টিসাংপা পশ্চাদপসরণ করে, নায়াং নামগায়াল[৪][৫] এর কৌশলপূর্ন বিজয়
সিমতোখা ডংয়ের দ্বিতীয় যুদ্ধ[৪] অথবা ভুটানে তিব্বতীয়দের দ্বিতীয় আক্রমণ[১১] ছিল ১৬৩৪ সালে ঝাবড্রাং নাওয়াং নামগায়ালের সমর্থক এবং তিব্বতি টিসাংপা রাজবংশের বাহিনী এবং তার বিরোধী কতিপয় ভুটানি লামা জোটের সশস্ত্র যুদ্ধ। শেষেরটি প্রাথমিকভাবে সিমতোখা ডংয়ে ঝাবড্রাংয়ের আসন দখল করে তার নব রাজত্ব নিশ্চিত করার হুমকির মুখে ফেলেছিল। যুদ্ধের সময় দুর্ঘটনাক্রমে দুর্গের অস্ত্রাগারে আগুন লেগে গিয়েছিল, ফলে বিস্ফোরনে সিমতোখা ডংয়ের এবং প্রচুর তিব্বতীয় সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়েছিল। এই সুযোগে ঝাবড্রাং এর অনুসারীরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল এবং তিব্বতিদের তাদের অঞ্চল থেকে উচ্ছেদ করেছিল। যুদ্ধে নায়াং নামগায়ালের ছলনাপূর্ণ কৌশলগত বিজয় হয়েছিল, ফলে তার শাসনে ভুটানের একত্রিকরনের পথ সুগম হয়েছিল।
সতেরো শতকের শুরুর দিকে তিব্বতে ড্রুপকা লিনিয়েজের পুন-জন্ম নিয়ে ধর্মতত্ত্ব ও রাজনৈতিক বিতর্কের ফলস্বরুপ রালুং মঠের ১৮তম মঠাদক্ষ্যের দাবিদার দুজন ছিলেন: নায়াং নামগায়াল ও গালওয়াং পাগসাম ওয়াংপো। দুজনেরই ড্রাকপা উপদলের বিভিন্ন দলের সমর্থন ছিল, কিন্তু শেষের জনের সমর্থন ছিল টিসাংপা রাজবংশের, যারা সেসময় মধ্য তিব্বত শাসন করতো। পরিনামস্বরুপ সংঘাত বেড়ে গিয়েছিল এবং ১৬১৬/১৭ সালে নায়াং নামগায়াল, যার "উচ্চস্তরের বুদ্ধিমত্তা, নৈপুণ্য এবং উচ্চাকাংক্ষাকে প্রতিষ্ঠানের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হুমকি বলে মনে করা হতো" স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নেন। গাসার লামার আমন্ত্রণে তিনি ও তার সহকর্মিদল এমন স্থানে থিতু হন যা পরে পশ্চিম ভুটানে পরিণত হয়।[১২][১৩] এই স্থান সে সময়ে বিভিন্ন চীফডম,ছোট রাজ্য ও বিভিন্ন বৌদ্ধ্য উপদলে বিভক্ত ছিল যারা শ্রেষ্ঠত্বের জন্য অবিরত মারামারি করতো। নায়াং নামগায়াল স্থানীয় ড্রাকপা কাগয়ু যাজিকদের দ্বারা সাদরে গৃহীত হয়েছিল এবং টিসাংপা রাজবংশ সহ তিব্বতে তাদের বিরোধীদের তুচ্ছ করার সাথে সাথে স্থানীয় জনতার মধ্যে সমর্থন বাড়ানো শুরু করেছিল।[১৪] তার খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে,"তিনি 'ঝাবড্রাং রিনপোচ' উপাধী অর্জন করেছিলেন,আক্ষরিক অর্থে 'মূল্যবান রত্ন যার পায়ে কেউ সমর্পন করে।[১৩]
তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব শুধু তার তিব্বতীয় শত্রুদেরকেই রাগান্বিত করেনি বরং পশ্চিম ভুটানের বিরোধী ক্ষমতাশীল বুড্ডিস্ট স্কুল যেমন লাপা উপদলকেও রাগান্বিত করেছিল। পরিনামস্বরুপ ১৬১৯ সালে নায়াং নামগায়ালকে সরানোর জন্য লাপা মঠ প্রধানের সহযোগীতায় টিসাংপা ভুটান আক্রমণ করেছিল।পরিণামস্বরুপ এই প্রথম আক্রমণকে ভুটানি সেনাপ্রধান পরাজিত করেছিল, যিনি ঝাবড্রাং-এর সমর্থনে শক্তি পুনরুদ্ধার করেছিলেন, কিন্তু অভিযোগে বর্নিত নায়াং নামগায়ালের জাদুকরি শক্তিতে গুটি বসন্তের মহামারিতে রাজা কার্মা ফুন্টসক নামগায়াল এবং তিব্বতীয় রাজবংশের অন্যান্য অনেক সদস্য মারা যাওয়া পর্যন্ত তার এবং টিসাংপার মধ্যে সংঘর্ষ চলেছিল।[১৫]
নিজের বেছে নেওয়া আত্ম-নিসঙ্গতার পর,ঝাবড্রাং তার আধ্যাতিক ও পার্থিবভাবে ভুটানের শাসক হওয়ার ইচ্ছা ঘোষণা করেছিলেন। যদিও ড্রাকপা কাগয়ু, সাকয়া এবং নিঙ্গমা স্কুলসহ নানা গোত্র প্রধান তার রাজনৈতিক শাসন মেনে নিয়েছিলেন, কিছু অন্য লামারা তা মেনে নেয় নি এবং তাকে প্রতিরোধ করতে শুরু করে।[১৬][১৭] পশ্চিম উপত্যকায় তার নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার সাথে সাথে, ১৬২৯ সালে তিনি তার ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে কৌশলপূর্ন স্থানে ডং নির্মাণ শুরু করেছিলেন।[১৮] এই নির্মাণের সময় পাঁচ লামা দল তার দল ও সমর্থকদের আক্রমণ করেছিল। পরবর্তী সিমটোখা ডং-এর প্রথম যুদ্ধে নায়াং নামগায়ালের প্রতারণাপূর্ণ বিজয় হয়েছিল, যদিও ডং নির্মাণ শেষ হয়েছিল ১৬৩১ সালে। ঝাবড্রাংকে সরানোর তাদের নিজস্ব চেষ্টা ব্যার্থ হলে, লামারা নতুন টিসাংপা শাসক,কারমা টেঙ্কয়ং-এর কাছে তাদের বিরোধীদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করার জন্য ভুটানে আরেকটি আক্রমণের অনুরোধ করে।[১৯][২০] যদিও যুদ্ধ এড়ানোর জন্য কয়েক বছর ধরে তিব্বতীয় এবং নায়াং নামগায়ালের অনুসারিদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। এটি ব্যার্থ প্রমাণিত হয়েছিল এবং এর ফলে টিসাংপা ১৬৩৪ সালে তাদের দ্বিতীয় আক্রমণ শুরু করেছিল। এর ফলে ভুটানিরা দাবী করে যে তিব্বতীয় শাসক কখনো শান্তি চায়নি এবং আলোচনা ছিল কেবল একটি কৌশলগত কাজ।[২১] রাজা কারমা টেঙ্কইয়ং এর আক্রমণের সঠিক উদ্দেশ্য অস্পষ্ট,যদিও কারমা ফান্টসো অনুমান করেন যে সে হয় ঝাবড্রাং কে আটক করে ভুটানে তার শাসন অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল অথবা ভুটানের অধিকারে থাকা তিব্বতীয়দের পবিত্র পুরাকির্তী নিতে চেয়েছিল।[৪] উভয় ক্ষেত্রে, নতুন আক্রমণ ১৬১৯ সালেরটি থেকে অনেক দীর্ঘ ও উন্নত প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল।[২১]
সশস্ত্র ভুটানি বাহিনীর সাহায্যে রাজা টেঙ্কঈয়ং ভুটানে পাচটি তিব্বতীয় ডিভিশন পাঠিয়েছিলেন: এদের মধ্যে চারটি গাসা এবং পারো উপত্যকার মাধ্যমে সিমটোখা ডং লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছিল, যদিও পঞ্চমটি নিরপেক্ষ ভুমটাং রাজ্যের ভূমটাং উপত্যকা দখল করেছিল। কেন টিসাঙ্গপা রাজবংশ ভুমটাং দখল করেছিল তা অজ্ঞাত, কিন্তু জন এ আরড্রাসি অনুমান করেন যে, হয় সেখানে নায়াং নামগায়ালের অনেক অনুসারি ছিল অথবা অন্তত তিব্বতীয়রা তাই বিশ্বাস করতো।[১০][২১] আর একবার ঝাবড্রাং-এর অনুসারিরা তার প্রতিরক্ষায় সংহত হইয়েছিল, কিন্তু এটা দৃশ্যত প্রতিয়মান ছিল যে তিব্বতীয়-লামা জোট অনেক শক্তিশালী ছিল। তার রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বায়িত্ব তার বিশ্বস্ত তেঞ্জিং ড্রাংকগায়ালের উপর ন্যস্ত করে নায়াং নামগায়াল খোথাংগার জারগাং-এ পশ্চাদপসরণ করেছিলেন এবং তার রাজত্ব ধ্বংস হয়ে গেলে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঝাবড্রাং এর বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলে তিব্বতীয় বাহিনী সিমটোখা ডং আক্রমণ করেছিল।[১০] প্রচুর সংখ্যক ম্যাচলক ও চৈনিক ট্রেবুচেটে [২৩] সজ্জিত হয়ে কারমা টেংকইয়ং-এর বাহিনী দ্রুত প্রাসাদে প্রবেশ করেছিল। তিব্বতীয়রা নায়াং নামগায়ালের কাছে বন্দীমুক্তি দাবী করে আসছিল, যদিও তিনি তাদের অবজ্ঞাসুচক জবাব দিয়েছিলেন। তিব্বতীয় সেনারা ডং লুট করার সময় দুর্ঘটনাবশত তাদের বারুদের গুদামে আগুন লেগে গিয়েছিল। তিন বছর আগে নির্মিত সিমটোখা ডং বিস্ফোরিত হয়েছিল,উপস্থিত অধিকাংশ তিব্বতীয় সেনা মারা গিয়েছিল।[৬] গোলাবারুদ সম্পর্কে তিব্বতীয়রা অসচেতন থাকায়, অজানা বিস্ফোরনে বেচে যাওয়া সেনাদের মধ্যে দ্রুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সুযোগ বুঝে ঝাবড্রাং এর বাহিনী প্রতি-আক্রমণ করে অবশিষ্ট তিব্বতীয়দের পরাজিত করেছিল। ভুটানি উৎস দাবী করে যে "কিছু [আক্রমণকারি] ভয়ানক পরাজয়ের খবর নিয়ে তিব্বতে ফিরে গিয়েছিল।[৪] যদিও আরড্রাসি যুক্তি দেন যে,এটা নিশ্চিত [নয় যে] তিব্বতীয় ও সহযোগি ভুটানি বাহিনী সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল" এবং সম্ভবত ১৬৩৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম ভুটানে বিক্ষিপ্ত লড়াই চলেছিল।[৫] সিমটোখা ডং-এ তাদের বিজয়ের পর নায়াং নামগায়াল ও তার অনুসারিরা বারাওয়া সন্নাসীদের তাদের গাসা উপত্যকার দুর্গ থেকে বহিষ্কার করে এবং ভুটানের ভালর জন্য একটি প্রতিদ্বন্দী দলকে দূর করে।[৭]
যদিও তার বাহিনী তিব্বতীয় বহিঃআক্রমণকারীদের উপর বিজয় লাভ করেছিল এবং তিনি ক্ষমতায় থেকে গিয়েছিলেন, নায়াং নামগায়াল এর বিজয় ছিল ব্যায়বহুল। তার শাসন প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তার নতুন ক্ষমতার স্থান ধ্বংস হয়েছিল, যদিও টিসাংপা ও প্রতিদ্বন্দী লামারা উভয়ই তার রাজ্যের প্রতি অপরিবর্তিত হুমকি হিসেবে থেকে গিয়েছিল।[৫] তা সত্ত্বেও, নায়াং নামগায়াল "তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে তার দেশ গড়ার কাজ" পুনরায় শুরু করেছিলেন। কারগি মঠের নিহত সেনাদের জন্য প্রার্থনার পর তিনি সিমটোখা ডং-এর চেয়ে বড় ডং নির্মাণের জন্য দ্রুত জায়গা খোজা শুরু করেছিলেন। জায়গা পাওয়ার পর, ১৬৩৭ সালে নতুন পুনাখা ডং-এর ভিত দেওয়া হয়েছিল।[২৪] এর নির্মাণ শেষ হওয়ার পর ১৯৫৫ সালে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে সরানোর আগ পর্যন্ত এটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ও ভুটান সরকারের আসন ছিল।[২৫] অন্যদিকে, সিমটোখা ডং ১৬৭১ সালে পুননির্মিত হয়েছিল।[৪] যখন নায়াং নামগায়াল ভুটানকে এক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিব্বতীয়রা এবং তাদের মিত্র বিরোধী মতালম্বি ভুটানি ১৬৩৯ সালে একবার শেষ বহিঃআক্রমণ করে কিন্তু এই যুদ্ধ দ্রুত অচলাবস্থায় পরিণত হয়েছিল। এই সময়ে টিসাংপা তিব্বতে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সুতরাং সংঘর্ষ শেষ করার জন্য কারমা টেঙ্কইয়ং আলোচনা শুরু করেছিলেন। ঝাবড্রাং রিনপোচ নায়াং নামগায়াল,তিব্বতীদের কাছে পশ্চিম ভুটানের শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং তার মৃত্যুর বছর পর্যন্ত যে দল তার বিরোধীতা করতো তাদের সরিয়ে দিতেন এবং তিনি পূর্ব ভুটানের অনেক অংশ জয় করেন।[২৬]