স্কাথি (/ˈskɑːði/),[৬][খ] (মূলত স্কাডি (Skadi)) শনি XXVII নামে পরিচিত, শনি গ্রহের একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ। স্কাথি শনি গ্রহের নর্স উপগ্রহ গোষ্টীর একটি অনিয়মিত উপগ্রহ। ২০০০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রেট গ্ল্যাডম্যানের নেতৃত্বাধীন একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী উপগ্রহটি আবিষ্কার করেছিল।[৭] শনির অন্যান্য সাতটি উপগ্রহ; যথা- টারভোস, ইজিরাক, থ্রাইমার, সিয়ারনাক, মুন্ডিলফারি, এরিয়াপাস, এবং সুতুঙ্গর[৮]-এর সাথে ২০০০ সালের ৭ ডিসেম্বর স্কাথি উপগ্রহ আবিষ্কারের ঘোষণা আসে।[৭] জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুর গ্রিক এবং রোমান নামের পাশাপাশি বৈচিত্র্যতা আনার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে নর্স পুরাণের দেবী স্কাথির নামে উপগ্রহটির নামকরণ করা হয়েছিল।
শনি গ্রহের কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করতে স্কাথির মাত্র ৭২৫ দিনের বেশি সময় লাগে। এটি তার অক্ষের উপর ঘুরতে ১১.১±০.০২ ঘন্টা সময় নেয় বলে অনুমান করা হয়। শনি গ্রহের অন্যান্য অনেক উপগ্রহের তুলনায় গ্রহ থেকে এটি অতিবেশি দূরত্বে থেকে প্রদক্ষিণ করে। একটি বৃহৎ কক্ষীয় নতি এবং উৎকেন্দ্রিকতা সহ, এবং এটি একটি বিপরীতমুখী গতির উপগ্রহ। স্কাথি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, কারণ এটি একটি অস্পষ্ট ও অনুজ্জ্বল বস্তু। পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ ব্যতীত, এটি শুধুমাত্র ক্যাসিনি-হাইগেন্স কর্তৃক পর্যবেক্ষিত এবং এমনকি উপগ্রহটির বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পরিমাপ প্রায় ৯.৭ নিযুত কিলোমিটার (৬ নিযুত মাইল) দূর থেকে নেওয়া হয়েছিল।
স্কাথির উদ্ভব নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। একটি সম্ভাবনা হল যে এটি মূলত একটি গ্রহাণু যা অন্যত্র তৈরি হয়েছিল এবং মহাশূন্যে ভ্রমণের সময় শনির মাধ্যাকর্ষণে বাঁধা পড়েছিল। আরেকটি সম্ভাবনা হল যে এটি মূলত শনির বৃহ্ৎ কোন উপগ্রহের অংশ ছিল (যেমনঃফিবি), যেটি সংঘর্ষের সময় বিভক্ত হয়ে একটি স্বাধীন উপগ্রহে পরিণত হয়েছে। এর ভৌত বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা হয়নি, তবে এটি প্রায় ৮ কিলোমিটার (৫ মাইল) দীর্ঘ অনিয়মিত আকৃতির উপগ্রহ।
২০০০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রেট গ্ল্যাডম্যান, জন কাভেলার্স, জ্যা-মার্ক পেতিঁ, হ্যান্স স্কোল, ম্যাথিউ জে. হলম্যান, ব্রায়ান জি. মার্সডেন, ফিল নিকলসন এবং জোসেফ এ বার্নস স্কাথি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন।[২] দলটি মাউনা কি মানমন্দিরের কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপের তোলা আলোকচিত্র ব্যবহার করেছিলেন।[২]
প্রথমত, স্কাথিকে একটি অস্থায়ী নাম দেওয়া হয়েছিলঃ "S/2000 S 8" নামটির "S", ইংরেজি 'Satellite' শব্দের অদ্যাক্ষর, যেটি দিয়ে স্কাথিকে একটি উপগ্রহ হিসেবে নিশ্চিত করা হয়, "2000" উল্লেখ করে যে এটির আবিষ্কারের বছর ২০০০, দ্বিতীয় "S" দিয়ে ইংরেজি 'Saturn' বা শনি গ্রহকে নির্দেশ করে এবং সংখ্যা '8' এর মানে হল যে এটি সে বছর আবিষ্কৃত এধরনের অষ্টম বস্তু।[৮]
নামটি বিশেষভাবে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বস্তুর নামকরণে বৈচিত্র্যতা আনার জন্য বাছাই করা হয়েছিল। বেশিরভাগ গ্রহের ইংরেজি নাম রোমান ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং উপগ্রহের নামকরণের ক্ষেত্রেও জ্যোতির্বিদরা এই ধারা অনুসরণের প্রবণতা দেখিয়েছেন।[৯][১০] এপ্রেক্ষিতে, ঐতিহাসিক ইয়ুর্গেন ব্লাঙ্ক লিখেছেন যে কাভেলার্স, নতুন আবিষ্কৃত উপগ্রহ "যেগুলি একই সাথে বহুসংস্কৃতি এবং কানাডিও ছিল"- নাম বরাদ্দের ক্ষেত্রে "জ্যোতির্বিজ্ঞানে নামকরণের গ্রেকো-রোমানো-রেনেসাঁর ধারা থেকে বাইরে আসার জন্য চেষ্টা করেছিলেন"।[৮] স্কাথির জন্য তিনি নর্স পৌরাণিক কাহিনী থেকে একটি নাম বেছে নিয়েছিলেন, যেখানে 'স্কাডি' হলেন একজন নারী দৈত্য যে তার বাবার হতার প্রতিশোধ নিতে এসগার্ড ভ্রমণ করেছিলেন।[২] শনির অন্যান্য উপগ্রহের বেশ কয়েকটি নাম (ইজিরাক, কিভিউক, পালিয়াক, সিয়ারনাক এবং টারকেক) ইনুইট পুরাণ থেকে নেওয়া হয়েছে।[৮]
২০০৩ সালে উপগ্রহটির নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন এটিকে "স্কাডি" (ইংরেজি: Skadi) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। যেখানে ইংরেজি ⟨d⟩-এর ব্যবহার হয়েছিল আইসল্যান্ডিক অক্ষর⟨ð⟩(eth) এর উচ্চারণগত স্পষ্ট অনুমানের ভিত্তিতে।[১১]
স্কাথিকে স্থায়ী নামের পাশাপাশি একটি রোমান সংখ্যার উপাধি হিসেবে বিকল্পনাম "শনি XXVII" দেওয়া হয়েছিল।[৮]
শনি গ্রহের নর্স গোষ্টীর অন্যান্য উপগ্রহের মত স্কাথির কক্ষপথ ও ঘুর্ণনের বৈশিষ্ট প্রায় একই রকম।[১২] স্কাথির একটি বিপরীতমুখী কক্ষপথ রয়েছে, অর্থাৎ এটি শনির কক্ষপথের হিসাবে বিপরীত দিকে প্রদক্ষিণ করে।[৪]শনির চারপাশে একবার সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে ৭২৫ দিনের বেশি সময় লাগে এবং এটি গড়ে ১,৫৫,৭৬,০০০ কিলোমিটার (৯৬,৭৮,০০০ মাইল) দূরত্বে অতিক্রম করে।[৫] শনির অনিয়মিত উপগ্রহগুলির জন্য মাত্র দুই বছরেরও বেশি সময়ের কক্ষপথ পরিভ্রমণের হিসেবে দ্রুত, এবং স্কাথি ফোবি ব্যতীত শনির অন্যান্য বিপরীতমুখী উপগ্রহের চেয়ে দ্রুত কক্ষপথ ভ্রমণ সম্পূর্ণ করে।[৪]:৪১১ এর কক্ষপথের নতি, বা তির্যকতা (সেই সমতলের সাথে তুলনা করা হয় যেটির উপর বেশিরভাগ বস্তু সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে), সৌরজগতের গ্রহের তুলনায় ১৪৯° এবং শনির বিষুবরেখার তুলনায় ১৫০°।[৫] অর্থাৎ এটি সৌরজগতের বেশিরভাগ বস্তুর তুলনায় একটি তীক্ষ্ণ কোণে নিজগ্রহকে প্রদক্ষিণ করে। এছাড়া স্কাথিরও কক্ষীয় বিকেন্দ্রতার মান ০.২৪৬।[৫] একটি বৃত্তাকার কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতার মান শূন্য হয়; সেহিসেবে স্কাথির কক্ষপথ সৌরজগতের অনেক বস্তুর কক্ষপথের চেয়ে বেশি উপবৃত্তাকার, উদাহরণ সরূপ পৃথিবীর, এককেন্দ্রিকতার পরিমাণ ০.০১৭।[১৩] আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে স্কাথির নিজ অক্ষে ঘুর্ণন বা আবর্তনকাল প্রাথমিকভাবে ১১ থেকে ১২ ঘন্টার মধ্যে অনুমান করা হয়েছিল।[৫] তবে ২০১৯ সালে, ক্যাসিনি মহাকাশযান দ্বারা সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট হিসাবে স্কাথির নিজ অক্ষে আবর্তনকাল ১১.১০±০.০২ ঘন্টা নির্ণিত হয়েছিল।[৫]
স্কাথি প্রথমত পৃথিবীর হাওয়াই দ্বীপ হতে পর্যবেক্ষণে চিহ্নিত হয়েছিল। স্কাথির বৈশিষ্ট্য এবং গঠন সম্পর্কে অনেক তথ্য পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণে বর্ণিত হয়। এটির ভৌত বৈশিষ্ঠ্যের বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায় ক্যাসিনি অভিযানের পর। ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৮টি ভিন্ন সময়ে ক্যাসিনি অভিযানের মহাকাশযান স্কাথিকে পর্যবেক্ষণ করে।[৫] তবে এই পর্যবেক্ষণসমূহ করা হয়েছিল ৯.৭ নিযুত কিলোমিটার (৬ নিযুত মাইল) দূর থেকে একটি পার্শ্ব-অতিক্রমী উড্ডয়নের সময়। এমনকি এসব পর্যবেক্ষণে স্কাথি ছিল একটি অস্পষ্ট ও অনুজ্জ্বল আলোকবিন্দু মাত্র।[১৪]
পৃথিবী থেকে স্কাথির দৃশ্যমান উজ্জ্বলতার আপাত মান ২৩.৬, এবং পরম চাক্ষুষ মাত্রা প্রায় ১৪,[৪] তাই এটি পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান সৌরজগতের বাইরের কয়েক লক্ষ বস্তুর তুলনায় অনেক কম উজ্জ্বল।[১৫] পৃথিবী থেকে, এটি শনি গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে এমন অনেক উজ্জ্বল বস্তুর কাছাকাছি দেখা যায় এবং অনুমান করা হয় এটির নিম্ন পৃষ্ঠের প্রতিফলন অনুপাত প্রায় ০.০৬।[৪][১৬]:৪১৩
ক্যাসিনির পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায় যে স্কাথির ব্যাস প্রায় ৮ কিলোমিটার (৫ মাইল)[৫] স্কাথির আলো প্রতিফলিত করার পরিমাণ এটির আবর্তনের সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়, ফলে বোঝা যায় যে এটি একটি অনিয়মিত আকৃতির বস্তু।[৪]:৪১৮ শনিগ্রহের গ্যালিক গোষ্টীর উপগ্রহ এরিয়াপাস এবং টারভোসের অনুরূপ স্কাথির বর্ণালী ঢাল +৫.২%/১০০ এনএম যা একটি লাল রঙের পৃষ্ঠ নির্দেশ করে।[৪]:৪১৬
শনির অনেক উপগ্রহ বরফ এবং কঠিন শিলা দিয়ে গঠিত, কিন্তু স্কাথির রাসায়নিক গঠন নির্ধারণ করা হয়নি। শনির অন্যান্য উপগ্রহের তুলনায় স্কাথির ভিন্ন ভৌতিক গঠন থাকতে পারে (কারণ এটি শনির আশেপাশে উদ্ভূত নাও হতে পারে)।[১৭] স্কাথির ঘনত্বও জানা হয়নি, তবে শনির অনিয়মিত উপগ্রহগুলির সাধারণত ঘনত্ব কম, প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১ গ্রামের নিচে[১৬] এবং কম ঘনত্ব এসকল অনিয়মিত উপগ্রহের সাধারণ ভৌত বৈশিষ্ট্য।[৪]:৪২৩–৪২৪
শনি গ্রহের নিয়মিত উপগ্রহ এবং সৌরজগতের অন্যান্য উপগ্রহের কক্ষপথের তুলোনায় অনিয়মিত উপগ্রহগুলির কক্ষপথের ভিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে স্কাথি এবং শনির অন্যান্য অনিয়মিত উপগ্রহের উৎপত্তি নিয়ে সক্রিয় বিতর্ক হয়েছে।[১৮] একটি গ্রহতন্ত্রের গ্রহ এবং উপগ্রহগুলি সাধারণত আদিগ্রহীয় চাকতিতে থাকা বস্তুগুলিকে বিবৃদ্ধি বা একত্রিত করে গঠন করে বলে ধারণা করা হয়।[১৯] যেহেতু একটি আদিগ্রহীয় চাকতির যেকোনো অংশের কণাগুলি সাধারণত একই অভিমুখে এবং একই গতিতে চলে, তাই কণাগুলির একত্রীকরণ থেকে যে উপগ্রহ তৈরি হয় তা চাকতিটির প্রায় সমতলে একটি মোটামুটি বৃত্তাকার, অগ্রহমুখী গতির কক্ষপথ থাকা উচিত।[১৯]
তবে শনির অন্যান্য অনিয়মিত কক্ষপথে আবর্তন করা প্রাকৃতিক উপগ্রহের মতই স্কাথির অনিয়মিত কক্ষপথ এটির উৎপত্তি সম্পর্কে বিকল্প জল্পনাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।[২] একটি সম্ভাবনা হলো স্কাথির উৎপত্তি মূলত শনি গ্রহের আশেপাশে ছাড়া অন্য কোথাও হয়েছিল এবং তারপর মহাকাশে ভ্রমণকালে শনির মধ্যাকর্ষণে বন্দি হয়ে গ্রহটির উপগ্রহে পরিণত হয়।[১৮] আরেকটি সম্ভাবনা হলো যে স্কাথি, শনির অন্য কোন উপগ্রহের ধ্বংসাবশেষের একটি টুকরো যা উপগ্রহের সাথে অন্য জ্যোতির্বস্তুর সংঘর্ষের সময় ছিটকে গিয়েছিল।[২০] যেহেতু কক্ষপথ প্রাথমিক অবস্থায় অত্যন্ত বিশৃঙ্খল এবং সংবেদনশীল হতে পারে, এটি সম্ভব যে কোন ধরনের সংঘর্ষ স্কাথির মতো একটি অত্যন্ত অনিয়মিত কক্ষপথ তৈরি করতে পারে,[২০] যদিও এই কক্ষপথগুলি সাধারণত খুব দীর্ঘ সময়কালে স্থিতিশীল থাকে না।[১৮]