লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যাল (তিব্বতি: ལུང༌ཤར༌རྡོ་རྡྟེ་མཚོ་རྒྱལ, ওয়াইলি: lung shar rdo rje mtsho rgyal) (১৮৮০-১৯৩৮) একজন তিব্বতী রাজনীতিবিদ ছিলেন।
লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যাল ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য তিব্বতের র্তা-নাগ (তিব্বতি: རཊ་ ནག, ওয়াইলি: rta nag) নামক স্থানের একটি ঐতিহ্যশালী অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই পরিবাররের সদস্যরা পঞ্চম দলাই লামার সময় থেকে বহু প্রজন্ম ধরে তিব্বত সরকারে আধিকারিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।[১][২]:৩৮৫ তার পিতার নাম ছিল লুং-শার-ল্হুন-গ্রুব-র্দো-র্জে (ওয়াইলি: lung shar lhun grub rdo rje)।[২]:৩৯৫ আট বছর বয়সে তার পিতার মৃত্যু হলে তার মাতার প্রচেষ্টায় তিনি তিব্বতী চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন এবং সঙ্গীত ও নৃত্যকলার শিক্ষালাভক করেন।[n ১]
কুড়ি বছর বয়সে তিনি র্তা-নাগ অঞ্চলের এক অভিজাত পরিবারের কন্যাকে বিবাহ করেন এবং তাদের দুই জন সন্তানের জন্ম হয়। এই সময় তিনি তিব্বত সরকারের অধীনে একজন আধিকারিক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। গণিতশাস্ত্রের দক্ষতার কারণে তাকে করবিভাগের হিসাবরক্ষকের দায়িত্বলাভ করেন ও এই পদে তিনি প্রায় দশ বছর অতিবাহিত করেন।[n ২] এই সময় তার স্ত্রীর মৃত্যু হলে তিন বছর পরে অপর একটি বিবাহ করেন এবং তাদের পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।[n ৩]
ত্রয়োদশ দলাই লামা তিব্বতকে আধুনিক করার উদ্দেশ্যে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে ব্যাং-ঙ্গোস-পা-রিন-স্গাং (ওয়াইলি: byang ngos pa rin sgang), দ্বাং-'দুস-নোর-বু (ওয়াইলি: dbang 'dus nor bu), ম্খ্যেন-রাব-কুন-ব্জাং (ওয়াইলি: mkhyen rab kun bzang) এবং ব্সোদ-নাম্স-স্গোম-পো-গো-খার-বা (ওয়াইলি: bsod nams sgom po go khar ba) নামক চারজন তিব্বতীকে ইংল্যান্ডে আধুনিক শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যালকে এই চারজন ছাত্রকে ইংল্যান্ড পৌছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।[n ৪] ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে এপ্রিল তারা ইংল্যান্ড পৌছন এবং সম্রাট পঞ্চম জর্জের সঙ্গে সাক্ষাত করে ত্রয়োদশ দলাই লামার পক্ষ থেকে তাকে উপহার প্রদান করেন।[n ৫] চারজন তিব্বতী ছাত্রের সঙ্গী হিসেবে আগত লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যাল নিজেকে তিব্বতের রাজদূতের মতো উচ্চপদাধিকারী হিসেবে সকলের নিকট পরিচয় দিতেন বলে ব্রিটিশরা লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যালকে খুব একটা পছন্দ করতেন না,।[n ৬] এছাড়া তিনি ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড ও বেলজিয়াম ভ্রমণ করে চীন, ভারত ও জাপানের বিপ্লবীদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন বলে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের নজরে পড়ে যান।[৫]:১৯১ ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই সেপ্টেম্বর তিনি ইংল্যান্ড থেকে যাত্রা করেন।[৩]
লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যাল তিব্বতে ফিরে এসে ত্রয়োদশ দলাই লামার সংস্কার নীতির অন্যতম সমর্থক হয়ে ওঠেন।[n ৭] এই সময় তিনি লাসা ও ব্ক্রা-শিস-ল্হুন-পো বৌদ্ধবিহারের মধ্যে আর্থিক চুক্তির ব্যবস্থা করেন এবং গ্যানৎসে অঞ্চলে অর্থদপ্তরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ত্রয়োদশ দলাই লামার নির্দেশে করদপ্তরের প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। এই সময় কর সংগ্রহের একটি দপ্তর খুলে তাকে এর প্রধান করে দেওয়া হয়। তিনি তিব্বতের সেনাবাহিনীর স্বার্থে অভিজাত ও ধনী ব্যক্তি, মন্ত্রী এবং বিহারগুলির ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করেন, যে কারণে তিনি এই সকল ব্যক্তিদের বিরাগভাজন হন।[n ৮] জাতীয় মন্ত্রীসভার সদস্যরা আজীবন পদ অধিকার করে না থেকে চার বছর তাদের পদে থাকতে পারেন, এই মর্মে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বেশ কিছু আধিকারিককে সঙ্গে নিয়ে সরকারের নিকট একটি আবেদন দাখিল করেন। এই যুগান্তকারী সংস্কারণীতির ফলে তার সঙ্গে অভিজাত সম্প্রদায়ের দুরত্ব তৈরী হয়।[n ৯][n ১০] ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুলকে সরিয়ে লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যালকে তিব্বতী সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়। তিনি দায়িত্ব নিয়ে সৈন্যদের বেতন এবং খাদ্যের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেন, যার ফলে তিনি বাহিনীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।[৩]
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতের রাজপ্রতিনিধি থুব-ব্স্তান-'জাম-দ্পাল-য়ে-শেস-র্গ্যাল-ম্ত্শান (ওয়াইলি: thub bstan 'jam dpal ye shes rgyal mtshan) নামক পঞ্চম র্বা-স্গ্রেং রিন-পো-ছে (ওয়াইলি: rwa-sgreng rin-po-che) উপাধিধারী লামার নির্দেশে লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যালকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বাড়ি থেকে মন্ত্রী খ্রি-স্মোন-ঝাব্স-পাদকে (ওয়াইলি: khri smon zhabs pad) হত্যার ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়।[n ১১] এই সকল অভিযোগের ভিত্তিতে তার দুইটি চোখ উপড়ে শাস্তি দেওয়া হয়।[n ১২] তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয় ও তার সমর্থকদের তিব্বত থেকে নির্বাসন দেওয়া হয়। তার পরিবারের কোন সদস্য প্রসাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে না বা অভিজাতদের দলভুক্ত হতে পারবে না বলে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়।[n ১৩] ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং এক বছর বাদে তার মৃত্যু ঘটে।[৬]:২১১
লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যালের তিব্বতের রাজনৈতিক সংস্কারের প্রচেষ্টাই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এই ধরনের শেষ পদক্ষেপ। তার মৃত্যু ও এই সংস্কার প্রচেষ্টার ধ্বংসসাধনের মাধ্যমে তিব্বতের ইতিহাস অন্য খাতে বইতে শুরু করে। চিরায়ত ব্যবস্থার প্রতিনিধি হিসেবে খ্রি-স্মোন-ঝাব্স-পাদ ও তার সমর্থকেরা লুং-শার-র্দো-র্জে-ম্ত্শো-র্গ্যালের সংস্কারকে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখলেও তা ছিল তাদের অজ্ঞতারই নামান্তর। কয়েক দশক পরে তিব্বতের লামাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের মূলে তার মৃত্যু অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হয়।[n ১৪]