খাদ্য শৃঙ্খল বা খাদ্য শিকল হচ্ছে উৎপাদক জীব (অর্থাৎ, উদ্ভিদ যা খাদ্য তৈরির জন্য সূর্যের বিকিরণ ব্যবহার করে) থেকে শুরু করে শীর্ষে অবস্থানকারী সর্বোচ্চ স্তরের খাদক বা শিকারী প্রজাতির (গ্রিজলি ভাল্লুক বা খুনে তিমির মতো) এবং বিয়োজক তথা মৃতভোজী (যেমন: কেঁচো বা ঘুনপোকা) এবং পচনকারীতে (যেমন ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া) সমাপ্ত হওয়া কোনও খাদ্য জালের বিভিন্ন অংশের একটি রৈখিক সম্পর্ক। এছাড়াও একটি খাদ্য শৃঙ্খল আরও দেখায় বিভিন্ন জীব খাদ্যের জন্য কীভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তর একটি আলাদা ট্রফিক স্তর প্রতিনিধিত্ব করে। খাদ্য জাল থেকে খাদ্য শৃঙ্খল আলাদা। কারণ কোন বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন প্রাণির মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের জটিল নেটওয়ার্ক একত্রিত হয়ে খাদ্য জাল তৈরি হয়; অন্যদিকে খাদ্য শৃঙ্খল কেবল অল্প কয়েকটি জীবের মধ্যে খাদ্য-খাদকের একমূখী সম্পর্ক। অনেকগুলি খাদ্য শৃঙ্খলের মধ্যে প্রাকৃতিক আন্তঃসংযোগগুলো মিলে একটি খাদ্য জাল তৈরি হয়। অর্থাৎ, খাদ্য শৃঙ্খল হচ্ছে খাদ্য জালের একটি অংশ।
খাদ্য জালের ট্রফিক কাঠামোর পরিমাণের জন্য ব্যবহৃত একটি সাধারণ মেট্রিক হচ্ছে খাদ্য শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্য। এর সরলতম রূপটিতে, একটি খাদ্য শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ট্রফিক খাদক এবং খাদ্য জালের ভিত্তির মধ্যে সংযোগের সংখ্যা। একটি সম্পূর্ণ খাদ্য জালের কোন খাদ্য শৃঙ্খলের গড় দৈর্ঘ্য হচ্ছে খাদ্য জালের অন্তর্ভুক্ত সব খাদ্য শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্যের গাণিতিক গড়।[১][২] খাদ্য শৃঙ্খল হচ্ছে শক্তি পরিবহনের একটি রেখাচিত্র। কোন খাদ্য শৃঙ্খল শুরু হয় উৎপাদক থেকে। আর উৎপাদককে খেয়ে থাকে প্রথম স্তরের খাদক। প্রাথমিক স্তরের খাদককেও কোনও দ্বিতীয় স্তরের খাদক খেতে পারে, এভাবে ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয় স্তরের খাদককে তৃতীয় স্তরের খাদক এবং তৃতীয় স্তরের খাদককেও সর্বোচ্চ স্তরের খাদক খেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদক হিসাবে কোনও সবুজ উদ্ভিদ (যেমন ঘাস) দিয়ে কোনও খাদ্য শৃঙ্খল শুরু হতে পারে। প্রথম স্তরের খাদক ঘাসফড়িং ঘাস তথা উৎপাদককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই ঘাসফড়িংকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে ব্যাঙ। তাই ব্যাঙ হচ্ছে দ্বিতীয় স্তরের খাদক। ব্যাঙ পুনরায় তৃতীয় স্তরের খাদক সাপের খাদ্যে পরিণত হয়। আবার এই সাপকেও খেতে পারে বাজপাখি। তাই বাজপাখি হচ্ছে সর্বোচ্চ স্তরের খাদক। ফলে খাদ্য শৃঙ্খলটি হয়:
বেশিরভাগ প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য শৃঙ্খল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি খাদ্য শৃঙ্খল থেকে কেবল একটি উপাদান সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়ায় কোনও প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। উৎপাদক জীব তথা উদ্ভিদ সৌর শক্তি বা রাসায়নিক শক্তিকে ব্যবহারযোগ্য যৌগে রূপান্তরিত করতে পারে। যেহেতু, সালোকসংশ্লেষণের জন্য সূর্য প্রয়োজনীয়, তাই সূর্য অদৃশ্য হয়ে গেলে জীব জগৎ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পচনকারী জীব (ডিকম্পোজার) মৃত প্রাণিদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে জৈব যৌগগুলোকে সাধারণ পুষ্টি উপাদানে বিভক্ত করে পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়। এসব পুষ্টি উপাদান পুনরায় উদ্ভিদের জৈব যৌগ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয়। অনুমান করা হয় যে পরিবেশে ১,০০,০০০ রকমেরও বেশি পচনকারী জীব রয়েছে।
অনেক খাদ্য জালে একটি কি-স্টোন প্রজাতি থাকে। কি-স্টোন প্রজাতি হচ্ছে এমন কোন প্রজাতি যা আশেপাশের পরিবেশে বৃহৎ প্রভাব ফেলে এবং সরাসরি খাদ্য শৃঙ্খলকে প্রভাবিত করতে পারে। যদি এই কি-স্টোন প্রজাতিটি মারা যায়, তাহলে এটি পুরো খাদ্য শৃঙ্খলের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। কি-স্টোন প্রজাতিগুলো তৃণভোজীদেরবাস্তুতন্ত্রের সবুজ গাছপালা ব্যাপক হারে হ্রাস করা থেকে বিরত রাখে এবং কোন প্রজাতির বৃহত্তর বিলুপ্তি প্রতিরোধ করে। [৩]
সর্বপ্রথম দশম শতাব্দীতে আরব বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক আল-জাহিজ খাদ্য শৃঙ্খলের ধারণার প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে চার্লস এলটনের ১৯২৭ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে খাদ্য শৃঙ্খলের ধারণার জনপ্রিয়তা লাভ করে। পাশাপাশি চার্লস এলটনই সর্বপ্রথম খাদ্য জালের ধারণার প্রবর্তন করেন। [৪][৫][৬]