ছত্রাক হল এক ধরনের ইউক্যারিওটিক পরজীবী বা মৃতজীবী জীব যা উদ্ভিদরাজ্য, ছত্রাক গোষ্ঠীর অন্তর্গত। ছত্রাকদের মূলত অণুজীবদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এই জীবগুলি রাজ্য ছত্রাকের অধীনে শ্রেণিবদ্ধিত হয়। ইউক্যারিওটিক, ক্লোরোফিলবিহীন, রেণু ধারণকারী, নালিকাবান্ডিলবিহীন, শাখাযুক্ত অণুসূত্র গঠনকারী জীবগোষ্ঠী ছত্রাকের যৌন ও অযৌন উভয় প্রকার জনন দেখা যায় এবং কোষপ্রাচীর কাইটিন (N-অ্যাসিটাইল গ্লুকোস্যামাইনের পলিমার)(C8H13O5N)n ও অন্যান্য বহুশর্করা দ্বারা নির্মিত হয়। স্পষ্টতই ক্লোরোফিল না থাকায় এরা সালোকসংশ্লেষনের মাধ্যমে শর্করা তৈরি করতে পারে না এবং এদের দৃঢ় কোষ প্রাচীর রয়েছে যা কাইটিন এবং পলিস্যাকারাইড দ্বারা গঠিত।
একটি চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য ছত্রাকের অবস্থান গাছ, প্রাণী ও কিছু প্রোটিস্ট থেকে ভিন্ন জগতে তা হল তাদের কোষপ্রাচীরে কাইটিন (দীর্ঘ শিকলের যৌগিক মনোস্যকারইড গ্লুকোজ) এর উপস্থিতি। প্রাণীর মত, ছত্রাক পরভোজী; তারা দ্রবীভূত অণুগুলো শোষণ করে, সাধারণত তাদের হজমে সাহায্যকারী এনজাইমগুলো গোপন করে তাদের পরিবেশে খাদ্য অর্জন করে। জল বা বাতাসের মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে এমন কিছু বীজগুটি (যাদের কিছু উপাঙ্গিত) ছাড়া তাদের বৃদ্ধি গতিশীলতার মাধ্যমে। ছত্রাক বাস্তুসংস্থান পদ্ধতির মুখ্য পাচক বা বিয়োজক। এই এবং অন্যন্য পার্থক্যগুলোকে ছত্রাকদের স্থান দিয়েছে একটি আলাদা গোষ্ঠীর দলগত জীব হিসাবে, যার নাম ইউমিকোটা (প্রকৃত বা সত্য ছত্রাক)।
খাদ্য হিসেবে ছত্রাক
ছত্রাক এর বেশ কিছু প্রজাতি রয়েছে। যার মধ্যে কিছু প্রজাতির ছত্রাক খাদ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এমন ছত্রাক এর নামই হচ্ছে মাশরুম। volvariella, pleurotus, Agaricus ইত্যাদি গণের অন্তর্ভুক্ত মাশরুম খাদ্য হিসেবে খাওয়া হয়। এছাড়া এর বেশ কিছু ঔষধ গুণাবলীও রয়েছে। ডায়াবেটিস রুগীদের জন্য মাশরুম হতে পারে আদর্শ খাবার, কেননা খাদ্য উপাদানে শর্করা ও চর্বির পরিমাণ কম। মাশরুমে নানান পুষ্টিগুণ থাকায় এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়াতে পারে। তবে মাশরুমের কিছু প্রজাতি আবার বিষাক্ত যা খেলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। উজ্জ্বল বর্ণের কিংবা ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত মাশরুম প্রজাতি না খাওয়াই শ্রেয়, কেননা এগুলো বিষাক্ত প্রজাতির হয়ে থাকে।
ছত্রাক ঘটিত রোগ
জীবদেহে নানান প্রকার রোগের কারণ এই ছত্রাক। সাধারণত ছত্রাক জাতীয় রোগ গুলো ছোঁয়াচে হয়ে থাকে। আলু গাছের বিলম্বিত ধ্বসা রোগ, মানুষের দেহে ছোঁয়াচে দাদ রোগ, চুলে খুশকি ইত্যাদি ছত্রাকজনিত রোগ।
উৎপত্তি
ছত্রাক শব্দটির ইংরেজি শব্দ ফাংগাস (Fungus), যা একটি ল্যাটিন শব্দ Fungour থেকে এসেছে। Fungour শব্দটির অর্থ হল 'দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া'।
দেহগঠন
ছত্রাক ইউক্যারিওটিক কোষ বা আদিকোষ দ্বারা গঠিত। এরা এককোষী বা বহুকোষী জীব হতে পারে। ছত্রাক দীর্ঘ সুতার মতো গঠন নিয়ে গঠিত যা হাইফে নামে পরিচিত। এই হাইফা একত্রে মাইসেলিয়াম নামক জালের মতো গঠন তৈরি করে। ছত্রাকের কোষ প্রাচীর রয়েছে যা কাইটিন এবং পলিস্যাকারাইড দ্বারা গঠিত। কোষ প্রাচীর প্রোটোপ্লাস্ট নিয়ে গঠিত যা কোষের ঝিল্লি, সাইটোপ্লাজম, এবং নিউক্লিয়াসের মতো অন্যান্য কোষের অংশগুলির মধ্যে পার্থক্য করে। নিউক্লিয়াস ঘন, পরিষ্কার, ক্রোমাটিন যুক্ত। নিউক্লিয়াস একটি পরমাণু ঝিল্লি দ্বারা বেষ্টিত হয়।
ছত্রাকের বৈশিষ্ট্য
ছত্রাক (Sing. Fungus, pl. Fungi) এক ধরনের ক্লোরোফিলবিহীন সমাঙ্গদেহী উদ্ভিদ। ক্লোরোফিল না থাকার জন্য এরা সালোকসংশ্লেষে খাদ্য উৎপন্ন করতে পারে না। এরা তাই পরভোজী।
[১] ছত্রাকের দেহ এককোষী (যেমন; ঈস্ট) অথবা বহুকোষী, একটি বা অনেকগুলি নিউক্লিয়াসযুক্ত অনুসূত্র বা হাইফা (Hypha, Plural-Hyphae) নিয়ে গঠিত।
[২] এরা ক্লোরোফিলবিহীন পরভোজী উদ্ভিদ। অথবা মিথোজীবী হিসেবে জীবনধারণ করে।
[৩] এরা মৃতজীবী, পরজীবী অথবা মিথোজীবী হিসেবে জীবনধারণ করে।
[৪] ছত্রাকের শাখাযুক্ত হাইফা যে জালক সৃষ্টি করে তার নামমাইসিলিয়াম(Mycelium)
[৫]ছত্রাকের কোষ-প্রাচীর কাইটিন (Chitin) নামে কার্বোহাইড্রেট দিয়ে তৈরি।
[৬] কোষের মধ্যে শ্বেতসার (Starch) বা গ্লাইকোজেন (Glycogen) খাদ্য হিসেবে জমা থাকে।
[৭] ছত্রাক যৌন জনন, অযৌন জনন কিংবা অঙ্গজ জননের মাধ্যমে বংশ-বিস্তার করে।[১]
আকার-আকৃতি
শ্রেণিবিন্যাস
বিভিন্ন বিন্যাসবিদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ছত্রাকের শ্রেণিবিন্যাস করে থাকেন, তবে ব্যপকভাবে গৃহীত শ্রেণিবিন্যাস হিসেবে ভাউগান ও বার্নেশ কর্তৃক প্রবর্তিত শ্রেণিবিন্যাসকে বিবেচনা করা হয়।
ফাইকোমাইসিটিস
অ্যাসকোমাইসিটিস
ডিউটেরোমাইসিটিস
ব্যাসিডিওমাইসিটিস
এককোষী ছত্রাক
একটি মাত্র কোষ দ্বারা গঠিত। যেমন ইষ্ট
বহুকোষী ছত্রাক
বেশীর ভাগ ছত্রাকই বহুকোষী। বহুকোষী ছত্রাক অসংখ্য সরু সরু সুতোর মত অংশ নিয়ে গঠিত। এগুলিকে হাইফা (Hypha) বলে। একবচনে হাইফা, বহুবচনে হাইফি (Hyphae) । এগুলি একত্রিত হয়ে মাইসিলিয়াম (Mycelium) গঠন করে।
এককোষী ব্যতীত সব ছত্রাকের দেহ হাইফি দ্বারা গঠিত।
ছত্রাকের শ্রেণিবিন্যাস
গঠন কাঠামো অনুসারে ফাংগাসকে নিম্নভাবে শ্রেণী বিন্যাস করা যায়:
ইস্ট: এরা এককোষী। যেমন: ক্রিপ্টোকক্কাস নিওফরমেন্স।
মোল্ড: এরা বহুকোষী। যেমন: ট্রাইকোফাইটন রুব্রাম।
ডিমরফিক: পরিবেশের উপর নির্ভর করে এরা কখনও এককোষী কখনও বহুকোষী। যেমন: হিষ্টোপ্লাজমা ক্যাপসুলেটাম।
ছত্রাকবিদ্যা বা মাইকোলজি
জীববিজ্ঞানের এই শাখায় ছত্রাকের বাসস্থান, গঠনপ্রকৃতি, প্রজনন ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সহ এর ব্যবহারিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
পেনিসিলিনসহ বহু মূল্যবান ঔষধ ছত্রাক থেকে তৈরি করা হয়। পাউরুটি তৈরিতে ইস্ট নামক ছত্রাক ব্যবহার করা হয়। ইস্ট ভিটামিন সমৃদ্ধ বলে ট্যাবলেট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অ্যাগারিকাস(Agaricus) নামক একধরনের মাশরুম ছত্রাক শৌখিন খাদ্য বলে বিবেচিত। বর্তমানে ভারত বাংলাদেশসহ বহু দেশে চাষ করা হয়। আবর্জনা পচিয়ে মাটিতে মেশাতে ছত্রাকের ভূমিকা রয়েছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে উপকারী ভূমিকা
আলেক্জান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেন, যা প্রধাণত অনেক রোগে গ্ৰাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়াদেরকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে; বিশেষ করে প্রদাহ জনিত রোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে। Streptomyces griseus থেকে উৎপন্ন স্ট্রেপ্টোমাইসিন বিভিন্ন গ্ৰাম নেগেটিভ জীবাণুকে ধ্বংস করে। Penicillium griseofulvum থেকে গ্ৰাসিয়োফুল্ভিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় যা ছত্রাকঘটিত রোগ নিরাময় করে। এর জননাঙ্গের নির্যাস থেকে আর্গোটিন নামক উপক্ষার পাওয়া যায়, যা প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও ছত্রাক থেকে লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথাইল অ্যামাইড পাওয়া যায় যা মানসিক রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। Aspergillus uiger থেকে কটিসন নামক স্টেরয়েড পাওয়া যায় যা বাতজনিত রোগের ক্ষেত্রে সহায়ক। এছাড়াও Clavatia gigantea ছত্রাক থেকে ক্যাল্ভাসিন নামক ক্যানসার প্রতিরোধক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। ইস্ট (Saccharomyces) কোষে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির মাধ্যমে হেপাটাইটিস-B এর ভ্যাকসিন উৎপন্ন করা হয়ে থাকে।[২][৩][৪]
গবেষণার কার্যে উপকারী ভূমিকা
ইস্ট ও নিউরোস্পোরা কোষবিজ্ঞান ও জিনতত্ত্বের গবেষণায় ব্যবহৃত হয়।