হার্বার্ট লরেন্স অ্যান্ডারসন (২৪ মে ১৯১৪-১৬ জুলাই ১৯৮৮) একজন আণবিক পদার্থবিজ্ঞানী, তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন।
ম্যানহাটন প্রকল্পে অ্যান্ডারসন বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নিউক্লীয় বিভাজন প্রদর্শনকারী প্রথম দলের সদস্য ছিলেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুপিন হলের বেসমেন্টে এই প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, যার সাংকেতিক নাম ছিল ট্রিনিটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ও ১৯৮২ সালে অবসরগ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। তিনি সেখানে বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মিকে ফার্মি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি ফার্মি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি লস অ্যালামোস জাতীয় বিজ্ঞানাগারের জ্যেষ্ঠ ফেলো ছিলেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অ্যান্ডারসন এনরিকো ফার্মি পুরস্কার লাভ করেন।
শিক্ষা
নিউ ইয়র্ক শহরে একটি ইহুদি পরিবারে অ্যান্ডারসন জন্মগ্রহণ করেন। "পদুয়ার মহারাম", রাব্বি মেয়ার কাতজেনেলেবোলগেন তার পূর্বসূরি। "অবিভক্ত শৃঙ্খল" বা দি আনব্রোকেন চেইন গ্রন্থে এর বিস্তৃত বর্ণনা আছে। অ্যান্ডারসন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনটি ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথমটি হলো- মানবিক অনুষদ হতে স্নাতক (১৯৩১), তড়িৎপ্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক (১৯৩৫) ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি (১৯৪০)।[১]
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন আর ডানিং, আর্নেস্ট লরেন্সের সাইক্লোট্রনের উপর করা কাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ডানিং একটি অধিক শক্তিশালী নিউট্রন-উৎসের অনুসন্ধান করছিলেন। সাইক্লোট্রন এ কাজে তার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে অনেক অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত অনুদানের সাহায্যে তিনি সাইক্লোট্রন নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অ্যান্ডারসন যখন তড়িৎপ্রকৌশলের উপর পড়াশোনা করছিলেন, তখন সাইক্লোট্রন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছিল। অধ্যাপক ডানা মিশেলের পরামর্শে ডানিং অ্যান্ডারসনকে শিক্ষণ সহকারী (Teaching assistant) পদে নিয়োগের প্রস্তাব দেন। তবে এক্ষেত্রে ডানিংয়ের শর্ত ছিল, অ্যান্ডারসনকে সাইক্লোট্রন নির্মাণে সাহায্য করতে হবে। অ্যান্ডারসন এ প্রকল্পে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রথমত, তিনি উচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফিলামেন্টের নকশা করেন, যা সাইক্লোট্রনের উচ্চ চৌম্বকক্ষেত্রে বেশি দিন টিকে থাকতে সক্ষম। এছাড়াও সাইক্লোট্রনের ডি আকৃতির তড়িৎদ্বারগুলোকে কার্যক্ষম করার জন্য কনসেন্ট্রিক রেখার ব্যবহার ছিল তার অন্যতম সফলতা। এর ফলে সাইক্লোট্রনের যথেষ্ট মানোন্নয়ন হয় এবং আজও সাইক্লোট্রন নির্মাণে এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখা হয়। এ কাজে তাকে অধ্যাপক ডানিং ছাড়াও আর যারা সাহায্য করেন,তারা হলেন- ইউজিন টি বুথ, জি নরিস গ্লাসোয়ে ও হিউ গ্লাসফোর্ড। এছাড়াও ১৯৩৮ সালের শেষভাগে তিনি আয়নিকরণ প্রকোষ্ঠ(Ionization chamber) ও দৈর্ঘ্য বিবর্ধক (Linear amplifier) ব্যবহার করেন। [১][২]
১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে জার্মান রসায়নবিদ অটো হান ও ফ্রিৎস স্ট্রাসম্যান ন্যাচারউইজেনশাফতেন পত্রিকায় একটি পাণ্ডুলিপি পাঠান। এতে তারা দাবি করেন, ইউরেনিয়ামকে নিউট্রন দ্বারা আঘাত করার ফলে তারা বেরিয়াম নামক নতুন মৌল শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা লিজ মেইটনারকে তাদের পরীক্ষার ফলাফল প্রেরণ করেন। মেইটনার ও তার ভাগনে অটো রবার্ট ফ্রিৎস এই ঘটনাকে নিউক্লীয় বিভাজন রূপে শনাক্ত করেন। [৩] ফ্রিৎস ১৯৩৯ সালের ১৩ জানুয়ারি পরীক্ষার মাধ্যমে এটি সুনিশ্চিত করেন।[৪] ১৯৪৪ সালে অটো হান নিউক্লীয় বিভাজন আবিষ্কারের জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক দাবি করেন, লিজ মেইটনারকেও নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত ছিল। [৫]
হান ও স্ট্রাসম্যানের গবেষণা সম্পর্কে মেইটনার ও ফ্রিৎসের অভিমত প্রকাশের পূর্বেই ড্যানিশ বিজ্ঞানী নিলস বোর এ সম্পর্কে অবহিত হন। বোর তখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইসিডোর আইজ্যাক রাব্বি ও উইলিস ল্যাম্ব তখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। দ্রুত তারা এ সংবাদ কলাম্বিয়ায় পৌঁছান। ইসিডোর দাবি করেন, তিনি প্রথম এ সম্পর্কে ফার্মিকে জানিয়েছিলেন- যদিও ফার্মি দাবি করেন, ল্যাম্ব তাকে এ সম্পর্কে প্রথম অবহিত করেন। বোর তৎক্ষণাৎ ফার্মির সাথে সাক্ষাতের জন্য কলাম্বিয়া যান। ফার্মিকে তার কক্ষে খুঁজে না পেয়ে বোর সাইক্লোট্রন কক্ষে যান। অ্যান্ডারসন সেখানেই অবস্থান করছিলেন। অ্যান্ডারসনকে জড়িয়ে ধরে বোর বলেন, "ওহে যুবক, তোমাকে আমি পদার্থবিজ্ঞানের একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা সম্পর্কে আজ অবহিত করবো। " কলাম্বিয়ার বিজ্ঞানীদের কাছে এটি পরিষ্কার হয়ে যায়, নিউক্লীয় বিভাজনের ফলে যে শক্তি নির্গত হয়, সেটি তাদের শনাক্ত করা উচিত। ১৯৩৯ সালের ২৫ জানুয়ারি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুপিন হলের বেসমেন্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নিউক্লীয় বিভাজন প্রক্রিয়া ঘটানো হয়। এ কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন- অ্যান্ডারসন, ডানিং, ফার্মি, জি নরিস গ্লাসগো ও ফ্রান্সিস কি স্ল্যাক।
এই ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর মাত্র কিছুদিন পূর্বে ফার্মি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। এর মারফতে অ্যান্ডারসন ও ফার্মির মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয়, যা ১৯৫৪ সালে ফার্মির মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ফার্মি ও অ্যান্ডারসন একত্রে অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এর মধ্যে রয়েছে- গ্রাফাইটে নিউট্রনের গতি হ্রাস, ধীরগতিসম্পন্ন নিউট্রনের প্রাসঙ্গিক পদার্থেরর মাধ্যমে শোষণ ও প্রতিফলন এবং গ্রাফাইটের অভ্যন্তরে ইউরেনিয়াম স্ফটিকের উপর প্রাথমিক পরীক্ষা। অ্যান্ডারসনের পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভের আলোকে প্রণীত গবেষণাপত্র "ইউরেনিয়ামে নিউট্রনের অনুনাদ শনাক্তকরণ", নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রণয়নের দশ বছর পর প্রকাশিত হয়।
শৃঙ্খল বিক্রিয়া
ম্যানহাটন প্রকল্পের অংশ হিসাবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ধাতুবিদ্যা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অ্যান্ডারসন ফার্মির অধীনে "শিকাগো-পাইল-১" নির্মাণ করেন, যেটি ঐ বছরের ডিসেম্বরে বিশ্বের প্রথম মনুষ্যসৃষ্ট নিউক্লীয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হয়। [৬] অ্যান্ডারসন ১৯৪৩ সালে আরগোন জাতীয় বিজ্ঞানাগারে শিকাগো-পাইল-২ তৈরির নেতৃত্ব দেন। তিনি দুপোঁ কোম্পানিকে হানফোর্ড বিক্রিয়ক নির্মাণে সাহায্য করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল নিউক্লীয় বিভাজনের জন্য বিভাজনযোগ্য প্লুটোনিয়াম তৈরি করা।
১৯৪৪ সালে তিনি লস আলামোস জাতীয় বিজ্ঞানাগারে গবেষণা শুরু করেন। সেখানে ওমেগা বিক্রিয়ক ব্যবহার করে তিনি ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর ক্রিটিক্যাল ভর (নিউক্লীয় বিভাজনের জন্য ন্যূনতম যে পরিমাণ বিভাজনযোগ্য পদার্থের প্রয়োজন হয়) নির্ণয় করেন। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই প্রথম নিউক্লীয় অস্ত্র পরীক্ষার জন্য অ্যান্ডারসন নিউক্লীয় নমনাঙ্ক বের করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফার্মি ও অ্যান্ডারসন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি সেখানে নিউক্লীয় অধ্যয়ন ইনস্টিটিউট(বর্তমান এনরিকো ফার্মি ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে সহকারী অধ্যাপক, ১৯৪৭-১৯৫০ সালে সহযোগী অধ্যাপক, ১৯৫০-১৯৭৭ সালে অধ্যাপক ও ১৯৭৭-১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিশেষ সম্মানপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৫৮-১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি এনরিকো ফার্মি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন।
এছাড়াও অ্যান্ডারসন ব্রাজিল ও ইতালিতে কাজ করেছেন। এরপর তিনি লস আলামোস ফিরে আসেন। ১৯৭৮ সালের ১৬ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বেরিলিয়াম নিয়ে কাজ করার দরুন তার ফুসফুস অকেজো হয়ে যায়। এটিই শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।