কান্সাই অঞ্চল (関西地方,কান্সাই-চিহোও) অথবা কিংকি অঞ্চল (近畿地方,কিংকি-চিহোও) বলতে জাপানের বৃহত্তম দ্বীপ হোনশুর দক্ষিণ-মধ্য অঞ্চলটিকে বোঝায়।[২] এই অঞ্চলের অন্তর্গত প্রশাসনিক অঞ্চলগুলি হল মিয়ে, নারা, ওয়াকায়ামা, কিয়োতো, ওসাকা, হিয়োগো এবং শিগা। কোনও কোনও মত অনুযায়ী ফুকুই, তোকুশিমা ও তোত্তোরি প্রশাসনিক অঞ্চলগুলিকেও এর অন্তর্গত ধরা হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কান্সাই ও কিংকি কথা দুটির ব্যবহারের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটলেও বর্তমানে দুটি শব্দই বহুল প্রচলিত। ওসাকা, কোওবে ও কিয়োতোর মিলিত নগরাঞ্চল বৃহত্তর তোকিও অঞ্চলের পরেই জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম।
ভূগোল
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে কান্সাই অঞ্চলকে জাপানের হৃদয় বলা যেতে পারে। ২০১০ খ্রিঃ এর জনগণনা অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ছিল ২,২৭,৫৭,৮৯৭ জন। অঞ্চলটির কেন্দ্র হল ওসাকা সমভূমি, যেখানে অবস্থান করছে দুই মহানগর ওসাকা এবং কিয়োতো। এখান থেকে পূর্বদিকে কান্সাইয়ের বিস্তৃতি বিওয়া হ্রদ অবধি, যা জাপানের বৃহত্তম স্বাদু জলের হ্রদ। এই হ্রদ ছাড়িয়ে ইবুকি পর্বত ও ইসে উপসাগরের উপকূল হল এর সর্ব পূর্ব সীমানা। পশ্চিমে কোওবে ও হিমেজি নগর পর্যন্ত এই অঞ্চলের বিস্তার, উত্তরে জাপান সাগর এবং দক্ষিণে কিই উপদ্বীপ ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাধ্যমে এর সীমা সূচিত হয়েছে। জাপানের চারটি জাতীয় উদ্যান কান্সাই অঞ্চলের অন্তর্গত। জাতীয় সম্পদের সংখ্যার নিরিখেও জাপানের প্রথম সাতটি প্রশাসনিক অঞ্চলের ছয়টিই এখানে অবস্থিত। অন্যান্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে কিয়োতো প্রশাসনিক অঞ্চলের আমানোহাশিদাতে এবং হিয়োগো প্রশাসনিক অঞ্চলের আওয়াজি দ্বীপ।
ইতিহাস
কান্সাই (関西), কিংকি (近畿) ও কিনাই (畿内) শব্দগুলি প্রাচীন। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর রিৎসুরিও সংস্কারের সময় য়ামাতো, য়ামাশিরো, কাওয়াচি, সেৎৎসু ও ইযুমি এই পাঁচটি প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। কিনাই ও কিংকি এই দুটি শব্দই এই প্রদেশগুলোকে বোঝাত।[৩] শব্দ দুটিরই মানে হল "রাজধানীর নিকটে"। বর্তমানে কিনাই বলতে ওসাকা-কোবে-কিয়োতো মহানগরত্রয়ীকে বোঝায়।
কান্সাই কথাটির আক্ষরিক অর্থ "টোলগেটের পশ্চিমে"। প্রাথমিকভাবে শব্দটি ওসাকা টোলগেটের (逢坂関, ওসাকা নো সেকি) পশ্চিমদিকের ভূভাগকে বোঝাত, যা পূর্বতন য়ামাশিরো প্রদেশ ও ওওমি প্রদেশের সীমায় (অধুনা কিয়োতো ও শিগা প্রশাসনিক অঞ্চল) অবস্থিত ছিল।[৪]কামাকুরা যুগে ওওমি ও ইগা প্রদেশের মধ্যে এই সীমারেখার পুনর্বিন্যাস করা হয়।[৪] অঞ্চলটি তার বর্তমান আকৃতি লাভ করে এদো যুগে (১৬০০-১৮৬৮ খ্রিঃ)।[৫] জাপানের অন্যান্য অঞ্চলের মতই কান্সাই অঞ্চলও কোনও প্রশাসনিক একক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের নিরিখে স্বতন্ত্র একটি অঞ্চল।
কান্সাই অঞ্চলে জাপানের সভ্যতার প্রথম পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। রেশম পথের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ছিল নারা, জাপানের প্রথম স্থায়ী জাতীয় রাজধানী শহর। এই যুগে (৭১০-৭৮৪ খ্রিঃ) জাপানে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে এবং ৭৪৫ খ্রিঃ তোওদাই-জি মন্দির নির্মিত হয়। স্থানীয় শিন্তো ধর্মের পবিত্রতম তীর্থস্থান, মিয়ে প্রশাসনিক অঞ্চলের ইসে তীর্থও (৬৯০ খ্রিঃ নির্মিত) এই অঞ্চলেই অবস্থিত।[৬]
হেইয়ান যুগে জাপানের রাজধানী হেইআন-ক্যো নগরে (平安京, অধুনা কিয়োতো) স্থানান্তরিত হয় এবং তার পরবর্তী হাজার বছর ধরে মেইজি পুনর্গঠন পর্যন্ত কিয়োতোই রাজধানী থাকে। এই হাজার বছরের মধ্যেই কান্সাই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ধ্রুপদী জাপানি সংস্কৃতির জন্ম হয়। ৭৮৮ খ্রিঃ বৌদ্ধধর্মের তেন্দাই শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাইচো, শিগা প্রশাসনিক অঞ্চলের হিয়েই পর্বতে তার মঠ স্থাপন করেন। হেইআন-ক্যোর রাজসভায় জনৈক সহকারী মুরাসাকি শিকিবু রচনা করেন জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনী ও তর্কযোগ্যভাবে পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস গেঞ্জির গল্প । জাপানের দুই ঐতিহ্যবাহী নাটকের ধারা নো এবং কাবুকির জন্ম ও পরিমার্জন হয় কিয়োতোয়। অন্যদিকে জাপানি পুতুলনাচ বুন্রাকুর জন্ম হয় ওসাকায়।
জাপানের ইতিহাসে কান্সাই অঞ্চলের বিশিষ্ট অবস্থান, সেইসঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহ থেকে ধ্বংসের হাত থেকে ঘটনাচক্রে রক্ষা পাওয়ার ফলে এই অঞ্চলে জাপানের অন্য যে কোনও অঞ্চলের তুলনায় বেশি সংখ্যক ইউনেস্কো নির্দিষ্ট বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান কেন্দ্রীভূত রয়েছে।[৭] এই তালিকায় কান্সাইয়ের অন্তর্গত মোট পাঁচটি স্থান হল হোরিউ-জি অঞ্চলের বৌদ্ধ মন্দিরসমূহ, হিমেজি দুর্গ, প্রাচীন কিয়োতোর ঐতিহাসিক সৌধসমূহ (কিয়োতো, উজি ও ওৎসু নগর), প্রাচীন নারার ঐতিহাসিক সৌধসমূহ এবং কিই পার্বত্য অঞ্চলের তীর্থস্থানসমূহ।[৮]