রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬-১৮৮৬) ছিলেন ১৯শ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট বাঙালি হিন্দু ধর্মগুরু ও জনপ্রিয় লোকশিক্ষক। তিনি সরল গ্রাম্য বাংলা ভাষায় উপমা ও নীতিগর্ভ কাহিনির মাধ্যমে ধর্মোপদেশ দান করতেন।[১] তার প্রধান শিক্ষা ছিল ঈশ্বরলাভই মানবজীবনের পরম উদ্দেশ্য, ‘কাম-কাঞ্চন’ ত্যাগ, সর্বধর্ম-সমন্বয় ও ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’। রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিক্ষার মূল উপজীব্যই ছিল একেশ্বরবাদ এবং সকল ধর্মমতের সত্যতা উপলব্ধি ও সমন্বয়।[২]
রামকৃষ্ণ পরমহংসের মতে, ঈশ্বর-উপলব্ধি বা ঈশ্বরলাভই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য।[৩] তিনি নিজে বিভিন্ন ধর্মমত অনুশীলন করেছিলেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, বিভিন্ন ধর্মমত হল ঈশ্বরলাভের ভিন্ন ভিন্ন পথ মাত্র। তিনি মনে করতেন, প্রত্যেকটি ধর্মমত সর্বোচ্চ সত্যের সামগ্রিক দিকটির পরিবর্তে শুধুমাত্র তার অংশবিশেষই প্রকাশ করতে পারে।[৪]
রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিক্ষা অনুসারে, মানবজীবনের প্রধান বন্ধন হল ‘কাম-কাঞ্চন’ (কামনাবাসনা ও অর্থসম্পত্তি)। পুরুষ ভক্তদের উপদেশ দেওয়ার সময় তিনি তাদের ‘কামিনী-কাঞ্চন’ (নারীসঙ্গ কামনা ও অর্থসম্পত্তি) সম্পর্কে সতর্ক করতেন:[৫]
"অভ্যাসযোগের দ্বারা কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ করা যায়। গীতায় এ-কথা আছে। অভ্যাস দ্বারা মনে অসাধারণ শক্তি এসে পড়ে, তখন ইন্দ্রিয়-সংযম করতে—কাম, ক্রোধ বশ করতে—কষ্ট হয় না। যেমন কচ্ছপ হাত-পা টেনে নিলে আর বাহির হয় না; কুড়ুল দিয়ে চারখানা করে কাটলেও আর বাহির করে না।"[৬][৭] "কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগই ত্যাগ।"[৮][৯]
"অভ্যাসযোগের দ্বারা কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ করা যায়। গীতায় এ-কথা আছে। অভ্যাস দ্বারা মনে অসাধারণ শক্তি এসে পড়ে, তখন ইন্দ্রিয়-সংযম করতে—কাম, ক্রোধ বশ করতে—কষ্ট হয় না। যেমন কচ্ছপ হাত-পা টেনে নিলে আর বাহির হয় না; কুড়ুল দিয়ে চারখানা করে কাটলেও আর বাহির করে না।"[৬][৭]
"কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগই ত্যাগ।"[৮][৯]
অনুরূপভাবে স্ত্রীভক্তদের উপদেশ দেওয়ার সময় তিনি তাদের ‘পুরুষ-কাঞ্চন’ (পুরুষসঙ্গ কামনা ও অর্থসম্পত্তি) সম্পর্কে সতর্ক করতেন। রামকৃষ্ণের বিশিষ্ট স্ত্রীভক্ত গৌরী মা বলেছিলেন:
[রামকৃষ্ণ] সতর্ক করার মতো করে এই কথা বলতেন। তিনি অর্থসম্পদ ও ইন্দ্রিয়সম্ভোগের থেকে সতর্ক করতেন। ভোগসর্বস্ব জীবনের থেকে নিরত থাকতে বলতেন। কিন্তু তিনি নারীবিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি যেমন তপস্বীকে নারীর মোহ থেকে সতর্ক করতেন, তেমনি ধর্মপ্রাণা নারীদের পুরুষসঙ্গ থেকে দূরে থাকতে বলতেন। ঠাকুরের সমগ্র জীবন এই সাক্ষ্য দেয় যে, নারীর প্রতি তাঁর সামান্যতম বিদ্বেষও ছিল না। বরং তিনি তাঁদের প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল এবং প্রগাঢ় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।[১০]
ভক্তদের বিশ্বাস অনুসারে, নির্বিকল্প সমাধি লাভের পর থেকে রামকৃষ্ণ পরমহংস মায়ার দুটি দিক অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই দুই দিককে তিনি ‘অবিদ্যামায়া ও বিদ্যামায়া’ নামে অভিহিত করেন। তার মতে, ‘অবিদ্যামায়া’ হল ব্রহ্মাণ্ডের অন্ধকার শক্তি (যেমন ইন্দ্রিয়প্রবৃত্তি, অশুভ চিন্তা, লোভ, কামনাবাসনা ও নির্দয়তা)। অবিদ্যামায়া মানুষকে চৈতন্যের নিম্নভূমিতে নামিয়ে রাখে। এই শক্তি মানুষকে জন্ম ও মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ করে। মানুষের উচিত এই শক্তির বিরুদ্ধে নিয়ত সংগ্রাম করে এগুলিকে জয় করা। অপরদিকে ‘বিদ্যামায়া’ হল ব্রহ্মাণ্ডের উচ্চতর শক্তি (যেমন আধ্যাত্মিকতা, জ্ঞান লাভের সহায়ক গুণাবলি, দয়া, পবিত্রতা, প্রেম ও ভক্তি)। এগুলি মানুষকে চৈতন্যের উচ্চতর স্তরে উন্নীত করে।[১১]
রামকৃষ্ণ বিভিন্ন ধর্মমতের পার্থক্যগুলিকে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই পার্থক্য সত্ত্বেও সকল ধর্মমত একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যপথের সন্ধান দেয়। সেই কারণে তার মতে, সকল ধর্মমতই গ্রহণযোগ্য ও সত্য।[১২] অমিয় পি. সেন লিখেছেন যে, রামকৃষ্ণের শিক্ষাগুলির ভিত্তি ভক্তি ও ঈশ্বরে বিশ্বাস। সেই কারণে এই শিক্ষাগুলিকে বিশ্বজনীন মনে হয়। এগুলিকে সংকীর্ণ মতবিশ্বাস মনে হয় না।[১৩] বিশিষ্ট ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টি. টয়েনবি লিখেছেন, “...মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার আদর্শ ও শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মসমন্বয়বাদ: এখানে আমরা সেই মনোভাব ও উৎসাহের সন্ধান পাই যা মানবজাতির একক পরিবারে ও এক আণবিক যুগে একত্রে বাস সম্ভব করেছে। এটি আমাদের নিজেদের ধ্বংস করার একমাত্র বিকল্প।[১৪][১৫]
ধর্মসমন্বয়ের ক্ষেত্রে রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছেন,[১৬]
"আমি সকল ধর্ম অনুশীলন করেছি—হিন্দুধর্ম, ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম—এবং আমি বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের পথও অনুসরণ করেছি। আমি দেখেছি যে একই ঈশ্বরের দিকে বিভিন্ন পথে আমরা ধাপে ধাপে উঠে চলেছি। তোমাকে অবশ্যই সকল মত অনুশীলন করতে হবে এবং সকল পথ একই সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে। আমি যেখানেই দেখি, দেখতে পাই মানুষ ধর্মের নামে কলহ করছে—হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্ম, বৈষ্ণব আর সকলে। কিন্তু তারা কখনই বলে না যে, যাঁকে কৃষ্ণ বলা হয়, তিনিই শিব, এবং তিনিই আদ্যাশক্তি, যিশু ও আল্লাহ্ নামে পরিচিত—এক রাম, তাঁর হাজার নাম...
ভাওউক তাঁর কালচার’স ইনফ্লুয়েন্স অন ক্রিয়েটিভিটি: দ্য কেস অফ ইন্ডিয়ান স্পিরিচুয়ালিটি জার্নালে লিখছেন যে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ২০০১ সালের জঙ্গিহানার পরিপ্রেক্ষিতে মানবসমাজে রামকৃষ্ণের অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভাওউক লিখেছেন যে, উক্ত জঙ্গিহানার জন্য ইসলামকে দোষারোপ করা চলে না। কোনও ধর্মকেই কোনও সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপের জন্য দায়ী করা যায় না। কারণ, রামকৃষ্ণের জীবন ঘোষণ করছে যে, সকল ধর্ম একই ঈশ্বরের পথে নিয়ে যায়।[১৭]
রামকৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন “যত্র জীব তত্র শিব” (যেখানেই জীব আছে, সেখানেই শিব আছেন)। এই ধারণাটি সত্য সম্পর্কে রামকৃষ্ণের অদ্বৈতবাদী বোধ থেকে উৎসারিত। তিনি তার শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন, “জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা।” গবেষকদের মতে, স্বামী বিবেকানন্দ এই বার্তা থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণকার্য, অনাথ আশ্রম, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের মতো সমাজসেবামূলক কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। রামকৃষ্ণের এই শিক্ষার অনুপ্রেরণাতেই তিনি বলেছিলেন, “কোথায় ঈশ্বরের খোঁজ করতে যাবে? সকল দরিদ্র, হতভাগ্য, দুর্বলরা ভাল নয় কি? তাদের পূজা আগে কর না কেন?... এরাই হোক তোমার ঈশ্বর...”[১৮] রামকৃষ্ণ প্রত্যক্ষভাবে সমাজসেবার কাজে হাত দেননি। তবে তিনি এই কাজের জন্য তার প্রধান শিষ্য বিবেকানন্দকে প্রস্তুত করেছিলেন।[১৯]
রামকৃষ্ণ প্রথাগতভাবে একজন দার্শনিক হিসেবে শিক্ষালাভ করেননি। তবে জটিল দার্শনিক ধারণাগুলি সম্পর্কে তার একটি সহজাত বোধ ছিল।[২০] তিনি মনে করতেন, ব্রহ্মাণ্ড (দৃশ্য ব্রহ্মাণ্ড ও অন্যান্য অনেক ব্রহ্মাণ্ড) হল জ্ঞানের সর্বোচ্চ মহাসমুদ্র ব্রহ্ম থেকে উৎসারিত বুদবুদ মাত্র।[২১]
রামকৃষ্ণের এক হাজার বছর আগে আদি শঙ্কর হিন্দুসমাজকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। রামকৃষ্ণও একই কাজ করেন। ১৯শ শতাব্দীতে হিন্দুধর্মের আচারসর্বস্বতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সরল ঈশ্বর বিশ্বাস ও ভক্তিযোগের শিক্ষা দেন। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম আধুনিক যুগের গোড়ার দিকে হিন্দুধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই দুই ধর্মের আগ্রাসের বিরুদ্ধেও তিনি হিন্দুধর্মকে রক্ষা করেন।[২২] যদিও আদি শঙ্করের থেকে একটি দিক থেকে তার অমিল ছিল। সমাধি-উত্তর কালে সাংসারিক ভূমিতে চৈতন্যকে নামিয়ে আনা সম্পর্কে তিনি নিজস্ব ধারণা পোষণ করতেন। এই ধারণাকেই তিনি ‘বিজ্ঞান’ বলচতেন। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করেও তিনি বলেছিলেন, “নিত্যকে (সর্বোচ্চ সত্য) ছেড়ে লীলা (আপেক্ষিক সাংসারিক জগৎ), লীলাকে ছেড়ে নিত্য ভাবা যায় না!”[২৩][২৪]
রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিক্ষার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তার উপমা ও নীতিগর্ভ কাহিনিগুলি।[২৫] উপকথা ও নীতিশিক্ষামূলক কাহিনিগুলির মাধ্যমে রামকৃষ্ণ তার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বার্তাগুলি প্রকাশ করতেন।[২৬]
এক পুকুরে চার ঘাট তার একটি বিখ্যাত উপমাত্মক উপদেশ:[২৪]
রামকৃষ্ণের প্রিয় একটি বিখ্যাত নীতিগর্ভ কাহিনি হল আমি সাঁতার জানি। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে এটি তার শিষ্য মণিলাল মল্লিকের দ্বারা কথিত হয়েছে। এই কাহিনিটি শিয়াল ও বিড়াল কাহিনির অনুরূপ:[২৭]
“পণ্ডিত সগর্বে কথা কহিতেছেন ও লোকটি চুপ করে বসে আছেন। এমন সময়ে ভয়ঙ্কর ঝড়—নৌকা ডুবতে লাগল। সেই লোকটি বলল—“পণ্ডিতজী, আপনি সাঁতার জানেন?” পণ্ডিত বললেন, ‘না’। সে বললে, ‘আমি সাংখ্য, পাতঞ্জল জানি না, কিন্তু সাঁতার জানি’।”[২৮]
I have practised all religions—Hinduism, Islam, Christianity—and I have also followed the paths of the different Hindu sects. I have found that it is the same God toward whom all are directing their steps, though along different paths. You must try all beliefs and traverse all the different ways once. Wherever I look, I see men quarrelling in the name of religion—Hindus, Mohammedans, Brahmos, Vaishnavas, and the rest. But they never reflect that He who is called Krishna is also called Siva, and bears the name of the Primal Energy, Jesus, and Allah as well—the same Rama with a thousand names...
Ramakrishna was a teacher with some popular appeal, speaking in vivid images and stories and parables.