বিজ্ঞানের দর্শন বলতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার উপাদানগুলোকে দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিতে অধ্যয়ন করা বোঝায়। বিজ্ঞানের অনুশীলন এবং লক্ষ্যগুলোর অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব এবং নীতিবিদ্যা সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণ জ্ঞানের এই শাখায় প্রাধান্য পায়।[১] উদাহরণ স্বরূপ, বিজ্ঞান ও সত্যের সম্বন্ধ অধ্যয়ন করাকালীন — কীভাবে বিজ্ঞান মিথ্যা প্রমাণিত করার যোগ্য ভবিষ্যদ্বানী প্রদান করে এবং বিজ্ঞানের এই কার্য কীভাবে বিজ্ঞানকে অধিক নির্ভরশীল করে তোলে। সাধারণভাবে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি অনেক দার্শনিক আবার বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট শাখাগুলোকেও দর্শনের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন যে কারণে পদার্থবিজ্ঞানের দর্শন, জীববিজ্ঞানের দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোর জন্ম হয়েছে।
বিজ্ঞানের দার্শনিক আলোচনা বিষয়ে স্বয়ং বিজ্ঞানীদের অবস্থান বেশ দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে অনেক বিজ্ঞানী যেমন বিজ্ঞানের দর্শনে অবদান রেখেছেন, অন্যদিকে অনেকে আবার এর সমালোচনা করেছেন এবং বিজ্ঞানের জন্য এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন বিখ্যাত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন, "পাখিদের জন্য পক্ষীবিদ্যার উপযোগীতা যতটুকু বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞানের দর্শনের উপযোগীতা তার থেকে বেশি নয়"। কিছু দার্শনিক আবার তার এই উক্তির সমালোচনা করেছেন। যেমন অধিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় রত মার্কিন দার্শনিক জোনাথন শাফার ফাইনম্যানের বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেছেন, পক্ষীবিদ্যা পাখিদের জন্য সত্যিই খুব উপকারী হতো যদি পাখিদের সেই বিদ্যা আয়ত্ত করার ক্ষমতা থাকতো।[২]
বিজ্ঞানের দর্শনের মুখ্য প্রশ্নসমূহের বিষয় 'বিজ্ঞান কি এবং কি নয়', 'বৈজ্ঞানিক প্রণালীসমূহের নির্ভরশীলতা', 'বিজ্ঞানের শেষ লক্ষ্য' ইত্যাদি। বিজ্ঞানের দর্শনের বহু মুখ্য প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে দার্শনিকগণ একমত নন। 'বিজ্ঞান অনিরীক্ষণীয় বিষয়ের সত্য অনাবৃত করতে পারবে কি না?', 'বৈজ্ঞানিক যুক্তির ন্যায্যতা বা প্রতিপন্ন করতে পরা যায় কি যায় না?' ইত্যাদি প্রশ্ন তার অন্তর্গত। বিজ্ঞান বিষয়ক তেমন সাধারণ প্রশ্নসমূহ ছাড়াও দর্শনের এই ভাগে বিজ্ঞানের কোনো এক ধারায় (যেমন জীববিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান ইত্যাদি) প্রযোজ্য প্রশ্নেরও উত্তর সন্ধান করে। কোনো কোনো দার্শনিক আধুনিক বিজ্ঞানের ফলাফলের সহায়তায় স্বয়ং দর্শনের বিষয়ই মীমাংসা করে থাকেন।
যদিও বিজ্ঞান বিষয়ক দার্শনিক চিন্তা অন্ততঃ অ্যারিস্টটলের সময় থেকেই চলে আসছে, বিজ্ঞানের দর্শনের এক পৃথক শৃঙ্খলা রূপে বিকাশ বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকেই আরম্ভ হয়েছে। এমনটা হয়েছিল যৌক্তিক দৃষ্টবাদের প্রাক্কালে। যৌক্তিক দৃষ্টিবাদের লক্ষ্য প্রতিটি দার্শনিক বিবৃতির অর্থপূর্ণতার মাপ-কাঠি নির্ণয় করা এবং বস্তুবাদী রূপে সেই বিবৃতিসমূহকে পরিমাপ করা। টমাস কুনের ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'দ্য ষ্ট্রাক্সার অব সায়েণ্টিফিক রেভোলিউসন্স' (১৯৬২) বৈজ্ঞানিক উন্নতি যে অবিচলিত, এবং জ্ঞানের সঞ্চয়িত অধিগ্রহণ নিশ্চিত প্রণালীর ওপর আধারিত, সেই ধারণাকে প্রত্যাহ্বান করে। তিনি তার পরবর্তী তর্ক করেন যে, যেকোনো উন্নতি এক বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ের দৃষ্টান্তের (প্রশ্ন, ধারণা, চর্চার) সাথে আপেক্ষিক।
পরবর্তী সময়ে, ডাব্লিউ ভি কুয়াইন এবং অন্যান্যদের জন্য বিজ্ঞানের সুসংগত অভিগমন, যে শাস্ত্র মান্য হয় যদি এই পর্যবেক্ষণকে এক সুসংগত সমগ্রের অংশ হিসাবে দেখানো যায় — এই অভিগমন প্রধান হয়ে পড়ে। স্টিফেন জে গুডের মতো কোনো কোনো চিন্তাবিদ বিজ্ঞানকে স্বয়ংসিদ্ধ ধারণার সমষ্টিতে স্থলিত করতে শুরু করেন, যেমন: প্রকৃতির সামঞ্জস্য। পল ফেয়েরাব্যান্ডকে ধরে দার্শনিকদের এক কণ্ঠ্য সংখ্যালঘু দল তর্ক করে যে, 'বৈজ্ঞানিক প্রণালী'র মতো আসলে কোনো বস্তুই নেই, তারা বিজ্ঞানের সকল অভিগমনকে মান্যতা প্রদান করতে থাকেন, অলৌকিকতাসমূহকেও। বিজ্ঞানের বিষয়ে চিন্তা করার অন্য এক অভিগমন হল সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞান কীভাবে সৃষ্টি হয় তা অধ্যয়ন করা। এমন অভিগমনকে ডেভিড ব্লুর, বেরী বার্নসের মতো দার্শনিক সমর্থন করেন। শেষে, ১৯-২০ শতাব্দীর ইউরোপীয় দর্শন বিজ্ঞানকে মানব অভিজ্ঞতার কঠোর বিশ্লেষণ হিসাবে চায়।
বিজ্ঞানের বিশেষ ভাগ সম্বন্ধীয় দার্শনিক প্রশ্নসমূহ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে উদিত সময়ের প্রকৃতি বিষয়ক, রাজনীতিতে অর্থনীতির প্রভাব ইত্যাদি। একটি মুখ্য বিষয় হল, কোনো এক বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলাকে অন্য এক শৃঙ্খলয় অনুবাদ করতে পারা যায় কি যায় না। যেমন, রসায়ন বিজ্ঞানকে ভৌত বিজ্ঞানে অনুবাদ করতে পারি কি না? সমাজবিজ্ঞানকে ব্যক্তিগত মনোবিজ্ঞানর স্তরে অনুবাদ করতে পারি কি না? বিজ্ঞানের দর্শনের সাধারণ প্রশ্নসমূহেরও বিজ্ঞানের কোনো এক ধারায় বিশেষ গুরুত্ব থাকতে পারে। যেমন বৈজ্ঞানিক যুক্তির বৈধতার পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রতিষ্ঠাপনে বিশেষ গুরুত্ব আছে। কি বিজ্ঞান হয় এবং কি বিজ্ঞান নয়, সেকথা চিকিৎসা বিজ্ঞানের দর্শনে জীবন-মরণের প্রশ্ন। তদুপরি, জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদির দর্শনসমূহ মানব প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নে বস্তুবাদী রূপ লাভ করতে পারবে, না মূল্যবোধ এবং সামাজিক সম্বন্ধ প্রভাবিত হয়ে থাকবে, তেমন বিষয়েও অধ্যয়ন করে।
বিজ্ঞান এবং অ-বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য করাকে সীমা সমস্যা বলা হয়। যেমন, মনোবিশ্লেষণ বিজ্ঞান হয় কি না? তথাকথিত সৃষ্টির বিজ্ঞান, স্ফীতিজনিত মাল্টিভার্স পরিকল্পনা বা সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে কি বলতে পারি? কার্ল পপারের মতে, এই প্রশ্নই বিজ্ঞানের দর্শনের মূল প্রশ্ন।[৩] পরে, এই প্রশ্নের কোনো সর্বজনবিদিত সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই অথবা এই প্রশ্ন রুচিহীন বলে গণ্য করেন।[৪][৫] মার্টিন গার্ডনার অপবিজ্ঞান শনাক্ত করতে পটার ষ্টিয়ার্ট মানক ব্যবহার করতে পরামর্শ প্রদান করেন — "আমি এটি জানি কারণ আমি এটি দেখেছি"।
যৌক্তিক দৃষ্টবাদীগণ প্রথমে বিজ্ঞানকে পর্যবেক্ষণ স্থলিত করেছিলেন, তার বিপরীতে অ-বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণহীন এবং সেইজন্য অর্থহীন।[৬] পপার তর্ক করেছিলেন যে, বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় গুণ হল মিথ্যায়ন। অর্থাৎ, প্রতি বাস্তবিক বৈজ্ঞানিক দাবীকে, অন্ততঃ সিদ্ধান্ত হ'লেও, অসত্য প্রমাণ করা যায়।
অধ্যয়ন বা ভাবনা-চিন্তার কোনো ক্ষেত্র, যে ক্ষেত্রই অন্যথা লাভ করতে না পারার বৈধতার দাবী করার প্রচেষ্টাতে বিজ্ঞানের ছদ্মবেশ ধারণ করে, সেই অধ্যয়ন বা ভাবনা চিন্তাকে অপবিজ্ঞান, পার (ফ্রিঞ্জ — fringe)) বিজ্ঞান বা আবর্জনা বিজ্ঞান বলা হয়।[৭] ভৌতবিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনমেন এমন ঘটনাসমূহের জন্য, যে ঘটনাসমূহে গবেষণাকারীবৃন্দ তাদের কার্যকে বিজ্ঞান বলে ভাবেন, কিন্তু আসলে বাইরে থেকে বৈজ্ঞানিক আবরণ থাকলেও কার্যসমূহে কাঠিন্যের মূল্যায়ন করার যোগ্য "চরম সততা" থাকে না, সেগুলিকে মাল-পন্থ বিজ্ঞান (কার্গো-কাল্ট সায়েন্স (cargo-cult science)) সংজ্ঞা ব্যবহার করেছিলেন।
অন্য এক প্রশ্ন হল "ভাল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কাকে বলা হয়?"। ভবিষ্যতের ঘটনার পূর্বানুমান করা ছাড়াও, সমাজ প্রায়ই বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহের সহায়তায় বর্তমানে ঘটে থাকা এবং পূর্বে ঘটিত ঘটনার ব্যাখ্যা তুলে ধরে। দার্শনিকগণ বৈজ্ঞানিক সূত্র কোনো এক ঘটনাকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করছে কি না এবং এটি বৈজ্ঞানিক সূত্রের ব্যাখ্যার শক্তি আছে কি না, তা নির্ণয় করার মাপ-কাঠি অনুসন্ধান করে চলেছেন।
একটি আগেকার সময় থেকে চলে আসা প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সূত্র হল ন্যায়িক-নোমলজিকাল মডেল। এই মডেল অনুসারে, এক সফল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রশ্নোদ্ধৃত ঘটনায় কোনো এক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত থেকে যুক্তিতে উপনীত হতে হয়।[৮] এই ধারণাকে বারংবার সমালোচনা করা হয়েছে এবং অনেক অভ্যুদাহরণ বহুলভাবে স্বীকৃত।[৯] বিশেষত, ব্যাখ্যা শনাক্ত করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে যখন ব্যাখ্যা করাকালীন বস্তুত কোনো সিদ্ধান্ত থেকে যুক্তিতে উপনীত হতে পারা না যায়। কারণ এটি কেবল সুযোগের বস্তু, বা একে যা জনা যায় তা সঠিকভাবে পূর্বানুমান করতে পারা যায় না। বেস্লি সেল্মনের মতে, একটি ভাল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পরিসংখ্যানভাবে ব্যাখ্যা করতে ফলাফলের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতে হয়।[১০][১১] অন্যান্য মতে, ভাল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার চাবি হল ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাকে একই ব্যাখ্যা দ্বারা বোঝানো।
যদিও এই কথাকে বিনা প্রমাণে শুদ্ধ বলে প্রায় ধরে নেওয়া হয়, তবে এই কথা একেবারেই স্পষ্ট নয় যে কয়েকটি পরীক্ষা শুদ্ধ হলে বা কয়েকটি উদাহরণ দেখালে কোনো সূত্রকে কীভাবে বৈধ বলে ধরা যায়।[১২] উদাহরণ স্বরূপ, একটি মুরগি পর্যবেক্ষণ করে যে, প্রতি রাতে মালিক আসে এবং খাদ্য প্রদান করে। তেমন অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। সেক্ষেত্রে, মুরগিটি প্রস্তাবনামূলক যুক্তির দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে যে মালিক সমস্ত রাতেই খাদ্য প্রদান করবে। পরে, একবার রাতে, মালিক আসল এবং মুরগিটিকে খাদ্য প্রদান করার পরিবর্তে হত্যা করল। বৈজ্ঞানিক যুক্তি মুরগিটির যুক্তির থেকে কীভাবে অধিক নির্ভরশীল?
এক অভিগমন হল এই কথা লক্ষ্য করা যে, অধিস্থাপনই নিশ্চয়তা প্রদান করতে না পারে, কিন্তু একটি সাধারণ বিবৃতির উদাহরণ বারে বারে পর্যবেক্ষণ করলে অন্ততঃ বিবৃতিটি অধিক সম্ভাব্য হয়। সেক্ষেত্রে, প্রতি রাতে অভিজ্ঞত থেকে মুরগিটি ধারণা করতে পারে যে, এই কথা অধিক সম্ভাব্য যে পরবর্তী রাতে মালিক খাদ্য প্রদান করবে, যদিও এই কথা নিশ্চিত নয়। পরে, প্রতি পর্যবেক্ষণে সাধারণ বিবৃতিতে কি যথাযথ সম্ভাবনীয়তা দাবি করে, সেই বিষয়ে অনেক কঠিন প্রশ্ন থেকে যায়। এই কঠিনতাসমূহ থেকে মুক্তি পাওয়ার এক উপায় হল এই কথা ঘোষণা করা যে, বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহের বিষয়ে থাকা বিশ্বাস বিষয়বাদী, বা ব্যক্তিগত, এবং শুদ্ধ যুক্তি কেবল কীভাবে একজনের সাক্ষ্য বিষয়বাদী বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে, সেই বিষয়ে।
অনেকে তর্ক করেন যে, বিজ্ঞানীগণ অধিস্থাপনামূলক যুক্তি ব্যবহারই করেন না। তার পরিবর্তে এব্ডাক্টিভ যুক্তির (abductive reasoning) প্রয়োগ করে। এই হিসাবে বিজ্ঞান বিশেষ ঘটনাসমূহের সাধারণীকরণ বিষয়ক নয়, পরে, পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যার জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করার বিষয়ে। পূর্বে আলোচনা করার মতো, এই কথা সর্বদাই স্পষ্ট নয় যে কোন্ ব্যাখ্যাটি "উৎকৃষ্টতম্"। অকহামর রেজর সবচেয়ে সরল ব্যাখ্যাকে চয়ন করার পরামর্শ প্রদান করেন। সেক্ষেত্রে এই অভিগমনের কোনো কোনো সংস্করণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুরগির উদাহরণের দিকে পুনরায় তাকালে, কোন্ পরিকল্পনাটি অধিক সরল—মালিক তাকে ভালবাসে এবং খাদ্য প্রদান করে যায়, না মালিক তাকে ভক্ষণ করার পূর্বে ভালকরে খাইয়ে-দাইয়ে পরিপুষ্ট করছে? দার্শনিকগণ এই অনুসন্ধানমূলক নীতিকে অধিক যথাযথ করতে চেষ্টা করেছেন শাস্ত্রীয় মিতব্যয়িতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে। তথাপি, সরলতার বহু যুক্তি প্রদান করলেও, সাধারণত মেনে নেওয়া হয়েছে যে সূত্র-মুক্ত সরলতার যুক্তি নেই। অন্য শব্দে, সরলতার যুক্তি চয়ন করার কার্যও সূত্রসমূহের একটিকে চয়ন করার মতোই সমস্যাপূর্ণ।
পর্যবেক্ষণ করতে, বিজ্ঞানীগণ টেলিস্কোপে দেখেন, বৈদ্যুতিক পর্দায় ছবি দেখেন, মিটার রিডিং রেকর্ড করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রারম্ভিক স্তরে, তারা যা দেখেছেন তা মেনে নিতে হয়, যেমন: থার্মোমিটারে ৩৭.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস দেখাচ্ছে। পরে, যদিও ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানীর সূত্রর বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা থাকে, যে সূত্রকে এই প্রারম্ভিক পর্যবেক্ষণসমূহ ব্যাখ্যা করতে তৈরি করা হয়েছে, তবুও তারা কি পর্যবেক্ষণ করেছেন সেই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন। যেমন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রের পূর্বে , পর্যবেক্ষকগণ প্রদান করা ছবিটিতে ৫টা বস্তু দেখা যাচ্ছে বলে মত পোষণ করতেন। পরে, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গে পরিচিত বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সেটি আসলে দুটি বস্তুর ছবি। একটা মধ্যে, এবং অন্য চারটি ছবি, চারটি আলাদা আলাদা স্থানে। তার বিপরীতে, কোনো কোনো বিজ্ঞানী টেলিস্কোপটি ঠিকমতো কাজ করছে না বলে, কেবল একটা বস্তুর ছবিই দেখা গেছে বলেন। বিজ্ঞানীর এই দল অন্য এক পৃথক সূত্রকে সমর্থন জানিয়েছেন। যে পর্যবেক্ষণকে সূত্রের থেকে আলাদা করতে পারা যায় না, সেই পর্যবেক্ষণকে সূত্র-ভারাক্রান্ত বলা যায় (theory-laden)।
প্রতি পর্যবেক্ষণে ধারণা এবং অনুভূতি থাকে। অর্থাৎ, কোনো পর্যবেক্ষণ নিষ্ক্রিয় করে না, পরে কাছের গ্রহণশীল তথ্য থেকে ঘটনাকে পৃথক করা কার্যে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত। সেটি, পর্যবেক্ষণকে কোনো সিস্টেম কেমনভাবে কাজ করে, সেই বিষয়ে যেমনভাবে বোঝে, সেকথাই প্রভাবান্বিত করে — সেই বোঝাতে কি অনুভূত হয়েছে, মনে করা হয়েছে, বা বিবেচনার যোগ্য বলে গণ্য করা হয়েছে, সেই কথা প্রভাবান্বিত করে। এই অর্থে, এই কথার দাবিতে তর্ক করা যায় যে, সকল পর্যবেক্ষণই সূত্র-ভারাক্রান্ত।
বিজ্ঞান প্রকৃত সত্য প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে কাজ করে, এমন কোনো প্রশ্ন নেই যার উত্তর বিজ্ঞান প্রদান করতে না পারে? বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদীদের মতে, বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সত্য প্রকাশ করা হওয়া উচিত এবং মানুষকে বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহকে সত্য, প্রায় সত্য বা সম্ভাব্য সত্য রূপে গণ্য করতে হয়। তার বিপরীতে বৈজ্ঞানিক অ-বাস্তববাদীগণ তর্ক করেন যে, বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সত্য নয় (অন্ততঃ সত্যে উপনীত হতে পারে না) এবং বিশেষত অপর্যবেক্ষণীয়সমূহের সত্য, যেমন ইলেক্ট্রন বা অন্য ব্রহ্মাণ্ডের সত্য বিজ্ঞান প্রকাশ করতে পারে না।[১৩] বাদকসলক তর্ক করেন যে, বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহকে ব্যবহারযোগ্যতার ওপরেই মূল্যাংকন করতে হয়। এই দৃষ্টিতে, বৈজ্ঞানিক সূত্র সত্য না মিথ্যা সেটি আলোচনার বিষয় নয়, কারণ বিজ্ঞানকে সঠিক পূর্বানুমান এবং প্রভাবশালী প্রযুক্তি নির্মাণ করতেই ব্যবহার করা হয়।
বাস্তববাদীগণ প্রায় নতুন সূত্রসমূহের সফলতার কথা বলেন — সত্যের (বা সত্যের কাছের) সাক্ষ্যরূপে।[১৪][১৫] অবাস্তববাদীগণ বিজ্ঞানের ইতিহাসের মিথ্যা প্রমাণিত সূত্রসমূহ[১৬][১৭], জ্ঞানশাস্ত্রীয় মডেলসমূহ[১৮] , মিথ্যা মডেলিং ধারণাসমূহের সফলতা[১৯], বা বহুলভাবে ব্যবহৃত বস্তুবাদের উত্তরাধুনিক সমালোচনাকে বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদবিরোধী সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করেন।[১৪] অবাস্তববাদীগণ বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহের সাফল্য সত্যের উল্লেখ না করা পর্যন্ত বোঝাতে চেষ্টা করেন।[২০] কোনো কোনো অবাস্তববাদী দাবী করেন যে, বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহ কেবল পর্যবেক্ষণীয় বস্তুর বিষয়ে সঠিক হওয়া লক্ষ্য করে এবং তর্ক করেন যে, সেই সূত্রসমূহের সাফল্য কেবল সেই শর্তের মাধ্যমেই মূল্যাংকন করা হয়।
মূল্যবোধ এবং বিজ্ঞান ভিন্ন ধরনে পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। জ্ঞানশাস্ত্রীয় মূল্যবোধ বিজ্ঞানকে প্রধানত মার্গদর্শন করে। বৈজ্ঞানিক অভ্যাস ব্যক্তিগত অভ্যাসকারীর দ্বারা বিশেষ সংস্কৃতি তথা মূল্যবোধে খচিত হয়েছে। মূল্যবোধ বিজ্ঞানের থেকে সৃষ্ট হয় এবং সমাজের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিতরিত হয়ে থাকতে পারে।
যদিও এটি অস্পষ্ট যে কি বিজ্ঞান হয়, সূত্রসমূহের কার্যক্ষমতা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, এবং বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যই বা কি, তবুও মূল্যবোধ এবং অন্যান্য সামাজিক প্রভাবে বিজ্ঞানের আকার নির্ণয় করার ভালোমতো সুযোগ আছে। নিশ্চয়ই, মূল্যবোধ ভূমিকা পালন করতে পারে, কোন্ গবেষণাটি অধিক পুঁজি লাভ করেছে, কোন্ সূত্রগুলি বিজ্ঞান জগতে অধিক আদর বা স্বীকৃতি লাভ করেছে ইত্যাদি বিষয়ে।[২১] উদাহরণ স্বরূপ, ১৯ শতকে বর্ণবাদী চিন্তাধারা ক্রমবিকাশের অধ্যয়নে সহায়তা করে এবং সামাজিক শ্রেণীর মূল্যবোধ কপাল-বিদ্যা বিষয়ক তর্কে আগ্রহ যোগায় (সেই সময়ে কপাল-বিদ্যাকে বিজ্ঞান বলে গণ্য করা হত)।[২২] বিজ্ঞানের নারীবাদী দার্শনিকগণ, বিজ্ঞানের সমাজবিজ্ঞানীগণ এবং অন্যান্য লোকেরা বিজ্ঞানের ওপর সামাজিক মূল্যবোধের প্রভাব অধ্যয়ন করেন।
|শিরোনাম=