আর্মেনিয়ার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে, উরার্তু বা ভান রাজ্যের অংশ হিসেবে। রাজ্যটি ককেসাস অঞ্চল ও পূর্ব এশিয়া মাইনর এলাকাতে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। সেলেউসিদ সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পর ১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম আর্মেনীয় রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯৫ থেকে ৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এই নবগঠিত রাষ্ট্রের চরম উৎকর্ষের সময়। এসময় আর্মেনিয়া সমগ্র ককেসাস অঞ্চল তো বটেই, এরও বাইরে বর্তমান পূর্ব তুরস্ক, সিরিয়া এবং লেবানন পর্যন্ত সীমানা বিস্তার করে। কিছু সময়ের জন্য আর্মেনিয়া ছিল রোমান পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য। ৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এটি রোমান সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিক, দার্শনিক ও ধর্মীয়ভাবে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি অণুসরণ করা শুরু করে।
৩০১ খ্রিষ্টাব্দে আর্মেনিয়া ইতিহাসের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে এবং আর্মেনীয় গির্জাব্যবস্থার পত্তন করে। আজও আর্মেনীয় গির্জা রোমান ক্যাথলিক গির্জাব্যবস্থা এবং পূর্ব অর্থডক্স গির্জাব্যবস্থা অপেক্ষা স্বাধীন একটি গির্জাব্যবস্থা হিসেবে বিদ্যমান। পরবর্তীতে আর্মেনিয়ার রাজনৈতিক সংকটের সময় এই গির্জা আর্মেনিয়ার অদ্বিতীয় জাতীয় সত্তা সংরক্ষণে সাহায্য করে। আনুমানিক ১১০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র দেশের দক্ষিণদিকে সরে যায়। এসময় আর্মেনীয় সিলিসিয়া রাজ্য ইউরোপীয় ক্রুসেডার রাজ্যগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মাইনর এলাকাতে সমৃদ্ধি অর্জন করে, যদিও রাজ্যটি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের করায়ত্ত হয়।
৪র্থ থেকে ১৯শ শতক পর্যন্ত আর্মেনিয়া বিভিন্ন বড় শক্তির শাসনাধীনে আসে। এদের মধ্যে পারসিক, বাইজেন্টীয়, আরব, মোঙ্গল এবং তুর্কি জাতি উল্লেখযোগ্য।
১৯১৫ সালে সংঘটিত আর্মেনিয় গণহত্যা দেশটির এক উল্লেখযোগ্য কালো অধ্যায়।
১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ক্ষুদ্র সময়ের জন্য এটি একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ছিল। ১৯২০ সালে স্থানীয় সাম্যবাদীরা ক্ষমতায় আসে এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনী দেশটি দখল করে। ১৯২২ সালে আর্মেনিয়া আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অংশে পরিণত হয়। ১৯৩৬ সালে এটি আর্মেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
আর্মেনিয়ায় ২০১৭ সালে একটি সাংবিধানিক গণভোট আয়োজিত হয়। সেখানে আর্মেনীয়রা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। অতঃপর রাষ্ট্রপতি সার্জ সার্জিসান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়, যা আর্মেনীয় ভেলভেট বিপ্লব নামে পরিচিতি লাভ করেছে। সার্জিসান পদত্যাগ করলে বিরোধী নেতা নিকোল পাশিনিয়ান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তঁার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
আর্মেনিয়া রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের অন্তর্বর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। উত্তর আর্মেনিয়া জুড়ে রয়েছে ক্ষুদ্রতর ককেশাস পর্বতমালা, যেটি সেভান হ্রদ ও আজারবাইজানের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে এবং আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সীমান্ত হয়ে ইরানে চলে গেছে। এই পর্বতগুলির কারণে আর্মেনিয়ার দক্ষিণ থেকে উত্তরে ভ্রমণ করা কষ্টকর। আর্মেনিয়ায় প্রায়ই ভূমিকম্প হয় এবং এর ফলে অনেক প্রাণহানি ঘটে।
আর্মেনিয়ার প্রায় অর্ধেক এলাকা সমুদ্র সমতল থেকে ২০০০ মিটারের বেশি উচ্চতায় অবস্থিত। দেশটির মাত্র ৩% ৬৫০ মিটারের নিম্ন উচ্চতায় অবস্থিত। আরাস নদী ও দেবেত নদীর উপত্যকাগুলি দেশের নিম্নতম এলাকা, এবং এগুলিও যথাক্রমে ৩৮০ মিটার ও ৪৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণে আছে আর্মেনীয় মালভূমি, যা দক্ষিণ-পশ্চিমে আরাস নদীর দিকে ঢালু হয়ে গেছে। মালভূমিটিতে পাহাড় পর্বত ও মৃত আগ্নেয়গিরি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের মধ্যে ৪৪৩০ মিটার উঁচু আরাগাৎস পর্বত আর্মেনিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।
৩৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও সর্বোচ্চ ৭২.৫ কিলোমিটার প্রস্থবিশিষ্ট সেভান হ্রদ আর্মেনিয়ার ভূগোলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হ্রদটি সমুদ্রতল থেকে ২০৭০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। আরাস নদী প্রধানতম নদী। সেভান হ্রদ থেকে উপনদী রাজদান প্রবাহিত হয়ে আরাসে পড়েছে।
উল্লেখ্য বিতর্কিত নাগার্নো-কারাবাগ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে সামরিক সংঘাত চলে আসছে।এতে এ পর্যন্ত দু দেশের প্রায় ৩০০ এর বেশি বেসামরিক লোকজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে।[১১]
সামরিক শক্তি
চারদিকে স্থলবেষ্টিত হওয়ায় দেশটিতে মূলত স্থল বাহিনী ও বিমানবাহিনী রয়েছে। ভারতীয় সুখই-৩০ এর উন্নত ধরন সুখই-৩০এসএম এর ৪টি বিমান রয়েছে বাহিনীর কাছে। ৫০০ কিমি পরিসীমার 9K720 ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্রো ব্যবস্থা রয়েছে।
অর্থনীতি
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আর্মেনিয়াতে অর্থনৈতক মন্দা দেখা দিলেও দেশটি ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠছে। তবে ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং ১৯৯০-এর দশকে আজারবাইজানের সাথে নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে যুদ্ধ আর্মেনিয়ার অর্থনীতিতে আজও প্রভাব রেখে চলেছে।
২৭-০৯-২০ যুদ্ধে কারাবাখ আজারভাইজানের হাতে চলে যাবে..
আর্মেনিয়াতে নগরায়নের হার উচ্চ। এখানে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক শহরে বাস করে। নদী উপত্যকায়, বিশেষত হ্রাজদান নদীর তীরে বসতির ঘনত্ব বেশি। হ্রাজদান নদীর তীরেই আর্মেনিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী ইয়েরেভান অবস্থিত। আর্মেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হল গিয়ুম্রি। ১৯৮৮ সালে গিয়ুম্রি শহর এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের শিকার হয়।
ভাষা
আর্মেনিয়ার ৯৮% অধিবাসী আর্মেনীয় ভাষায় কথা বলে থাকেন। আর্মেনীয় ভাষা দেশটির রাষ্ট্রভাষা। আর্মেনীয় ভাষাকে পূর্ব ও পশ্চিম এই দুইটি সাহিত্যিক আদর্শ ভাষায় ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে পূর্ব আর্মেনীয়কেই বর্তমানে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ার গণহত্যার সময় অনেক আর্মেনীয় পশ্চিম আর্মেনিয়াতে (বর্তমান তুরস্ক) পালিয়ে যান এবং বর্তমান আর্মেনিয়ার বাইরে বসতি স্থাপন করেন। তাদের ব্যবহৃত ভাষাই পশ্চিম আর্মেনীয় ভাষা। এছাড়াও আর্মেনীয় গির্জাগুলিতে গ্রাবার নামের একটি প্রাচীন লিখিত আর্মেনীয় ভাষা ব্যবহৃত হয়।
সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে আছে রুশ ভাষা, কুর্মান্জি (ইয়েজিদীয়) নামের একটি কুর্দি উপভাষা, নব্য-আসিরীয়, গ্রিক ও ইউক্রেনীয় ভাষা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের ভাষা ছাড়াও রুশ কিংবা আর্মেনীয়তে কথা বলতে পারে।
আর্মেনিয়ায় দ্বিবিধ ভাষারীতি (diglossia) বিদ্যমান। লিখিত মাধ্যমে, নথিপত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে আর্মেনীয়রা আদর্শ পূর্ব আর্মেনীয় ভাষা ব্যবহার করে। কিন্তু প্রাত্যহিক কাজেকর্মে ও কথাবার্তায় স্থানীয় উপভাষাই বেশি চলে।
আর্মেনীয়দের ভাষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল প্রায় ৯০% আর্মেনীয় আর্মেনীয় ও রুশ উভয় ভাষাতেই স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন। আর্মেনিয়া যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল তখন রুশ ভাষার এখানে একটি বিশেষ অবস্থান ছিল। রুশ ভাষার সাথে তুলনায় আর্মেনীয় ভাষার মর্যাদা ছিল কম। তবে আর্মেনিয়ার স্বাধীনতার পর দৃশ্যপট বদলেছে। বর্তমানে আর্মেনীয় ভাষাই দেশের মূল ভাষা।
আর্মেনীয়রা স্কুলে রুশ ও ইংরেজি এই দুই বিদেশী ভাষা সম্পর্কেই ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে। তবে ইদানীং ইংরেজির আধিপত্য বেড়েছে।
জনসংখ্যা
২০১১ এর আদমশুমারি অনুযায়ী আর্মেনিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ ১৮ হাজার।
ধর্ম
খ্রিস্টানধর্ম, আরো বিশেষ করে বলতে গেলে, আর্মেনিয় অ্যাপসল গির্জার ধর্ম, আর্মেনিয়ার প্রায় ৯৫% অধিবাসীর ধর্ম। যিশুর দুই শিষ্য বার্থেলেমিউ ও থাদেউস প্রথম শতকেই এখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। ৩য় শতকে আর্মেনিয়ার রাজা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং একে দেশটির রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রচলিত করেন। এছাড়া দেশটিতে স্বল্পসংখ্যক ইহুদি, ইয়াজিদি ও মুসলমান অধিবাসী বসবাস করেন।
আর্মেনীয়রা সাধারণত পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখে এবং তাদের বিশেষ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখে। আর্মেনীয় সঙ্গীত ও রান্না অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশগুলির মত। খাবারের মধ্যে দোলমা বা শর্মা এবং পানীয়ের মধ্যে ওয়াইন ও ব্র্যান্ডি গুরুত্বপূর্ণ। উৎসবের সময় আর্মেনীয়রা ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত গাইতে এবং বৃত্তাকারে গাইতে পছন্দ করে। বাস্কেটবল, ফুটবল ও টেনিস জনপ্রিয় খেলা। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আর্মেনীয়রা কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ, ভারোত্তোলন এবং জিমন্যাস্টিক্সে সাফল্য লাভ করেছে। আর্মেনীয়রা অবসর সময়ে দাবা ও অন্যান্য বোর্ড খেলা খেলতেও পছন্দ করে। শহরের বেশির ভাগ অধিবাসী সোভিয়েত আমলে নির্মিত অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে বাস করে; যেগুলির বর্তমান অবস্থা তেমন ভাল নয়। গ্রামের লোকেরা সাধারণত এক পরিবারের জন্য নির্মিত বাড়িতে বাস করে। অনেক সময় যৌথ পরিবারের অনেক সদস্য একই ছাদের নিচে বাস করে। পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সামাজিক জীবনের কেন্দ্র। আর বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রজন্মে প্রজন্মে সংযোগ স্থাপিত হয়।
বিখ্যাত ভারতীয় শাস্রীয় সঙ্গীত গায়িকা গওহর জান ছিলেন আর্মেনিয়ান বংশোদ্ভূত।