আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আস-সুলামি আদ-দারির আল-বুগি আত-তিরমিজি (আরবি: أبو عيسى محمد بن عيسى السلمي الضرير البوغي الترمذي ; ৮২৪–৮ অক্টোবর, ৮৯২) বা ইমাম তিরমিজি ছিলেন একজন পারসিক[১][২] ইসলামি পণ্ডিত ও হাদিসবেত্তা। তিনি সুনান আল-তিরমিজী হাদিসগ্রন্থের সংকলক। এ গ্রন্থ কুতুব আল-সিত্তাহর অন্যতম এবং এটি সুন্নিদের মাঝে একটি সহিহ হাদিস গ্রন্থ হিসেবেও বিবেচিত হয়। এছাড়াও তিনি শামাইল মুহাম্মাদিয়াহ (শামাইল আত-তিরমিজি নামে পরিচিত) গ্রন্থের রচয়িতা। এটি একটি হাদিস গ্রন্থ। তবে এতে মুহাম্মদ সা. এর ব্যক্তি ও চরিত্র সম্পর্কে হাদিস রয়েছে। ইমাম তিরমিজি একজন দক্ষ আরবি ব্যকরণবিদও ছিলেন। আরবি ব্যাকরণে তিনি বসরার চেয়ে কুফার ধারার পক্ষপাতী ছিলেন।[৩]
আত-তিরমিজির নাম ছিল "মুহাম্মদ"। আবু ঈসা ("ঈসার বাবা") ছিল তার কুনিয়াত। তার বংশতালিকা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না; তার নসব নিম্নোক্তরূপে পাওয়া যায়:
তিনি তার লকব "আদ-দাহহাক" ("অন্ধ") বলেও পরিচিত ছিলেন। বলা হয় যে তিনি জন্মের সময় অন্ধ ছিলেন। তবে অধিকাংশ পণ্ডিত এ বিষয়ে একমত যে তিনি তার জীবনের শেষের দিকে অন্ধ হয়ে যান।[৫][১৪]
আত-তিরমিজির পরিবার আরব গোত্র বনু সুলাইমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। একারণে নিসবাত হিসেবে "আস-সুলামি" এসেছে।[১৫] তার দাদা মার্ভের লোক ছিলেন এবং তিরমিজে বসতি স্থাপন করেন।[৫]
মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিজি আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুনের শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার জন্মসাল হিসেবে ২০৯ হিজরি (৮২৪/৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ) উল্লেখ পাওয়া যায়।[১৫][১৬][১৭] তবে আয-যাহাবি বলেছেন যে আত-তিরমিজি ২১০ হিজরির (৮২৫/৮২৬ খ্রিষ্টাব্দ) কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন।[৫] তাই কিছু সূত্রে তার জন্মসাল ২১০ হিজরি উল্লেখিত হয়েছে।[৪][১৮] কিছু সূত্র মোতাবেক তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছেন।[১৯] তবে অন্যদের মতে তার জন্মস্থান তিরমিজ। এটি বর্তমানে উজবেকিস্তানের দক্ষিণে অবস্থিত।[১৫] এ বিষয়ে তিরমিজ বিষয়ক মতটি সবচেয়ে শক্ত।[৫] বিশেষত তিনি তিরমিজের একটি উপশহর বুগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, একারণে তার নিসবাত হিসেবে "আত-তিরমিজি" ও "আল-বুগি" এসেছে।[১৬][১৮][২০][২১]
আত-তিরমিজি ২০ বছর বয়সে হাদিস অধ্যয়ন শুরু করেন। ২৩৫ হিজরি (৮৪৯/৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে শুরু করে হাদিস সংগ্রহের জন্য তিনি খোরাসান, ইরাক ও হেজাজ সফর করেছেন।[৪][৯][১০] তার শিক্ষক ও যাদের কাছ থেকে তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন:
তৎকালীন সময়ে আত-তিরমিজির জন্মস্থান খোরাসান জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল। এখানে ব্যাপক সংখ্যক মুহাদ্দিসের আবাস ছিল। আত-তিরমিজির সফর করা অন্যান্য জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ইরাকি শহর কুফা ও বসরা। আত-তিরমিজি ৪২ জন কুফি শিক্ষকের কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার জামি গ্রন্থে তিনি অন্যান্য যেকোন শহরের শিক্ষকদের চেয়ে কুফার শিক্ষকদের বর্ণনা বেশি ব্যবহার করেছেন।
আত-তিরমিজি ইমাম বুখারীর ছাত্র ছিলেন। বুখারীও খোরাসানের বাসিন্দা ছিলেন। আয-যাহাবি লিখেছেন, "তার হাদিসের জ্ঞান আল-বুখারীর কাছ থেকে এসেছে।"[১৫] আত-তিরমিজি তার জামি গ্রন্থে ইমাম বুখারীর নাম মোট ১১৪ বার উল্লেখ করেছেন। হাদিসের বর্ণনায় বিবরণ বা বর্ণনাকারীদের তারতম্যের উল্লেখের সময় তিনি ইমাম বুখারীর কিতাব আত-তারিখকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি ইমাম বুখারীকে ইরাক বা খোরাসানে হাদিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি বলে প্রশংসা করেছেন। তার কাছে ইমাম আবু হানিফার ফতোয়া উল্লেখের জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র ছিল না বিধায় ফকিহদের অভিমত বর্ণনার সময় তিনি আবু হানিফার নাম উল্লেখ করেননি। এর পরিবর্তে তিনি "কুফার কিছু ব্যক্তি" বলে উল্লেখ করতেন।[১৪] ইমাম বুখারীও আত-তিরমিজিকে উচ্চ মর্যাদা দিতেন। বলা হয় যে তিনি আত-তিরমিজিকে বলেছিলেন, "আপনি আমার কাছ থেকে যতটা না উপকৃত হয়েছেন তার চেয়ে আমি আপনার কাছ থেকে বেশি উপকৃত হয়েছি"। তার প্রণীত সহিহ বুখারীতে তিনি আত-তিরমিজির বর্ণিত দুইটি হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন।[১৪][১৫]
আত-তিরমিজি এছাড়াও আবু দাউদ ও মুসলিমের কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন[১৪] মুসলিমও তার সহিহ মুসলিম গ্রন্থে আত-তিরমিজির বর্ণিত হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন।[১৫]
এ. জে. উয়েনসিঙ্ক বলেছেন যে আহমাদ ইবনে হানবাল আত-তিরমিজির শিক্ষক ছিলেন।[৯][১৪] তবে হুসেনের মত আত-তিরমিজি কখনো বাগদাদ যাননি এবং তিনি আহমাদ ইবনে হানবালের কোনো বক্তৃতায় অংশ নেননি। তাছাড়া আত-তিরমিজি তার জামি গ্রন্থে সরাসরি কখনো আহমাদ ইবনে হানবালের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেননি।[১৪]
আত-তিরমিজির কিছু শিক্ষক ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও আন-নাসাইয়েরও শিক্ষক ছিলেন।
ইমাম তিরমিজি ইমাম বুখারীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিরমিজি শাফিয়ি বা হাম্বালি মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। এমন হতে পারে যে তিনি নিজে একজন মুজতাহিদ ছিলেন অথবা ইমাম বুখারীর খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কিছু অভিমত অনুযায়ী তিনি তার মাজহাব অনুসরণ করতেন।
আয-যাহাবির মতানুযায়ী আত-তিরমিজি তার জীবনের শেষ দুই বছর অন্ধ অবস্থায় কাটান।[১০] বলা হয় যে আল্লাহর ভয় বা ইমাম বুখারীর মৃত্যুর কারণে অতিরিক্ত কান্নার জন্য তিনি দৃষ্টিহীন হয়েছিলেন।[৪][৫][১০][১৪][১৫]
ইমাম তিরমিজি ২৭৯ হিজরির ১৩ রজব সোমবার রাতে (৮ অক্টোবর ৮৯২ খ্রিষ্টাব্দ, রোবরার রাত) বুগে মৃত্যুবরণ করেন।[note ১][৭][১০][১৪] তাকে বর্তমান উজবেকিস্তানের তিরমিজ থেকে ৬০ কিমি উত্তরে শিরাবাদে দাফন করা হয়। তিরমিজে তিনি স্থানীয়ভাবে আবু ঈসা আত-তিরমিজি বা "তিরমিজ উতা" (তিরমিজের পিতা) নামে পরিচিত।[২১]
|trans_chapter=