ট্রেভর লেসলি গডার্ড (ইংরেজি: Trevor Goddard; জন্ম: ১ আগস্ট, ১৯৩১ - মৃত্যু: ২৫ নভেম্বর, ২০১৬) নাটাল প্রদেশের ডারবানে জন্মগ্রহণকারী দক্ষিণ আফ্রিকান টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭০ সময়কালে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের পক্ষে ৪১ টেস্টে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। দলে তিনি মূলতঃ অল-রাউন্ডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।[১] বামহাতে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বামহাতে মিডিয়াম বোলিং করতেন ট্রেভর গডার্ড।
তারুণ্যে উজ্জীবিত দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে ১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে পাঁচ মাসের জন্য অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরে নেতৃত্ব দেন। তন্মধ্যে, অস্ট্রেলিয়ার সাথে সিরিজে সমতা আনয়ণ করেন। এছাড়াও সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
প্রারম্ভিক জীবন
চার ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বাবা নাটাল মার্কারির লিনোটাইপ অপারেটর ছিলেন।[২] ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সময়কালে ডারবান হাইস্কুলের প্রথম একাদশে খেলেন। এ সময়ে বেশ কয়েকটি সেঞ্চুরি হাঁকান ও বামহাতে অর্থোডক্স স্পিন বোলিং করে অনেক উইকেট পান। প্রায়শঃই হিউ টেফিল্ডের ছোট ভাই আর্থার টেফিল্ডের সাথে বোলিং করতেন।[৩] ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকান বিদ্যালয় একাদশে আর্থার টেফিল্ডের সাথে খেলেছেন।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট
ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী ছিলেন। ডারবানে টেক ক্লাবে খেলার সময় পেস বোলিংয়ের দিকে মনোনিবেশ ঘটান। এ সময় দলে লেস পেইনের ন্যায় বামহাতি স্পিন বোলার ছিল ও মিডিয়াম পেসার প্রয়োজন ছিল।[৪]
১৯৫২-৫৩ মৌসুমে ডারবানে অনুষ্ঠিত প্রথম-শ্রেণীর খেলায় ট্রান্সভালের বিপক্ষে তার অভিষেক ঘটে। ঐ খেলায় বোলিং উদ্বোধনে নামেন ও সাত নম্বরে ব্যাটিং করেছিলেন। তৃতীয় খেলায় ইস্টার্ন প্রভিন্সের বিপক্ষে অপরাজিত ১০০* রানের মনোমুগ্ধকর সেঞ্চুরি করেন। ঐ মৌসুমে ৪৩.৩০ গড় ৪৩৩ রান ও ৩০.০০ গড়ে ১৮ উইকেট দখল করেন। পরের মৌসুমে নাটালের পক্ষে অধিনায়ক জ্যাকি ম্যাকগ্লিউ’র সাথে ব্যাটিং উদ্বোধনে নামেন। দ্বিতীয় খেলায় ব্যাটিং উদ্বোধনে নেমে ১৭৪ রানসহ বোলিং উদ্বোধন করে ৫/৭৩ পান। তিনি এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে কারি কাপ জয়ে সবিশেষ ভূমিকা রাখেন। ৫১.১১ গড় ৪৬০ রান, ১০ ক্যাচ ও ১৬.০০ গড়ে ৯ উইকেট তুলে নেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৫ সালে ইংল্যান্ড সফরের জন্য মনোনীত হন।
নাটালের পক্ষে ফুটবল খেলায়ও অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু, ১৯৫৪ সালে এ ক্রীড়া ছেড়ে দেন সম্ভবতঃ আঘাতকে এড়িয়ে ক্রিকেটে নিজস্ব অবস্থান পাকাপোক্ত করতে। এছাড়াও, দুই ক্রীড়ায় সম্পৃক্ততায় কর্তৃপক্ষের প্রশ্নবানকে এড়াতেই এটি করেছেন।[৫]
খেলোয়াড়ী জীবন
১৯৫৫ সালের ইংল্যান্ড সফরে ২৩ খেলায় অংশ নেন তিনি। ৩০.৬০ গড়ে ১১৬৩ রান ও ২১.৯০ গড়ে ৬০ উইকেট পান। পাঁচ টেস্টের ঐ সিরিজের সবগুলোতেই ব্যাটিং উদ্বোধন করেন ও দুই টেস্টে বোলিং উদ্বোধনে নামেন। ঐ সিরিজে বোলারদের দাপট পরিলক্ষিত হয়। তিনি ২১.১২ গড়ে ২৫ উইকেট ও ২৩.৫০ গড়ে ২৩৫ রান তোলেন। লিডসে অনুষ্ঠিত চতুর্থ টেস্টে দলের জয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। উভয় ইনিংসে যথাক্রমে ৯ ও ৭৪ রান করেন। তন্মধ্যে, ২০ রানে পিছিয়ে থেকে সোয়া চার ঘণ্টায় ম্যাকগ্লিউ’র সাথে ১৭৬ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও বল হাতে ২/৩৯ ও ৫/৬৯ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। শেষদিনে ১১:৩০ থেকে ৪:১২ ঘটিকায় খেলায় জয় পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে বোলিং করতে থাকেন। খেলায় তার বোলিং পরিসংখ্যান ছিল ৬২-৩৭-৬৯-৫।[৬] এ সফর সম্পর্কে নরম্যান প্রিস্টন লেখেন যে, ব্যাপক সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি অধিকাংশ সময়ই রক্ষণাত্মক ক্রিকেটার ছিলেন। যখন তিনি ব্যাটিংয়ে নামেন, তখন ক্রিজকে রক্ষা করাই প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং যখন বোলিংয়ে নামতেন তখন ক্রমাগত লেগ স্ট্যাম্প বরাবরে বোলিং করতেন।[৭]
অধিনায়কত্ব
১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে পাঁচমাসের জন্য অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অধিনায়ক মনোনীত হন। তার নিয়োগকর্তা তাকে দীর্ঘদিনের ছুটি দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। সেজন্যে কেবলমাত্র এ সফরেই তাকে দেখা যায়। ক্রিকেটপ্রেমী বৃহৎ আকারের ডারবান বিপনীবিতানের পরিচালক তাকে জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান ও অবসর সময়ে ক্রিকেট খেলার জন্য অনুমোদন প্রদান করেন।[৮]
সফরের শুরুর দিকে সাইনুসাইটিসে আক্রান্ত হন এবং পার্থ ও ব্রিসবেনের হাসপাতালে সময় কাটান। প্রথম টেস্ট শেষে তার অস্ত্রোপাচার করতে হয়।[৯]অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাঁচ টেস্টের সিরিজে ৬৪.৮৫ গড়ে ৪৫৪ রান ও ৩৮.১৮ গড়ে ১১ উইকেট পান। তরুণ দলকে নেতৃত্ব দিয়ে তিন টেস্টে ড্র করান ও ১-১ ব্যবধানে সিরিজ ড্র হয়।
মূল্যায়ন
ধ্রুপদী সঠিকমানের বামহাতি উদ্বোধনী বামহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি।[১] বামহাতি মিডিয়াম পেস বোলার হিসেবে প্রভূতঃ সফলতা পেয়েছেন। টেস্ট পর্যায়ে ১২৩ উইকেট দখল করেন। কমপক্ষে ৭৫ বা তদূর্ধ্ব উইকেট শিকারীদের মধ্যে তিনি সকলের শীর্ষে রয়েছেন। প্রতি ওভারে তিনি মাত্র ১.৬৪ রান দিয়েছিলেন।[১০] প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৪০.৬০ গড়ে ১১,০০০-এরও বেশি রান তুলেছেন। এছাড়াও, ২১.৬৫ গড়ে ৫৩৪ উইকেট পেয়েছেন।[১] ১৯৫২-৫৩ থেকে ১৯৬৫-৬৬ পর্যন্ত নাটাল, ১৯৬৬-৬৭ থেকে ১৯৬৭-৬৮ পর্যন্ত নর্থ ইস্টার্ন ট্রান্সভালে খেলেন। এরপর ১৯৬৮-৬৯ ও ১৯৬৯-৭০ এ শেষ দুই মৌসুমে পুনরায় নাটালের পক্ষে খেলার জন্য ফিরে যান।
ট্রেভর গডার্ড (২৫১৬ রান, ১ সেঞ্চুরি); অ্যালিস্টেয়ার ক্যাম্পবেল (২৮৫৮ রান, ২ সেঞ্চুরি); চামিন্দা ভাস (৩০৮৯ রান, ১ সেঞ্চুরি) ও অনিল কুম্বলে (২৫০৬ রান, ১ সেঞ্চুরি) - এ চারজন ক্রিকেটার তাদের টেস্ট খেলোয়াড়ী জীবনে দুই হাজার রান সংগ্রহের পর তাদের প্রথম সেঞ্চুরির সন্ধান পান। তন্মধ্যে, গডার্ড প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দুই হাজার রান তোলার পর প্রথম সেঞ্চুরি করেন। ঐ ইনিংসটিকে ১১২ রানে নিয়ে যেতে পেরেছেন।
ক্রিকেট সাংবাদিক টেলফোর্ড ভাইস গডার্ডকে দূর্লভ চকচকে, বুদ্ধিদীপ্ত ও উজ্জীবন শক্তির অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করেন।[১১] অন্যদিকে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান তাকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্বাসযোগ্য ও সৎ খেলোয়াড় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, গডার্ড ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করে গেছেন ও চমৎকার নজির গড়েছেন।[১২]
ব্যক্তিগত জীবন
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত তিনি। সেপ্টেম্বর, ১৯৫৪ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী জিনের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করে।[১৩] তিনি ও তার স্ত্রী খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত। ১৯৭৫ সালে তার স্ত্রী জিন মৃত্যুবরণ করেন।[১৪] ১৯৭৭ সালে নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ছেড়ে দেন ও মিশনারী কাজে মনোনিবেশ ঘটান।[১৫] মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় অনেক সেবাধর্মী কাজে যুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে বিধবা লেসলি’কে বিয়ে করেন।[১৬]
ডিসেম্বর, ১৯৮৫ সালে গাড়ী চালনারত অবস্থায় গ্রাফ-রেইনেটের কাছাকাছি হুইলে অজ্ঞান অবস্থায় দেখা যায়। বেশ কয়েক জায়গায় আঘাত পান ও কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলেন। এরপর তিনি সুস্থ হন।[১৭] দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ তারিখে ৮৫ বছর বয়সে ট্রেভর গডার্ডের দেহাবসান ঘটে।[১৮]