কোশল রাজ্য (সংস্কৃত: कोसल राज्य) প্রাচীন ভারতের রাজ্য, যা বর্তমান উত্তর প্রদেশের আওধ অঞ্চলের সন্নিকটে অবস্থিত।[২]বৈদিক যুগের শেষের দিকে এটি একটি ছোট রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল, যার প্রতিবেশী বিদেহ রাজ্যের সাথে সংযোগ ছিল।[৩][৪] খৃস্টপূর্ব ৭০০ হতে ৩০০ শতাব্দীতে কোশল রাজ্য উত্তর-ভারতীয় কৃষ্ণ চিক্কণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতির অংশ ছিল। এ রাজ্য হতে শ্রমণ আন্দোলন, জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব ঘটে।[৫] কোশলের সংস্কৃতি নগরীকরণ ও লোহার ব্যবহারের স্বাধীন বিকাশের পরে রাজ্যটি পশ্চিম দিকে কুরু-পাঞ্চালের বৈদিক আর্যদের চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল।[৬]
গৌতম বুদ্ধ শাক্য জনগোষ্ঠীর লোক ছিলেন। খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে শাক্য জনগোষ্ঠীর জনপদ কোশল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ অঙ্গুত্তরনিকায় ও জৈন ধর্মগ্রন্থ ভগবতি সূত্র অনুসারে খৃস্টপূর্ব ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে কোশল উত্তর ভারতীয় ষোল মহাজনপদ গুলোর অন্যতম রাজ্য।[৭] সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে এটি শক্তিশালী রাজ্যের মর্যাদা পেয়েছিল। তবে প্রতিবেশি মগধ রাজ্যের সাথে একাধিক যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কোশলের দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে মগধ রাজ্য এটি শোষণ ও দখল করেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন এবং কুশান সাম্রাজ্যের বিস্তারের আগে কোশল রাজ্য দেব রাজবংশ, দত্ত রাজবংশ এবং মিত্র রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছিল।
ধর্মীয় গ্রন্থে
পুরাণ
প্রাথমিক বৈদিক সাহিত্যে কোশলের কথা পাওয়া যায়নি, তবে শতপথ ব্রাহ্মণ (খৃস্টপূর্ব ৭ম-৬ষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত[৮], ও খৃস্টপূর্ব ৩০০ সালের সর্বশেষ সংস্করণে[৯]) এবং (খৃস্টপূর্ব ৬ষ্ট শতাব্দীর[১০]) কল্পসূত্র(বেদাঙ্গ)-তে কোশল রাজ্যকে একটি অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণে রাজা ইক্ষবাকুর রাজবংশকে কোশল রাজ্যের শাসক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[১১] পুরাণে ইক্ষবাকু হতে প্রসেনজিত(পালি:পসেনাদি)[১২] পর্যন্ত ইক্ষবাকু রাজবংশের রাজাদের তালিকা আছে। রামায়ণ অনুসারে, রাম তার রাজধানী অযোধ্যা হতে কোশল রাজ্য শাসন করতেন।[১৩]
বৌদ্ধধর্ম ও জৈন ধর্ম
জৈন ধর্মের ২৪তম তীর্থঙ্কর, মহাবীর কোশল রাজ্যে তাঁর পাঠ গ্রহণ করেন। বৌদ্ধদের মজ্জিমনিকায় গ্রন্থে গৌতম বুদ্ধকে কোশলের অধিবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি বুদ্ধের শাক্য জনগোষ্টির জনপদ কোশল রাজ কর্তৃক দখল হওয়ার ইঙ্গিত করে।[১৪]
কোশল রাজ্যের রাজধানী শ্রাবস্তীর একটি দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ
আজমীর জৈন মন্দিরে অযোধ্যা শহরের স্বর্ণ নির্মিত কল্পিত প্রতিকৃতি
গৌতম বুদ্ধের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে শ্রাবস্তী হতে কোশলের রাজা প্রসেনজিতের শোভাযাত্রা, সাঁচী[১৫]
ইতিহাস
প্রাক মৌর্য যুগ
প্রাক মৌর্য যুগে কোশলের রাজা মহাকোশল প্রতিবেশী কাশী রাজ্য দখল করে কোশলের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।[১৬] (খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে) মহাকোশলের কন্যা কোশলদেবী মগধের রাজা বিম্বিসারকে বিয়ে করেছিলেন।[১৭] মহাকোশলের পুত্র প্রসেনজিত বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তার অবর্তমানে মন্ত্রী দিঘ চরায়ণ, রাজপুত্র বিদুদভ বিরুধককে কোশলের সিংহাসনে বসিয়ে ছিলেন।[১৮] বিদুদভের সময় বাঘোচিয়া বংশের রাজা বীর সেন, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের পিতৃগোষ্ঠী শাক্যদের জনপদ আক্রমণ ও অধিকার করে কোশল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।[১৯] এর কিছুকাল পরে (খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর শেষে অথবা ৪র্থ শতাব্দীর শুরুতে) মগধের হর্য্যংক বংশের রাজা অজাতশত্রু কোশল রাজ্য জয়[১১] ও মগধ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন, যা মৌর্য সাম্রাজ্যের ভিত তৈরি করেছিল। সবশেষে মগধের আরেক রাজা শিশুনাগ কোশল রাজ্য অধিকার করেছিলেন।[২০]
মৌর্য যুগ
ধারণা করা হয়, মৌর্য শাসনামলে কোশল রাজ্য প্রশাসনিকভাবে কৌশম্বির অধীনস্থ ছিল।[২১] মৌর্যবংশের প্রথম সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে সগৌড় তাম্রপাতে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে শ্রাবস্তীর দুর্ভিক্ষে রাজকর্তাদের গৃহীত ত্রাণব্যবস্থার বর্ণনা আছে, যা কোশল রাজ্যকে মৌর্য রাজবংশের অধীনে থাকার বিষয় নির্দেশ করে।[২২] গর্গ সংহিতার যুগ পুরাণ অংশে শেষ মৌর্য্য শাসক বৃহদার্থের রাজত্বকালে যবন (ইন্দো-গ্রিক) আগ্রাসন এবং পরবর্তী সময়ে কোশলের সায়েত দখল সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।[২৩]
মৌর্য যুগ পরবর্তী
মৌর্য্য রাজবংশের রাজত্ব শেষে বেশ কয়েকজন রাজা কোশল রাজ্য শাসন করেছিলেন। অযোধ্যা হতে মুদ্রিত চতুর্ভুজ আকৃতির তামার মুদ্রায় অঙ্কিত নাম হতে এসকল রাজাদের নাম জানা যায়।[২৪] এরমধ্যে দেব রাজবংশের মুলাদেব, বায়ুদেব, বিশাখাদেব, ধনদেব, নরদত্ত, জ্যেষ্ঠদত্ত ও শিবদত্তের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে এই মুদ্রায় প্রকাশিত মুলাদেব, শুঙ্গ সম্রাজ্যের শাসক বসুমিত্রের হন্তারক মুলাদেব একই ব্যক্তি হওয়ার বিষয়টি জানা যায়নি।[২৫]
মুদ্রায় নামাঙ্কিত রাজা ধনদেবকে অযোধ্যা শিলালিপিতে উল্লিখিত রাজা ধনদেব (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী) হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে । সংস্কৃত শিলালিপিতে রাজা কৌশিকীপুত্র ধনদেব তাঁর পিতা ফাল্গুদেবের স্মরণে কেতন উড়ানোর কথা উল্লেখ আছে। এই শিলালিপিতে তিনি নিজেকে পুষ্যমিত্র শুঙ্গ রাজার বংশোদ্ভূত ষষ্ঠ পুরুষ হিসাবে দাবি করেছিলেন। ধনদেব ঢালাই তামা ও ছাঁচে গড়া মুদ্রার প্রকাশ করেছিলেন, উভয় ধরনের মুদ্রার পশ্চাৎ অংশে কুজো ষাঁড়ের ছবি অঙ্কিত থাকতো।[২৬][২৭]
মুদ্রা থেকে কোসলের কিছু স্থানীয় শাসকদের নাম পাওয়া গেছে, এদের মধ্যে একদল শাসকদের নামের শেষে 'মিত্র' পাওয়া গেছে: সত্যমিত্র, আর্যমিত্র, বিজয়মিত্র এবং দেবমিত্র, এদেরকে কখনও কখনও "কোসলের প্রয়াত মিত্র রাজবংশ" বলা হয়। তাদের মুদ্রা থেকে পরিচিত অন্যান্য শাসকরা হলেন: কুমুদ সেন, অজবরমণ এবং সংঘমিত্র।[২৮]
নগরকেন্দ্র
অযোধ্যা, সাকেত এবং শ্রাবস্তী ছিল কোশলের প্রধান নগরকেন্দ্র। সেতব্য, উকথা[২৯], দণ্ডকাপ, নলকাপণ এবং পঙ্কধ ছিল কোশলের উল্লেখযোগ্য ছোট শহর।[৩০] পুরাণ ও মহাকাব্য রামায়ণ অনুসারে রাজা ইক্ষবাকু এবং তাঁর বংশধরদের রাজত্বকালে অযোধ্যা নগর কোসলের রাজধানী ছিল।[৩১] মহাজনপদ সময়কালে(খৃস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতাব্দী) কোসলের রাজধানী হিসাবে শ্রাবস্তী নগরের নাম পাওয়া যায় তবে মৌর্য-পরবর্তী (খৃস্টপূর্ব ২য়-১ম শতাব্দী) সময় কোশলের মুদ্রা অযোধ্যা হতে মুদ্রিত হতো।
সংস্কৃতি ও ধর্ম
খৃস্টপূর্ব ৭০০ হতে ৩০০ শতাব্দীতে কোশল রাজ্য উত্তর-ভারতীয় কৃষ্ণ চিক্কণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতির অংশ ছিল।[১] যা পূর্বের (খৃস্টপূর্ব ১৪৫০ হতে ১২০০ শতাব্দীর) কৃষ্ণ ও লোহিত মৃৎপাত্র সংস্কৃতির উত্তরসুরি। কোশল রাজ্য অবস্থানগত ভাবে মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে জনপদসমূহের একটি, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিক ধান আবাদ করা শুরু হয়েছিল, এবং খৃস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীর দিকে লৌহযুগে প্রবেশ করে।[১] ধর্মবিদ্যার পণ্ডিত জিয়োফ্রি স্যামুয়েল ও পরবর্তিতে টিম হপকিন্সের সমর্থিত মতে মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমির লোকসংস্কৃতি অঞ্চলটির পশ্চিমে অবস্থিত কুরু-পাঞ্চাল এলাকার বৈদিক আর্যদের চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন এবং নগরায়ণ ও লোহার ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিকাশিত হয়েছিল।[৬]
বৌদ্ধ ধর্ম উত্থানের সময় ও উদ্ভবের পূর্বে কোশলে সমাজে বৈদিক-ব্রাহ্মণীয় ঐতিহ্যের লৈকিক ও পার্থিব দেবতাদের বিশেষ করে দেবতা যক্ষের প্রভাব ছিল।[৩২] স্যামুয়েলস কোশলের ধর্ম বিশ্বাসকে 'উর্বরতা ও অনুকুলতার ধর্ম' । হপকিন্সের মতে, কোশল "অঞ্চলের ধর্ম বিশ্বাস নারী শক্তি, প্রাকৃতিক রূপান্তর, পবিত্র পৃথিবী এবং পবিত্র স্থান, রক্তের ত্যাগ এবং তাদের সম্প্রদায়ের পক্ষে দূষণকে গ্রহণকারী আচারবাদীদের দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল"।[৩৩] কুরু-পঞ্চলা অঞ্চলের বিকাশমান ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের বিপরীতে, কোসল অঞ্চল যেখানে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম বিকশিত হয়েছিল; এছাড়া অঞ্চলটি ব্রাহ্মণ্যিক ঐতিহ্যের উপনিষদ বা বেদান্ত রচনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। "[৫] স্যামুয়েলসের মতে, কোশলে বৌদ্ধধর্ম বিকাশ ও প্রসারের কারণ কুরু-পাঞ্চালায় বিকশিত একটি বৈদিক-ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ ছিল না, বরং এই বৈদিক-ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থার ব্রাহ্মণদের উচ্চতর অবস্থান দেওয়া ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের বিরোধিতা ছিল।[৩৪]
Bhandare, S. (২০০৬), Numismatic Overview of the Maurya-Gupta Interlude in P. Olivelle, সম্পাদক, Between the Empires: Society in India 200 BCE to 400 CE, New York: Oxford University Press, আইএসবিএন0-19-568935-6উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link) .
Falk, H. (২০০৬), The Tidal Waves of Indian History in P. Olivelle, সম্পাদক, Between the Empires: Society in India 200 BCE to 400 CE, New York: Oxford University Press, আইএসবিএন0-19-568935-6উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Lahiri, B. (১৯৭৪), Indigenous States of Northern India (Circa 300 B.C. to 200 A.D.), Calcutta: University of Calcuttaউদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Law, B. C. (১৯৭৩), Tribes in Ancient India, Poona: Bhandarkar Oriental Research Instituteউদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Mahajan, V.D. (১৯৬০), Ancient India, New Delhi: S. Chand, আইএসবিএন81-219-0887-6উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Pargiter, F.E. (১৯৭২), Ancient Indian Historical Tradition, Delhi: Motilal Banarsidassউদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Raychaudhuri, H.C. (১৯৭২), Political History of Ancient India, Calcutta: University of Calcuttaউদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Samuel, Geoffrey (২০১০), The Origins of Yoga and Tantra: Indic Religions to the Thirteenth Century, Cambridge University Press, পৃষ্ঠা 61–63উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link) .
Thapar, R. (২০০১), Aśoka and the Decline of the Mauryas, New Delhi: Oxford University Press, আইএসবিএন0-19-564445-Xউদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)