮০,০০০ যানবাহনও প্রায় ১০ লক্ষ পথচারী চলাচল করে।[২৭] এই জাতীয় সেতুগুলির মধ্যে রবীন্দ্র সেতু বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম[২৮]
বিবেকানন্দ সেতু (পূর্বনাম "বালি ব্রিজ") হাওড়ার বালি ও উত্তর চব্বিশ পরগণার দক্ষিণেশ্বরের এটি ১৯৩২ সালে নির্মাণ করা হয়। এটি একটি বহু-স্প্যানবিশিষ্ট ইস্পাতনির্মিত সেতু। সেতুটিতে রেল ও সড়ক দুই ধরনের পরিবহন ব্যবস্থাই রয়েছে। রেলপথে সেতুটি শিয়ালদহ স্টেশনকে দিল্লির সাথে যুক্ত করেছে। সড়কপথে এটি হাওড়ার গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডকে কলকাতার ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের সাথে যুক্ত করেছে।
নিবেদিতা সেতু (নির্মাণকালীন নাম "দ্বিতীয় বিবেকানন্দ সেতু") বিবেকানন্দ সেতুর পাশে নির্মিত একটি কেবল-স্টেইড সেতু। বিবেকানন্দ সেতুর যানবাহনের চাপ কমাতে সাম্প্রতিককালে এই সেতুটি নির্মিত হয়েছে।
উলুবেড়িয়া মহকুমার গাদিয়াড়ায় হুগলি ও রূপনারায়ণ নদীর মিলনস্থলটি এখন জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। এখানকার পুরনো রাইস মিলের বিলাসবহুল বাড়িটি এখন একটি পর্যটন আবাস। শীতকালে এখানে প্রচুর মানুষ পিকনিক করতে আসেন।
হুগলি ও দামোদর নদের সংগমস্থলে গড়চুমুক এই জেলার অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র। এখানে দামোদর নদের উপর এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ স্লুইশ গেট অবস্থিত। স্লুইশ গেটের দক্ষিণাংশে জেলা পরিষদের তরফ থেকে বনসৃজন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশু উদ্যান, ভ্রমণ স্থল, চড়ুইভাতির মাঠ, নদীর বুকে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা।[২]
↑ কখগ"ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন", বাংলার ঐতিহ্য কলকাতার অহংকার, পল্লব মিত্র, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৭৪-৭৭
↑
Sarina Singh। India। পৃষ্ঠা p.452।অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: অতিরিক্ত লেখা (link)
↑"Belur Math"। ২০০৮-১২-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১০-১০।
↑
Cyrus R. Pangborn। "The Ramakrishna Math and Mission"। Hinduism: New Essays in the History of Religions। পৃষ্ঠা p.118।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: অতিরিক্ত লেখা (link)
↑"Day of anjali & attraction"। The Telegraph। October 7 , 2008। ২০০৮-১০-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 2008-10-10।এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
↑"বিদ্যাসাগর সেতু", বাংলার ঐতিহ্য কলকাতার অহংকার, পল্লব মিত্র, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৫০-৫৪
↑Durkee, Jackson (১৯৯৯-০৫-২৪), National Steel Bridge Alliance: World's Longest Bridge Spans(পিডিএফ), American Institute of Steel Construction, Inc, ২০০৮-১২-৩০ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০১-০২উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
বহিঃসংযোগ
উইকিমিডিয়া কমন্সে হাওড়া জেলা সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।