জলোচ্ছ্বাস হলো সমুদ্রের জল ফুলে উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানা। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে, সাধারণত ঘূর্ণিঝড়, সুনামির কারণে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। সুনামির ক্ষেত্রে সমুদ্রের জল সর্বোচ্চ প্রায় ৬৫ মিটার উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এধরনের জলোচ্ছ্বাসে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবার সংকীর্ণ ও অগভীর নদীপথ অথবা মোহনায় প্রবল জোয়ারের কারণে সৃষ্ট তরঙ্গকেও জলোচ্ছ্বাস বলা হতে পারে।[১]
বর্ণনা
জলোচ্ছ্বাস বিশ্বব্যাপী কম জায়গায় তেই ঘটে। জলোচ্ছ্বাস সাধারণত একটি বৃহৎ জোয়ারের পরিসীমা, যা উচ্চ এবং নিম্ন জোয়ারের মধ্যে প্রায় ৬ মিটার (২০ ফু)* উঁচু হয়ে থাকে, এবং অগভীর সংকীর্ণ নদী বা হ্রদ দিয়ে বিস্তৃত উপসাগরের মধ্যে বিস্তৃত করা হয়।[২] ফানেলের মত আকৃতি শুধুমাত্র জোয়ারের পরিসীমা বৃদ্ধি করে না এটি বন্যার জোয়ারের সময়কালও কমিয়ে দিতে পারে যাতে বন্যায় হঠাৎ করে পানির স্তর বৃদ্ধি পায়।
একটি জলোচ্ছ্বাস, বিভিন্ন আকার নিতে পারে। এটি হতে পারে সমুদ্রের ছোটো ঢেউয়ের মতো, যে ক্ষেত্রে তরঙ্গের গতি পথের সম্মুখ অংশ তথা তরঙ্গমুখ ধীরে ধীরে উচ্চতা হারাতে থাকে (রোলার হিসেবে পরিচিত) ― হাইড্রোলিক জাম্পের মতো।[৩][৪][৫] আরেকটি ধরন হল আনডিউলার জলোচ্ছ্বাস, যেখানে পানির গতিপথের একটি মসৃণ তরঙ্গমুখ থাকে এবং এর পিছে থাকে অগৌণ তরঙ্গগুচ্ছ, যাকে ওয়েল্পস বলা হয়। বড় জলোচ্ছ্বাসগুলো জাহাজ চলাচলের জন্য বিশেষভাবে অনিরাপদ হতে পারে কিন্তু এটি রিভার সার্ফিংয়ের সুযোগ করে দেয়।[৫]
জলোচ্ছ্বাসের দুটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো তীব্র অস্থিরতা এবং প্রবাহ এগিয়ে যাওয়ার সময়কার অশান্ত মিশ্রণ (টার্বুলেন্ট মিক্সিং) ও এর সাথে যুক্ত হওয়া গর্জন। জোয়ারের দৃশ্যমান পর্যবেক্ষণ ক্রমবর্ধমান পানির অস্থির প্রকৃতিকে তুলে ধরে। জলোচ্ছ্বাস জলাশয় এলাকায় এই শক্তিশালী অশান্ত মিশ্রণকে প্ররোচিত করে এবং এর প্রভাব যথেষ্ট দূরত্বেও অনুভূত হতে পারে। বেগ পর্যবেক্ষণ জলোচ্ছ্বাসের গতিপথ এবং বেগের ওঠানামার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রবাহের দ্রুত হ্রাসকে ইঙ্গিত করে।[৬][৭] জলোচ্ছ্বাসের প্রবাহ বেশ শক্তিশালী গর্জন তৈরি করে, এবং এর সাথে যুক্ত হয় প্রবাহের উত্তাল সম্মুখ অংশ, ওয়েল্পস, প্রবাহের রোলারে আটকে পড়া বায়ু বুদবুদ, তীরবর্তী পলি ও প্রবাহের গতিপথের মাটি ক্ষয়, এবং পথে পড়া কোনো বাধার সাথে সংঘর্ষ। একটি জলোচ্ছ্বাস একটি শক্তিশালী গর্জন তৈরি করে যা অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায় কারণ এর ফ্রিকোয়েন্সি কম হওয়ায় এটি দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। নিম্ন-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দটি অগ্রগতি রোলারের বৈশিষ্ট্যযুক্ত যেখানে বড় আকারের বায়ু বুদবুদগুলি শাব্দিকভাবে সক্রিয় থাকে এবং শক্তিশালী-শব্দ উৎপাদনে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।[৮]
জলোচ্ছ্বাস বিপজ্জনক হতে পারে। কিছু নদী যেমন ফ্রান্সেরসেন, কানাডার পেটিটকোডিয়াক নদী, এবং মেক্সিকোর কলোরাডো নদীর জলোচ্ছ্বাসের জন্য জঘন্য খ্যাতি রয়েছে। চীনে, কিয়ানতাং নদীর তীরে সতর্কতা জারি করা সত্ত্বেও প্রতি বছর বেশ কিছু প্রাণহানি ঘটে যারা জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে পারাপারের চেষ্টা করে।[২] জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজ এবং নৌ চলাচলের উপর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, পাপুয়া নিউ গিনির (মাছি এবং বামু নদী), মালয়েশিয়া (বাতাং লুপারে বেনাক) এবং ভারতের (হুগলী নদী)।
অন্যদিকে, জোয়ার-ভাটা আক্রান্ত জলাশয় সমৃদ্ধ খাদ্য অঞ্চল এবং বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণীর প্রজনন ক্ষেত্র।[২] এস্টুয়ারিন অঞ্চল বিভিন্ন দেশীয় মাছের প্রজাতির উৎপত্তিস্থল এবং প্রজনন ক্ষেত্র। জলোচ্ছ্বাস দ্বারা প্ররোচিত এরেশন অনেক প্রজাতির মাছ এবং চিংড়ির বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। জলোচ্ছ্বাস এছাড়াও বিনোদনমূলক অন্তর্দেশীয় সার্ফিং করার সুযোগ প্রদান করে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের ডি নদী [৯], গ্যারোন[১০][১১][১২][১৩][১৪] , ফ্রান্সে স্যালুন,[১৫], অস্ট্রোলিয়ার ডালি নদী[১৬][১৭] এবং চীনের কিয়ান্টাং নদীর মোহনায় বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয়েছে।[১৮][১৯] জোয়ারের প্রবাহের শক্তি পরিমাপ প্রায়ই বৈজ্ঞানিক পরিমাপের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, ডি নদীতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে কাজের ঘটনা থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছে।
জলোচ্ছ্বাস সহ নদী এবং উপসাগর
নদী এবং উপসাগর যেগুলি জলোচ্ছ্বাস প্রদর্শনের জন্য পরিচিতি ওগুলো নিচে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।[২][২০]
কিয়ানতাং নদী, চীন, পৃথিবীর বৃহত্তম জলোচ্ছ্বাসের নদী।[২][১৯] এটিতে ৯ মি (৩০ ফু) পর্যন্ত উঁচু এবং ৪০ কিমি/ঘ (২৫ মা/ঘ) গতির জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।
মালায়েশিয়ার শ্রী আমানের নিকটে বাতাং লুপার বা লুপার নদী। জলোচ্ছ্বাসের জন্য স্থানীয়ভাবে বেনাক নামে পরিচিত।[৫]
বাতাং সাদং বা সাদং নদী, সরওয়াক, মালয়েশিয়া।
বোনো, কাম্পার নদী, ইন্দোনেশিয়া। স্থানীয়রা এই নদীতে জাহাজ ডুবার আশঙ্কা করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এটিতে ১৩০ কিমি (৮১ মা) পর্যন্ত গতিবেগের জলোচ্ছ্বাস প্রবাহের রেকর্ড রয়েছে, তবে সাধারণত ৪০ কিমি (২৫ মা) বেগের সাথে ৬ মি (২০ ফু) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।[২১]
মিরসি নদী, কিয়ানতাং এর পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়। এটিতে ১.৭ মিটার (৬ ফু) অবধি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়। এটি ম্যানচেস্টার জাহাজ খালের পাশে হওয়ায় এর চারপাশে জলোচ্ছ্বাস তৈরি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
সেভার্ন নদী, ওয়েলস ও ইংল্যান্ড। এখানে ২ মিটার (৭ ফু) পর্যন্ত উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।
রিভার ট্রেন্টে, ইংল্যান্ড। এখানে ১.৫ মিটার (৫ ফু) পর্যন্ত উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।
পেরেট নদী
ওয়েলল্যান্ড নদী
রিভার ক্যান্টের আরনসাইড বোর
রিভার গ্রেট ওউস
ইয়র্কশায়ার নদী (এটি "দ্য এজির" নামেও পরিচিত।)
ইডেন নদী
এস্ক নদী
নিত নদীর
লুনা নদী, ল্যাঙ্কাশায়ার
রিভ রিবল, ল্যাঙ্কাশায়ার
নদী ইয়ালাম, ডিভন
লেভেন নদী, কুম্বরিয়া
বেলজিয়াম
ডুরমে, ফ্ল্যান্ডার্স
ফ্রান্স
ফরাসি ভাষায় এই ঘটনাকে সাধারণত আন মাস্কারেটের নামে উল্লেখ করা হয়।[২২] তবে স্থানীয়ভাবে পছন্দসই নামে ডাকা হয়।[২০]
সাইন ১৯৬০ এর দশক অবধি স্থানীয়ভাবে লা ব্যারে নামে পরিচিত ছিল। তবে ড্রেজিং এর কারণে এখন জলোচ্ছ্বাস দেখা যায় না।[২০]
কুয়েসনন, সেলুন, এবং সে সহ মন্ট-সেন্ট-মিশেল উপসাগর
সাভান্না নদী, এখানে ১০ মাইল (১৬ কিমি) গতির জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।
মিসিসিপি উপসাগরীয় উপকূলে জোয়ারের তীরে মাত্র কয়েক ইঞ্চি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।
কানাডা
নোভা স্কটিয়া এবং নিউ ব্রান্সউইকের মধ্যবর্তী উঁচু উপসাগর উপর দিয়ে প্রবাহিত বেশিরভাগ নদীতে জলোচ্ছ্বাস রয়েছে। উল্লেখযোগ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:
পেটিকোডিয়াক নদী, পূর্বে এখানে ২ মিটার (৬.৬ ফু) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা যেত,[২৪] তবে নদী পুনরুদ্ধারের পর জুলাই ২০১৩ সাল থেকে ১ মিটার (৩.৩ ফু) উচ্চতা এবং ২৯ কিলোমিটার (১৮.০ মা) গতির জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়।
ঐতিহাসিকভাবে, কলোরাডো নদীর মুখে মেক্সিকোর ক্যালিফোর্নিয়া উপসাগরে একটি জোয়ার ছিল। এটি মন্টাগ দ্বীপের উপকূলে গঠিত হয় এবং উপরের স্রোত কে ছড়িয়ে দেয়। এটা একসময় খুব শক্তিশালী ছিল কিন্তু সেচ ব্যবস্থার কারণে নদীর বিচ্যুতি নদীর প্রবাহকে দুর্বল করে দিয়েছে যার কারণে জলোচ্ছ্বাস ও জহচশ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ব্রাজিলের আরাগুয়ারি নদী। অতীতে এটিতে খুব শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাস ছিল। এটি ২০১৫ সাল এর পর থেকে সেচ, এবং নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণের ফলে হারিয়ে যায়।
জলোচ্ছ্বাসের ফলে হ্রদ
জলোচ্ছ্বাসের ফলে নদীর মোহনায় হ্রদ তৈরি করতে পারে।
উত্তর আমেরিকা
ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপের নিতিনাট হ্রদ কখনও কখনও একটি বিপজ্জনক জলোচ্ছ্বাসের জোয়ারের মুখোমুখি হয় যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়। হ্রদটিতে ধারাবাহিক বায়ু প্রবাহের কারণে এটি বায়ু-সার্ফারদের কাছে জনপ্রিয়।
↑Simpson, J.H., Fisher, N.R., and Wiles, P. (২০০৪)। "Reynolds Stress and TKE Production in an Estuary with a Tidal Bore": 619–27। ডিওআই:10.1016/j.ecss.2004.03.006।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: লেখকগণের তালিকা (link)
↑p. 159, Barrie R. Bolton. 2009. The Fly River, Papua New Guinea: Environmental Studies in an Impacted Tropical River System. Elsevier Science. আইএসবিএন৯৭৮-০৪৪৪৫২৯৬৪০.
↑Museum, Museum of Natural History Nova Scotia (22 ফেব, 1996)। "Topic 6 (T6): The Ocean"। Nova Scotia Museum। 0 (0) – ojs.library.dal.ca-এর মাধ্যমে।এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
বহিঃসংযোগ
উইকিমিডিয়া কমন্সে জলোচ্ছ্বাস সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।