– Europe-এ (হালকা সবুজ & গাঢ় ধূসর)– the European Union-এ (হালকা সবুজ) – [ব্যাখ্যা]
সমকামিনী, সমকামী, উভকামী এবং হিজড়া (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্র্যান্সজেন্ডার সংক্ষেপে এলজিবিটি) অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে ফ্রান্স ঐতিহ্যগতভাবেই উদার এবং ইউরোপ ও সারা বিশ্বের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে।[১] যদিও প্রাচীন যুগে ফ্রান্সে সমকামিতাকে একটি বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং এটার সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত, ১৭৯১ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় সকল 'সডোমী আইন' (Sodomy শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ পায়ুকাম) বাতিল করা হয়। তারপরেও, একটি কমজানা 'অশ্লীল পোশাক আইন' ১৯৬০ সালে চালু করা হয় যেটার মাধ্যমে মাঝেমাঝেই সমকামীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হত, আইনটি ২০ বছর পর উঠিয়ে দেওয়া হয়। সম-লিঙ্গের মানুষের মধ্যে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে ন্যূনতম বয়স ১৫ করা হয় ১৯৮২ সালে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোয়াঁ মিটার্যান্ড এর আমলে। সমলিঙ্গের যুগলদের জন্যে 'ডমেস্টিক পার্টনারশীপ' (যেটি 'সিভিল সলিডেয়ারিটি প্যাক্ট-১৯৯৯' হিসেবে পরিচিত) সুবিধা দেওয়ার পর ২০১৩ সালে ফ্রান্স বিশ্বের ১৩তম দেশ হিসেবে পরিগণিত হয় সম-লিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ের বৈধতার ক্ষেত্রে, দেশটিতে কিছুটা বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও। ১৯৮৫ সালে যৌন অভিমুখিতা এবং 'লিঙ্গ পরিচয়' এর ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবেনা এ মর্মে একটি আইন করা হয়। লিঙ্গ পরিবর্তনে ইচ্ছুক মানুষেরা তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারবেন, এটি আইনগতভাবে বৈধ এবং ২০০৯ সাল থেকে ফ্রান্স লিঙ্গ-পরিবর্তনের মন-মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে মানসিক রোগী আখ্যা দেওয়া বাদ দিয়ে দেয়, ফ্রান্সই পৃথিবীর প্রথম দেশ এই পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে। ফ্রান্সকে বিশ্বের অন্যতম সমকামীবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে সবসময়ই ধরা হয়। জরিপে দেখা যায় যে অধিকাংশ ফরাসী মানুষ সম-লিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে হওয়াটাকে সমর্থন করে এবং ২০১৩তে,[২] একটি জরিপ নির্দেশ করে যে ৭৭% ফরাসী মানুষ বলেন যে সমকামিতাটা সমাজ দ্বারা সমর্থিত হওয়া উচিত, যেই সমর্থন করার প্রবণতাটা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ।[৩] অনেক সংবাদমাধ্যম প্যারিস শহরটিকে বিশ্বের অন্যতম সমকামীবান্ধব হিসেবে ধরেছে, প্যারিসের 'লে মারাইস', 'কুয়ারটিয়ার পিগালে' এবং 'বইস ডে বউলগ্নে' কে বলা হয় 'সমৃদ্ধশালী সমকামী এবং হিজড়া'দের এলাকা এবং এ এলাকাগুলো সমকামীদের নৈশক্লাবের জন্য বিখ্যাত।[৪]
ফরাসী বিপ্লবের আগে পায়ুকাম ছিল একটি বড় ধরনের অপরাধ। জন ডায়ট এবং ব্রুনো লেনয়ের ছিলেন সর্বশেষ সমকামী যাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় ১৭৫০ সালের ৬ জুলাইয়ে।[৫] প্রথম ফরাসী বিপ্লব সমকামিতাকে বৈধ করে যখন '১৭৯১ সালের দণ্ডবিধি' সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে গোপন সম্পর্ক গুরুত্ব দেওয়া বাদ দেয়। ১৮১০ সালের দণ্ডবিধিতে এই নীতিটি রেখে দেওয়া হয় গোপন যৌনকর্মের ক্ষেত্রে, এবং ফ্রান্স যেসব দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল সেসব দেশ এই বিধি অনুসরণ করেছিল। এখনও সমকামিতা এবং ক্রস-ড্রেসিংকে অস্বাভাবিক বলে গণ্য করা হচ্ছিল এবং সমকামীদেরকে বিষমকামীরা মানসিকভাবে হেনস্তা করত কারণ এরকম অনেক আইন ছিল যেগুলো নৈতিকতার আইন হিসেবে পরিচিত ছিল। এ্যালসেস এবং লোরেইন এলাকার কিছু সমকামীকে ১৯৪০ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনী অত্যাচার করে, হত্যা করে এবং জেলে আটকিয়ে রাখে।
দণ্ডবিধিতে ১৮৩২ সালের ২৮ এপ্রিল দৈহিক মিলনের সম্মতির ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়। উভয় লিঙ্গের জন্য ১১ বছর করা হয়, এটাকে ১৩ বছর করা হয় ১৮৬৩ সালে। ১৯৪২ সালের ৬ আগস্ট 'ভিচি সরকার' দণ্ডবিধিতে একটি বৈষম্যমূলক আইন চালু করে: অনুচ্ছেদ ৩৩৪ (১৯৪৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ৩৩১ অনুচ্ছেদে সরানো হয়[৬] ফরাসী প্রজাতন্ত্রের প্রভিশনাল সরকার দ্বারা) দৈহিক মিলনের সর্বনিম্ন বয়স সমকামীদের জন্য কমপক্ষে ২১ এবং বিষমকামীদের জন্য কমপক্ষে ১৫ করে দেয়। এই ২১ বছরটি ১৯৭৪ সালে কমিয়ে ১৮ করা হয়, যেটি বৈধ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বয়স হিসেবে পরিচিতি পায়।[৭] এই আইন ১৯৮২ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত কার্যকর থাকে, যখন এটি রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোয়াঁ মিটার্যান্ড কর্তৃক বাতিল হয়ে বয়স কমপক্ষে ১৫ বছর হয়ে যায়,[৮] 'ফরাসী ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলীতে' জন ফোয়ারের বিরোধিতা সত্ত্বেও।[৯]
একটি কমজানা বৈষম্যমূলক আইন ১৯৬০ সালে বের করা হয়, দণ্ডবিধিতে ঢুকিয়ে (অনুচ্ছেদ ৩৩০, ২য় অশিষ্ট) একটি সারাংশ যেটি সমকামী ব্যক্তিদের অশ্লীল পোশাক পরিধানের জন্যে দ্বিগুন শাস্তির বিধান করে। এই আইনটি[১০] চালু করা হয় বেশ্যাবৃত্তির দালালী বন্ধ করার জন্য। সমকামিতা বিরোধী সারাংশ বানানো হয় পার্লামেন্টের ইচ্ছা অনুয়ায়ী, ইচ্ছাটি নিম্নরুপ:
এই আইনটি নির্বাহী দ্বারা চালু করা হয় পার্লামেন্টের বৈধতা পাওয়ার পর 'জাতীয় সমস্যা' (যেমন মাদকসেবন) এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে। পল মিরগুয়েট, ন্যাশনাল এ্যাসেেম্বলী এর একজন সদস্য,ধরে নেন সমকামিতাও একটি সমস্যা এবং তিনি একটি উপ-অধ্যাদেশ জারী করেন, যেটি 'মিরগুয়েট অধ্যাদেশ' হিসেবে পরিচিতি পায়, এর মাধ্যমে সরকারের উপর দায়িত্ব বর্তায় সমকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে।[১১][১২]
১৯৮০ সালে এই ৩৩০ অনুচ্ছেদের ২য় অশিষ্ট বাতিল করে দেওয়া হয়।[১৩]
'সিভিল সলিডেয়ারিটি প্যাক্ট' (Civil Solidarity Pact সংক্ষেপে PACS, প্যাক্স), এক প্রকারের রেজিস্টার্ড 'ডমেস্টিক পার্টনারশীপ' (একসঙ্গে একই গৃহে বাস করা এবং যৌনমিলন করা) নীতি, ১৯৯৯ সালে চালু করা হয় সম-লিঙ্গের মানুষের প্রেমের যুগলদের জন্যেও আবার বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রেমের যুগলদের জন্যেও তবে এটি ছিল কেবলমাত্র অবিবাহিত যুগলদের জন্যে, এটি চালু করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিওনেল জসপিন। যে সকল যুগলরা 'প্যাক্স' চুক্তিতে আবদ্ধ হন তারা বিষমকামী বিয়ের মতই আইনি সুরক্ষা, অধিকার এবং দায়-দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার এবং কৃত্রিম গর্ভধারণ প্যাক্স গ্রহণকারীদের জন্যে নিষেধ। বিবাহিত যুগলদের মত এরা সম্পর্কের ৩ বছর পার হওয়ার আগ পর্যন্ত 'সম্পর্ক-কর' ফিরিয়ে নিতে পারতেন না, যদিও এটি ২০০৫ সালে বাতিল করা হয়, এখন প্যাক্স গ্রহণকারীরা যখন ইচ্ছা তখন সম্পর্ক-কর ফিরিয়ে নিতে পারবেন।[১৪]
সম-লিঙ্গের সিভিল ইউনিয়ন/ডমেস্টিক পার্টনারশীপ বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর আইনে যেভাবে দেওয়া আছে সেগুলো ফ্রান্স মেনে নেবেনা। যুক্তরাজ্যে রেজিস্টার্ড সিভিল পার্টনারশীপ অনুমতিপ্রাপ্ত নয় – এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সে কোনো ব্রিটিশ যুগল প্যাক্স সুবিধা নিতে চাইলে তাদের অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। নেদারল্যান্ডে সমকামী বিয়ে যেহেতু বৈধ তাই নেদারল্যান্ডের যুগলদের ফ্রান্সে স্বীকৃতি এবং সুযোগ-সুবিধা মিলবে। যদিও ফ্রান্স সমকামী যুগলদের দ্বৈত-নাগরিকত্বের সুযোগ দেবেনা, এটা কেবলমাত্র বিপরীত লিঙ্গের যুগলদের জন্যেই দেওয়া হবে। উদাহরণস্বরুপ, যদি কোনো ফরাসী পুরুষ নেদারল্যান্ডে গিয়ে ঐ দেশের কোনো পুরুষকে বিয়ে করে এবং ঐদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে যায় তবে সে (ফরাসী পুরুষ) ফ্রান্সের নাগরিকত্ব হারাবে।
২০১১ সালের ১৪ জুন ফ্রান্সের 'ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলী' সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ের স্বীকৃতি নিয়ে ভোটের আয়োজন করে এবং ভোটের ফলাফলে ২৯৩-২২২ জন সমলিঙ্গের মানুষের বিয়ের বিরোধিতা করে এবং পক্ষে মত দেয়।[১৫] তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল 'ইউনিয়ন ফর এ পপুলার মুভমেন্ট' সমকামী বিয়ের বিরুদ্ধে ভোট দেয় এবং বিরোধী দল 'সোশালিস্ট পার্টি' সমকামী বিয়ের পক্ষে ভোট দেয়। 'সোশালিস্ট পার্টি' এর সদস্যরা বলে দেয় যে ২০১২ সালের 'ফরাসী ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলী নির্বাচন' এ তারা জিততে পারলে সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে বৈধ করে দেবে।[১৬] ২০১২ সালের ৭ মে 'সোশালিস্ট পার্টি' এর নেতা ফ্রাসোয়া ওলাদ নির্বাচনে জিতে যান এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি হন। অক্টোবর মাসে ফরাসী সরকার কর্তৃক আইনটির খসড়া (সমলিঙ্গের বিয়ে বিষয়ক আইন) পেশ করা হয়।[১৭] ২০১৩ এর ২ অক্টোবরে ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলী আইনটির ১ নং আইনের বৈধতা দেয়, ২৪৯ টি ভোটের মাধ্যমে, যে ভোটটির বিরোধিতা হিসেবে পড়ে মাত্র ৯৭টি ভোট।[১৮] ২০১৩ এর ১২ ফেব্রুয়ারিতে, ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলী আইনটির বৈধতা দেয় ৩২৯-২২৯ ভোটে এবং এটিকে 'সিনেট' এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।[১৯] ক্ষমতাসীন দল 'সোশালিস্ট পার্টি' আইনটির পক্ষে ভোট দেয় (এ দলের কেবলমাত্র ৪ জন মানুষ সমকামী বিয়ের বিরুদ্ধে ভোট দেয়), অন্যদিকে বিরোধী দল 'ইউনিয়ন ফর এ পপুলার মুভমেন্ট' এর মাত্র দু'জন ব্যক্তি ছাড়া বাকী সবাই সমকামী বিয়ের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।[২০]
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে 'সিনেট' আইনটি নিয়ে বিতর্কের আয়োজন করে এবং পাঁচদিন পরে এটা ওটার প্রথম নিবন্ধের অনুমোদন দেয়, ১৭৯-১৫৭ ভোটের মাধ্যমে।[২১] ১২ এপ্রিলে 'সিনেট' আইনটির পুর্ণ অনুমোদন দিয়ে দেয় একটি ছোট এমেন্ডমেন্ট এর মাধ্যমে। ২৩ এপ্রিলে ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলী এ্যামেন্ডেড আইনটির অনুমোদন দেয় ৩৩১টি ভোটের মাধ্যমে যার বিপরীতে ছিল ২২৫ টি ভোট, এভাবে সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে করা এবং বাচ্চা দত্তক নেওয়ার পথ ত্বরান্বিত হয়, ফ্রান্সকে বিশ্বের ১৪তম দেশ হিসেবে বানিয়ে দেওয়া হয় সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ের বৈধতার ক্ষেত্রে।[১]
যদিও রক্ষণশীল দল 'ইউনিয়ন ফর এ পপুলার মুভমেন্ট' যারা সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ের বিরোধিতা করছিল 'কন্সটিটিউশনাল কাউন্সিল' এ ঐ আইনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে।[২২][২৩] ২০১৩ এর ১৭ মে কাউন্সিল আইনটিকে সাংবিধানিক বলে রায় দেয়।[২৪] ২০১৩ এর ১৮ মে'তে রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোয়া ওলাদ আইনটিতে স্বাক্ষর করেন,[২৫] যেটি পরের দিন সরকারীভাবে প্রকাশ করা হয় 'জার্নাল অফিসিয়েল' এ যেটি হচ্ছে ফ্রান্সের সরকারের গ্যাজেট পত্র।[২৬] প্রথম সরকারী সমকামী বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ২৯ মে'তে মন্টপেলিয়ার শহরে।[২৭]
সমকামী যুগলরা বাচ্চা দত্তক নিতে পারেন ২০১৩ সাল থেকেই, যখন সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে নিয়ে আইন কার্যকরী হয়। প্রথম সমকামী যুগল দ্বারা যুগ্ম দত্তক নেওয়ার খবর আসে ১৮ অক্টোবর (২০১৩তেই)।[২৮][২৯]
২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী নারী সমকামীযুগলদের 'এ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজি' এর সুযোগ নেই। ফ্রান্সে 'প্রোক্রিয়েশন মেডিক্যালমেন্ট এ্যাসিস্টি' (পিএমএ) শুধুমাত্র বিষমকামী যুগলদের জন্যেই দেওয়া হয়। ২০১২ সালের একটি জরিপে দেখা যায় যে ৫১% ফরাসী মানুষ নারীসমকামীযুগলদের জন্যে 'এআরটি' সমর্থন করে।[৩০] 'সোশালিস্ট পার্টি'ও এটা সমর্থন করে।[৩১]
১৯৮৫ সালে 'জাতীয় আইন' পাশ করা হয় এ মর্মে যে সমকামীদেরকে মানসিকভাবে হয়রানি বা শারীরিকভাবে হেনস্তা করা যাবেনা, আইনটি কর্মক্ষেত্র, বাসা-বাড়ি এবং অন্যান্য সব জায়গার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।[৩২] জুলাই ২০১২তে ফরাসী পার্লামেন্ট ফরাসী আইনের সংরক্ষিত ক্ষেত্রে 'সেক্সুয়াল আইডেনটিটি' যোগ করে। 'সেক্সুয়াল আইডেনটিটি' শব্দটির সমার্থক শব্দ হিসেবে 'জেন্দার আইডেনটিটি' শব্দটির ব্যবহার চালু হয় 'ILGA-Europem' এর কিছুটা বিরোধিতা সত্ত্বেও যারা এখনো এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখে।[৩৩][৩৪]
২০০৮ এর মার্চে ফ্রান্সের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জেভিয়ার ড্যারকস একটি নীতি চালু করেন যেই নীতিটি ছিল বিদ্যালয়ে সকল প্রকারের বৈষম্য দূর করা বিষয়ক, এর মধ্যে সমকামীদেরকে ঘৃণা করা যাবেনা - এটিও ছিল, এই নীতিটি বিশ্বের অন্যতম প্রথম। এটি ছিল ২০০৮-২০০৯ শিক্ষা বর্ষের 'শিক্ষার ১৫টি ন্যাশনাল প্রায়োরিটি' এর একটি।
ফ্রান্সের 'উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক সংঘ' - ফ্রান্সের উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা গঠিত প্রথম সংঘ - বিদ্যালয় এবং উঠতি বয়সের মানুষের মধ্যে 'সমকামিতাঘৃণা' এর বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করেছে।
২০০৪ এর ৩১ ডিসেম্বরে ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলী একটি এ্যামেন্ডমেন্ট দেয় বৈষম্য বিরোধী আইনের, এ আইনে সমকামবিরোধী কোনো মন্তব্য করা যাবেনা বলা হয়। সমকামিতার বিরুদ্ধে যারা কথা বলে তাদের জন্য ৪৫,০০০ টাকা জরিমানা এবং/অথবা ১২মাস কারাদণ্ডকে মানবতাবিরোধী আখ্যা দেয় 'রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার্স' নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জ্যাক শিরাক এই আইনের পক্ষে কথা বলে বলেন যে সমকাম-বিরোধী হিংস্রতা বন্ধের জন্য আইনটি জরুরী। শিরাক সরকারের এক সংসদসদস্য 'ক্রিশ্চিয়ান ভান্নেস্টে' (শিরাকের নিজেরই রাজনৈতিক দল 'ইউনিয়ন ফর এ পপুলার মুভমেন্ট' এর সদস্য) ২০০৬ এর জানুয়ারী মাসে এই আইনের কবলে পড়েন সমকামবিরোধী মন্তব্য দেওয়ার জন্য, যদিও তার অপরাধ পরে ক্ষমা করে দেওয়া হয় তার 'কোর্ট অব ক্যাসেশন' এ আবেদন করার ফলশ্রুতিতে।[৩৫]
ডিসেম্বর ২০০৪ এর একটি আইন 'হাই অথোরিটি এগেইন্সট ডিসক্রিমিনেশন এ্যান্ড ইকুয়ালিটি' তৈরি করে। কোনো সমকামী ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে আঘাত/হত্যা করলে সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
লিঙ্গ পরিবর্তনে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা চাইলে তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারবেন। ২০০৯ সালে ফ্রান্স বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে লিঙ্গপরিবর্তনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরকে মানসিক রোগী আখ্যা দেওয়া বাদ দিয়ে।[৩৬] লিঙ্গপরিবর্তনের ইচ্ছা হচ্ছে 'এএলডি ৩১' এর একটি অংশ এবং এর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করে 'সোশাল সিকিউরিটি ইন ফ্রান্স' নামের একটি সংগঠন।[৩৭]
২০১২ সালে সেক্স বা জেন্ডার পরিচয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।[৩৩][৩৪]
২০১৫ এর ৬ নভেম্বরে ফরাসী সিনেট লিঙ্গপরিবর্তনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরকে 'লিঙ্গ পরিবর্তন অস্ত্রোপচার' এর আইনগত বৈধতা দেয়।[৩৮] ২৪ মে ২০১৬ তে ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলী বিলটির অনুমোদন দেয়।[৩৮][৩৯][৪০] সংসদসদস্য প্যাসকেল ক্রোজোন, যিনি বিলটি উত্থাপন করেন, অন্যান্য সংসদসদস্যদেরকে ভোটের আগে বোঝান যে, 'লিঙ্গ পরিবর্তন অস্ত্রোপচার' অনেক দীর্ঘ, অনিশ্চিত এবং কষ্টকর। ভিন্ন লেখার কারণে, একটি যুগ্ম সেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৬ সালের ১২ জুলাইতে ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলী বিলটির একটি মোডিফাইড ভার্সন অনুমোদন করে যেখানে বলা ছিল যে লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য মনোরোগবিশেষজ্ঞের সার্টিফিকেট লাগবেনা এবং লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য কোনো কিছুর প্রমাণও লাগবেনা, এক্ষেত্রে কোনো লিঙ্গের নিজ-সার্টিফিকেটেরও কোনো প্রয়োজন পড়বেনা।[৪১] ২৮ সেপ্টেম্বরে ফরাসী সিনেট বিলটি নিয়ে আলোচনা করে।[৪২] ফরাসী জাতীয় এ্যাসেম্বলী ১২ অক্টোবরে একটি 'প্লেনারী সেশন' এ বসে ঐ বিলটি আবার অনুমোদন করার জন্য এবং ফরাসী সিনেট দ্বারা তৈরি এ্যামেন্ডমেন্ট এর বিরোধিতা করে যেখানে বলা হয়েছিল যে চিকিৎসার প্রমাণ দেখাতে হবে।[৪৩][৪৪] ১৭ নভেম্বরে 'সাংবিধানিক কাউন্সিল' ঘোষণা দেয় যে বিলটি সাংবিধানিক হয়েছে।[৪৫][৪৬] রাষ্ট্রপতি কর্তৃক এটি স্বাক্ষরিত হয় ১৮ নভেম্বর ২০১৬ এ, সরকারী গ্যাজেটে এটা পরের দিনই প্রকাশ পায় (জার্নাল অফিসিয়েলে),[৪৭] আর আইনটি কার্যকরী হয় ২০১৭ এর ১ জানুয়ারীতে।[৪৮]
ফ্রান্সে অনেক সংগঠন আছে যারা সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে যেমনঃ 'এ্যাক্ট আপ প্যারিস', 'এসওএস হোমোফোবি', 'এ্যারকেডি', 'এফএইচএআর', 'গোউইন্স রগ্স', 'জিএলএইচ', 'সিইউএআরএইচ', 'ট্র্যান্স এইড এ্যাসোসিয়েশন' (২০০৪ এর সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত) এবং Bi'cause (উভকামী)।
ফরাসী সামরিক বাহিনীতে সমকামীদের যোগদান করার অনুমতি রয়েছে।[৪৯][৫০]
১৯৮৩ সালের ২০ জুন স্বাস্থ্য মহাপরিদপ্তর সমকামী পুরুষদের রক্তদানে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। ২০০৯ এর ১২ জানুয়ারী বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদে পুনরায় ওঠানো হয়।[৫১]
২০১৫ এর ৩ এপ্রিলে 'ইউনিয়ন অফ ডেমোক্র্যাটস এ্যান্ড ইন্ডিপেন্ডেন্টস' এর একজন উপসদস্য আর্নার্ড রিচার্ড সমকামী পুরুষদের রক্তদানের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে একটি এ্যামেন্ডমেন্ট প্রকাশ করেন যেটি ঐ একই মাসেই পরে গৃহীত হয়।[৫২]
২০১৫ সালের নভেম্বরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মারিসোল টউরেইন ঘোষণা দেন যে সমকামী পুরুষ এবং উভকামী পুরুষ রক্তদান করতে পারবে, ২০১৬ সালের ১০ই জুলাই তারিখ থেকে নির্দেশনাটি কার্যকর হয়।[৫৩][৫৪]
২০০১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্যারিসের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করা পুরুষ বার্ট্রান্ড ডেলানো (সোশালিস্ট পার্টির নেতা) জনসম্মুখে তার সমকামী পরিচয় দেন ১৯৯৮ সালে, তার প্রথম নির্বাচন হয় ২০০১ সালে।
২০০৬ এর ডিসেম্বরে Ipsos-MORI Eurobarometer এ করা জরিপের ফলাফলে দেখা যায়: ৬২% মানুষ সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে সমর্থন করে, যেখানে ৭৩% বিরোধিতা করে; ৫৫% মানুষ বিশ্বাস করেছিল সমকামী এবং সমকামিনীদের বাবা-মা হওয়ার অধিকার দেওয়া উচিত নয়, অপরদিকে ৪৪% বিশ্বাস করেছিল সমলিঙ্গের মানুষের যুগলদের বাচ্চা দত্তক নেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত।[৫৫]
২০১১ এর জুনে, একতি Ifop জরিপের ফলাফলে দেখা যায় ৬৩% লোক সমকামী বিয়ের পক্ষে, এবং ৫৮% মানুষ সমলিঙ্গের মানুষের যুগলের জন্যে বাচ্চা দত্তক নেওয়া সমর্থন করেছিল।[২]
২০১৩এ 'পিউ রিসার্চ সেন্টার' জনমত জরিপ দেখায় যে ৭৭% ফরাসী জনগণ বিশ্বাস করে যে সমকামিতা সমাজ দ্বারা গৃহীত হওয়া উচিত, এবং ২২% বলেছিল সমকামিতার বিরুদ্ধে।[৩] তরুণ-তরুণীরা আরো বেশি সমর্থন করেছিল: ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে ৮১% সমকামিতার পক্ষে কথা বলে, ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে ৭৯% এবং ৫০ এর বেশি বয়স্ক মানুষের মধ্যে ৭৪%।
২০১৫ সালে সমকামীদের নিয়ে কাজ করা একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'প্ল্যানেট রোমিও' সর্বপ্রথম তাদের 'গে হ্যাপিনেস ইনডেক্স' (জিএইচআই) প্রকাশ করে। ১২০ টি দেশের সমকামীদের উপর জরিপ চালানো হয় যে 'সমাজের সমকামিতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে তাদের অনুভূতি কিরকম, তাদের মনে কেমন লাগে যখন মানুষ তাদের সাথে কথা বলে এবং তারা তাদের জীবন নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট'। এ জরিপে ফ্রান্স ২১তম অবস্থান লাভ করে, তবে সাউথ আফ্রিকার ওপরে এবং অস্ট্রেলিয়ার নিচে অবস্থিত হয়, ফ্রান্সের 'জিএইচআই' স্কোর ছিল ৬৩।[৫৬]