ফিল্ড মার্শাল (সংক্ষেপে এফএম) হচ্ছে ভারতের পাঁচ-তারকা জেনারেল অফিসার পদ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অর্জনযোগ্য সর্বোচ্চ পদমর্যাদা। ফিল্ড মার্শালকে জেনারেলের ঠিক উপরে স্থান দেওয়া হয়, তবে নিয়মিত সেনা কাঠামোতে এটি ব্যবহৃত হয় না। এটি মূলত একটি আনুষ্ঠানিক বা যুদ্ধকালীন পদমর্যাদা তথা র্যাঙ্ক। ভারতে কেবল দুজন সেনা কর্মকর্তাকে এই পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ফিল্ড মার্শালের পদমর্যাদাচিহ্নের প্রশস্ত দিকে একটি পদ্ম ফুলের পুষ্পস্তবক বেষ্টিত আড়াআড়ি ছেদ করা লাঠি ও বাঁকা তলোয়ার এবং এর উপরে ভারতের জাতীয় প্রতীক তথা অশোকের সিংহস্তম্ভ রয়েছে।
শ্যাম মানেকশ’ হচ্ছেন ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারিতে তিনি এই পদকে ভূষিত হন। দ্বিতীয় জন হচ্ছেন কোদানদেরা মদপ্পা কারিয়াপ্পা। ১৯৮৬ সালের ১৫ জানুয়ারিতে তিনি এই পদমর্যাদা অর্জন করেন।
ফিল্ড মার্শাল ভারতীয় নৌবাহিনীতে অ্যাডমিরাল অফ দ্য ফ্লিট এবং বিমানবাহিনীতে "মার্শাল অফ দ্য (ইন্ডিয়ান) এয়ার ফোর্সের" সমতুল্য। এখন পর্যন্ত নৌবাহিনীতে কাউকেই অ্যাডমিরাল অফ দ্য ফ্লিট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি, তবে বিমানবাহিনীতে অর্জন সিংহকে মার্শাল অফ দ্য এয়ার ফোর্স পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
ইতিহাস
এখন পর্যন্ত কেবল দুইজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাকে এই পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে দায়িত্ব ও নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সর্বপ্রথম ১৯৭৩ সালে শ্যাম মানেকশ’কে এই পদে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মানেকশ’কে ফিল্ড মার্শালে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং একইসময়ে তাকে চিফ অফ দ্য ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) পদে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সরকারি আমলা এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর কমান্ডারদের একাধিক আপত্তির পরে এই নিয়োগ বাতিল করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান (চিফ অফ আর্মি স্টাফ) হিসাবে দায়িত্ব সমাপ্তির পর মানেকশ’কে ফিল্ড মার্শাল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি প্রথম নিয়োগ হওয়ায় প্রতীক ও ফিতাসহ পদমর্যাদার বেশ কয়েকটি মাপকাঠি তখনও তৈরি করা হয়নি। মানেকশ’র নিয়োগের কয়েক সপ্তাহ আগে দিল্লি সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর কর্মশালায় ফিল্ড মার্শালের পদমর্যাদার প্রতীক তৈরি করা হয়। তারা ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদাচিহ্ন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।[৩]
এই পদে ভূষিত হওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন কোদানদেরা মদপ্পা কারিয়াপ্পা। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান (কমান্ডার-ইন-চিফ) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। শ্যাম মানেকশ’ অবসর গ্রহণের ঠিক আগে[ক] এই পদমর্যাদায় ভূষিত হলেও কারিয়াপ্পা নিয়োগের পূর্বেই ১৯৫৩ সালে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। একজন ফিল্ড মার্শাল যেহেতু কখনোই অবসর নেন না, তাই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এই পদমর্যাদা দেওয়া যায় না। জাতির প্রতি তার আদর্শিক সেবার কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে ভারত সরকার এই পদবি প্রদানের পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত যোগ্যতার শর্তসমূহ বাতিল করে। প্রথা ভেঙ্গে পরিবর্তিত নিয়ম অনুযায়ী ১৯৮৬ সালের ১৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে অবসর প্রাপ্ত কারিয়াপ্পাকে ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা প্রদান করে।[৫]
অবলোকন
ফিল্ড মার্শাল হচ্ছে পাঁচ-তারকা পদ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অর্জনযোগ্য সর্বোচ্চ পদ। পদটিকে জেনারেলের উপরে স্থান দেওয়া হলেও নিয়মিত সেনা কাঠামোতে এটি ব্যবহার হয় না। এটি মূলত একটি আনুষ্ঠানিক বা যুদ্ধকালীন পদমর্যাদা, যা শুধু দুইজনকে প্রদান করা হয়েছে।[৬]
একজন ফিল্ড মার্শাল চার-তারকা জেনারেলের পুরো বেতন পান এবং তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একজন সার্ভিসিং অফিসার হিসাবে বিবেচিত হন। তারা সবধরণের আনুষ্ঠানিক পরিবেশে পূর্ণ সামরিক পোশাক পরেন। এছাড়াও তারা একটি সচিবালয় নিয়ে সেনা সদর দপ্তরে একটি কার্যালয় পরিচালনা করেন।[৬]
পদমর্যাদাচিহ্ন
ফিল্ড মার্শালের পদমর্যাদাচিহ্নের (ইনসিগনিয়া) প্রশস্ত দিকে একটি পদ্ম ফুলের পুষ্পস্তবক বেষ্টিত আড়াআড়ি ছেদ করা লাঠি ও বাঁকা তলোয়ার এবং এর উপরে ভারতের জাতীয় প্রতীক তথা অশোকের সিংহস্তম্ভ রয়েছে।
নিয়োগের সময় ফিল্ড মার্শালকে অগ্রভাগ স্বর্ণে মোড়ানো একটি লাঠি দেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক পরিবেশে তারা এটি বহন করে থাকেন। এই পদের তারকা পদমর্যাদাচিহ্ন লাল পটির উপরে পাঁচটি সোনালি তারা নিয়ে গঠিত। এটি গাড়ির সামনে লাগানো ছোট পতাকা, পদমর্যাদা পতাকা এবং সামরিক পোশাকের কলারে ব্যবহৃত হয়।[৬]
পদাধিকারীগণ
শ্যাম মানেকশ’
শ্যাম মানেকশ’, এমসি (১৯১৪–২০০৮), হচ্ছেন প্রথম ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা যিনি ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি "শ্যাম বাহাদুর" ("শ্যাম দ্য ব্রেভ") নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৩৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সেনা একাডেমির মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তবে দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট হিসেবে তার সেনা নথিতে তা লিখা হয়েছিলো ১৯৩৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। তার বিশিষ্ট সামরিক কর্মজীবন চার দশক ও পাঁচটি যুদ্ধ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে তার যুদ্ধ জীবনের সূচনা হয়। তিনি প্রথমে রয়্যাল স্কটসের ২য় ব্যাটালিয়নের সাথে সংযুক্ত হন, এবং পরে দ্বাদশ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ৪র্থ ব্যাটালিয়নে নিযুক্ত হন, যা সাধারণত ৫৪তম শিখ নামে পরিচিত। দেশভাগের পর তাকে ষোড়শ পাঞ্জাব রেজিমেন্টে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়।[৮][৯]
১৯৬৯ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৮ম সেনাপ্রধান (সিওএএস) হিসেবে উন্নীত হন এবং তার নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করে। যুদ্ধটি ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ দিন ধরে চলে। এটি ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি। একই সাথে এর সমান্তরালে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে চলমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব সহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ঢাকায় আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। সেদিন ৯৩ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে, যা ইতিহাসের বৃহত্তম আত্মসমর্পণের মধ্যে একটি হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। যদিও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান আত্মসমর্পণের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু তার সৈন্যদের জীবন রক্ষার্থে তাকে রাজি হতে হয়েছিল। এই যুদ্ধে মানেকশ’র চৌকস সামরিক নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিষ্পত্তিমূলক ফলাফল জাতির মধ্যে নতুন আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। তাই তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি তাকে ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা প্রদান করেন। পরবর্তীতে ভারতীয় জাতির প্রতি তার সেবার জন্য তাকে যথাক্রমে ভারতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণ ও পদ্মভূষণ পুরস্কারও প্রদান করা হয়।[৮][১০]
বিতর্ক
যদিও শ্যাম মানেকশ’কে ১৯৭৩ সালে ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদায় ভূষিত করা হয়। কিন্তু জানা যায়, ফিল্ড মার্শাল হিসেবে তিনি যে সম্পূর্ণ ভাতা পাওয়ার অধিকারী ছিলেন, তা তাকে কখনোই দেওয়া হয়নি। ওয়েলিংটনে মানেকশ'র সাথে সাক্ষাতের সময় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম উদ্যোগ গ্রহণ করে তাকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে তার ৩০ বছরেরও বেশি সময়ের বকেয়া বেতন হিসেবে ₹১.৩ কোটি ভারতীয় টাকার চেক প্রদান করার ব্যবস্থা করেন। আরও আশ্চর্যের বিষয়, মানেকশ’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সামরিক-বেসামরিক বা রাজনৈতিক শীর্ষ-ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন না।[৩][১১]
কোদানদেরা মদপ্পা কারিয়াপ্পা
স্যার কোদানদেরা মদপ্পা কারিয়াপ্পা, ওবিই (১৮৯৯-১৯৯৩), প্রথম ভারতীয় হিসাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান (কমান্ডার-ইন-চিফ) নিযুক্ত হন। তার বিশিষ্ট সামরিক ক্যারিয়ার প্রায় তিন দশক ধরে বিস্তৃত। কারিয়াপ্পা ১৯১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ২/৩৮ কার্ন্যাটিক পদাতিকে অস্থায়ী দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট হিসাবে কমিশন লাভ করেন। পরে তাকে ২২/১২৫ নেপিয়ার রাইফেলস বদলি করা হয়। এরপর ১৯২২ সালের জুন মাসে ৭ম প্রিন্স অফ ওয়েলস ওন ডোগরা রেজিমেন্টে এবং সবশেষে ১/৭ রাজপুত রেজিমেন্টে বদলি করা হয়, যা তার মূল রেজিমেন্টে পরিণত হয়। [১২]
তিনিই কোয়েটারের স্টাফ কলেজের কোর্সে অংশ নেওয়া এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে একটি ব্যাটালিয়ন [খ] কমান্ড করা প্রথম ভারতীয় কর্মকর্তা। এছাড়াও তিনি যুক্তরাজ্যের ক্যামবার্লির ইম্পেরিয়াল ডিফেন্স কলেজে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত প্রথম দুই ভারতীয়ের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ইউনিট এবং কমান্ড সদর দপ্তরে (এইচকিউ) এবং নয়াদিল্লির জেনারেল সদর দপ্তরে বিভিন্ন পদে কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। তিনি সশস্ত্রবাহিনী পুনর্গঠন কমিটির সেনা উপ কমিটির সদস্য ছিলেন, যা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পরে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে বিভক্ত করে। ১৯৫৩ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[১৪] জাতির প্রতি তার দৃষ্টান্তমূলক সেবার প্রতি কৃতজ্ঞতা হিসেবে ভারত সরকার ১৯৮৬ সালের ১৪ জানুয়ারিতে ৮৭ বছর বয়সে কারিয়াপ্পাকে ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা প্রদান করে।
আরও দেখুন
পাদটীকা
- ↑ সেনাপ্রধান (সিওএএস) হিসাবে মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে মানেকশ’কে ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল।
- ↑ একটি ব্যাটেলিয়নে চারটি কোম্পানি থাকে। প্রতিটি কোম্পানি চারটি প্লাটুনে বিভক্ত। একটি প্লাটুনে মোট ১০জন সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত হয়।[১৩]
তথ্যসূত্র