বিড়লা শিল্প ও কারিগরি সংগ্রহশালা বা বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম (সংক্ষেপে- বিআইটিএম), ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অধীনস্থ ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়াম (এনসিএসএম) তথা জাতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহালয় পরিষদের সহযোগী সংস্থা। এটি কলকাতা মহানগরের গুরুসদয় রোডে অবস্থিত।
ইতিহাস
সূচনা—
ভারতের প্রথম বিজ্ঞান সংগ্রহশালা বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২ মে কলকাতায় উদ্বোধন হয়। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় লন্ডন সায়েন্স মিউজ়িয়াম এবং মিউনিখের ডাচেস মিউজ়িয়াম সফরের পর কলকাতায় অনুরূপ সংগ্রহশালা গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে পৌঁছলে শুরু হয় উদ্যোগ। খ্যাতনামা উদ্যোগপতি ঘনশ্যাম দাস বিড়লা এ জন্য ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বালিঞ্জের ১৮ স্টোর রোডের (বর্তমান ১৯ এ গুরুসদয় রোডের) প্রাসাদোপম বাড়িসহ প্রশস্ত প্রাঙ্গণ- ‘বিড়লা পার্ক’ বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের নামে উইল করে উৎসর্গ করে দেন জাতির উদ্দেশ্যে। ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে একদল জাদুঘর সম্পর্কিত বিষয়ে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও তাদের সুচারু গবেষণা ও পরিশ্রমের গড়ে ওঠে সংগ্রহশালাটি।
মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়, বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের মহাপরিচালক এম এস ঠক্কর এবং বিড়লা শিল্প ও কারিগরী সংগ্রহশালার পরিকল্পনা রূপায়ণকারী আধিকারিক অমলেন্দু বসুর উপস্থিতিতে ভারতের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২ মে উদ্বোধন করেন। সংগ্রহশালায় প্রথম প্রদর্শনীর মধ্যে ছিল - চিত্তাকর্ষক পদার্থ বিজ্ঞান , গণিত, জীবন বিজ্ঞান, বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম, পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা আয়রন, স্টিল এবং কপার, অপটিক্স, ইলেকট্রনিক্স, টেলিভিশন এবং শিশুদের গ্যালারী। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সংযোজিত হয় -
মোটিভ পাওয়ার (১৯৬২), কমিউনিকেশন (১৯৬৩), মাইনিং (১৯৬৪), জনপ্রিয় বিজ্ঞান তথা পপুলার সায়েন্স (১৯৬৫), পরিবহন বা ট্রান্সপোর্ট (১৯৭৩), আন্ডারগ্রাউন্ড মক-আপ কয়লা খনি বা কৃত্রিম কয়লাখনি (১৯৮৩), এবং অ্যাটম বা পরমাণু (১৯৮৪) প্রভৃতি বিষয়গুলি। এগুলির সর্বসাধারণের চাহিদা ও প্রত্যাশা অনুসারে পুরানো গ্যালারির অনেকগুলি হয় সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে বা আধুনিক প্রদর্শনী দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে৷ সূচনাকাল হতেই বিআইটিএম সংগ্রহশালা শিক্ষামূলক কার্যক্রম যেমন সকলের জন্য সেমিনার এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে আসছে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে, শিশুদের জন্য সায়েন্স ডেমন্সট্রেশন লেকচার্স (SDL) তথা বিজ্ঞান প্রদর্শনীর বক্তৃতা সব সময়ই বিআইটিএম আয়োজন করে। একই সময় ধরে আওয়ার ফ্যামিলিয়ার ইলেকট্রিসিটি বা 'আমাদের পরিচিত বিদ্যুৎ' থিমে চাকার উপর প্রথম মোবাইল বিজ্ঞান প্রদর্শনী (এমএসই) চালু রয়েছে। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ হতে স্কুলের ছাত্রদের জন্য 'বিজ্ঞান মেলা' এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
বিগত কয়েক দশকে সৃজনশীল ক্ষমতা কেন্দ্র (সিএসি), কম্পিউটার সচেতনতা প্রোগ্রাম, ইঞ্জিনিয়ারিং ফেয়ার, পেট লাইব্রেরি, ইনফ্ল্যাটেবল ডোম প্ল্যানেটেরিয়াম শো, পাবলিক সায়েন্স শো, ছাত্রদের বিজ্ঞান সেমিনার, বিজ্ঞান নাটক, অবকাশকালীন শখের ক্যাম্প, এবং অসংখ্য অন্যান্য ইন-মিউজিয়াম এবং কমিউনিটি এনগেজমেন্ট একাডেমিক উদ্যোগের বিভিন্ন ঘটনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিআইটিএম বারোটি শিক্ষামূলক এবং বিশেষভাবে নির্মিত যেমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য 'ওয়ার্ল্ড ইন ডার্কনেস' তথা অন্ধকারে বিশ্বপরিচয়ের ব্যবস্থা করেছে। বিআইটিএম সারা বছরই বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং অত্যন্ত আকর্ষক বৈজ্ঞানিক প্রদর্শনী এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার আয়োজন করে থাকে।
ভারত জুড়ে বিজ্ঞান সংগ্রহশালা গড়তে ও উন্নয়নে বিআইটিএম-এর ভূমিকা—
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিআইটিএম তথা বিড়লা শিল্প ও কারিগরি সংগ্রহশালা প্রদর্শন দেশ জুড়ে সর্বসাধারণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বিশেষকরে ছাত্র ছাত্রীদের বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ বৃদ্ধি হয়। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়াম (এনসিএসএম) বা জাতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহালয় পরিষদ গঠিত হলে, তার তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী বিজ্ঞান সংগ্রহালয় তৈরির প্রকল্প গৃহীত হয়। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গালুরুতে দেশের দ্বিতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহশালা বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের নেটওয়ার্কে স্থাপিত হয় বিশ্বেশ্বরায়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়াম (VITM)। এর স্থাপনার দায়িত্ব ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বিআইটিএম টিমের উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের পরিকল্পনা কমিশন বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বিজ্ঞান সংগ্রহশালার কার্যক্রম পরীক্ষায় মুম্বাই-এ 'নেহেরু বিজ্ঞান কেন্দ্র' নামে এক বিশেষ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে এবং দেশজুড়ে সম্প্রসারণের সম্ভাব্য দিক নির্দেশ করে। বিজ্ঞানমনষ্কতা গড়ে তোলার জন্য সংগ্রহশালার ভূমিকা ও প্রচুর সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেশজুড়ে তিন-গুণ নেটওয়ার্ক-জাতীয়, আঞ্চলিক এবং জেলায় স্থাপন করা হবে। এবং পরবর্তীতে দেশ জুড়ে বিশাল সম্প্রসারণ পরিকল্পনা চালানোর জন্য এবং বিজ্ঞান সংগ্রহশালার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল দ্য ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়াম (এনসিএসএম) প্রতিষ্ঠিত হয়। বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের অধীনে আগে প্রতিষ্ঠিত দুটি সংগ্রহশালা, বিআইটিএম (কলকাতা) এবং ভিআইটিএম (ব্যাঙ্গালোর) বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদ থেকে আলাদা করে এনসিএসএম-এর কর্তৃত্বের আওতায় আনা হয়। জাতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহালয় পরিষদের অধীনে এখন সারাদেশে পঁচিশটি বিজ্ঞান সংগ্রহশালা এবং বিজ্ঞান কেন্দ্র রয়েছে এবং এর মধ্যে আটটি বিআইটিএম-এর কার্যক্রমের আওতাধীন।
বিআইটিএম ভবনের ইতিকথা—
বিড়লা শিল্প ও কারিগরি সংগ্রহশালার অবস্থান ১৯এ, গুরুসদয় রোড পূর্বে ১৮ বালিগঞ্জ স্টোর রোড নামেই পরিচিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে এটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সম্পত্তি ছিল। এক সূত্র হতে জানা যায় যে, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মির্জা আবদুল করিমের কাছ থেকে কিনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা মীরা দেবী শৈশবের বেশিরভাগ সময় এখানেই কাটান। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ঘনশ্যাম দাস বিড়লা সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে জমিটি ক্রয় করেন এবং তারপর এটি বিড়লা পার্ক হিসাবে পরিচিত হয়।[৩]
ঘনশ্যাম দাস বিড়লা এই সম্পত্তি নেওয়ার পরে ঠাকুর পরিবারের তৈরি বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলেন এবং স্থপতি এন. গুইন অ্যান্ড কোং.কে নিযুক্ত করে ইউরোপীয় স্থাপত্য নকশার প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি করেন। ঠাকুর পরিবারের আমলে, এসেছিলেন বিখ্যাত জাপানি চিত্রশিল্পী কাকুজো ওকাকুরা, ইয়োকোয়মা, টিকান, হিশিদা এবং কাতুস্তা প্রমুখেরা। এছাড়াও চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ এবং আনন্দমোহন সেনের মতো সেকালের প্রবীণ বিপ্লবীরাও বিভিন্ন সময়ে ঠাকুর পরিবারের অতিথি হয়েছিলেন এখানে।
বিড়লাদের ১৯এ গুরুসদয় রোড (বিড়লা পার্ক) বিড়লাদের হওয়ার পরেও এটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য এক অনন্য ল্যান্ডমার্ক হিসাবে রয়ে গেছে। কারণ মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, লালা লাজপত রায় এবং পন্ডিত মদন মোহন মালব্যের ন্যায় জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘনশ্যাম দাস বিড়লার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। চীনা প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাই-শেক এই বিড়লা পার্কে মহাত্মা গান্ধীর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করেছিলেন।[৪]
শিশুদের গ্যালারি। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর তারিখে উদ্বোধন করা হয়
বিদ্যুৎ
চিত্তাকর্ষক পদার্থবিদ্যা
জীবন বিজ্ঞান
গণিত
ধাতু
কৃত্রিম কয়লা খনি
মোটিভ পাওয়ার
জনপ্রিয় বিজ্ঞান
টেলিভিশন
পরিবহন
নিয়মিত কার্যক্রম
ত্রিমাত্রিক ফিল্ম শো, 'টার্টল অ্যাডভেঞ্চার'
আন্ডারগ্রাউন্ড মক আপ কয়লা খনি শো
চিত্তাকর্ষক রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, বিজ্ঞান যাদু এবং অলৌকিক, মজার বিজ্ঞান এবং বুদবুদ প্রদর্শনের উপর বিজ্ঞান শো
আকাশ পর্যবেক্ষণ
তারামন্ডল (স্ফীত-গম্বুজ প্ল্যানেটেরিয়াম)
স্যাটেলাইট ইউনিট
বর্ধমান বিজ্ঞান কেন্দ্র, বর্ধমান[১]। 9 জানুয়ারী 1994 সালে উদ্বোধন করা হয়। আচ্ছাদিত মেঝে এলাকা 952.7 বর্গ. মিটার
দিঘা বিজ্ঞান কেন্দ্র ও জাতীয় বিজ্ঞান শিবির, নিউ দিঘা[২]। 31 আগস্ট 1997 সালে উদ্বোধন করা হয়। আচ্ছাদিত মেঝে এলাকা 2589 বর্গ. মিটার
জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্র, পুরুলিয়া[৩]ওয়েব্যাক মেশিনেআর্কাইভকৃত ২ মার্চ ২০২৩ তারিখে। 15 ডিসেম্বর 1982 সালে উদ্বোধন করা হয়। আচ্ছাদিত মেঝে এলাকা 1637.40 বর্গ. মিটার
উত্তরবঙ্গ বিজ্ঞান কেন্দ্র, মাটিগাড়া[৪]। 17 আগস্ট 1997 সালে উদ্বোধন করা হয়। আচ্ছাদিত মেঝে এলাকা 1875 বর্গ. মিটার
শ্রীকৃষ্ণ বিজ্ঞান কেন্দ্র, পাটনা[৫]। 14 এপ্রিল 1978 সালে উদ্বোধন করা হয়। আচ্ছাদিত মেঝে এলাকা 3523 বর্গ. মিটার