লবণ বা নুন হল একটি খনিজ উপাদান ইহা সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) দ্বারা গঠিত একটি রাসায়নিক যৌগ যা লবণের বৃহত্তর শ্রেণীর অন্তর্গত। লবণ এক ধরনের প্রাকৃতিক স্ফটিক যা খনিজ লবণ বা হ্যালাইট নামেও পরিচিত। সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে লবণ থাকে। মহাসাগরে প্রতি লিটার পানিতে প্রায় ৩৫ গ্রাম (১.২ আউন্স) কঠিন পদার্থ থাকে,যার লবণাক্ততা ৩.৫%।
এটি প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য।লবণের স্বাদ তথা নোনতাকে মৌলিক স্বাদের একটি বলে গণ্য করা হয়। লবণ হল প্রাচীনতম এবং বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহৃত মশলাগুলির মধ্যে একটি। লবণাক্তকরণ খাদ্য সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি।
প্রাচীনকালে লবণ প্রক্রিয়াকরণের কিছু নজির আছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৬০০০ সালের দিকে বর্তমান রোমানিয়ার অঞ্চলে বসবাসকারী লোকেরা লবণ আহরণের জন্য সাগরের পানি ফুটাতো(সিদ্ধ করত); চীনে লবণ আহরণ সম্ভবত একই সময় শুরু হয়েছিল। প্রাচীন ইব্রীয়, গ্রিক, রোমান, বাইজেন্টাইন, মিশরীয় এবং ভারতীয়রাও লবণ ব্যবহার করতো। এভাবেই লবণ বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠে। তখন ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে নৌকার মাধ্যমে, বিশেষভাবে নির্মিত লবণ পরিবহনের রাস্তা দিয়ে এবং সাহারা মরুভূমির উপর দিয়ে উটের কাফেলায় লবণ পরিবহন করা হতো। লবণের ঘাটতি এবং সার্বজনীন প্রয়োজনীয়তার কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্র যুদ্ধে যেতে এবং লবণের উপর রাজস্ব/কর বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে। লবণ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়।লবণের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত তাৎপর্য রয়েছে।
সমুদ্রের পানি, অগভীর জলাশয়ে খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ ঝর্ণার পানি বাষ্পীভবনের মাধ্যমে অথবা লবণের খনি থেকে লবণ প্রক্রিয়াজাত করা হয়। লবণ থেকে উৎপাদিত প্রধান শিল্প পণ্য হল কস্টিক সোডা এবং ক্লোরিন। পলিভিনাইল ক্লোরাইড, প্লাস্টিক, কাগজের মন্ড এবং আরও অনেক শিল্প পণ্য তৈরিতে লবণ ব্যবহার করা হয়।প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়। যার প্রায় ৬% মানুষ খাওয়ার জন্য ব্যবহার করে। পানি পরিশোধন প্রক্রিয়া, বরফ গলানো (de-icing) প্রক্রিয়া, এবং কৃষিক্ষেত্রেও লবণ ব্যবহার করা হয়।খাবার লবণ মূলতঃ সামুদ্রিক লবণ। আয়োডিনের ঘাটতি মেটানোর জন্য এতে আয়োডিন যুক্ত করা হয়। আর লবণে অ্যান্টি-কেকিং এজেন্টও থাকে। রান্নায় এবং টেবিলে এর ব্যবহারের পাশাপাশি অনেক প্রক্রিয়াজাত খাবারেও লবণ থাকে।
সোডিয়ামতড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ এবং ইহা অভিস্রবণে সহায়তা করে। তাই সোডিয়াম মানব স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান।[১][২][৩] অতিরিক্ত লবণ খাওয়া শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। লবণের এই স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধ্যায়ন করানো হচ্ছে। তদনুসারে,বিশ্বের অনেক স্বাস্থ্য সংস্থা এবং উন্নত দেশগুলির বিশেষজ্ঞরা নোনতা খাবার কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।[৩][৪]বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণের(NaCl) সমপরিমাণ তথা ২গ্রামের কম সোডিয়াম(Na) খাওয়ার সুপারিশ করেছে।[৫][৬]
শব্দতত্ত্ব
লবণ বা নুন উভয় শব্দই এসেছে ইন্দো-ইরানীয় বা আর্য ধাতুমূল (সংষ্কৃত ও আবেস্তান) নৃণ থেকে, নুন বা নমক/ নিমক হল এর অর্ধ তৎসম রূপ, আর লবণ হল এর তদ্ভব রূপ, অর্থাৎ, নৃণ>নুন/নমক/নিমক>লবণ/লবন।
ইতিহাস জুড়ে, লবণের প্রাপ্যতা সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বুলগেরিয়ার সোলনিটসাটা(Solnitsata) শহর, যাকে ইউরোপের প্রথম শহর বলে বিবেচনা করা হয়, সেখানে একটি লবণের খনি ছিল। ৫৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে সেখানে লবণ ছিল যা বর্তমানে বলকান অঞ্চল নামে পরিচিত।[৭] এমনকি সোলনিটসাটা(Solnitsata) নামের অর্থই হল "লবণের কাজ"।
যদিও মানুষ গত একশ বছর ধরে খাবার সংরক্ষণের জন্য কৌটাজাতকরণ এবং হিমায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে, তথাপি হাজার হাজার বছর ধরে লবণ সবচেয়ে পরিচিত খাদ্য সংরক্ষক, বিশেষ করে মাংসের জন্য।[৮] বিভিন্ন প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে পূর্ব কুকুটেনি সংস্কৃতির নব্যপ্রস্তর যুগের লোকেরা ৬,০৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লবণ আহরণের জন্য ব্রিকেটেজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লবণ-সমৃদ্ধ ঝরনার পানিকে নিষ্কাশন করত।[৯] এই অপারেশন থেকে আহরিত লবণের প্রাথমিক উৎপাদন শুরু হওয়ার পরপরই এই সমাজে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। [১০]চীনেরশানশিতেইয়েনচেং এর কাছে শিচি হ্রদ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ সনের দিকে লবণ সংগ্রহ করা হতো, যা প্রাচীনতম লবণ উৎপাদনের মধ্যে একটি।[১১]
উদ্ভিদ টিস্যুর তুলনায় প্রাণী টিস্যু যেমন মাংস, রক্ত এবং দুধে বেশি লবণ থাকে।[১২] যাযাবর, যারা পশুপালনেই তাদের জীবন নির্বাহ করে তাদের খাবারের সাথে পৃথকভাবে লবণ খাওয়ার প্রয়োজন নেই, তবে যারা কৃষক তারা প্রধানত শস্য এবং উদ্ভিজ্জ্জ খাবার খায়, তাই তাদের খাবারের সাথে লবণ গ্রহণ করতে হবে।[১৩] সভ্যতার বিস্তারের সাথে সাথে লবণ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হয়। প্রাচীন হিব্রু, গ্রিক, রোমান, বাইজেন্টাইন, হিট্টাইট এবং প্রাচীনকালের অন্যান্য লোকদের কাছে লবণের মূল্য অনেক বেশি ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চুক্তি সিলমোহর করার জন্য লবণ ব্যবহার করা হত এবং প্রাচীন হিব্রুরা ঈশ্বরের সাথে একটি "লবণের চুক্তি" করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের আস্থা দেখানোর জন্য তাদের বেদীতে লবণ ছিটিয়েছিল।[১৪][ভাল উৎস প্রয়োজন] যুদ্ধের সময় প্রাচীন লোকদের একটি অভ্যাস ছিল যে তারা যুদ্ধের সময় জমিনকে লবণাক্ত করত; পরাজিত শহরের চারপাশে লবণ ছড়িয়ে দিত; উদ্ভিদের বৃদ্ধি রোধ করার জন্য। বাইবেলে রাজা আবিমেলেকের গল্প আছে, যেখানে বলা হয়েছে রাজা আবিমেলেক শেকেম নামক স্থানে এ কাজ করার জন্য ঈশ্বর কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিলেন।[১৫] বিভিন্ন গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে যে রোমান সেনাপতি সিপিও অ্যামিলিয়ানাস আফ্রিকানাস তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধে (১৪৬ খ্রিষ্টপূর্ব) পরাজিত হওয়ার পরে কার্টেজ শহরকে লবণ দিয়ে চাষ করেছিলেন।[১৬]
নব্যপ্রস্তর যুগেআনাতোলিয়ায় বাণিজ্যের সময় লেনদেনের জন্য অবসিডিয়ান(কাচের মতো দেখতে একজাতীয় আগ্নেয়শিলা) নামক পণ্যবিনিময়ের জন্য লবণ ব্যবহার করা হতো।[১৭] খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে প্রাচীন মিশরীয় সমাধিতেঅন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৈবেদ্যগুলির(উৎসর্গকৃত বস্তুর) মধ্যে লবণ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেমন: লবণাক্ত পাখি এবং লবণ দিয়ে মাখানো মাছ।[১৮] আনুমানিক ২৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে মিশরীয়রা লেবাননের সিডার, কাচ এবং প্রাকৃতিক বেগুনি রঙের বিনিময়ে ফিনিশিয়ানদের কাছে লবণ দিয়ে সংরক্ষিত মাছ রপ্তানি শুরু করে;[১৯] ফিনিশিয়ানরা তাদের ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্য সাম্রাজ্য জুড়ে মিশরের লবণযুক্ত মাছ এবং উত্তর আফ্রিকা হতে আমদানিকৃত লবণের ব্যবসা করত।[২০]হিরোডোটাস খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে লিবিয়া জুড়ে লবণ ব্যবসার পথ সম্পর্কে বর্ণনা করেছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম দিকে, লবণ আমদানির জন্য ওস্টিয়া থেকে লিবিয়ার রাজধানী পর্যন্ত লবণ পরিবহনের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল।[২১]
আফ্রিকায়, সাহারার দক্ষিণে মুদ্রা হিসেবে লবণ ব্যবহার করা হতো এবং আবিসিনিয়ায় মুদ্রা হিসেবে সৈন্ধ্যব লবণ ব্যবহার করা হতো।[১৩]তুয়ারেগরা ঐতিহ্যগতভাবে সাহারা জুড়ে বিশেষ করে আজালাই (লবণ বহনকারী কাফেলার) দ্বারা লবণ পরিবহনের রাস্তা সচল রেখেছিল। উটের কাফেলাগুলি এখনও দক্ষিণ নাইজার থেকে বিলমা পর্যন্ত মরুভূমিতে চলাচল করে, যদিও এখন বেশিরভাগ বাণিজ্য ট্রাকে হয়।প্রতিটি উট দুই গাট পশুখাদ্য এবং বাণিজ্য পণ্য উত্তর দিকে অর্থাৎ বিলমার দিকে নিয়ে যায় এবং লবণের পিলার ও খেজুর বোঝাই করে ফিরে আসে।[২২]গ্যাবনে ইউরোপীয়দের আগমনের আগে, উপকূলের লোকেরা সমুদ্রের লবণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ লোকদের সাথে একটি লাভজনক বাণিজ্য চালিয়েছিল। ইউরোপীয়দের নিয়ে আসা লবণের দ্বারা ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসার পতন হচ্ছিল, এভাবে উপকূলের স্থানীয়রা তাদের আগের লাভ হারিয়ে ফেলে; ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকেও সামুদ্রিক লবণ অভ্যন্তরীণ অংশে সর্বোত্তম প্রশংসিত মুদ্রা ছিল।[২৩]
সালজবার্গে মধ্য অস্ট্রিয়ার সালজাচ নদীর তীরে ১৭কি.মি. ব্যাপী বিস্তৃত লবণের স্তর বিদ্যমান।সালজাচ শব্দের আক্ষরিক অর্থ "লবণ নদী" এবং সালজবার্গ অর্থ "লবণ দুর্গ", উভয় নাম জার্মান ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে। সালজ (Salz) অর্থ লবণ। হলস্ট্যাট ছিল বিশ্বের প্রথম লবণ খনি।[২৪] প্রথম সহস্রাব্দের দিকে, সেল্টিক সম্প্রদায়গুলি প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে, মদ ও অন্যান্য বিলাস সামগ্রীর বিনিময়ে প্রচুর পরিমাণে বাণিজ্যিক লবণ এবং সল্টেড মাংস বিক্রি করতো।[৮]
বেতন(salary) শব্দটি লবণের ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে। এর কারণ অজানা; বর্তমানে অনেকেই দাবি করে যে রোমান সৈন্যদের মাঝে মাঝে বেতন হিসেবে লবণ দেওয়া হত।তবে এ দাবি ভিত্তিহীন।[২৫][২৬][২৭]সালাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ "লবণযুক্ত", এবং শাক-সবজি লবণাক্ত করার প্রথাটি প্রাচীন রোমানদের থেকে এসেছে।.[২৮]
পূর্বে লবণ নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে। ইতালির ভেনিস শহর জেনোভা শহরের সাথে লবণ নিয়ে যুদ্ধ করে জিতেছিল এবং আমেরিকান বিপ্লবে এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ওভারল্যান্ডের বাণিজ্য রুটের শহরগুলো লবণের উপর শুল্ক আরোপের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী হয়েছিল[২৯]। লিভারপুলের মতো শহর চেশিয়ারের লবণের খনি থেকে আহরিত লবণ রপ্তানি করার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছিল।[৩০] বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন সময়ে তাদের জনগণের উপর লবণের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রার খরচ দক্ষিণ স্পেনের লবণ উৎপাদন থেকে অর্থায়ন করা হয়েছিল বলে জানা যায়, এবং ফ্রান্সে জবরদস্তিমূলক লবণ কর ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ ছিল।কর প্রত্যাহার করার পরে, নেপোলিয়ন যখন সম্রাট হয়েছিলেন তার নেপলীয় যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য এই কর পুনরায় আরোপ করেছিলেন এবং ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এই কর বাতিল করা হয়নি।[২৯]মহাত্মা গান্ধী "ডান্ডি মার্চ" বা "লবণ সত্যাগ্রহ"-এ ১ লক্ষ বিক্ষোভকারীদের একটি সমাবেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যে সময় তারা(বিক্ষোভকারীরা) ঔপনিবেশিক(ব্রিটিশ) সরকার কর্তৃক আরোপিত লবণ ট্যাক্সের বিরোধিতার অংশ হিসেবে সমুদ্র থেকে নিজেরাই লবণ তৈরি করেছিল। আইন অমান্যের এই আন্দোলন অসংখ্য ভারতীয়কে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং একজন অভিজাত ব্যক্তি ও অল্প জনসমর্থন নিয়ে শুরু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে একটি জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল।[৩১]
লবণের বেশিরভাগই সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl)। সমুদ্রের লবণ এবং খনি থেকে আহরিত লবণে কিছু দুষ্প্রাপ্য উপাদান থাকতে পারে। খনি থেকে আহরিত লবণকে সাধারণত পরিশোধিত করতে হয়। লবণের স্ফটিক স্বচ্ছ এবং ঘনক আকৃতির হয়; লবণ সাধারণত সাদা দেখায় তবে অপদ্রব্যের উপস্থিতির কারণে নীল বা বেগুনি আভাযুক্ত হতে পারে। পানিতে দ্রবীভূত হলে সোডিয়াম ক্লোরাইড Na+ এবং Cl− আয়নে বিভক্ত হয়। লবণের দ্রবণীয়তা প্রতি লিটারে ৩৫৯ গ্রাম।[৩২] ঠান্ডা দ্রবণ থেকে লবণ দ্বি-হাইড্রেট NaCl·2H2O হিসাবে স্ফটিক হয়ে যায়। সোডিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণের বৈশিষ্ট্য বিশুদ্ধ পানির থেকে আলাদা; হিমাঙ্ক হল −২১.১২ °C (−৬.০২ °F) লবণের ২৩.৩১ wt%, এবং স্যাচুরেটেড লবণ দ্রবণের স্ফুটনাংক প্রায় ১০৮.৭ °C (২২৭.৭ °F)।
ভোজ্য লবণ
মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর সুস্বাস্থ্যের জন্য লবণ অপরিহার্য। লবণের স্বাদ পাঁচটি মৌলিক স্বাদের মধ্যে একটি।[৩৩] লবণ অনেক রান্নায় ব্যবহার করা হয় এবং খাবারে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য প্রায়ই খাওয়ার টেবিলে লবণদানি পাওয়া যায়। লবণ বহুল উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে একটি। টেবিল লবণ হল পরিশোধিত লবণ যাতে প্রায় ৯৭ থেকে ৯৯ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে।[৩৪][৩৫][৩৬] কেকে সাধারণত, অ্যান্টিকেকিং এজেন্ট যেমন সোডিয়াম অ্যালুমিনোসিলিকেট বা ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট যোগ করা হয় যাতে এটি সহজে ফুলে ওঠে।পটাশিয়াম আয়োডাইট ধারণকারী আয়োডিনযুক্ত লবণ, সর্বত্র পাওয়া যায়। কিছু লোক লবণের অতিরিক্ত আর্দ্রতা শুষে নিতে অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত লবণের দলা ভাঙতে সাহায্য করার জন্য তাদের লবণদানি গুলোতে ডেসিক্যান্ট (যেমন রান্না না করা চালের কয়েকটি দানা)[৩৭] বা সল্টিন ক্র্যাকার রাখে।[৩৮]
ফর্টিফাইড টেবিল লবণ
খাওয়ার জন্য বিক্রি করা টেবিল লবণে কিছু পদার্থ সংযোজন করা হয়, যা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার সমাধান করে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। সংযোজনকৃত পদার্থ গুলো দেশভেদে আলাদা হয়। আয়োডিন মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। আয়োডিনের ঘাটতির কারণে থাইরক্সিন হরমোন কম উৎপন্ন হয়। ফলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে গলগন্ড (থাইরয়েড গ্রন্থি বৃদ্ধি) অথবা হাইপোথাইরয়েডিজম এবং শিশুদের মধ্যে ক্রিটিনিজম(বামনত্ব) রোগ দেখা যায়।[৩৯] ১৯২৪[৪০] সাল থেকে এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করা শুরু হয়েছে এবং এতে অতি অল্প পরিমাণ পটাশিয়াম আয়োডাইড, সোডিয়াম আয়োডাইড বা সোডিয়াম আয়োডেট মেশানো হয়। আয়োডিন স্থিতিশীল করতে অল্প পরিমাণে ডেক্সট্রোজ যোগ করা যেতে পারে।[৪১] আয়োডিনের ঘাটতি সারা বিশ্বে প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে এবং এটি মানসিক প্রতিবন্ধকতার প্রধান প্রতিরোধযোগ্য কারণ।[৪২] আয়োডিনযুক্ত খাবার লবণ ব্যবহারের ফলে বর্তমানে উল্লেখযোগ্যভাবে আয়োডিনের অভাবজনিত ব্যাধিগুলি হ্রাস পেয়েছে।[৪৩]
সোডার হলুদ প্রুসিয়েট নামে পরিচিত সোডিয়াম ফেরোসায়ানাইড কখনও কখনও অ্যান্টিকেকিং এজেন্ট(anticaking agent) হিসাবে লবণের সাথে যোগ করা হয়।[৪৪][৪৫] প্রায় ১৯১১ সাল থেকে এই জাতীয় অ্যান্টিকেকিং এজেন্টগুলি যুক্ত করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট লবণে যোগ করা হয়েছিল যাতে এটি আরও সহজে প্রবাহিত হয়।[৪৬] ১৯৮৮ সালে বিষাক্ততা সংস্থার দ্বারা খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে সোডিয়াম ফেরোসায়ানাইডের ব্যবহার সাময়িকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল।[৪৪] অন্যান্য অ্যান্টিকেকিং এজেন্টগুলির মধ্যে রয়েছে ট্রাইক্যালসিয়াম ফসফেট, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট, ফ্যাটি অ্যাসিড লবণ (অ্যাসিড লবণ), ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড, সিলিকন ডাই অক্সাইড, ক্যালসিয়াম সিলিকেট, সোডিয়াম অ্যালুমিনোসিলিকেট এবং ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনোসিলিকেট।[৪৭] ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ঔষধ প্রশাসন (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন FDA উভয়ই সর্বশেষ দুটি যৌগতে অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।[৪৭]
"ডাবল ফরটিফাইড সল্ট"-এ আয়োডিন এবং আয়রন লবণে যোগ করা হয়। আয়রন, আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতা দূর করে, যা উন্নয়নশীল বিশ্বের আনুমানিক ৪০% শিশুর মানসিক বিকাশ প্রভাবিত করে। লোহার(আয়রন) সাধারণ উৎস হল ফেরাস ফিউমারেট।[৪৮] ফলিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি৯) লবণের আরেকটি সংযুক্তি,যা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যার উপস্থিতি খাদ্য লবণকে হলুদ রঙ দেয়। ফলিক অ্যাসিড নিউরাল টিউব ত্রুটি এবং রক্তসল্পতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অল্পবয়সী মায়েদের গর্ভকালীন স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। [৪৮]
দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ফ্লোরাইডের অভাব ব্যাপক হারে দন্তক্ষয়ের কারণ।[৪৯]দাঁতের ক্ষয় কমানোর লক্ষ্যে খাবার লবণে ফ্লোরাইড যোগ করা যেতে পারে, বিশেষ করে যেসব দেশে ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট এবং পানি থেকে উপকৃত হয়নি। কিছু ইউরোপীয় দেশে এই অভ্যাসটি বেশি দেখা যায় যেখানে পানির ফ্লুরাইডেশন করা হয় না। ফ্রান্সে, বিক্রি হওয়া ৩৫% খাবার লবণে সোডিয়াম ফ্লোরাইড যোগ করা হয়।[৪৮] পরিশোধিত লবণ শিল্প, বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলে যে কিছু কিছু সমুদ্র এবং লবণের শিলাতে আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত আয়োডিন লবণ থাকে না।[৫০]
অন্যান্য প্রকার
অপরিশোধিত সামুদ্রিক লবণে অল্প পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম হ্যালাইড এবং সালফেট, শৈবাল, লবণ-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া এবং পলিকণা থাকে। ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম লবণকে হালকা তিক্তভাব প্রদান করে এবং অপরিশোধিত সমুদ্র লবণকে হাইগ্রোস্কোপিক (অর্থাৎ, এটি খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ করা হলে এটি ধীরে ধীরে বাতাস থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে) করে তোলে। শৈবালগুলো মৃদু "মাছ" বা "সমুদ্র-বায়ুর"মত গন্ধ তৈরি করে, যা অর্গানোব্রোমিন যৌগ(C ও Br বন্ধনযুক্ত জৈব যৌগ) থেকে আসে।পলিকণা লবণকে একটি নিস্তেজ ধূসর চেহারা দেয়। পলিকণার পরিমাণ উৎসের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। যেহেতু স্বাদ এবং গন্ধযুক্ত যৌগগুলি মানুষ স্বল্প ঘনত্বে শনাক্ত করতে পারে, তাই খাবারের উপরে সামুদ্রিক লবণ ছিটিয়ে দিলে বিশুদ্ধ সোডিয়াম ক্লোরাইডের চেয়ে অধিক তীব্র গন্ধ ছড়াতে পারে। রান্নার সময় সামুদ্রিক লবণ যোগ করা হলে, এই অপ্রত্যাশিত গন্ধ বা স্বাদ খাদ্য উপাদানগুলির দ্বারা প্রশমিত হতে পারে [৫১]পরিশোধিত লবণ শিল্প, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলে যে, কিছু সমুদ্র এবং লবণের শিলাতে আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত আয়োডিন লবণ থাকে না।[৫০]
লবণে তাদের উৎসের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন খনিজ উপাদান রয়েছে, যার প্রত্যেকটি লবণকে অনন্য স্বাদ দেয়। ফ্লেউর ডি সেল(লবণের ফুল) পাত্রে ব্রাইন বাষ্পীভূত করার মাধ্যমে প্রাপ্ত লবণ একটি প্রাকৃতিক সামুদ্রিক লবণ।ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান রন্ধনশৈলীতে, তথাকথিত "বাঁশের লবণ" প্রস্তুত করা হয় একটি বাঁশের পাত্রে দুই প্রান্তে কাদা লাগিয়ে লবণ ভাজা ভাজা করে।[৫২]। এই পণ্যটি বাঁশ এবং কাদা থেকে খনিজ পদার্থ শোষণ করে এবং ডোয়েনজাং (একটি গাঁজানো শিমের পেস্ট) এর অ্যান্টিক্লাস্টোজেনিক এবং অ্যান্টিমিউটাজেনিক বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি করে বলে দাবি করা হয়েছে।[৫৩]
কিচেন লবণ টেবিল লবণের চেয়ে আকারে বড় হয় এবং এটি রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এটি মাংস বা মাছ লবণাক্ত করতে, রুটি বা প্রিটজেল তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। ইহা তেলের সাথে মিলিত হলে স্ক্রাবিং এজেন্ট হিসাবে কাজ করে।[৫৪]
জারিত লবণ অতি-সূক্ষ্ম দানাদার হয় যাতে এটি দ্রুত ব্রাইন তৈরির জন্য দ্রবীভূত হয়।
খাদ্যে লবণ
বেশিরভাগ খাদ্যদ্রব্যে লবণ থাকে, তবে স্বাভাবিকভাবেই এসকল খাদ্যদ্রব্যে যেমন মাংস, শাকসবজি এবং ফলের মধ্যে এটি খুব কম পরিমাণে থাকে। প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রায়ই লবণ যোগ করা হয় (যেমন টিনজাত খাবার, লবণাক্ত খাবার, আচারযুক্ত খাবার এবং জলখাবার বা অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাবার)। সেখানে লবণ সংরক্ষক এবং স্বাদবৃদ্ধিকারক(ফ্লেভার) হিসেবে কাজ করে। মাখন এবং পনির পণ্য তৈরিতে দুগ্ধ লবণ ব্যবহার করা হয়।[৫৫] একটি ফ্লেভার হিসাবে, লবণ সেই খাবারের তিক্ততা দমন করে অন্যান্য খাবারের স্বাদ বাড়ায় এবং সেগুলিকে আরও সুস্বাদু এবং তুলনামূলকভাবে মিষ্টি করে তোলে।[৫৬]
বিদ্যুৎ চালিত রেফ্রিজারেটরের আবির্ভাবের আগে, সল্টিং(লবণাক্তকরণ) ছিল খাদ্য সংরক্ষণের অন্যতম প্রধান পদ্ধতি। সামুদ্রিক হেরিং মাছে প্রতি ১০০ গ্রামে ৬৭ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে, যেখন সংরক্ষিত স্যামন মাছে, ৯৯০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে। একইভাবে, শূকরের মাংসে সাধারণত ৬৩ মি.গ্রা সোডিয়াম থাকে যেখানে লবণে সংরক্ষিত শূকরের মাংসে ১৪৮০ মি.গ্রা.সোডিয়াম থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম আলুতে থাকে ৭ মি.গ্রা. কিন্তু আলুর চিপসে ৮০০ মি.গ্রা. সোডিয়াম থাকে।[১২]রান্নাতে স্বাদের জন্য লবণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। লবণ দিয়ে রান্নার কৌশলের মধ্যে অন্যতম হলো লবণের ক্রাস্ট এবং ব্রিনিং। সোডিয়াম ক্লোরাইডের সরাসরি ব্যবহার ছাড়াও পশ্চিমা খাবারে লবণের প্রধান উৎস হল রুটি এবং অন্যান্য খাদ্যশস্য, মাংসজাত খাবার এবং দুধ ও দুগ্ধ্বজাত খাবার।[১২]
অনেক পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংস্কৃতিতে, লবণ ঐতিহ্যগতভাবে মসলা হিসাবে ব্যবহৃত হয় না।[৫৭] এসব দেশে লবণের পরিবর্তে সয়া সস, ফিশ সস এবং ঝিনুক সসের মতো মশলাগুলি ব্যবহার করা হয়। এগুলোতে উচ্চমাত্রায় সোডিয়াম থাকে এবং পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত খাদ্য লবণের মতোই ভূমিকা রাখে। এগুলি প্রায়ই টেবিলের মশলা হিসাবে ব্যবহার না করে রান্নার জন্য ব্যবহৃত হয়।[৫৮]
জিহ্বার স্বাদ শনাক্তকরণ কোষে উপস্থিত সোডিয়াম স্বাদ রিসেপ্টর দ্বারা মানুষ লবণের স্বাদ অনুভব করে।[৫৯] মানুষের সংবেদনশীল স্বাদ পরীক্ষার গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে এপিথেলিয়াল সোডিয়াম চ্যানেল (ENaC) এর প্রোটিওলাইজড কোষগুলো মানবদেহে লবণের স্বাদ গ্রহণকারী হিসাবে কাজ করে।[৬০]
খাদ্য লবণে ওজন অনুসারে ৪০% এর কম সোডিয়াম থাকে,তাই ৬ গ্রাম(১ চা চামচ) পরিবেশনে প্রায় ২,৪০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে।[৬১] সোডিয়াম মানবদেহে ইলেক্ট্রোলাইট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি স্নায়ু এবং পেশীগুলিকে সঠিকভাবে কাজ করতে সহায়তা করে এবং শরীরের অঙ্গগুলিতে অসমোরেগুলেশনের মাধ্যমে তরলের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।[৬২] পশ্চিমা খাদ্যাভ্যাসে সোডিয়ামের প্রধান উৎস হলো লবণ।[৩] অনেক পশ্চিমা দেশে প্রতিদিনের খাদ্যাভাসে লবণ খাওয়ার পরিমাণ প্রায় ১০ গ্রাম। পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক দেশে লবণ গ্রহণের পরিমাণ তার চেয়েও বেশি।[৬৩] অনেক প্রক্রিয়াজাত খাবারে উচ্চ মাত্রায় সোডিয়াম খাওয়ার ফলে মোট পরিমাণের উপর বড় প্রভাব পড়ে।[৬৪] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের খাওয়া সোডিয়ামের ৭৫% প্রক্রিয়াজাত এবং রেস্তোরাঁর খাবার থেকে আসে, ১১% রান্না এবং পাতে(প্লেটে) ব্যবহৃত লবণ থেকে এবং বাকিটা প্রাকৃতিকভাবে খাদ্যসামগ্রীতে পাওয়া যায়।[৬৫]
যেহেতু অত্যধিক সোডিয়াম খাওয়া কার্ডিওভাসকুলার রোগের[৩] ঝুঁকি বাড়ায়,তাই বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা জনগণকে খাদ্যতালিকায় লবণ গ্রহণ কমিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন।[৩][৬৬][৬৭][৬৮] উচ্চ সোডিয়াম গ্রহণ স্ট্রোক সহ অন্যান্য কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং কিডনি রোগের ঝুঁকির বাড়ায়।[২][৬৩] প্রতিদিন সোডিয়াম গ্রহণের পরিমাণ ১ গ্রাম হ্রাস করলে কার্ডিওভাসকুলার রোগের আশঙ্কা প্রায় ৩০% কমে যায়।[১][৩] প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশু যাদের মধ্যে গুরুতর কোন অসুস্থতা নেই, তারা সাধারণ উচ্চমাত্রা থেকে সোডিয়াম গ্রহণের পরিমাণ হ্রাস করলে রক্তচাপ হ্রাস পায়।[৬৭][৬৯] কম সোডিয়াম গ্রহণ করলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্তচাপের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়।[৭০][৭১]
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করে যে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ২০০০ মিলিগ্রামের কম সোডিয়াম (যা ৫ গ্রাম লবণে থাকে) খাওয়া উচিত।[৬৬] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নির্দেশিকা সুপারিশ করে যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত আফ্রিকাবাসী, মার্কিনী,মধ্যবয়সী,বয়স্ক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ১৫০০ মিলিগ্রামের বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করা উচিত নয়। একইসাথে ফল, সবজি ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে প্রতিদিন ৪৭০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম গ্রহণ করা উচিত।[৩][৭২]
একটি পর্যালোচনা সুপারিশ করেছে যে প্রতিদিন কমপক্ষে ১২০০ মিলিগ্রামের (যা ৩ গ্রাম লবণে থাকে) কম সোডিয়াম গ্রহণ করতে হবে,যদিও উন্নত দেশগুলো প্রতিদিন ২,৩০০ মিলিগ্রামের কম সোডিয়াম গ্রহণের সুপারিশ করে,[৩] একটি পর্যালোচনা সুপারিশ করেছে যে প্রতিদিন কমপক্ষে ১২০০ মিলিগ্রামের (যা ৩ গ্রাম লবণে থাকে) কম সোডিয়াম গ্রহণ করতে হবে। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ সব বয়সের এবং জাতিগোষ্ঠীর জন্য সিস্টোলিক রক্তচাপে বৃদ্ধির কারণ।[৬৭] অন্য একটি পর্যালোচনা দাবি করেছে যে প্রতিদিন ২,৩০০ মিলিগ্রামের কম সোডিয়াম গ্রহণ করা উপকারী না অপকারী এর উপর কোন যুক্তিসঙ্গত ও পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায় নি।[৭৩]
বিভিন্ন প্রমাণাদি লবণ এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের মধ্যে আরও জটিল সম্পর্ক দেখিয়ে বলে "সোডিয়াম গ্রহণ এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ বা মৃত্যুহারের মধ্যে সম্পর্ক U-আকৃতির, বেশি বা কম সোডিয়াম গ্রহণ উভয় ক্ষেত্রেই এসব রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।"[৭৪] গবেষণায় দেখা গেছে যে অত্যধিক লবণ গ্রহণের ফলে মৃত্যুহার বৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে উচ্চ রক্তচাপযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। পরবর্তীকালে রক্তচাপ বিবেচনা না করে সীমিত লবণ গ্রহণকারীদের মধ্যে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির মাত্রা একই রকম বলে মনে হয়েছে। এই প্রমাণ দেখায় যে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের প্রাথমিকভাবে সুপারিশকৃত মাত্রায় সোডিয়াম কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, সমস্ত ব্যাক্তিকে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ গ্রাম (১০-১৩ গ্রাম লবণের সমতুল্য) সোডিয়াম গ্রহণের একটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত।[৭৪]
বিশ্বে অক্ষমতার জন্য দুটি সবচেয়ে লক্ষণীয় খাদ্যাভ্যাসগত ঝুঁকির মধ্যে একটি হল উচ্চ সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার।[৭৫]
বিশ্বে উৎপাদিত লবণের মাত্র ৬% খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। অবশিষ্টাংশের মধ্যে ১২% জল কন্ডিশনার প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়, ৮% ডি-আইসিং হাইওয়েতে (বরফ অপসারণে) এবং ৬% কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।[৭৬] সোডিয়াম ক্লোরাইড আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম অজৈব কাঁচামালগুলোর মধ্যে একটি। সোডিয়াম ক্লোরাইড থেকে উৎপাদিত প্রধান রাসায়নিক পণ্য হল কস্টিক সোডা এবং ক্লোরিন। এগুলি পিভিসি, কাগজের পাল্প(মন্ড) এবং অন্যান্য অনেক অজৈব এবং জৈব যৌগ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনে ফ্লাক্স হিসেবেও লবণ ব্যবহার করা হয় যাতে গলিত লবণের একটি স্তর গলিত ধাতুর উপরে ভাসে এবং লোহাসহ অন্যান্য ধাতব দূষিত পদার্থগুলিকে সরিয়ে দেয়। এটি সাবান এবং গ্লিসারিন তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়, যেখানে এটি চর্বিকে স্যাপোনিফাই করতে ব্যবহৃত হয়। লবণ ইমালসিফায়ার হিসাবে সিন্থেটিক রাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। লবণের আরেকটি ব্যবহার হল মৃৎপাত্রকে অগ্নিসংযোগের জন্য যখন চুল্লিতে নেয়া হয় তখন যোগ করা লবণ সিরামিক উপাদানের পৃষ্ঠে চাকচিক্যতা প্রদান করে।[৭৭]
বালি বা নুড়ির মতো আলগা উপাদান দিয়ে ড্রিলিং(ঢালাই) করার সময়, ধসে যাওয়া প্রতিরোধ করার জন্য এবং একটি স্থিতিশীল "প্রাচীর" প্রদানের জন্য ড্রিলিং তরলে(ঢালাইয়ের মিশ্রণে ) লবণ যোগ করা যেতে পারে। আরও অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে যাতে লবণ ব্যবহার করা হয় যেমন কাপড় শিল্পে রংয়ের মর্ডান্ট হিসেবে, জল পরিশুদ্ধ করার জন্য রজন পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে, চামড়ার ট্যানিং, মাংস ও মাছ সংরক্ষণ এবং মাংস ও সবজির কৌটাজাতকরণে।[৭৭][৭৮][৭৯]
সমুদ্রের লোনা জল ফুটিয়ে বাষ্পীভূত করে লবণ উৎপাদন করা হয়। এছাড়া লবণাক্ত কূপ অথবা লবণাক্ত হ্রদের জল থেকেও লবণ আহরণ করা হয়ে থাকে। লোনা জলের পাশাপাশি পাথুরে খনি হতেও লবণ আহরণ করা হয়। ২০০২ সালে বিশ্বে মোট ২১০ মিলিয়ন টন লবণ উৎপাদন করা হয়। শীর্ষ ৫ উৎপাদক রাষ্ট্র হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, (৪০.৩ মিলিয়ন টন), চীন (৩২.৯), জার্মানি (১৭.৭), ভারত (১৪.৫), এবং কানাডা (১২.৩).[৮০]
শিল্পোন্নত দেশগুলোর মোট খাদ্য লবণ উৎপাদনের একটি ক্ষুদ্র অংশ ইউরোপে (৭%) উৎপন্ন হয়[৮১], যদিও বিশ্বব্যাপী মোট উৎপাদনের ১৭.৫% খাদ্যে ব্যবহৃত হয়।[৮২]
২০১৮ সালে, বিশ্বব্যাপী লবণের মোট উৎপাদন ছিল ৩০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন, শীর্ষ ছয় উৎপাদক হচ্ছে চীন (৬৮ মিলিয়ন), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৪২ মিলিয়ন), ভারত (২৯ মিলিয়ন), জার্মানি (১৩ মিলিয়ন), কানাডা (১৩ মিলিয়ন) এবং অস্ট্রেলিয়া (১২ মিলিয়ন) মেট্রিক টন।[৮৩]
থাইল্যান্ডের নান প্রদেশের বো ক্লুয়ে জেলায় লবণ উৎপাদনের জন্য লবণের কূপে লোনা পানি সিদ্ধ করা হয়।
লবণ উৎপাদন প্রাচীনতম রাসায়নিক শিল্পগুলির মধ্যে একটি।[৮৪] লবণের একটি প্রধান উৎস হল সমুদ্রের জল, যার লবণাক্ততা প্রায় ৩.৫%।[৭৬] এর মানে হল প্রতি ১কিলোগ্রাম(২.২ lbs) পানিতে ৩৫ গ্রাম (১.২ oz) লবণ তথা, সোডিয়াম(Na+ )
এবং ক্লোরাইড(Cl− ) আয়ন দ্রবীভূত থাকে। [৮৫] বিশ্বের মহাসাগরগুলো লবণের অফুরন্ত উৎস এবং সর্বত্র লবণের প্রাচুর্যের অর্থ হল মহাসাগরগুলোতে অগণিত লবণ মজুদ রয়েছে।[৭৮] উচ্চ বাষ্পীভবন এবং কম বৃষ্টিপাত হয় এমন সামুদ্রিক দেশগুলোতে সামুদ্রিক জলের বাষ্পীভবন হল লবণ উৎপাদনের প্রধান পদ্ধতি।লবণের বাষ্পীভবন পুকুরগুলো সমুদ্রের পানি দিয়ে ভর্তি করা হয় এবং পানি শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে লবণের স্ফটিক সংগ্রহ করা যায়। কখনও কখনও এই পুকুরগুলো উজ্জ্বল রঙের হয়ে থাকে, কারণ কিছু প্রজাতির শেওলা এবং অন্যান্য অণুজীব উচ্চ লবণাক্ততার পরিস্থিতিতে বংশবৃদ্ধি করে।[৮৬]
অন্যান্য দেশে সহস্রাব্দ বছর ধরে সমুদ্র এবং হ্রদের বাষ্পীভবন থেকে সৃষ্ট বিস্তৃত পাললিক স্তর থেকে লবণ আহরণ করা হয়। এই উৎসগুলি সরাসরি খনন করে শিলা লবণ উৎপাদন করে বা জলাধারের মধ্যে পাম্প করে নিষ্কাশন করা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই, লবণকে যান্ত্রিক বাষ্পীভবন দ্বারা পরিশুদ্ধ করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে, অগভীর খোলা প্যানে লবণ উত্তপ্ত করা হয় বাষ্পীভবনকে ত্বরান্বিত করার জন্য। ভ্যাকুয়াম(শূন্যস্থান)-ভিত্তিক পদ্ধতিগুলিও অনেক সময় অনুসরণ করা হয়।[৭৯] অপরিশোধিত লবণকে রাসায়নিক উপাদান দিয়ে বিভিন্ন অপদ্রব্যগুলি ( ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম লবণ) পরিশোধিত করা হয়। অতঃপর বাষ্পীভবনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করার মাধ্যমে লবণ পরিশুদ্ধ হয়।[৮৭] অনেক সময় আলবার্গার প্রক্রিয়া ব্যবহার করে লবণ উৎপন্ন করা হয়, যার মধ্যে ভ্যাকুয়াম প্যান বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত।[৮৮]প্যারাগুয়েরচাকোর একটি আদিবাসী গোষ্ঠী আয়োরিওরা, ভারতীয় লবণ গাছ (মেটেনাস ভিটিস-আইডিয়া) এবং অন্যান্য গাছের কাঠ পুড়িয়ে উৎপাদিত ছাই থেকে লবণ সংগ্রহ করে।[৮৯]
পাকিস্তানের খেওড়া লবণ খনি বিশ্বের বৃহত্তম লবণ খনিগুলোর মধ্যে একটি। খনিটিতে উনিশটি তলা রয়েছে, যার মধ্যে এগারোটি ভূগর্ভস্থ, এবং ৪০০ কি.মি. (২৫০ মাইল) দীর্ঘ পথ রয়েছে। এখানে রুম এবং স্তম্ভ(চেম্বার) পদ্ধতিতে লবণ খনন করা হয়, যেখানে উপরের স্তরকে সাপোর্ট করার জন্য প্রায় অর্ধেক উপাদান রেখে দেওয়া হয়। এখান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৩৮৫,০০০ টন হারে প্রায় ৩৫০ বছর হিমালয় লবণ উত্তোলন করা যাবে বলে ধারণা করা হয় হয়।[৯০]
লবণ তৈরি
প্রকৃতিতে লবণের সন্ধানের চারটি সাধারণ উপায় হ'ল মাটিতে শুকনো লবণের খনি,
মহাসাগরে, ভূগর্ভস্থ ঝর্ণা এবং পৃথিবীর নিচে পাথর। প্রাচীন লবণ হ্রদ যে জায়গাগুলিতে মানুষ প্রথমবারের মতো ভূমির তলদেশে লবণ পেয়েছিলশুকিয়ে গেছে। পশু, যা মানুষের চেয়ে বেশি লবণের প্রয়োজন হয়, সাধারণত কিন্তু এই জায়গাগুলো মানুষের আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই জায়গাগুলিকে কখনও কখনও "লবণ-চাটা" বা লবণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এটিকে চাটানোর জায়গাও বলা হয় কারণ প্রাণীগুলি সেখানে নোনতা জমিকে চাটাত। মানুষ লবণ সংগ্রহের জন্য, এটি মাটি থেকে খনন করে আলাদা করা হয়েছিল। লবণের বৃহত্তম ও প্রচুর উত্স হ'ল সমুদ্র। তবে লবণ পাওয়ার আগে সমুদ্রের জল থাকতে হবে এটি কয়েক ঘন্টা ধরে সিদ্ধ করতে হবে। এটি লবণ উৎপাদন একটি খুব ব্যয়বহুল পদ্ধতি কারণ এটি এটি কাঠ এবং কয়লার মতো প্রচুর জ্বালানী গ্রহণ করে। লবণের চেয়ে প্রায়শই বেশি জ্বালানী মূল্যবান হতে পারে। কিন্তু এর একটা সমাধান আছে। সমুদ্রের দ্বারা মানবসৃষ্ট পুকুরে সমুদ্রের জল, এটি রোদে পোড়া হয়। শুকানো বা গরম করা। কিন্তু এটি একটি খুব ধীর প্রক্রিয়া। পুকুরের জল শুকিয়ে যায় এবং লবণ স্ফটিক তৈরি হতে এক বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। তবে এতে লবণ এবং সূর্যের আলো উভয়ই থাকে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।[৯১][৯২][৯৩]
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
ধর্ম ও সংস্কৃতিতে লবণের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। বামনরা বলিদানের সময়, হিট্টাইটরা আচার-অনুষ্ঠানে এবং অমাবস্যার সময় সেমিটিক ও গ্রিকদের উৎসবের সময়, কর্কশ আওয়াজের সহিত লবণকে আগুনে নিক্ষেপ করা হত॥[৯৪] প্রাচীন মিশরীয়, গ্রিক এবং রোমানরা তাদের দেবতাদেরকে নুন জল দিয়ে আমন্ত্রণ জানাত এবং খ্রিস্ট্রীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু লোক লবণ পানিকে পবিত্র জলের উৎস বলে মনে করে।[৯৫]আজটেকের পৌরাণিক কাহিনীতে আছে, Huixtocihuatl ছিলেন একজন দেবী যিনি লবণ এবং নোনা জলের তত্ত্বাবধায়ক।[৯৬]
লবণকে হিন্দুধর্মে অত্যন্ত শুভ পদার্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। হিন্দু ধর্মের বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেমন ঘর-উষ্ণায়ন এবং বিবাহের ক্ষেত্রে লবণ ব্যবহৃত হয়[৯৭]জৈন ধর্মে, ভক্তরা তাদের ভক্তি বোঝাতে এক চিমটি লবণ দিয়ে কাঁচা চাল দেবতার সামনে নিবেদন দেয় এবং ছাই দাফনের আগে ব্যক্তির দহনকৃত দেহাবশেষে লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়।[৯৮]মহাযান বৌদ্ধ ঐতিহ্যে বিশ্বাস করা হয় যে, লবণ অশুভ আত্মাদের তাড়াতে পারে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রত্যেকের বাম কাঁধে এক চিমটি লবণ ছুড়ে দেওয়া হয় কারণ এটি অশুভ আত্মাদের ঘরে প্রবেশ করতে বাধা দেয় বলে তারা বিশ্বাস করে॥[৯৯]শিন্টৌ ধর্মতে, লোকেরা ধর্মীয় শুদ্ধিকরণের জন্য শিও(塩,"লবণ") ব্যবহার করে।তারা কোন স্থাপনাকে অমঙ্গল থেকে রক্ষা এবং স্থাপনার পৃষ্ঠপোষককে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে স্থাপনার প্রবেশদ্বারে খাবার লবণের ছোট স্তূপ রাখে।[১০০]
হিব্রু বাইবেলে পঁয়ত্রিশটি শ্লোক আছে যেখানে লবণের কথা বলা হয়েছে।[১০১] এর মধ্যে একটি লূতের স্ত্রীর কথা উল্লেখ রয়েছে, যিনি সদোম এবং গোমোরাহ শহরগুলির দিকে ফিরে তাকানোর সাথে সাথে লবণের স্তম্ভে পরিণত হয়েছিলেন (আদি পুস্তক ১৯:২৬) যখন ওই শহর করে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছিল। যখন বিচারক আবিমেলেক সেকেম শহর ধ্বংস করেছিলেন, তখন তিনি লবণ ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবত যে কেউ এটিতে পুনরায় বসবাস করবে তার জন্য অভিশাপ হিসাবে (বিচারক অংশ ৯:৪৫) তিনি লবণ ছিটিয়ে দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। বাইবেলের জব পুস্তকে মসলা হিসেবে লবণের প্রথম উল্লেখ রয়েছে,"যেটা অস্বাস্থ্যকর সেটা কি লবণ ছাড়া খাওয়া যায়? ডিমের সাদা অংশে কি কোনো স্বাদ থাকে?" (জব ৬:৬)।[১০১] বাইবেলের নতুন টেস্টামেন্টের ছয়টি আয়াতে লবণের কথা বলা হয়েছে। পর্বতের উপদেশে, যিশু তাঁর অনুসারীদের "পৃথিবীর লবণ" বলে উল্লেখ করেছেন। প্রেরিত পৌল খ্রিস্টানদেরকে উৎসাহিত করেছিলেন "তোমাদের কথোপকথন সর্বদা করুণায় পরিপূর্ণ, লবণে পরিপূর্ণ হোক" (কলোসিয়ানস ৪:৬)।[১০১] গির্জায় প্রচলিত বিধিবদ্ধ উপাসনায় লবণ বাধ্যতামূলক।[১০২]সেল্টিকদের পবিত্রতার তৃতীয় পদ্ধতি (এই পদ্ধতিতে এক্সরসিজম তথা অশুভ আত্মা সরানোর মন্ত্রও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে) হলো লবণ ব্যবহার করা, যা গির্জার পবিত্রতায় ব্যবহার করা হয়। রোমান ক্যাথলিক রীতিতে "পবিত্র পানি" তৈরির প্রথাগত নিয়ম হলো পানিতে লবণ যোগ।
[১০২]
ইহুদি ধর্মে, শনিবার (ইহুদিদের বিশ্রাম/ছুটির দিনে) কিডুশ(ছুটি বা পবিত্র দিনে ইহুদিদের বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠান) করার সময় তারা নোনতা(লবণাক্ত) রুটি খায়।কিডুশের পরে টেবিলের চারপাশে পাউরুটি দেওয়ার সময় রুটির উপরে কিছু লবণ ছড়িয়ে দেওয়া বা রুটিটি সামান্য লবণে ডুবিয়ে নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।[১০৩] মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে চুক্তি রক্ষা করার জন্য ইহুদিরা বিশ্রামবারে রুটি লবণে ডুবিয়ে দেয়।[৯৫]
পৌত্তলিক ধর্মে,লবণ পৃথিবীর উপাদানের প্রতীক। এটি ক্ষতিকারক বা অশুভ শক্তির একটি এলাকাকে পরিষ্কার করে বলেও বিশ্বাস করা হয়। এক থালা লবণ এবং এক থালা পানি প্রায় সবসময় তাদের বেদিতে(মন্ডপে) উপস্থিত থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠানে লবণ ব্যবহার করা হয়।[১০৪]
↑ কখCommittee on the Consequences of Sodium Reduction in Populations; Food Nutrition, Board; Board on Population Health Public Health Practice; Institute Of, Medicine; Strom, B. L.; Yaktine, A. L.; Oria, M. (২০১৩)। Strom, Brian L.; Yaktine, Ann L.; Oria, Maria, সম্পাদকগণ। Sodium intake in populations: assessment of evidence। Institute of Medicine of the National Academies। আইএসবিএন978-0-309-28295-6। ডিওআই:10.17226/18311। পিএমআইডি24851297। ১৯ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ অক্টোবর ২০১৩।
↑ কখগBuss, David; Robertson, Jean (১৯৭৩)। Manual of Nutrition। Her Majesty's Stationery Office। পৃষ্ঠা 37–38। আইএসবিএন978-0-11-241112-3।
↑ কখWood, Frank Osborne। "Salt (NaCl)"। Encyclopædia Britannica online। ২ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ অক্টোবর ২০১৩।
↑Suitt, Chris। "Covenant of salt"। Rediscovering the Old Testament। Seed of Abraham Ministries। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ অক্টোবর ২০১৩।
↑Gevirtz, Stanley (১৯৬৩)। "Jericho and Shechem: A Religio-Literary Aspect of City Destruction"। Vetus Testamentum। 13 (1): 52–62। জেস্টোর1516752। ডিওআই:10.2307/1516752।
↑Gainsford, Peter (১১ জানুয়ারি ২০১৭)। "Salt and salary: were Roman soldiers paid in salt?"। Kiwi Hellenist: Modern Myths about the Ancient World। ১৩ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১৭।
↑Wood, Frank Osborne; Ralston, Robert H.। "Salt (NaCl)"। Encyclopædia Britannica। ২ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১৩।
↑"The sense of taste"। ১৬ মার্চ ২০১৩। ৮ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ অক্টোবর ২০১৩।
↑"Tesco Table Salt 750g"। Tesco। ১১ মে ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১০। Nutritional analysis provided with Tesco Table Salt states 38.9 percent sodium by weight which equals 97.3 percent sodium chloride
↑"Canning and Pickling salt"। Penn State University। ৭ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।; "FAQs"। Morton Salt। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
↑"Morton Salt FAQ"। ১৯ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ মে ২০০৭।
↑ কখBurgess, Wilella Daniels; Mason, April C.। "What Are All Those Chemicals in My Food?"। School of Consumer and Family Sciences, Purdue University। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১।
↑Pieters, A.J.; Flint, D.; Garriott, E.B.; Wickson, E.J.; Lamson-Scribner, F.; Brackett, G.B.; Atwater, H.W.; Alvord, H.E.; Withcombe, J.; Howard, L.O. (১৮৯৯)। Experiment Station Work। Bread and the Principles of Bread Making। U.S. Department of Agriculture। পৃষ্ঠা 28–30। ১৬ জুন ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ নভেম্বর ২০১৫।
↑"Prevention of cardiovascular disease"। National Institute for Health and Clinical Excellence। ১ জুন ২০১০। ১৮ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ মে ২০১৫।
↑"Sodium and food sources"। Salt। Centers for Disease Control and Prevention। ১৯ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ অক্টোবর ২০১৩।
↑ কখগHe, F.J.; Li, J.; Macgregor, G.A. (৩ এপ্রিল ২০১৩)। "Effect of longer term modest salt reduction on blood pressure: Cochrane systematic review and meta-analysis of randomised trials."। BMJ (Clinical Research Ed.)। 346: f1325। ডিওআই:10.1136/bmj.f1325। পিএমআইডি23558162।
↑"Sodium and salt"। American Heart Association। ২০১৬। ১৭ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুন ২০১৬।
↑Dietary Guidelines for Americans(পিডিএফ)। U.S. Department of Agriculture & U.S. Department of Health and Human Services। ২০১০। পৃষ্ঠা 24। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৫। African Americans, individuals with hypertension, diabetes, or chronic kidney disease and individuals ages 51 and older, comprise about half of the U.S. population ages 2 and older. While nearly everyone benefits from reducing their sodium intake, the blood pressure of these individuals tends to be even more responsive to the blood pressure-raising effects of sodium than others; therefore, they should reduce their intake to 1,500 mg per day.
↑Bolen, Wallace P. (ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। "Salt"(পিডিএফ)। US Geological Survey, Mineral Commodity Summaries (প্রতিবেদন)। US Geological Survey। ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑"Salt made the world go round"। Salt.org.il। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭। ৫ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুলাই ২০১১।
↑"Alberger process"। Manufacture of salt: Uses of artificial heat। Encyclopædia Britannica online। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ অক্টোবর ২০১৩।
Carusi, Cristina (২০০৮)। Il sale nel mondo greco, VI a.C.-III d.C.: luoghi di produzione, circolazione commerciale, regimi di sfruttamento nel contesto del Mediterraneo antico [Salt in the Greek World, from the Sixth Century BC to the Third Century AD: Places of Production, Circulation, and Commercial Exploitation Schemes in the Ancient Mediterranean] (Spanish ভাষায়)। Edipuglia। আইএসবিএন9788872285428।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: অচেনা ভাষা (link)