নাৎসি জার্মানি এবং ৩য় রাইখ ১৯৩৩-৪৫ সাল পর্যন্ত সময়ে জার্মানির প্রচলিত নাম। এই সময়কালে জার্মান সরকার একটিমাত্র রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি বা নাৎসি পার্টির অধীনে ছিল যার কেন্দ্রে ফিউরার হিসেবে ছিলেন আডলফ হিটলার। হিটলারের অধীনে জার্মানি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তৃতীয় রাইখের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এ সকল প্রতিষ্ঠান তাদের মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশে ও বিদেশে অত্যন্ত বিতর্কিত। ১৯৪৫ সালের মে মাসে মিত্রশক্তি জার্মানিকে পরাজিত করলে ইউরোপ মহাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় এবং একই সাথে জার্মানিতে নাৎসি শাসনের অবসান ঘটে।
ভাইমার প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি পল ভন হিন্ডেনবার্গ ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেন। এর পরপরই নাৎসি পার্টি তার সকল বিরোধীপক্ষকে একে একে শেষ করা শুরু করে এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ পায়। ১৯৩৪ সালের ২ আগস্ট হিন্ডেনবার্গ মারা গেলে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের ক্ষমতা একত্রিত করা হয় এবং তার ফলস্বরূপ হিটলার জার্মানির একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৩৪ সালের ১৯ আগস্ট এক গণভোটের মাধ্যমে হিটলার জার্মানির একমাত্র আইনগত ফিউরার (নেতা) নির্বাচিত হন। হিটলার রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন এবং তার মুখের কথাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। তৎকালীন জার্মান সরকার কোন সমন্বিত ও সুসংগঠিত কাঠামো ছিল না বরং তা ছিল হিটলারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ারমাত্র। বৈশ্বিক মহামন্দার সময়ে হিটলার মিশ্র অর্থনীতির প্রচলন করে আর্থিক সাম্যবস্থা বজায় রাখতে সমর্থ হন এবং সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। হাইওয়ে নির্মাণসহ অন্যান্য জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। অর্থনৈতিক সাফল্য নাৎসি পার্টির জনপ্রিয়তা বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
বর্ণবাদ, বিশেষ করে ইহুদী বিদ্বেষ ছিল নাৎসি পার্টির শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জার্মান জনগণ নর্ডিক জাতি হিসেবে পরিচিতিপ্রাপ্ত হয় এবং নিজেদের আর্য জাতির বিশুদ্ধ উত্তরসূরি হিসেবে মনে করা শুরু করে। তারা একসময় প্রভুত্বকারী জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়া শুরু করে। ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। তাদের বেশিরভাগই অত্যাচার, নিপীড়ন বা হত্যার শিকার হন। হিটলারবিরোধী সকল শক্তিকে দমন করা হয়। উদারপন্থী, সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট বিরোধী দলের সদস্যদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়, বন্দী করা হয় নয়তো দেশান্তরী হতে বাধ্য করা হয়। এমনকি চার্চগুলোও নাৎসি পার্টির কড়া নজর থেকে রেহাই পায়নি। বহু ধর্মীয় নেতাকে অবৈধভাবে বন্দী করা হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্ণবাদী জীববিজ্ঞান, জনসংখ্যা নীতি ও সামরিক বাহিনীতে ভর্তির যোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়। মহিলাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করা হয়। এমনকি বিনোদন ও পর্যটনের মত সুযোগসুবিধাও সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত। হিটলারের জ্বালাময়ী ভাষণ, বিশাল বিশাল মিছিল আর প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের চলচ্চিত্রসমূহের মাধ্যমে সুকৌশলে জনগণের মতামত নিয়ন্ত্রণ করা হত। সরকার চিত্রকলায় বিশেষ কয়েকটি ধারা অনুশীলনে উৎসাহ প্রদান করে এবং অন্যান্য ধারাগুলোকে অনুৎসাহিত করা হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
নাৎসি জার্মানি তাদের জন্য অতিরিক্ত এলাকা দাবি করে এবং যুদ্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নেওয়ার হুমকি দেওয়া শুরু করে। ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে দেশটি অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে। হিটলার স্তালিনের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করেন। ইতালি ও অন্যান্য সহযোগী শক্তির সহায়তায় ১৯৪০ সালের মধ্যে জার্মানি ইউরোপের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে ফেলে। বেশিরভাগ দেশে নামেমাত্র সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করা হয়। পরবর্তীতে এসব হতভাগ্যদের জার্মান গণহত্যার শিকার হতে হয় যা ইতিহাসে হলোকস্ট নামে পরিচিত।
১৯৪১ সালে নাৎসি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ১৯৪৩ সালের পর বড় বড় যুদ্ধে জার্মান বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৯৪৪-এ জার্মানির শহর, রেললাইন ও তেলক্ষেত্রগুলো ব্যাপক বোমবর্ষণের শিকার হয়। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত বাহিনী জার্মানির পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমা মিত্রবাহিনী জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল দখল করে। হিটলার তবু আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে দেশটির অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধাপরাধের দায়ে নাৎসি জার্মানির অধিকাংশ নেতৃবৃন্দকে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
↑ হিটলারের মৃত্যু হলে এই পদটি শূন্য হয়। ১৯৩৪ সাল থেকে তার উপাধি ছিল ফিউরার উন্ড রাইখ্সকান্ৎলার।
↑ ১৯৩৯ সালের পরিসংখ্যান; এর পরেই জার্মানি ভার্সাই চুক্তির ফলে তার হারানো দুইটি অঞ্চল আল্সাক-লোরেন, ডানজিগ ও পোলিশ করিডোর পুনরুদ্ধার করে। অঞ্চল দুইটির মোট পরিমাণ ছিল ৬,৩৩,৭৮৬ বর্গকিলোমিটার (২,৪৪,৭০৬ মা২)।