মেধাস্বত্ব বা কপিরাইট বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিদ্যমান একটি আইনি অধিকার, যাতে কোনও মৌলিক সৃষ্টিকর্মের মূল সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কোনও পক্ষ সেই সৃষ্টিকর্ম ব্যবহার করতে পারবে কি না কিংবা কোন শর্তে ব্যবহার করতে পারবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ব্যাপারে ঐ মূল সৃষ্টিকর্তাকে একক ও অনন্য অধিকার প্রদান করা হয়। মেধাস্বত্ব সাধারণত একটি সীমিত মেয়াদের জন্য কার্যকর হয়। ঐ মেয়াদের পর কাজটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ক্ষেত্রের বা জনক্ষেত্রের (পাবলিক ডোমেইনের) অন্তর্গত হয়ে যায়।[১][২] মেধাস্বত্ব ছাড়াও আরেক ধরনের মেধা সম্পদ অধিকার বা স্বত্ব আছে, সেটি হলো শিল্প সম্পত্তি স্বত্ব। এই অনন্য অধিকারগুলি পরম অধিকার নয়, বরং এগুলির সীমাবদ্ধতা ও ব্যতিক্রম আছে (যেমন, ন্যায্য ব্যবহার বা ফেয়ার ইউজ)।
বৌদ্ধিক বা মেধাভিত্তিক সৃষ্টিকর্মটি যদি কোনও গ্রন্থ হয়, তাহলে বাংলাতে তার মেধাস্বত্বকে বিশেষ একটি পরিভাষা "গ্রন্থস্বত্ব" দ্বারা নির্দেশ করা হয়। এছাড়া গ্রন্থ ব্যতীত অন্যান্য রচনার জন্য সাধারণভাবে "লেখস্বত্ব", "রচনাস্বত্ব", ইত্যাদি পরিভাষাও প্রচলিত।
সৃষ্টিশীল, বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা শিল্পের বিভিন্ন প্রকার কাজের একটা বিরাট পরিব্যাপ্তিতে মেধাস্বত্ব থাকতে পারে বা হওয়া সম্ভব। কবিতা, অভিসন্দর্ভ, নাটক এবং অন্যান্য সাহিত্যকর্ম, চলচ্চিত্র, নৃত্যবিন্যাস (নাচ, ব্যালে ইত্যাদি), সঙ্গীত রচনা, ধারণকৃত শব্দ, চিত্রকর্ম, অঙ্কন, মূর্তি বা প্রতিকৃতি, আলোকচিত্র, সফটওয়্যার, বেতার ও টেলিভিশনের সরাসরি ও অন্যান্য সম্প্রচার, এবং কিছু কিছু এখতিয়ারে শিল্প-নকশা (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন) এর অন্তর্গত।
নকশা বা শিল্প-নকশাগুলোর (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন) জন্য কোন কোন এখতিয়ারে আলাদা বা যুগপৎ/অধিক্রমণকারী (ওভারল্যাপিং) আইন থাকতে পারে। মেধাস্বত্ব আইন, বুদ্ধিবৃত্তিক বা মেধা সম্পদ (ইন্টেলেকচুয়্যাল প্রোপার্টি) সংক্রান্ত একটি ব্যাপ্ত বিষয়ের অধীনে অনেকগুলি আইনের একটি।
মেধাস্বত্ব আইন শুধুমাত্র ঠিক কী উপায়ে বা কী রূপে ধারণাসমূহ (আইডিয়া) অথবা তথ্য পরিবেশিত হবে সেটা বিবেচনা করে। এটা মেধাস্বত্ব সংরক্ষিত কাজের মূল ধারণা, মূলনীতি (কনসেপ্ট), সত্য (ফ্যাক্ট), ধরন (স্টাইল) অথবা পদ্ধতিটিকে আওতাভুক্ত করে না বা করার চেষ্টা করে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিকিমাউস কার্টুন বিষয়ে যে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করা আছে, এটা অননুমোদিত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এই কার্টুন বিতরনের অধিকার রহিত করে এবং অননুমোদিত কেহ ডিজনীর সৃষ্ট মানুষসদৃশ মিকিমাউসের মতো একই রকম কোন ছবির অনুলিপি বা নকল করতে পারবে না; কিন্তু এই আইন সাধারণভাবে মানুষের মত দেখতে অন্য কোন ইঁদুর আঁকতে বা সৃষ্টি করতে বাধা দেয় না - যতক্ষণ সেগুলো ডিজনীর মূল নকশা থেকে যথেষ্ট অন্যরকম থাকে এবং ওটার (মিকিমাউসের) নকল বা অনুলিপির মত না হয়। কিছু কিছু এখতিয়ারে, মেধাস্বত্ব সংরক্ষিত কাজের বিদ্রুপাত্মক বা ব্যাখ্যামূলক কাজ প্রকাশেরও উপায় থাকে। ট্রেডমার্ক এবং প্যাটেন্ট-এর মত অন্যান্য আইনের ধারা পুনঃপ্রকাশ বা পুনঃউৎপাদন কিংবা ব্যবহারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে, যেটা মেধাস্বত্ব আইন করে না।
বিরাটাকার পরিব্যাপ্তিতে ছাপাখানার প্রসার হওয়ার আগে পর্যন্ত মেধাস্বত্ব উদ্ভাবিত হয়নি। আঠারো শতকের শুরুর দিকে ছাপাখানাগুলোর একচেটিয়া আচরণের প্রতিক্রিয়ায় প্রথমে ব্রিটেনে এরকম একটা আইনের ধারণা জন্ম নেয়। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস বইগুলির অনৈতিক অনুলিপি তৈরির ব্যাপারটা সম্পর্কে সচেতন হয়ে, রাজকীয় বিশেষাধিকার প্রয়োগ করে লাইসেন্স বা অনুমোদন বিধিমালা ১৬৬২ জারি করেন; এর ফলে অনুমোদনপ্রাপ্ত বইগুলির একটি নিবন্ধন তালিকা প্রতিষ্ঠা করতে হয়, এবং এটার একটা অনুলিপি সমস্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে জমা রাখতে হয়, এবং প্রয়োজন অনুসারে সুপ্রতিষ্ঠিত সমস্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অনুমোদন দেয়া চালু করা হয়। দ্য স্টাচু অব অ্যান ছিল মেধাস্বত্ব দ্বারা সংরক্ষিত প্রথম সৃষ্টিকর্ম। এর লেখককে নির্দিষ্ট সময়ের মেধাস্বত্ব প্রদান করা হয়েছিল এবং সেই নির্দিষ্ট সময়ের পরে মেধাস্বত্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেধাস্বত্ব বা কপিরাইট বই ও মানচিত্র প্রকাশের এবং অনুলিপি নিয়ন্ত্রণের একটি আইনি ক্ষেত্র থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রায় সকল আধুনিক শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাববিস্তারকারী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে শব্দধারণ, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, সফটওয়্যার এবং স্থাপত্যের কাজ মেধাস্বত্বের আওতাভুক্ত।
বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতা (দ্য বার্ন কনভেনশন)
১৮৮৬ সালের বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতা প্রথমে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিতে মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি দেয়। এই বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতা অনুসারে, মৌলিক কাজের মেধাস্বত্ব অর্জন করতে বা ঘোষণা করতে হবে না, কারণ সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সৃষ্টির সাথে সাথে কার্যকর হয়: বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতায় স্বাক্ষরকারী কোনও রাষ্ট্রের একজন লেখককে মেধাস্বত্বের জন্য কোন আবেদন বা নিবন্ধন করার প্রয়োজন হবে না। যখনই কাজটা সম্পন্ন হবে, অর্থাৎ লিখিত কিংবা অন্য কোনও মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হবে, এর স্রষ্টা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই কাজ এবং সেখান হতে উৎপন্ন অন্যান্য কাজের সমস্ত মেধাস্বত্বের অধিকারী হবেন, যদি না সেই স্রষ্টা সুনির্দিষ্টভাবে তার সৃষ্টিকর্মের স্বত্ব ত্যাগ করার ঘোষণা দেন কিংবা মেধাস্বত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। বিদেশী লেখকের মেধাস্বত্বের অধিকারও বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতা স্বাক্ষরকারী দেশসমূহ স্বদেশী লেখকদের মতই সমভাবে নিশ্চিত করে।
যুক্তরাজ্য ১৮৮৭ সালে বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতাতে স্বাক্ষর করে কিন্তু ১৯৮৮ সালের কপিরাইট ডিজাইন এন্ড প্যাটেন্ট অ্যাকট (মেধাস্বত্ব, নকশা ও কৃতিস্বত্ব বিধিমালা) অনুমোদিত হওয়ার আগের ১০০ বছর সমঝোতার বিরাট অংশের কোনও আইনি প্রয়োগ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতাতে স্বাক্ষর করেনি।
বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতার বিধিমালা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার TRIP চুক্তির সাথে একীভূত করা হয়, এবং এভাবে বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে কপিরাইট আইন
ভারতীয় উপমহাদেশে কপিরাইট আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল ১৯১২ সালে ।বাংলাদেশে কপিরাইট আইন প্রণয়ন করা হয় ২০০০ সালে এবং সর্বশেষ তা ২০০৫ সালের সংশোধন করা হয়।
↑Lee A. Hollaar। "Legal Protection of Digital Information"। পৃষ্ঠা Chapter 1: An Overview of Copyright, Section II.E. Ideas Versus Expression.। ২৮ অক্টোবর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১৭।