মেজবান (ফার্সি: میزبان) বা মেজবানি (ফার্সি: میزبانی) বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহুমাত্রিক ঐতিহ্যবাহী একটি ভোজের অনুষ্ঠান। চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী অঞ্চলে মেজবানি জেয়াফত নামে বহুল প্রচলিত, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ "ভোজ" বা "ভোজসভা"। কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, মৃত্যুবার্ষিকী, শিশুর জন্মের পর আকিকা, জন্মদিবস উপলক্ষে, ব্যক্তিগত সাফল্য, নতুন কোনো ব্যবসা আরম্ভ, নতুন বাড়িতে প্রবেশ, পরিবারে আকাঙ্ক্ষিত শিশুর জন্ম, বিবাহ, খৎনা, মেয়েদের কান ছেদন এবং ধর্মীয় ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মেজবানির আয়োজন করা হয়। এছাড়া নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়া বা কোনো শুভ ঘটনার জন্যও মেজবান করা হয়।[১][২] ঐতিহাসিকভাবে মেজবানি একটি ঐতিহ্যগত আঞ্চলিক উৎসব যেখানে অতিথিদের সাদা ভাত এবং গরুর মাংস খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।[২] মেজবান অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ সাধারণত প্রতিবেশীদের এবং আশেপাশের লোকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে শহরাঞ্চলে নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে অতিথিদের মাঝে বিলি করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে মেজবানি অনুষ্ঠান সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে,[১] তবে আধুনিক কালে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্তও ভোজনের উৎসব চলতে দেখা যায়।
ব্যুৎপত্তি এবং ইতিহাস
ফারসি মেজবান শব্দের অর্থ "অতিথি আপ্যায়নকারী" বা "নিমন্ত্রণকর্তা" এবং মেজবানি শব্দের অর্থ "আতিথেয়তা" বা "মেহমানদারি"।[১]চাটগাঁইয়া ভাষায় একে মেজ্জান বলা হয়ে থাকে।[২] চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী অঞ্চলে মেজবানি জেয়াফত নামে বহুল প্রচলিত,[১] ফার্সি ভাষায় যার অর্থ "ভোজ" বা "ভোজসভা"।
বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও বিভিন্ন উপলক্ষে ভোজের আয়োজন করা হয়। তবে মেজবানি চট্টগ্রাম অঞ্চলেই অধিক জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত। এই অঞ্চলে পূর্বে হাটেবাজারে ঢোল পিটিয়ে বা টিনের চুঙ্গি ফুঁকিয়ে মেজবানির নিমন্ত্রণ প্রচার করা হতো।[১] মেজবানের উৎপত্তির সঠিক সময় নির্ণয় করা যায় না। তবে এই প্রথা সুদীর্ঘকাল ধরে চর্চিত হয়ে আসছে।
মেজবান বিষয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকেরা অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। যেমন:
কালামইন্যা ধলামইন্যা
আনছে আদা জিরা ধইন্যা
আর লাগবে না ইলিশ-ঘইন্যা
গরু-খাসি আর বুটের ডালের
বস্তা দেখা যায়
মেজবানিই সেরা
মেজ্জান দিয়ে মেজ্জান দিয়ে
উইতারত, উইতারত, উইতারত
গরিবুল্ল্যাই মেইট্যা বছি
ডঁর মাইনষেরলাই বাসনত..
কি সৌন্দর্য বিছানত
মেজবান দিয়েছে মেজবান দিয়েছে
ওদের ওখানে, ওদের ওখানে, ওদের ওখানে
গরিবের জন্য মাটির পাত্র
ধনীর জন্য সুন্দর পাত্র
সুন্দর বিছানা
আষ্ট গরুর মেজ্জান দিয়ে
নূর বাল্যনি বঅরত..
চোখত্ মুখত্ পানি দি ছল
জলদি জোনাফ ফঅরত্...
আট গরুর মেজবান দিয়েছে নূর বালির বাপের বাড়ী
চোখে মুখে পানি দিয়ে চল চাঁদের আলোয় তাড়াতাড়ি
রীতি
বর্তমানের সাথে অতীতের মেজবান অনুষ্ঠানের কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পূর্বে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে ও মাটির সানকিতে [৩](থালা/পাত্র) আমন্ত্রিতদের খাবারের ব্যবস্থা করা হত।[৪] তবে[৫] বর্তমানে দুপুরে বা রাতে টেবিল চেয়ার ও সাধারণভাবে প্রচলিত থালায় খাবারের আয়োজন করা হয়।
খাদ্য
মেজবানে প্রধানত সাদা ভাত, গরুর মাংস, গরুর পায়ের হাড়ের ঝোল (চট্টগ্রামের ভাষায় "নলা কাজি" বলা হয়) ও বুটের ডাল পরিবেশন করা হয়।[২] কিছু ক্ষেত্রে মাছ এবং মুরগির মাংসও পরিবেশন করতে দেখা যায়। মেজবানের গরুর মাংসের স্বাদ এর খ্যাতির কারণ। মেজবানে রান্নার একটি বিশিষ্ট শৈলী রয়েছে যেখানে সঠিকভাবে মেজবানি মাংসের পরিমাণের একটি নির্দিষ্ট দক্ষতা দাবি করে;[২] উদাহরণস্বরূপ:[১]
গরুর নলা দিয়ে কম ঝাল, মসলাটক সহযোগে রান্না করা শুরুয়া বা কাঁজি, যা নিহারী কাঁজি নামে পরিচিত;
মাষকলাই ভেজে খোসা ছাড়িয়ে ঢেঁকিতে বা মেশিনে গুড়ো করে এক ধরনের ডাল রান্না করা হয় যাকে ঘুনা বা ভুনা ডাল বলে;
কলাই ডালের পরিবর্তে বুটের ডালের সাথে (উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে হলব্বু নামে পরিচিত) গরুর হাঁড়, চর্বি ও মাংস দিয়ে হালকা ঝালযুক্ত খাবার তৈরি করা হয়।
হিন্দু ঐতিহ্য
১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফেনী জেলার উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চল (পূর্বে ইসলামাবাদ) ও ত্রিপুরারচকলা-রোশনাবাদেজমিদারশমসের গাজী তার মা কোয়ারা বেগমের নামে একটি বড় পুকুর খনন করেছিলেন এবং সে উপলক্ষে ভোজের আয়োজন করেছিলেন। এই ভোজের জন্য চট্টগ্রামের নিজামপুর এলাকায় প্রতিবেশী পুকুর হতে মাছ ধরে আনা হয়।[১] হিন্দু ঐতিহ্যে মেজবান রান্নার সময় গরুর পরিবর্তে মাছ ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকে চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় প্রতি বছর "চট্টগ্রাম পরিষদ" এর ব্যানারে মেজবানি আয়োজন করে, মাছ, সবজি এবং শুকনো মাছ থেকে তৈরি কারি দিয়ে।[১]
উদযাপন
বাংলাদেশে মেজবানি বর্তমানে জনপ্রিয় রান্না। রাজধানী ঢাকায় মেজবানির প্রচলন শুরু হয় ষাটের দশকের শেষে, জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর নূরুল ইসলামের চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকার সভাপতি (১৯৬৮-৮৩) হবার পর।[১]
বাংলাদেশের সিলেট, খুলনাসহ দেশের বাইরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ও ইউরোপ, আমেরিকায় মেজবান পরিচিতি লাভ করেছে।