মহাত্মা গান্ধীকে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি নতুন দিল্লির একটি সুবৃহৎ প্রাসাদ বিড়লা হাউসের প্রাঙ্গণে (এখন গান্ধী স্মৃতি) হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর ঘাতক ছিলেন নাথুরাম গডসে। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভার সদস্য,[১] এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধাসামরিক স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) একজন প্রাক্তন সদস্য।[২] গডসে মনে করেছিলেন, এর আগের বছর, ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় গান্ধীজী মুসলমানদের পক্ষে খুব বেশি সহায়তা করেছিলেন।[৩][৪][৫] প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সন্ধ্যা ৫টা ১৭ মিনিটে গান্ধী বিড়লা হাউজের পিছনের দিকে লনে যাওয়ার সিঁড়ির মাথায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে তিনি প্রতি সন্ধ্যায় সর্ব ধর্মের প্রার্থনা সভা পরিচালনা করছিলেন। যেইমাত্র গান্ধী বেদির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, গডসে ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে গান্ধীর পথের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ (অস্ত্র থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি ব্যক্তিকে সরাসরি আঘাত করতে পারে) থেকে গান্ধীর বুকে এবং পেটে তিনটি গুলি ছুঁড়েছিলেন।[৬] গান্ধী মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে বিড়লা হাউসে তাঁর ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে কিছুক্ষণ পরে একজন প্রতিনিধি এসে তাঁর মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে।[৭][ক]
জনতা গডসেকে ধরে ফেলে এবং পুলিশের হাতে সমর্পন করে। গান্ধী হত্যার বিচার ১৯৪৮ সালের মে মাসে দিল্লির ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় শুরু হয়েছিল। প্রধান আসামী ছিলেন গডসে এবং তাঁর সহযোগী নারায়ণ আপ্তে। একই সঙ্গে সহ-আসামি হিসাবে আরও ছয় জনের বিচার শুরু হয়েছিল। "হত্যাকাণ্ড রোধে ব্যর্থতায় পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এড়ানোর জন্য"[৮] স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেলের ইচ্ছাতেই এই কাজ করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ৮ই নভেম্বর গডসে এবং আপ্তেকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ১৫ই নভেম্বর আম্বালা কারাগারে তাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।[৯]
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে, দিল্লি এবং পার্শ্ববর্তী প্রদেশে পূর্ব পাঞ্জাব হিংস্র দাঙ্গা রোধে সাহায্য করার জন্য গান্ধী দিল্লি চলে গিয়েছিলেন।[১০] ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের বিভাজনের প্রেক্ষিতে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। বিভাজনের পর ভারত ও পাকিস্তানের নতুন স্বাধীন অধিরাজ্য তৈরি হয়েছিল, এবং এই দুই অধিরাজ্যের মধ্যে বৃহৎ সংখ্যায় বসবাসকারীর বিশৃঙ্খল স্থানান্তর হয়েছিল।[১১][ক]
নাথুরাম বিনায়ক গডসে এবং তাঁর সহযোগীরা দাক্ষিণাত্যের বাসিন্দা ছিলেন। গডসে এর আগে ব্রিটিশ ভারতের দাক্ষিণাত্যে অঞ্চলে দেশীয় রাজ্য হায়দ্রাবাদের মুসলিম শাসক ওসমান আলী খানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গডসে ১৯৩৮ সালে হায়দরাবাদে একটি প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, ফেদারলিংয়ের মতে সেখানে হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছিল।[১২] রাজনৈতিক অপরাধের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনি কারাবাসের সাজা ভোগ করেছিলেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে, গডসে তাঁর অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যান এবং সাংবাদিক হিসাবে কাজ করে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু শরণার্থীদের দুর্ভোগের কথা এবং ১৯৪০ এর দশকে বিভিন্ন ধর্মীয় দাঙ্গার সময় হিন্দুদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন। [১৩][১৪][১৫]
অরবিন্দ শর্মার মতে, ১৯৪৮ সালে, গডসে এবং তাঁর সহযোগীরা গান্ধীকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন, ভারত ও পাকিস্তান ততদিনে কাশ্মীরের দখল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে। কংগ্রেস নেতাদের নেতৃত্বে ভারত সরকার, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে, পাকিস্তানকে যুদ্ধের সময় অর্থাগম বন্ধ করার জন্য তাদের অর্থ প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিল।[১৬] গান্ধী এই অর্থ প্রদান বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন, এবং ১৩ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে আমৃত্যু অনশন শুরু করেছিলেন যাতে ভারত সরকারকে চাপ দিয়ে পাকিস্তানকে অর্থ প্রদান শুরু করা যায়। ভারত সরকার গান্ধীর চাপের কাছে নতিস্বীকার করে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে। গডসে এবং তাঁর সহকর্মীরা এই ঘটনাক্রমকে ব্যাখ্যা করেছিলেন - মহাত্মা গান্ধী শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে ভারতকে আঘাত করছেন, এই ভাবে।[১৩][১৬]
যেদিন গান্ধী অনশন শুরু করেছিলেন, গডসে এবং তাঁর সহযোগীরা, কীভাবে গান্ধীকে হত্যা করা যায় তার পরিকল্পনা করতে শুরু করেছিলেন।[১৬][১৭] নাথুরাম বিনায়ক গডসে এবং নারায়ণ আপ্তে একটি বেরেট্টা এম ১৯৩৪ কিনেছিলেন। পিস্তল কেনার পাশাপাশি, গডসে এবং তার সহযোগীরা গান্ধীকে ছায়ার মত অনুসরণ করতে শুরু করেছিলেন।
গান্ধী প্রথমে নতুন দিল্লির উত্তর অংশে গোল মার্কেটের কাছে তপশিলী বাল্মিকি মন্দিরে থাকছিলেন, এবং সেখানে তাঁর প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত করছিলেন। দেশভাগের শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য যখন মন্দিরটি নেওয়া হয়েছিল, তিনি বিড়লা হাউসে চলে যান। এই বিশাল প্রাসাদটি দক্ষিণ-মধ্য নতুন দিল্লির তখনকার আলবুকার্ক রোডে অবস্থিত ছিল, যেটি কূটনৈতিক ভবনের থেকে খুব দূরে নয়।[৭] গান্ধী বিড়লা হাউজের বাম শাখায় দুটি আড়ম্বরহীন কক্ষে থাকতেন, এবং প্রাসাদের পিছনে একটি উঁচু লনে প্রার্থনা সভা পরিচালনা করতেন।[৭]
বিড়লা হাউসে গান্ধীকে হত্যার প্রথম প্রয়াস ১৯৪৮ সালের ২০শে জানুয়ারি ঘটেছিল। স্ট্যানলি ওলপার্টের মতে, নাথুরাম গডসে এবং তাঁর সহকর্মীরা গান্ধীকে একটি পার্কে অনুসরণ করে গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি কথা বলছিলেন।[১৮] তাঁদের মধ্যে একজন ভিড় থেকে দূরে একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে জনতা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। গান্ধী বক্তার মঞ্চে একা ছিলেন। আসল হত্যার পরিকল্পনায় ছিল, জনতা পালিয়ে যাওয়ার পরে দ্বিতীয় গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করার, যখন গান্ধী একা[১৮] তবে কথিত সহযোগী দিগম্বর ব্যাজ সাহস হারিয়ে ফেলেন এবং দ্বিতীয় গ্রেনেড নিক্ষেপ না করে ভিড়ের মধ্যে পালিয়ে যান। ভারত বিভাজনের পাঞ্জাবি শরণার্থী মদনলাল পাহওয়া ছাড়া হত্যার ষড়যন্ত্রকারীরা সকলেই পালিয়ে যান। তিনি গ্রেপ্তার হন[১৮] পাহওয়া ১৯৬৪ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন।[১৯]
গুজরাটি রীতিতে "মনুবেন" নামে পরিচিত, মনু (মৃদুলা) গান্ধী, ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নাতনি। পূর্ববাংলায় শান্তি মিশনে নোয়াখালী যাওয়ার সময় তিনি গান্ধীর পারিষদবর্গের সঙ্গে যোগ দিতে এসেছিলেন। নোয়াখালী তখন সাম্প্রদায়িক হিংসার বলি হয়েছিল। আভা চ্যাটার্জী (আভাবেন চ্যাটার্জী) গান্ধীর দত্তক নেওয়া মেয়ে ছিলেন, তিনি পরে গান্ধীর ভাইপো, কানু গান্ধী কে বিয়ে করেন। হত্যার সময় উভয় কিশোরী গান্ধীর পাশে ছিলেন।[২০] মনুবেন গান্ধীর একটি স্মৃতিচারণ লাস্ট গ্লিম্পসেস অফ বাপু ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেটি অনুসারে, মহাত্মা গান্ধী (বাপু) ভগবদ্গীতার আবৃত্তি শুনে বিড়লা হাউসে দিনটি শুরু করেছিলেন।[২১] তারপরে তিনি হরিজনয়ে প্রকাশ করার জন্য কংগ্রেসের সংবিধানে কাজ করেছিলেন, সকাল ৮ টায় অঙ্গসংবাহন করে স্নান করেন। এরপর তিনি ১৮ বছর বয়সী মনুবেনের স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে তাকে তিরস্কার করেছিলেন।[২২] স্নানের পরে ৭৮ বছর বয়সী গান্ধীর ওজন নেওয়া হয়েছিল তাঁর ওজন ছিল ১০৯.৫ পাউন্ড (৪৯.৭ কিলোগ্রাম)। তারপরে তিনি পিয়েরালালজির সাথে মধ্যাহ্নভোজ খেতে খেতে নোয়াখালী দাঙ্গা নিয়ে আলোচনা করেন।[২৩] মধ্যাহ্নভোজের পরে গান্ধী একটু ঘুমিয়ে নেন। ঘুম থেকে ওঠার পরে তিনি সর্দার দাদার সাথে বৈঠক করেন। দুই কাঠিয়াওয়ার নেতা তাঁর সাথে দেখা করতে চেয়েছিল, মনুবেন যখন গান্ধীকে জানিয়েছিলেন যে তারা তাঁর সাথে দেখা করতে চান, গান্ধী জবাব দিয়েছিলেন, "তাদের বল যে, আমি যদি বেঁচে থাকি তবে তারা আমার প্রার্থনার পরে পদচারণার সময় আমার সাথে কথা বলতে পারে"।[২৪]
মনুবনের স্মৃতিকথা অনুসারে বল্লভভাই প্যাটেল এবং গান্ধীর মধ্যে বৈঠক নির্ধারিত সময়ের পরেও চলেছিল এবং প্রার্থনা সভায় যেতে গান্ধীর প্রায় দশ মিনিট দেরী হয়েছিল।[২৫] ডানদিকে মনুবেন এবং বাম দিকে আভাকে নিয়ে তিনি প্রার্থনার স্থানের দিকে হাঁটা শুরু করেছিলেন। তিনি তাদের হাঁটার লাঠির মত ধরেছিলেন।[২৬] মনুবেন লিখেছেন, খাকি পোশাকের এক যুবক, ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে যুক্তকরে তাঁর সামনে নত হয়েছিল। মনুবেন ভেবেছিলেন লোকটি গান্ধীর পা ছুঁতে চায়। তিনি যুবকটিকে পাশে সরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "বাপুর ইতিমধ্যেই দশ মিনিট দেরি হয়ে গেছে, আপনি কেন তাকে বিব্রত করছেন?"। গডসে তাঁকে এত জোরে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং জপমালা, নোটবুক, এবং গান্ধীর যে থুকদানি তিনি বহন করছিলেন তা তাঁর হাত থেকে পড়ে গেল।[২৭] তিনি স্মরণ করে লিখেছিলেন যে তিনি জিনিসগুলি তুলতে যখন নিচের দিকে ঝুঁকেছিলেন তিনি চারটি শট শুনেছিলেন, এবং সর্বত্র ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল। গান্ধীর হাত জড়ো করা ছিল, তাঁর মুখ থেকে বার হচ্ছিল, "হে রা...ম! হে রা...!"। মনুবেন লিখেছেন আভাবেনও পড়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি দেখেছিলেন নিহত গান্ধী আভাবেনের কোলে পড়ে আছেন।[২৮]
মনুবেন লিখেছেন, পিস্তলের আওয়াজ তাঁকে বধির করে দিয়েছিল, ধোঁয়া খুব ঘন ছিল, এবং ঘটনাটি ৩ থেকে ৪ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় মনুবেনের মতে, জনতার ভিড় তাঁদের দিকে ছুটে আসে।[২৯] তিনি যে ঘড়িটি পরেছিলেন তাতে সময় দেখিয়েছিল সন্ধ্যা ৫:১৭ । তাঁদের সাদা পোশাকে সর্বত্র রক্তের দাগ ছিল। মনুবেনের আন্দাজমত গান্ধীকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে প্রায় দশ মিনিট সময় লেগেছিল, এবং সেই সময় কোনও চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। তাঁদের কাছে কেবল প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্স ছিল, কিন্তু তাতে গান্ধীর ক্ষতের চিকিৎসা করার মত কোনও ওষুধ ছিল না।[২৭] মনুবেনের মতে,
ঘাতকের সাত-বোরের স্বয়ংক্রিয় পিস্তলের প্রথম গুলিটি পেটের মাঝের ৩.৫ ইঞ্চি ডানদিকে এবং নাভির ২.৫ ইঞ্চি উপরে আঘাত করে; দ্বিতীয়টি পেটের মাঝখান থেকে ১ ইঞ্চি দূরে আঘাত করেছে, এবং তৃতীয়টি ডানদিকে ৪ ইঞ্চি দূরে"।[৩০]
গান্ধীর প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছিল। সবাই খুব জোরে কাঁদছিল। বাড়িতে ভাই সাহেব অনেকবার হাসপাতালে ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনও সাহায্য পাওয়া যায়নি। তারপরে তিনি নিজে উইলিংডন হাসপাতালে যান, কিন্তু হতাশ ফিরে এসেছিলেন। গান্ধীর দেহ ঘরে পড়েছিল এবং মনুবেন ও অন্যান্যরা গীতা পড়ছিলেন। কর্নেল ভার্গব এসেছিলেন এবং তিনি গান্ধীকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন।[৩০]
</reference>
<references>
<ref>
Assassination-related literature and the variance in its coverage:
Funeral, post funeral-rites and memorialization after Gandhi's assassination: