ম্যানহাটন প্রকল্পপারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রকল্পের নাম যাতে যুক্তরাজ্যের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মিত পারমাণবিক বোমা সফলভাবে বিস্ফোরণের ফলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। একে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ পদ্ধতিগত, শৈল্পিক ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
সাধারণ পরিচিতি
১৯৪৫ সালের মূল্য অনুযায়ী এই প্রকল্পের জন্য খরচ হয়েছিল প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলা টাকায় প্রায় ১৩৭১৮৮০৮০০০ টাকা ; এবং এতে মোট ১৭৫,০০০ লোক কাজ করেছিল। প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ গোপনে সম্পাদিত হয় এবং সেখানকার খুব কম লোকই তার প্রকৃত উদ্দেশ্য জানতো। প্রকল্পের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কিছু লোকই পারমাণবিক বোমা তথা তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র নির্মাণের বিষয়টি অবগত ছিল। ম্যানহাটন প্রকল্প পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা ঘটায় যাকে বলা হয় "পারমাণবিক যুগ"। পারমাণবিক বোমা কতটা ভয়ানক এবং বিধ্বংসী হতে পারে, আর এর প্রতিক্রিয়াই বা কি হতে পারে, প্রকল্পের মাধ্যমে তা পরিষ্কার হয়েছে। পারমাণবিক বোমা তৈরির পর একটি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার উদ্ভব ঘটেছে। এর ফলে বর্তমানে এতো পরিমাণ পারমাণবিক বোমা উৎপাদিত হয়েছে যার মাধ্যমে মানব সভ্যতা এবং পৃথিবীর অধিকাংশ জীবকূল মুহুর্তেই ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব।
১৯৪২ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৪৬ সালে একে এটমিক এনার্জি কমিশনের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। এর ফলে মূলত ম্যানহাটন প্রকল্পের সমাপ্তি ঘটে। এর প্রকৃত কেন্দ্র ছিল নিউ ইয়র্ক সিটিরম্যানহাটন নামক ব্যুরোতে। এছাড়াও দেশব্যাপী ৩টি স্থানে এর কেন্দ্র ও পরীক্ষাগার অবস্থিত ছিল। এই স্থানগুলো হচ্ছে টেনেসির ওক রিজে, ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ড এবং নিউ মেক্সিকোর লস আলামস। এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার লেজলি রিচার্ড গ্রোভ্স এবং লস আলামসের বৈজ্ঞানিক পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। বিংশ শতাব্দীর একদল সেরা বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ লস আলামসে ওপেনহাইমারের অধীনে কাজ করেছিলেন। প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের মধ্যে রয়েছেন : ফিলিপ এইচ আবেলসন, হান্স বেটে, নিল্স বোর, জেমস চ্যাডউইক, এনরিকো ফের্মি, রিচার্ড ফাইনম্যান, অটো ফ্রিশ্চ, জর্জ কিস্তিয়াকোভ্স্কি, আর্নেস্ট লরেন্স, ফিলিপ মরিসন, সেথ নেডারমেয়ার, জন ফন নিউমান, রুডলফ্ পিয়ার্লস, ইসিদোর ইজাক রাবি, লিও জিলার্দ, এডওয়ার্ড টেলার, স্তানিসল' উলাম, হ্যারল্ড উরে এবং ভিক্টর ওয়েইজকফ। প্রকল্পে কাজ শুরু করার আগেই এদের মধ্যে ৫ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং যুদ্ধের পর এখান থেকে আরও ৩ জন নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
ম্যানহাটন প্রকল্প ৪টি পারমাণবিক বোমা বানিয়েছিল। এর মধ্যে ট্রিনিটি নামক প্রথম বোমাটি নিউ মেক্সিকোর আলামোগোর্ডোর নিকটে পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরিত করা হয়। অন্য দুটি বোমা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট এবং ৯ আগস্ট তারিখে যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত হয়। শেষ বোমাটি আগস্টের শেষ দিকে জাপানের উপর নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
পারমাণবিক গবেষণার উৎস
ম্যানহাটন প্রকল্পই পৃথিবীর প্রথম সফল পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাই পারমাণবিক বোমা তৈরির ধারণার ইতিহাসকে এর ইতিহাস হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। ১৯০০'র সময়কার ব্রিটেন এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারেই এ ধারণার বীজ বুনন শুরু হয়। প্রথম দিকটায় পরমাণুকে নিরেট এবং অবিভাজ্য জ্ঞান করা হতো। তিনি এক্স-রশ্মি, রেডিয়াম, ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন এবং আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি আবিষ্কারের পর যে বিপ্লবের সূচনা হয় তাতে বিজ্ঞানীরা অতিপারমাণবিক জগৎকে বুঝতে শুরু করেন। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং ওলন্দাজ পদার্থবিজ্ঞানী নিল্স বোর পৃথক পৃথক দুটি পরমাণু মডেলের ধারণা দেন যেগুলোতে পরমাণুকে নিরেট না বলে অতি ক্ষুদ্র আকারের সৌর জগৎ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। বলা হয়, পরমাণুর কেন্দ্রের ধনাত্মক প্রোটন এবং নিরপেক্ষ নিউট্রনকে কেন্দ্র করে ঋণাত্মক ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন করছে।
বিজ্ঞানীরা জানতেন, প্রতিটি রাসায়নিক মৌলের পরমাণু আলাদা, একের সাথে অন্যের সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যেমন, হাইড্রোজেন মৌলের ক্ষেত্রে একটি ইলেকট্রন একটি প্রোটনকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এটিই সরলতম গঠন। ইউরেনিয়াম পরমাণুতে ৯২টি ইলেকট্রন ৯২টি প্রোটনকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে যা অনেকটাই জটিল। এই মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা তাই ৯২। এই মৌলগুলোর যে কোন একটির মধ্যেও আবার বিভিন্নতা দেখা যায় যাদেরকে বলা হয় সমাণুক। একটি নির্দিষ্ট মৌলে ইলেকট্রন ও প্রোটন সংখ্যা সর্বদা সমান এবং নির্দিষ্ট হলেও নিউক্লিয়াসের নিউট্রন সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এদের মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি হতে পারে। এভাবেই সমাণুকের সৃষ্টি হয়। ইউরেনিয়ামের তিনটি স্থায়ী সমাণুক রয়েছে যাদেরকে তাদের পৃথক পৃথক ভর সংখ্যা দ্বারা নামাঙ্কিত করা হয়। এগুলো হল U২৩৮, U২৩৫ এবং U২৩৪। ইউ-২৩৮ প্রকৃতিতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, আর ইউ-২৩৫ হল বিরলতম। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে শতকরা মাত্র ০.৭ ভাগ ইউ-২৩৫ থাকে। ইউরেনিয়াম যেহেতু অস্থিত মৌল, তাই তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা এর কেন্দ্রকে দ্রুত গতির নিউট্রন ঝড় দ্বারা আঘাত করে নতুন ধরনের শক্তি আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু করেছিলেন।
নাৎসি জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে পালিয়ে আসা হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানী লিও জিলার্দ ১৯৩৩ সালের কোন একদিন লন্ডনের রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের রং পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় তিনি হঠাৎ বুঝতে পারেন, সঠিক পদার্থ পাওয়া গেলে তার পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে বিভাজিত করে সেখান থেকে নিউট্রন বিমুক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে নিউক্লীয় শিকল বিক্রিয়া শুরু হতে পারে যার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে মুক্তিপ্রাপ্ত নিউট্রনগুলো আরও পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে থাকবে যার ফলে নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। তৈরি হবে স্বয়ংক্রিয় নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়ার ধারা এবং এর সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে নিউক্লীয় শক্তি বিমুক্ত হবে। এ ধরনের শিকল বিক্রিয়া তড়িৎ উৎপাদন বা বোমা তৈরিতে কাজে লাগানো যেতে পারে। পরের বছর জিলার্দ এ নিয়ে একটি ব্রিটিশ পেটেন্ট জমা দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেন। কিন্তু জার্মান বিজ্ঞানীরা পেটেন্টের কথা জেনে গিয়ে বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজে হাত দিতে পারে, এই ভয়ে তিনি পেটেন্ট জমা দেয়া থেকে বিরত থাকেন।
একই বছর অর্থাৎ ১৯৩৩ সালে ফ্রান্সেরপ্যারিসে ফরাসি বিজ্ঞানী আইরিন জোলিও-কুরি এবং তার স্বামী ফ্রেদেরিক জোলিও-কুরি একসাথে গবেষণা করে কৃত্রিমভাবে তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্টিতে সমর্থ হন। এর কিছুকাল পরেই ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি প্রথম কৃত্রিমভাবে রাসায়নিক মৌল তৈরি করেন যার পরমাণবিক সংখ্যা ইউরেনিয়াম থেকে বেশি। ফের্মি আসলে পরমাণুকেই বিভাজিত করেছিলেন, যদিও তখন তা বুঝতে পারেননি। জার্মানিরবার্লিনে ভৌত রসায়নবিদ অটো হান এবং ফ্রিৎজ স্ট্রসম্যান ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে নিউট্রনের মাধ্যমে আঘাত করে ফের্মির পরীক্ষার পুণরাবৃত্তি করেন। ১৯৩৮ সালে এ পরীক্ষার মাধ্যমে তারা বেরিয়াম মৌলটি পান যা ছিল অনেকটাই বিস্ময়কর। হান তার দীর্ঘ সময়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণা সহকর্মী লিজে মাইটনারকে এ বিষয়ে লিখেন। সমসাময়িককালের সেরা নারী বিজ্ঞানী মাইটনার হিটলারের কারণে জার্মানি ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। মাইটনার ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র অটো ফ্রিশ্চ হানের চিঠি পড়ে ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসেন। তারা বলেন, এই দুই জার্মান বিজ্ঞানী ইউরেনিয়াম পরমাণুর কেন্দ্রীয়কে প্রায় অর্ধেক অর্ধেক করে বিভাজিত করেছেন। ইউরেনিয়ামকে এভাবে বিভাজিত করার ফলে ৫৬ পারমাণবিক সংখ্যাবিশিষ্ট বেরিয়াম এবং ৩৬ পারমাণবিক সংখ্যাবিশিষ্ট ক্রিপ্টন মৌল দুটি সৃষ্টি হয়েছে। ফ্রিশ্চ প্রথম এই প্রক্রিয়ার নাম দেন "ফিশন" তথা কেন্দ্রীন বিভাজন।
মাইটনার ও ফ্রিশ্চ, হান ও স্ট্রসমানের ফলাফলের একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তারা যুক্তি দেখান যে এই ফলাফল বোরের পরমাণু মডেলকে সমর্থন করে। ইউরেনিয়াম পরমাণুর এ ধরনের বিভাজনে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় এবং এই পরিমাণ আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর-শক্তি সমীকরণ E=mc2 দ্বারা নির্ণয় করা যায়। এভাবে অতি ক্ষুদ্র ভর থেকে বিপুল শক্তি উৎপাদন সম্ভব। আর প্রতিটি কেন্দ্রীয় বিভাজনে যদি উপজাত হিসেবে নিউট্রন তৈরি হয় তবে তো শিকল বিক্রিয়ার আকারে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। মাইটনার ও ফ্রিশ্চ এই তথ্য নিয়ে কোপেনহেগেনে বোরের কাছে ছুটে যান যিনি তখন পদার্থবিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য ওয়াশিংটন ডিসি'র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছিলেন। এটা ১৯৩৯ সালের জানুয়ারির কথা। ইউরেনিয়ামের কেন্দ্রীয় বিভাজন সম্ভব জানতে পেরে ওয়াশিংটনের বিজ্ঞানীরা অনতিবিলম্বে তাদের গবেষণাগারে আগের পরীক্ষাগুলোর পুণরাবৃত্তি করতে শুরু করেন। এর মাত্র ১ বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয়ন বিভাজন বিষয়ে শতাধিক গবেষণাপত্রের উদ্ভব হয়। জিলার্দ ইউরেনিয়াম বিভাজনের খবর শুনে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, "পৃথিবী দুঃখের দিকে এগিয়ে চলেছে"। ১৯৩৯ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীদের একটি ছোট দল নিশ্চিত ছিলেন যে, এই প্রক্রিয়ায় অনন্য সাধারণ শক্তির এক অস্ত্র নির্মাণ সম্ভব, অন্তত তত্ত্ব তা-ই বলছিল।
ব্রিটিশ প্রচেষ্টা
বিজ্ঞানীরা দেখলেন, কেবল ইউরেনিয়াম-২৩৫ থেকেই বিভাজন সম্ভব। কিন্তু ৫০ থেকে ১৮০ টন প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে ইউ-২৩৫ থাকে শতকরা এক ভাগেরও কম। তাই পারমাণবিক বোমা বানালে তার ভর হবে প্রায় ৫০ টন যা অবাস্তব কল্পনা, বৈজ্ঞানিক নয়। তাই বোমার পরিবর্তে বড় আকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের কথা চিন্তা করতে থাকেন। কিন্তু ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর নাৎসি জার্মানিপোল্যান্ড দখল করার পর যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন বোঝাই যাচ্ছিল, যুদ্ধ শেষ না হলে এতো বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব নয়। পোল্যান্ড দখলের ২ সপ্তাহ পর হিটলার এক বেতার ভাষণে ব্রিটেনকে এই বলে ভয় দেখান যে, তার কাছে এমন অস্ত্র আছে যা ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এই ভাষণ নিয়ে গবেষণা করে এ ধরনের হুমকির চারটি সম্ভাব্য অর্থ বের করেন:
হিটলার কেবল মিথ্যা হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন।
নাৎসিরা একটি বিধ্বংসী বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করেছে।
হিটলার এর মাধ্যমে Luftwaffe নামে পরিচিত জার্মান বিমান বাহিনীকেই নির্দেশ করছিল।
জার্মানরা একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে।
১৯৩৯ সালের শুরতে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জার্মানির পারমাণবিক বোমা নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে বিশেষ দোটানার মধ্যে ছিল। তখনই প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল পারমাণবিক বোমা নিয়ে গবেষণার জন্য ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের নির্দেশ দেন। ব্রিটিশ সব বিজ্ঞানীরা অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এই দায়িত্ব অর্পিত হয় দুই শরণার্থী বিজ্ঞানী Otto Frisch এবং Rudolf Peierls-এর উপর। তারা ১৯৪০ সালে Frisch-Peierls স্মারক উত্থাপন করেন যাতে বলা হয়, প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম থেকে ইউ-২৩৫ পৃথক করতে পারলেই কেবল বোমা তৈরি সম্ভব। কারণ সেক্ষেত্রে, ৫০ টন ইউ-২৩৮ নয়, কেবল কয়েক কয়েক কেজি ইউ-২৩৫ দিয়েই বোমা তৈরি করা যাবে যার ফলে শিকল বিক্রিয়া শুরু হবে। পরবর্তীতে বলা হয়, ১০ কিলোগ্রাম ইউ-২৩৫ দিয়ে এ উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব। শিল্প-কারখানার প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এই পৃথকীকরণ করা যেতে পারে বলেও তারা উল্লেখ করেন। অবশ্য এই দুই বিজ্ঞানী এই বলে সতর্ক করেন, এর ফলে যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সৃষ্টি হবে তার কথা চিন্তা করে এ ধরনের প্রকল্প থেকে বিরত থাকা উচিত। চার্চিল এই স্মারকের বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখার জন্য একটি উচ্চস্থানীয় নিরীক্ষক দল তৈরি করেন যারা ১৯৪১ সালে পরমানবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করার পক্ষে মত দেয়। এ সময় স্যার জেমস চ্যাডউইক দুই মার্কিন বিজ্ঞানীকে বলেছিলেন, "আমার ইচ্ছা ছিল তোমাদের বলা যে, এই বোমা কাজ করবেনা। কিন্তু আমি শতকরা ৯০ ভাগ নিশ্চিত যে তা কাজ করবে।" ১৯৪০ সালের মধ্যে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা বোমা তৈরির বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছিল। কিন্তু চার্চিল জানতেন, ব্রিটিনের মাটিতে এতো বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবেনা। কারণ এতো বড় প্রকল্পের তথ্য হিটলার সহজেই জেনে যাবে এবং তার Luftwaffe দিয়ে ধ্বংস
স করে দেবে। তাই ব্রিটিশ গবেষণা তাত্ত্বিক পর্যায়েই রয়ে যায়।
মার্কিন প্রচেষ্টা
মার্কিন পরমাণু গবেষণা বেশ ধীরলয়ে চলছিল। অবশ্য ১৯৩৯ সালের প্রথম থেকেই অভিবাসী বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা ত্বরাণ্বিত করার জন্য সরকারকে রাজি করাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ঐ বছরের জুলাইয়ে মার্কিন প্রবাসী হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার, লিও জিলার্দ এবং এডওয়ার্ড টেলার মার্কিন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাটি কাজে লাগায়। তারা আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে এ বিষয় জানিয়ে চিঠি লেখার জন্য। ২ আগস্ট আইনস্টাইন এ অনুরোধ রক্ষা করে রুজভেল্টকে একটি নতুন ধরনের বোমার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেন। এর মাত্র ৬ বছরের মাথায়ই যে জাপানে অপরিমেয় শক্তির বোমা বিস্ফোরিত হতে পরে, আইনস্টাইন তখন তা ভাবতেও পারেননি। ঐ বছরেরই ১১ অক্টোবর Alexander Sachs (যার বিজ্ঞানী সমাজের সাথে কিঞ্চিৎ পরিচয় থাকলেও রুজভেল্টের সাথে ভাল পরিচয় ছিল) পত্রটি রুজভেল্টের কাছে হস্তান্তর করেন। রুজভেল্ট বিজ্ঞান সম্বন্ধে বেশ কমই জানতেন। তাই চিঠিটি পড়ে অবিলম্বে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে ইউরেনিয়াম সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে তথ্য জোগাড়ের নির্দেশ দেন। ১৯৪১ সালের ২৮ জুন রুজভেল্টের নির্দেশে সাইন্টিফিক রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট দফতরের মাধ্যমে "ন্যাশনাল ডিফেন্স রিসার্চ কমিটি" গঠিত হয়। অবশ্য মার্কিনীরা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে তখনও খুব একটি তাড়া বোধ করছিল না। কিন্তু ৭ ডিসেম্বর জাপান কর্তৃক পার্ল পোতাশ্রয় আক্রমণ তাদের টনক নড়িয়ে দেয়। এই আক্রমণের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র জাপান ও জার্মানির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই পারমারবিক বোমা নিয়ে যত তত্ত্বকথা চলছিল তা তৎক্ষণাৎ ব্যবহারিক প্রয়োগের মুখ দেখে। কারণ সবাই বুঝতে পারছিল, যে জাতি প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে তারা যুদ্ধে জিতবে।
পার্ল পোতাশ্রয় হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি কর্পস অফ ইঞ্জিনিয়ার্সের সহযোগিতায় পারমাণবিক বোমা নির্মাণ প্রক্রিয়াকে সরকারিভাবে সুসংগঠিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ কর্তৃক পরিচালিত সাধারণ গবেষণা প্রকল্প থেকে এই প্রচেষ্টা একটি সুবৃহৎ জাতীয় নির্মাণ প্রকল্পে রূপ নেয় যার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হয় ইঞ্জিনিয়ার্স কর্পসের "ম্যানহাটন ইঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্ট"-কে। এখান থেকেই ম্যানহাটন প্রকল্প নামটি এসেছে। প্রকল্পের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব নেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লেজলি রিচার্ড গ্রোভ্স। এই সুদক্ষ সামরিক প্রকৌশলী এর আগে পেন্টাগন নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন। গ্রোভ্স পারমাণবিক গবেষণা সংক্রান্ত সকল প্রচেষ্টাকে একক উদ্দেশ্যে সুসংহত করেন। ফলশ্রুতিতে বড় আকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বিমান, জাহাজ বা ডুবোজাহাজের জন্য শক্তির উৎস নির্মাণ সংক্রান্ত সকল পরিকল্পনা বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন থেকে এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল কেবল একটি, পারমাণবিক বোমা তৈরি করে সম্ভাব্য ন্যুনতম সময়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানো।
এদিকে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা পুরোদমে চালিয়ে গেলেন। এনরিকো ফের্মিকলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার গবেষণার স্থান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাতুবিজ্ঞান গবেষণাগারে নিয়ে আসলেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে অব্যবহৃত ফুটবল স্টেডিয়ামের নিচে একটি স্কোয়াশ কোর্ট কিছুদিনের জন্য ব্যবহার করতে দিল। সেখানে ফের্মি তার ক্রুদের সাহায্যে বিশাল বিশাল ইউরেনিয়াম দণ্ড ও গ্রাফাইট খণ্ড সন্নিবেশিত করলেন যেগুলো প্রায় কোর্টের ছাদ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ফের্মি দেখলেন, গ্রাফাইটের মাধ্যমে শিকল বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এভাবে ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর ফের্মি পৃথিবীর প্রথম নিয়ন্ত্রিত নিউক্লীয় শক্তি বিমুক্তিকরণ প্রক্রিয়া নির্মাণ করলেন। এর প্রায় ৪ বছর আগে বোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বিভাজন বিক্রিয়ার খবর এনেছিলেন। ফের্মি কেবল একটি বাতি জ্বালানোর মত শক্তি উৎপাদনে সমর্থ হয়েছিলেন। তথাপি এটি ছিল সকল ধরনের নিউক্লীয় শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ার আদি পুরুষ। ফের্মির উদ্ভাবনের পর বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হলেন এই ভেবে যে তারা সঠিক পথে রয়েছেন। তদুপরি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী বোমা তৈরি সহজসাধ্য ছিলনা। এর মূল কারণ, ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে প্রাচুর্যময় সমাণুক ইউ-২৩৮ নিউক্লীয়ভাবে বিভাজিত হয়না। সুতরাং বিজ্ঞানীদের পরমাণু পরমাণু ধরে ইউ-২৩৮ থেকে ইউ-২৩৫ পৃথক করার একটি কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। এক্ষেত্রে আবার রাসায়নিক পদ্ধতি কাজে দেবেনা, কারণ রাসায়নিকভাবে ইউ-২৩৮ ও ইউ-২৩৫ একই মৌল। এদেরকে পৃথক করতে হবে ভৌতভাবে।
ওক রিজ
ইউরেনিয়ামের সমাণুকগুলো পৃথক করার জন্য মার্কিন বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি পদ্ধতি নির্ণয় করেছিল, কিন্তু ঠিককোন পদ্ধতি ভাল কাজে দেবে তাবোঝা যাচ্ছিল না। আদৌ কোনটি কাজে দেবে কি-না তাও ছিল অনিশ্চিত। অগত্যা গ্রোভ্স সবগুলো পদ্ধতিতেই চেষ্টা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। এগুলোর জন্য বড় বড় দালান এবং তার চারপাশে নিরাপত্তার খাতিরে বিপুল পরিমাণ খালি জায়গার দরকার ছিল। মার্কিন সেনাবাহিনী এ ধরনের প্রথম স্থাপনা গড়ে তোলে টেনেসির পূর্বাঞ্চলে গ্রাম্য এলাকায় ক্লিঞ্চ নদীর তীরে। এর আয়তন ছিল ২৪,০০০ হেক্টর তথা ৫৯,০০০ একর। যুদ্ধের সময় এ স্থানটি সাইট এক্স নামে পরিচিত হলেও যুদ্ধের পরে এর নাম হয় ওক রিজ জাতীয় গবেষণাগার। গ্রোভ্সের প্রয়োজন অনুসারে প্রায় সবই ছিল এই ওক রিজে। উল্লেখ করার মধ্য ছিল: কাকাছির মধ্য বসবাসকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনশক্তি, পর্যাপ্ত জল এবং মৃদু আবহাওয়া যা নির্বিঘ্নে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ঠিকাদাররা অবিলম্বে ওক রিজে নির্মাণ কাজ শুরু করে। নির্মিত হয় তখন পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহত্তম স্থাপনা কে-২৫ প্ল্যান্ট। সমগ্র নিউ ইয়র্ক সিটির চেয়েও বেশি তড়িৎ শক্তি ব্যবহার করতো এই প্ল্যান্টটি। এতে গ্যাসীয় ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইউরেনিয়াম সমাণুক পৃথক করা হতো।
গোপনীয়তা
১৯৪৫ সালে লাইফ (ম্যগাজিন) একটি নিবন্ধে উল্লেখ করে যে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার আগে, হয়তো ১০ থেকে ১২ জন মানুষ জানত এই প্রজেক্টের আসল অর্থ কি, এবং হয়তো এক হাজারের খুব বেশি মানুষের বিন্দুমাত্র ধারণাই ছিল না পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে। ম্যাগাজিনের মতে প্রোজেক্টের ১ লাখ এর মত কর্মচারী অন্ধকারে ইঁদুরের মত কাজ করত। কোন তথ্য পাচারের শাস্তি ছিল, ১০ বছরের জেল অথবা ১০ হাজার ডলার জরিমানা।[১][২][৩][৪][৫]