বাংলায় মারাঠা আক্রমণের সময় যুদ্ধাপরাধ বলতে ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সালে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ চলাকালে মারাঠা বাহিনী কর্তৃক বাংলায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধসমূহকে বোঝায়। এসব অপরাধের মধ্যে ছিল গণহত্যা, লুটতরাজ[২], অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণ।
পটভূমি
১৭৪১ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত মারাঠা নেতা প্রথম রঘুজী ভোঁসলের সৈন্যবাহিনী বাংলার নবাবের শাসিত অঞ্চলসমূহে (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা) আক্রমণ চালাতে থাকে। এই আক্রমণসমূহের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার নবাবের কাছ থেকে চৌথ নামক কর আদায় করা। বাংলার নবাব আলীবর্দী খান এতে সম্মত না হলে মারাঠা অশ্বারোহী সৈন্যরা বারবার বাংলায় ঝটিকা আক্রমণ চালাতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে তারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে স্বল্পস্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং এসময় দখলকৃত অঞ্চলসমূহে বসবাসকারী জনসাধারণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়।
গণহত্যা
মারাঠারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণের কাছ থেকে খাজনা দাবি করে। জনসাধারণ এই খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালানো হয়। খাজনা দিতে অপারগ হওয়ার কারণে মারাঠা অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা উদ্দেশ্যহীনভাবে বহু মানুষকে হত্যা করে কিংবা বিকলাঙ্গ করে দেয়[৩]। একজন সমসাময়িক ঐতিহাসিক লিখেছেন, মারাঠারা গর্ভবতী নারী এবং শিশুদেরকেও হত্যা করত[৪]। এক হিসাব অনুযায়ী, দশ বছরব্যাপী মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় ৪,০০,০০০ অধিবাসী প্রাণ হারায়[১]।
লুটতরাজ
রঘুজীর বাহিনী
রঘুজীর আক্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল লুটতরাজ। রাজ্য জয় তার উদ্দেশ্য ছিল না। ফলে তার বিশাল সৈন্যবাহিনী দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ব্যাপক হারে লুটতরাজ চালায়। উদাহরণস্বরূপ - ১৭৪২ সালের মে মাসে মারাঠা সৈন্যরা মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠন করে এবং কেবল জগৎ শেঠের বাড়ি থেকেই তিন লক্ষ টাকা লুট করে[২][৫]। ১৭৪৪ সালে মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বর্ধমান থেকে সাত লক্ষ টাকা রাজস্ব লুট করেন[৬]। এভাবে দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী রঘুজীর মারাঠা হানাদারেরা বাংলা জুড়ে লুটতরাজ চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
বালাজীর বাহিনী
মুঘল সম্রাটের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তি অনুযায়ী মারাঠাদের পেশোয়া বালাজী বিহারের মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল রঘুজীর হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করা। কিন্তু তার রক্ষক বাহিনী লুটপাটের ব্যাপারে রঘুজীর বাহিনীর কোনো অংশে কম ছিল না। পথিমধ্যে তারাও ব্যাপক হারে লুটতরাজ চালিয়েছিল[২]।
নবাবের বাহিনী
মারাঠা উপদ্রবের কারণে নবাব আলীবর্দীর সামরিক ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। অর্থাভাবের কারণে তিনি তার সৈন্যদের নিয়মিতভাবে বেতন দিতে অপারগ ছিলেন। ফলে কখনো কখনো নবাবের সৈন্যরাও লুটতরাজে লিপ্ত হয়ে পড়ত[৭]।
অগ্নিসংযোগ
নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজের পাশাপাশি মারাঠারা অগ্নিসংযোগেও লিপ্ত হয়। তারা বাংলার অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ - ১৭৪২ সালের মে মাসে মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠনের পর প্রত্যাবর্তনকালে মারাঠা হানাদারেরা পথিমধ্যে অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং জ্বলন্ত গ্রামসমূহের সারি তাদের পদচিহ্ন হিসেবে থেকে যায়[৮]। ১৭৪২ সালের সেপ্টেম্বরে কাটোয়ার যুদ্ধে পরাজয়ের পর পলাতক মারাঠা সৈন্যরা মেদিনীপুরে যায়, সেখানকার একটি বিখ্যাত রেশম-পালন কেন্দ্র রাধানগর লুট করে এবং জ্বালিয়ে দেয়[৮]। এভাবে দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী তারা বাংলার অসংখ্য গ্রাম ও জনপদ ভস্মীভূত করে দেয়।
নারী নির্যাতন
দশ বছরব্যাপী বাংলা আক্রমণকালে অসংখ্য নারী মারাঠাদের হাতে নির্যাতিত হয়। মারাঠারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুন্দরী নারীদের অপহরণ করে[৪][৭]। অসংখ্য নারী মারাঠা সৈন্যদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয়। সমসাময়িক সূত্রসমূহের বর্ণনানুযায়ী, মারাঠা সৈন্যরা হিন্দু নারীদের মুখে বালি ভরে দিত, তাদের হাত ভেঙ্গে দিত এবং পিছমোড়া করে বেঁধে তাদেরকে গণধর্ষণ করত[৪][৮]। সমসাময়িক বাঙালি কবি গঙ্গারাম নারীদের ওপর মারাঠাদের অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, তারা সুন্দরী নারীদের টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেত এবং দড়ি দিয়ে তাদের আঙ্গুলগুলো তাদের ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে দিত। একজন বর্গি (মারাঠা সৈন্য) একজন নারীর সম্ভ্রমহানি করার পরপরই আরেকজন বর্গি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এসব নারীরা যন্ত্রণায় চিৎকার করত। এইসব পাপপূর্ণ কার্যকলাপের পর তারা এসব নারীদেরকে মুক্ত করে দিত[৯]। সমসাময়িক বর্ধমানের মহারাজার রাজসভার পণ্ডিত বনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারও মারাঠা সৈন্যদের সম্পর্কে লিখেছেন, তারা সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন করে এবং সতী স্ত্রীদের অপহরণ করে[১০]।
নারীদের প্রতি মারাঠা হানাদারদের নিষ্ঠুর নির্যাতন বাংলার জনসাধারণকে তীব্রভাবে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। বহু মানুষ নিজ পরিবারের নারীদের রক্ষা করার জন্য মারাঠাদের দখলকৃত এলাকা থেকে নবাবের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলসমূহে চলে যায় (যেমন - ১৭৪২ সালে মারাঠারা হুগলী দখল করে নেয়ার পর সেখানকার বহু মানুষ তাদের পরিবারের নারীদের সম্মান রক্ষার জন্য তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করেছিল[৫] এবং গঙ্গা নদীর পূর্বতীরে চলে গিয়ে গোদাগারীতে আশ্রয় নিয়েছিল[২])।
আরো দেখুন
তথ্যসূত্র