প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ (অকল্যান্ডের বোকামি নামেও পরিচিত) ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সালের মধ্যে আফগানিস্তান ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘটিত হয়। এতে আফগানরা জয়লাভ করে।[২][৩][৪][৫][৬] এই যুদ্ধে আফগান যোদ্ধাদের হাতে ৪,৫০০ ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈনিক এবং ১২,০০০ শিবির অনুসারী নিহত হয়। তবে সামগ্রিকভাবে পরাজিত হলেও সর্বশেষ লড়াইয়ে ব্রিটিশরা আফগানদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল।[১]গ্রেট গেমের সময় সংঘটিত সংঘর্ষের মধ্যে এটি অন্যতম প্রধান যুদ্ধ। এসময় এশিয়ার আধিপত্য নিয়ে যুক্তরাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল।[৭]
১৮৩০ এর দশকে ব্রিটিশরা ভারতে সুরক্ষিত অবস্থানে ছিল। কিন্তু ১৮৩৭ সাল নাগাদ আফগানিস্তান, সিন্ধুতে অস্থিতিশীলতা এবং শিখ সাম্রাজ্যের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে লর্ড পালমারস্টোন ও জন হবহাউস ভীত হয়ে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে ভারতে রুশ আক্রমণ হতে পারে ধারণা করেছিলেন। রুশ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ায় ধীরে ধীরে তার নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে চলছিল। রুশদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতার প্রস্তাব দিয়ে ব্রিটিশরা কাবুলে আফগানিস্তানের আমিরদোস্ত মুহাম্মদ খানের কাছে দূত পাঠায়।[৮][৯]
সম্প্রতি দোস্ত মুহাম্মদ খান আফগানিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী পেশাওয়ার শিখদের কাছে হারিয়েছিলেন এবং তা পুনরুদ্ধারের জন্য সহায়তা চান। কিন্তু ব্রিটিশরা সহায়তা দিতে ইচ্ছুক ছিল না। এদিকে রুশরা কাবুলে দূত হিসেবে ইয়ান ভিতকেভিচকে পাঠিয়েছে এই খবর ভারতের গভর্নর জেনারেললর্ড অকল্যান্ড জানতে পারেন। সমর্থনের জন্য দোস্ত মুহাম্মদ খান রুশদের সাথে হাত মেলাতে পারেন এমন সম্ভাবনা ছিল।[৭] ১৮৩৮ সালে আফগান ও রুশদের মধ্যে আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর ভারতে রুশ আগ্রাসন নিয়ে ব্রিটিশদের ভীতি আরো ঘনীভূত হয়। পারস্যের কাজার রাজবংশ রুশদের সহায়তায় হেরাত অবরোধ করে কিন্তু ব্রিটিশরা যুদ্ধের হুমকি দেয়ার পর তারা পিছিয়ে আসে।
রুশরা দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য বৃদ্ধি করতে চাইছিল। তারা কাজারদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। কাজারদের সাথে আফগানিস্তানের অঞ্চলগত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদ ছিল। লর্ড অকল্যান্ড প্রতিপক্ষকে দূর করে আফগানিস্তানে ব্রিটিশপন্থি শুজা শাহ দুররানিকে শাসক হিসেবে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা করেন।
ব্রিটিশরা আফগানিস্তানে আক্রমণের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জানায় যে তারা বিদেশি হস্তক্ষেপ দূর করে শুজার বৈধ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে।[১]
জন কেনের নেতৃত্বে সর্বমোট ২১,০০০ ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈনিকদের বাহিনী ১৮৩৮ সালের ডিসেম্বরে পাঞ্জাব থেকে যাত্রা শুরু করে। পরে তার বদলে যথাক্রমে স্যার উইলোবি কটন এবং এরপর উইলিয়াম এলফিনস্টোনকে নেতৃত্ব দেয়া হয়। তাদের সাথে ছিলেন কলকাতা সরকারের সাবেক প্রধান সচিব উইলিয়াম হে ম্যাকনাগটেন। তাকে কাবুলে ব্রিটেনের প্রধান প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছিল। ১৮৩৯ সালের মার্চের শেষভাগ নাগাদ ব্রিটিশ বাহিনী বোলান গিরিপথ অতিক্রম করে কোয়েটার বালুচ শহরে পৌছায় এবং কাবুলের দিকে যাত্রা শুরু করে। তারা দুর্গম এলাকা, মরুভূমি এবং ৪,০০০ মিটার উচু পার্বত্য গিরিপথ অতিক্রম করে ১৮৩৯ সালের ২৫ এপ্রিল কান্দাহার পৌছে শিবির স্থাপন করে।
১৮৩৯ সালের ২২ জুলাই একটি ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে ব্রিটিশরা গজনি দুর্গ দখল করে নেয়। এখান থেকে পূর্বের খাইবার পাখতুনখাওয়ার দিকের সমতল ভূমির দিকে নজর রাখা যেত। ব্রিটিশরা শহরের একটি ফটক উড়িয়ে দিয়েছিল। দুর্গ দখলের সময় ব্রিটিশদের পক্ষে ২০০ জন ও আফগানদের পক্ষে ৫০০ জন হতাহত হয়। ১.৬০০ আফগানকে বন্দী করা হয়। গজনিতে রসদ সরবরাহ ভালো থাকায় সামনে অগ্রসর হওয়া সহজ হয়ে পড়ে।
এরপর ব্রিটিশরা দোস্ত মুহাম্মদ খানের বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি বড় বিজয় লাভ করে। এতে দোস্ত মুহাম্মদের এক ছেলে আফগানদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দোস্ত মুহাম্মদ খান তার অনুগত অনুসারীদের নিয়ে বামিয়ানে এবং পরে বুখারা পালিয়ে যান। ৩০ বছর পর ১৮৩৯ সালের আগস্টে শুজা শাহ দুররানি পুনরায় কাবুলের সিংহাসনে বসেন।
ভারতে ফেরার সময় ১৮৩৯ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ বাহিনীর বোম্বে কলাম প্রতিশোধ হিসেবে কালাতের বালুচ গোত্রীয় দুর্গ আক্রমণ করে।[১০] ইতিপূর্বে বোলান গিরিপথের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় বালুচরা ব্রিটিশদের আক্রমণ করেছিল।
আফগানদের উপর দখলদারিত্ব এবং উত্থান
অধিকাংশ ব্রিটিশ সৈনিক ভারতে ফিরে আসে এবং শুধু ৮,০০০ সৈনিক আফগানিস্তানে থেকে যায়। তবে দ্রুত প্রতীয়মান হয় যে ব্রিটিশদের সবল উপস্থিতির মাধ্যমেই শুজার শাসন টিকে থাকতে পারে। ব্রিটিশ উপস্থিতি ও শাহ শুজার শাসনের ফলে আফগানরা ক্ষুব্ধ ছিল। সৈনিকদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য উইলিয়াম হে ম্যাকনাগটেন তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে আফগানিস্তানে নিয়ে আসার অনুমতি দেন যার ফলে আফগানরা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।[১১] এর ফলে ধারণা জন্মায় যায় ব্রিটিশরা স্থায়ীভাবে আধিপত্য স্থাপন করতে চাইছে। দোস্ত মুহাম্মদ ব্রিটিশ ও তাদের আফগান মিত্রদের উপর ব্যর্থ আক্রমণ চালান। এরপর তিনি আত্মসমর্পণ করেন এবং ১৮৪০ সালে ভারতে নির্বাসিত হন।
এই সময় নাগাদ ব্রিটিশরা বালা হিসার দুর্গ ত্যাগ করে এবং কাবুলের উত্তরপূর্বে স্থাপিত সেনানিবাসে সরে আসে। এই স্থান প্রতিরক্ষার দিক থেকে উত্তম ছিল না। এলাকাটি নিচু ও জলাকীর্ণ এবং পাহাড়বেষ্টিত ছিল। এছাড়াও সেনানিবাসটি ছিল সেনাসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি বড় এবং গুদাম ও রসদ ছিল মূল সেনানিবাস থেকে ৩০০ গজ দূরের পৃথক দুর্গে। [১২]
১৮৪১ সালের এপ্রিল ও অক্টোবরের মধ্যে অসন্তুষ্ট আফগান গোত্রগুলি দোস্ত মুহাম্মদ খানের পুত্র ওয়াজির আকবর খানকে সমর্থনের জন্য বামিয়ান ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার উত্তরে অন্যান্য স্থানে জোট বাধতে শুরু করে। তারা মীর মাসজিদি খান ও অন্যান্য নেতাদের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে।[১৩] ১৮৪১ সালের নভেম্বরে উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ অফিসার স্যার আলেক্সান্ডার বার্নাস ও তার সহযোগীরা কাবুলে জনতার হাতে নিহত হন। ব্রিটিশরা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে জনতা প্রতিরোধে আরো উৎসাহী হয়ে উঠে। ৯ নভেম্বর আফগানরা কাবুলের স্বল্প প্রতিরক্ষাসম্পন্ন সরবরাহ দুর্গে আক্রমণ করার পর ব্রিটিশদের অবস্থা আরো অবনতি হয়।
পরের সপ্তাহগুলিতে ব্রিটিশ কমান্ডাররা আকবর খানের সাথে আলোচনার চেষ্টা চালায়। আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের উপস্থিতির বিনিময়ে ম্যাকনাগটেন গোপনে আকবর খানকে উজির হওয়ার প্রস্তাব দেন। একই সময় আকবর খানকে হত্যার জন্য বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হয় এবং আকবর খান তা জানতে পারেন। ২৩ ডিসেম্বর সেনানিবাসের নিকটে আকবর খান ও ম্যাকনাগটনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে ম্যাকনাগটন ও তার সাথের অন্য তিনজন অফিসারকে আকবর খান হত্যা করেন। ম্যাকনাগটনের লাশ কাবুলের রাস্তায় টেনে নিয়ে বাজারে প্রদর্শন করা হয়। এলফিনস্টোন ইতোমধ্যে তার সেনাদের নেতৃত্ব কিছু অংশে হারিয়েছেন এবং তার কর্তৃত্ব অনেক হ্রাস পায়।
এলফিনস্টোনের বাহিনীর ধ্বংস
১৮৪২ সালের ১ জানুয়ারি উভয় পক্ষ একটি সম্মতিতে উপনীত হয়। এতে বলা হয় যে আফগানিস্তান থেকে ব্রিটিশ গেরিসন ও এর উপর নির্ভরশীলরা নিরাপদে দেশত্যাগ পারবে।[১৪] এর পাঁচদিন পরে প্রত্যাহার শুরু হয়। ব্রিটিশ পক্ষে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১৬,৫০০ যার মধ্যে ৪,৫০০ জন সৈনিক ও ১২,০০০ শিবির অনুসারী ছিল। ব্রিটিশ বাহিনীর অধিকাংশ ছিল ভারতীয় ইউনিটভুক্ত এবং এতে ৪৪তম রেজিমেন্ট অব ফুট ছিল একমাত্র ব্রিটিশ ব্যাটেলিয়ন।
তুষারাবৃত গিরিপথ অতিক্রমের সময় গিলাজাই যোদ্ধাদের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। গান্দামাক গিরিপথে ব্রিটিশ বাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক সংখ্যায় নিহত হয়। তাদের মধ্যে শুধু ড. উইলিয়াম ব্রাইডনজালালাবাদ ঘাটিতে পৌছান। এসময় বাহিনীর সদস্যসংখ্যা চল্লিশের নিচে নেমে আসে। লড়াইয়ে ৪৪তম রেজিমেন্ট অব ফুটের প্রায় সবাই নিহত হয়। শুধু ক্যাপ্টেন জেমস সুটার, সার্জেন্ট ফেয়ার ও সাতজন সৈনিক বন্দী হওয়ায় বেঁচে যায়।[১৫]
প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড
একই সময়ে আফগানিস্তানের অন্যান্য ব্রিটিশ অবস্থানের উপর আফগানরা আক্রমণ করে। আক্রান্ত স্থানের মধ্যে ছিল কান্দাহার, জালালাবাদ ও গজনি। এর মধ্যে কান্দাহারে সবচেয়ে বেশি ব্রিটিশ সেনার উপস্থিতি ছিল। গজনি পরাজিত হলেও অন্যান্য গেরিসনগুলি ১৮৪২ সালের বসন্তে ভারত থেকে সাহায্যকারী সৈন্যবাহিনী আসার পূর্ব পর্যন্ত টিকে ছিল। আকবর খান জালালাবাদের নিকটে পরাজিত হন এবং কাবুল পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটিশরা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।
এদিকে লর্ড অকল্যান্ড স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং লর্ড এলেনবোরো তার স্থলে গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। তাকে যুদ্ধের অবসান করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এলেনবোরো কান্দাহার ও জালালাবাদের সৈনিকদেরকে প্রতিশোধ গ্রহণ ও বন্দীদের মুক্তির পর ফিরে আসার নির্দেশ দেন।
১৮৪২ সালের আগস্টে জেনারেল নট কান্দাহার থেকে অগ্রসর হন। তিনি বিভিন্ন এলাকায় লুঠপাট চালান এবং গজনি দখল করেন। ইতোমধ্যে জেনারেল পোলক জালালাবাদ আসার জন্য খাইবার গিরিপথ পরিষ্কার করা শুরু করেন। এর আগে জেনারেল সেল অবরোধ তুলে নিয়েছিলেন। জালালাবাদ থেকে জেনারেল পোলক আকবর খানকে পরাজিত করেন। কাবুল দখলের পূর্বে ব্রিটিশদের সম্মিলিত বাহিনী সকল প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে। একমাস পরে বন্দীদের মুক্ত করা এবং শহর তছনছ করার পর ব্রিটিশরা খাইবার গিরিপথ দিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করে। দোস্ত মুহাম্মদ খান এরপর পুনরায় কাবুলের সিংহাসনে বসেন।
↑ কখগBaxter, Craig। "The First Anglo–Afghan War"। Federal Research Division, Library of Congress। Afghanistan: A Country Study। Baton Rouge, LA: Claitor's Pub. Division। আইএসবিএন1-57980-744-5। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১।
Fowler, Corinne, (2007) Chasing Tales: Travel Writing, Journalism and the History of British Ideas about Afghanistan, Amsterdam: Rodopi.
Greenwood, Joseph, (1844) Narrative of the Late Victorious Campaign in Affghanistan, under General Pollock: With Recollections of Seven Years' service in India. London: H. Colburn
Kaye, Sir John, (1860) History of the First Afghan War, London.
Macrory, Patrick, (1966) The Fierce Pawns, J.B. Lippincott Company, Philadelphia
Macrory, Patrick, (2002) Retreat from Kabul: The Catastrophic British Defeat in Afghanistan, 1842. Guilford, CT: The Lyons Press. আইএসবিএন৯৭৮-১-৫৯৯২১-১৭৭-০
Morris, Mowbray. The First Afghan War. London: Sampson Low, Marston, Searle, and Rivington (1878).
Perry, James M., (1996), Arrogant Armies: Great Military Disasters and the Generals Behind Them. New York:Wiley. আইএসবিএন৯৭৮-০-৪৭১-১১৯৭৬-০